একটি বিজেপি বিরোধী পর্যালোচনাঃ যদুনাথ-রোমিলার ভেদাভেদ করো, ইতিহাস তোমরা বোঝো না !!!

সুমিত গাঙ্গুলী

ক্রিকেট ইতিহাসবিদ

প্রাক্তন ছাত্র, ইতিহাস বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়  


বর্তমান বঙ্গীয় নির্বাচন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত  বিষয়গুলি নূতন রূপে আলোচিত হচ্ছে তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্বাচনী প্রচারমূলক সঙ্গীত। এহেন সঙ্গীতে একটি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দল (যারা যেন তেন প্রকারে বঙ্গভূমিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত) একটি মতের দিকে বঙ্গবাসীর কৌতূহল আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টায় রত হয়েছেন। তাঁরা দাবী করেছেন যে সুদীর্ঘকাল রক্তিম আভায় আছন্ন বঙ্গজনপদবাসী যে ইতিহাস পাঠ করেছেন তা রোমিলা থাপার রচিত; যদুনাথ সরকারের ইতিহাস তাঁরা পড়েন নি। বিষয়টি যৎপরসনাস্তি ভাবিয়ে তুলেছে; বিশেষতঃ ক্ষেত্র বিশেষে ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রীদের তো বটেই; কারণ আক্ষরিক অর্থেই এই দুই ইতিহাসবিদের রচনা না পড়লে বা আলোচনার সঙ্গে কিঞ্চিন্মাত্র সংযোগ না থাকলে কোনও ভারতীয় প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর উপাধি অর্জন করা একেবারেই অসম্ভব। অতএব এই দ্বিমূল তত্ত্বের মূলে পৌঁছে দেখা যাক বিষয়টি কি। 

আচার্য যদুনাথ জন্মেছিলেন উনিশ শতকের শেষপাদে। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্য্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সর্বোত্তম ছাত্রদের প্রধানতম যদুনাথ প্রবাদপ্রতীম মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ দামোদর ধর্মানন্দ কোশামবির ন্যায় অঙ্কশাস্ত্রের ছাত্র। ইতিহাস নিয়ে তাঁর আগ্রহ ও গবেষণা কিঞ্চিৎ পরবর্তী সময়ের। 

উনিশ শতকের শেষলগ্নে ভারতবর্ষের বৌদ্ধিক জগতে কয়েকটি বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল।

(১) রাজনৈতিক দল সৃষ্টি। 

(২) প্রশাসনে ভারতীয়দের বেশিমাত্রায় অংশগ্রহণ। 

(৩) আধুনিক ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত (প্রাতিষ্ঠানিক)।

(৪) আধুনিক ভাষাতত্ত্ব/লিপিতত্ত্ব চর্চার সূত্রপাত। 

(৫) ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রসার। 

(৬) বেদ, পুরান, মহাকাব্যকে নতুনভাবে দেখার সূত্রপাত। 

এবং মনে রাখা উচিত, যেহেতু পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব সবথেকে বেশি ছিল হিন্দু ধর্মের মানুষের উপর, তাই এই সব ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষদের সামনের সারিতে দেখা যায়, ক্ষেত্র বিশেষে ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্ব কিছুটা হলেও সেই আঙ্গিকেই চর্চা হয়। 

ফলতঃ ভারতের প্রথম প্রজন্মের ইতিহাসবিদদের মধ্যে স্যার যদুনাথের ইতিহাসচর্চায় কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। 

প্রথমত: ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চার প্রবণত ; যা সেই যুগের বৈশিষ্ট্য। 

দ্বিতীয়ত: সামান্য হলেও ব্রিটিশ সমর্থন। যা নিশ্চিতভাবেই তৎকালীন যুগের প্রভাব কারণ স্যার যদুনাথ নিজে ভিকটোরিয় যুগের ধ্রুপদী উদারবাদী শিক্ষার ফসল। 

তৃতীয়তঃ নিশ্চিত ভাবেই সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেছেন; কিন্তু মনে রাখতে হবে তিনি মূলতঃ পজিটিভিস্ট ইতিহাসবিদ। ফলে ‘History – as it was’ নামক আপ্তবাক্য স্মরণ করে ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। ঔরঙ্গজেবকে এশিয়ার তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ নরপতি বলে বিবেচনা করেছেন; শিবাজীর ভূয়সী প্রশংসা করলেও শিবাজীর রাষ্ট্র বানাতে ব্যর্থ হওয়ার সমালোচনা করেছেন; মুঘল ও মারাঠা উভয় বাহিনীর নৃশংসতার উল্লেখ করতে পিছপা হননি (যদিও আমি মনে করি মারাঠাদের সম্পর্কে এই মনোভাবের কারণ হলো তিনি বাঙালী, আর কে না জানে “…..বর্গী এল দেশে”)।

