প্রসঙ্গ ত্রিপুরার আদিবাসী স্বশাসিত পরিষদের নির্বাচনঃ দশরথ দেবের রাজনীতি থেকে আজকের শিক্ষা কি?

সায়ন নন্দী ও সুমিত ঘোষ


 

বাংলায় ভোটপর্ব চলার মাঝেই ত্রিপুরাতে মিটলো আদিবাসী স্বশাসিত অঞ্চলের (ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়াজ অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল) ভোট কাহন। মোট ৩০টি (২৮টি নির্বাচিত এবং ২টি রাজ্যপাল মারফৎ নিযুক্ত) আসনে এই নির্বাচনে বিজেপির ঝুলিতে এসেছে মাত্র ৯টি আসন। বামেদের একপ্রকার দুর্গ নামে একদা খ্যাত এবং আদিবাসী সম্প্রদায় অধুষ্যিত এই অঞ্চলে গত তিনবারের জয়ী দল সিপিআই(এম)-কে ফিরতে হল খালি হাতে। বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কানি দিয়ে বিজেপির রাজনীতির সমতুল্য একটি নতুন আঞ্চলিক জোট নিজেদের ক্ষমতার বিস্তার করতে আরম্ভ করেছে। নাম তিপরা মোথা (তিপরা ইন্ডিজিনাস প্রগ্রেসিভ রিজিওনাল অ্যালায়েন্স)। এই জোট চালিত হচ্ছে ত্রিপুরার রাজবাড়ির বংশধর এবং একদা কংগ্রেস নেতা প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মার তিপরা পার্টির দ্বারা। তিপরা মোথার মধ্যে রয়েছে তিপরা, ত্রিপুরা পিপল'স ফ্রন্ট, তিপরাল্যান্ড স্টেট পার্টি এবং ইন্ডিজিনাস ন্যাশনালিস্ট পার্টি অফ তিপ্রা। প্রশ্ন জাগতেই পারে, বিচ্ছিন্নতাবাদের কথা নতুন করে কিভাবে উঠে আসছে? তিপরা মোথা নামক জোটের প্রধান দাবীই হচ্ছে ত্রিপুরাতে আদিবাসী অধুষ্যিত অঞ্চলগুলিকে একত্রিত করে স্বাধীন প্রদেশ হিসেবে স্বীকৃতী দিতে হবে গ্রেটার তিপরাল্যান্ড নামক স্বশাসিত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে; মূলত ত্রিপুরা, বাংলাদেশ এবং মেঘালয়ের বেশ কিছুটা অঞ্চলকেও এই কাঙ্ক্ষিত তিপরাল্যান্ডের দাবীর অধীন রাখা হয়েছে! অর্থাৎ যে বিচ্ছিনতাবাদের ইতিহাসকে বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে ইন্ডিজিনাস পিপল'স ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা (আইপিএফটি)-র হাত ধরে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল, এই জোট সেই আদর্শকেই আরও জোড় কদমে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। 

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে ত্রিপুরার আদিবাসীরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় এবং ব্রিটিশদের অত্যাচারের মুখে পড়ে। স্বাধীনতার পর সামরিক শাসনের মাধ্যমে আদিবাসীদের এই সংগ্রামের কন্ঠ রোধের চেষ্টাতে লিপ্ত হয় ভারত সরকার। এমতাবস্থায় ১৯৪৮ সালে তৈরি হয় গণমুক্তি পরিষদ। উদ্বাস্তু বাঙালী এবং সংখ্যাগুরু আদিবাসীরা একযোগে ভারত সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ১৯৫০ সালে গণমুক্তি পরিষদ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করে সশস্ত্র আন্দোলন থেকে সরে আসে। পরর্বতীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, প্রচুর উদ্বাস্তু বাঙালী ত্রিপুরাতে স্হায়ী বাসস্থান গড়ে তুলতে কাঁটাতার পার করতে শুরু করলে কিছু বিচ্ছিনতাবাদী আদিবাসী সংগঠন আঞ্চলিকভাবে বাঙালী নিধনে সচেষ্ট হয়। ১৯৮০ সালের ম্যান্ডাই ম্যাসাকারের কুখ্যাত ঘটনা আজও সেখানকার মানুষের মনে উজ্জ্বল। পরর্বতীকালে বামফ্রন্টের অন্যতম নেতা, রাজ্যের প্রথম তিপ্রাসা মুখ্যমন্ত্রী এবং গণমুক্তি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা কমঃ দশরথ দেব তাঁর সপ্রতিভ চেষ্টাতেই আদিবাসী সমাজের মধ্যেকার বিচ্ছিন্নতাবাদের আগুন স্তিমিত করে তাদের অর্থনেতিক উত্তোলোনের পথে চালিত করেন। শুধু তাই নয়, তাদের নিজস্ব ভাষা কখবরক-এর কোনো নিজস্ব লেখ্য লিপি ছিলনা; দশরথ দেব নিজস্ব উদ্যোগে বাংলা ভাষার লিপিকেই এই ভাষার লিপি হিসেবে প্রচলন করেন। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার ইংরেজি এবং হিন্দি অক্ষরের প্রচলন এবং সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধার প্রচারের মাধ্যমে (বিশেষত হিন্দি) এ ভাষার লেখনীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে চলেছে নিজেদের ভাষা আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে। 


 দশরথ দেব

কমিউনিস্ট পার্টি গণমুক্তি পরিষদকে সর্বভারতীয় কিষান সভার অধীনে আনার অবস্থান নিলে দশরথ দেব প্রথম এই বক্তব্যটি রাখেন যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের এই সংগঠনকে কিষান সভার অধীন রাখা প্রয়োজন কারণ আদিবাসীরা মূলত চাষাবাদের সাথে যুক্ত থাকায় কিষান সভা তাদের শ্রেণী সংগঠন হিসেবে কাজ করবে; কিন্তু একই সাথে আদিবাসীদের নিজস্ব সামাজিক উত্তোলনের জন্য গণমুক্তি পরিষদ এবং তাদের নিজস্ব যুব ও ছাত্র সংগঠনের (যদিও সেগুলি পার্টির কেন্দ্রীয় যুব ও ছাত্র ফ্রন্টের গণসংগঠনের শাখা হিসেবে কাজ করবে) স্বনিয়ন্ত্রিত অস্তিত্বেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দশরথ দেবের এই দাবী পার্টিতে স্বীকৃতি লাভ করে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন আদিবাসীদের শ্রেণী রাজনীতির অধীন আনা সম্ভব হয়, আবার অন্যদিকে তাদের নিজস্ব সম্প্রদায়গত দাবিদাওয়াগুলো নিয়ে লড়াই করার ক্ষেত্রও বজায় থাকে। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে দশরথ দেবের এই নতুন সাংগঠনিক প্রক্রিয়া দলের গঠনতন্ত্রে এমন এক দ্বান্দ্বিক প্রাক্সিসের প্রচলন ঘটায় যার মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদ আদিবাসীদের মধ্য স্তিমিত হতে শুরু করে।

দশরথ দেবের আমলে আদিবাসীদের অর্থনৈতিক উত্তোলনের জন্য বাম দলগুলি সচেষ্ট হলেও পরবর্তীকালে আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত করার রাজনীতি পরিণত হয় উপেক্ষা ও দান খয়রাতির প্রান্তিকীকরণের রাজনীতিতে। এই সুযোগে বিজেপি যে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিষ ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে ছড়িয়েছিল, বর্তমানে তা আরও উগ্র রূপ ধারন করে তিপরা মোথা হিসেবে উঠে এসেছে। উগ্রতার দ্যোতনা এমনই যে বিচ্ছিন্নতাবাদের পুনর্জীবনের কান্ডারী এবং বিজেপির জোট সঙ্গী আইপিএফটি একটিও আসন পায়নি! 

উদ্বাস্তুদের 'আমরা আদিবাসীদের জন্য কাজ করছি' স্লোগানকে আজ আদিবাসীরা বদলাতে চাইছে 'আমরা উদ্বাস্তুদের জন্য কাজ করছি' স্লোগানে। এই আধিপত্যের লড়াই থেকে ত্রিপুরার সাধারণ জনগণকে বের করে আনার সংগ্রামে পাথেয় করতে হবে কমঃ দশরথ দেববর্মার রাজনৈতিক শিক্ষাকে।  

[Updated: 3rd March, 2023]

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!