কিন্তু স্মরণে রাখা উচিত, পজিটিভিস্ট অর্থাৎ Ranke মডেলের ইতিহাসবিদ হওয়ার কারণে দলিল দস্তাবেজ ও তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাসচর্চার প্রতি অসম্ভব অনুরাগবশতঃ নিজে এই ধারা থেকে কোনোকালেই পৃথক হননি। একথাও স্মরণিতব্য যে তিনিই প্রথম দরবারী ইতিহাসবিদদের দলিলের বাইরে আখবরাত, বেসরকারি ইতিহাস, চিঠি, আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা সবকিছু নির্ভর করে মুঘল ইতিহাসচর্চার সূত্রপাত ঘটান। শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রে Ranke-এর থেকে তিনি পৃথক ছিলেন। Ranke মনে করতেন ইতিহাসবিদরা বিচারক নয়। কারণ তিনি আপন দেশ হতে ইউরোপীয় বিপ্লবের সমস্ত সম্ভাবনা নিকেশ করতে চেয়েছিলেন (না হলে বহুজাতি সমন্বিত হ্যাবসবার্গ শাসন প্রভূত সমস্যার সামনে পড়তো)। কিন্তু উপনিবেশের সন্তান ও জাতীয়তাবাদী উন্মেষের যুগে জন্মানো স্যার যদুনাথ এতোটাও ঔপনিবেশিক শাসকের পক্ষপাত করতে রাজি ছিলেন না, তিনি ইতিহাসবিদদের বিচার ক্ষমতা রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। 

কিন্তু যুগের প্রয়োজন ও বাস্তবতা থেকে কোনও ইতিহাসবিদই সরে যেতে পারেন না, ফলতঃ যদুনাথের মধ্যে যেটুকু যুগের প্রতিনিধিত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা পরবর্তী কালের অতি-দক্ষিণপন্থী মতধারাকে পুষ্ট করেছে। 

কালের নিয়মেই স্যার যদুনাথের ছাত্রদের মধ্যে থেকে দুইটি ধারা ইতিহাসচর্চায় বিদ্যমান হয়। একটি জাতীয়রাবাদী ও অপরটি বামপন্থী (মার্ক্সবাদী)। 

ভারতে মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ ছিলেন দুইজন ব্যক্তি। রজনীপাম দত্ত ও দামোদর ধর্মানন্দ কোসামবি। ১৯৩৪ সালের পর থেকে কমিউনিস্ট পার্টি ভারতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে, ১৯৩৬ সালে তৈরি হয় নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন। এই সংগঠনের একাধিক ব্যক্তিবর্গ মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চায় পরবর্তী কালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন যেমন হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জী, সুশোভন সরকার, গৌতম চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি। এই ধারাতেই উঠে আসেন রামশরণ শর্মা, মহম্মদ হাবিব, কে এম পানিক্কর থেকে পরবর্তী কালের সুমিত সরকার, ইরফান হাবিব এমনকি রোমিলা থাপার। 

দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকলেও যদুনাথ সরকারের দেখানো পদ্ধতির ব্যত্যয় এরা কেউই করেননি। অর্থাৎ দলিল-দস্তাবেজের ব্যবহার, প্রতিটি সূত্রকে যাচাই করা, প্রয়োজনে খারিজ করা, এমনকি আরও বহু নূতনতর সূত্রের ব্যবহার (ক্ষেত্র বিশেষে দলিল ব্যতিরেকে)-এর মাধ্যমে এরা ইতিহাসচর্চায় নূতন যুগের সূত্রপাত ঘটান। 

নিশ্চিতভাবেই এই ইতিহাসবিদদের নিজেদের মধ্যে এবং অপরাপর ঘরানার ইতিহাসবিদগণের সঙ্গে প্রভূত পার্থক্য রয়েই গিয়েছে (থাকাটাই স্বাভাবিক), এমনকি যুগের নিয়মেই স্যার যদুনাথের বহু প্রতিপাদ্য বিষয় পরিত্যক্ত হয়েছে। কিন্তু তাঁর ইতিহাসচর্চার গুরুত্ব কোনোদিন হারায়নি।

ফলে যদুনাথ না রোমিলা এই দ্বিমূল একান্তভাবেই অনভিপ্রেত। বস্তুতপক্ষে রোমিলা বোঝার জন্য যদুনাথ পড়তেই হবে, এবং যদুনাথ থেকে উত্তরণ অনিবার্যভাবে রোমিলাকেই ইঙ্গিত করবে। 

মূল আকর ব্যবহারে যদুনাথ যতটা অপরিহার্য পথিকৃৎ; ভ্রান্ত ইতিহাস ব্যাখ্যা কাটিয়ে উঠতে রোমিলা ততটাই প্রয়োজনীয়। গুপ্ত যুগ যে কোনও ভাবেই স্বর্ণযুগ নয় তা বুঝতে গেলে রোমিলা পড়তেই হবে। ইতিহাস শুধুমাত্র রাজদরবারে আবদ্ধ নয়, রাজৈশ্বর্যের ঝলমলে আলো নিশ্চিত ইতিহাসের অন্যতর পাঠ থেকে চোখ ধাঁধিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সেই চোখ ধাঁধানো কল্পিত (বা সীমিত) ইতিহাস থেকে মুক্তি পেতে রোমিলা থাপার পাঠ না করলে চলবে কেন? 

যারা যদুনাথ-রোমিলা দ্বিমূলের জন্মদাতা/দাত্রী তাঁরা আসলে বিকৃত ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে ইতিহাসকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ-মাফিক চালাতে চান। 

ইতিহাস চলে ইতিহাসের পথে। সে এই সব কার্যকলাপের থোড়াই কেয়ার করে।

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার