ফ্যাসিস্ট অক্ষে নির্বাচন কমিশন?
অভিজ্ঞান চক্রবর্তী
ফ্যাসিজম এবং তারই যমজ ভাইবোনের দাপাদাপির মাঝে নির্বাচন কমিশনও আদতেই কি জনবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে, সেই প্রশ্নই কিন্তু উঠছে বারংবার।
প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি.এন. সেশন (তিরুনেল্লাই নারায়ণা আইয়ার সেশন) যে সকল পদ্ধতিগত পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের ঊর্দ্ধে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, আজকের যুগের নির্বাচন কমিশনও কি ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করছে? প্রসঙ্গত, টি.এন.সেশন এই পরিবর্তনগুলো করে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছিলেন নয়াউদারবাদী অর্থনীতির ঊষা লগ্নে, কিন্তু আজকের দিনের যথেষ্ট পরিণত নয়াউদারবাদী ব্যবস্থায় এবং ফ্যাসিজমের উত্থানের মুহূর্তে যেখানে গোটা দেশটাই কর্পোরেটদের প্রত্যক্ষ অঙ্গুলি হেলনে চলছে, সেখানে দাঁড়িয়ে ফ্যসিস্ট পার্টিকে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে কি আদেও আটকানো যাবে, এই প্রশ্নও উঠছে প্রগতিশীল মহলে।
গত দুই মাস ধরে নির্বাচন কমিশনের কার্যকলাপ প্রমাণ করছে যে এই কমিশনও আসলে সুপ্রিমকোর্ট এবং অন্যান্য বিভিন্ন সরকারী আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মতো ফ্যাসিস্টদেরই পক্ষাবলম্বন করছে। রাম মন্দির রায়, দিল্লীর কৃষি আন্দোলন নিয়ে অবস্থান ইত্যাদি বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের গেরুয়া রাজনীতির প্রতি আপোষকামী পদক্ষেপের মতোই নির্বাচন কমিশনও ফ্যাসিস্টদের সামাজিক উগ্রতার দোসরে পরিণত হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের বেশ কিছু জনবিরোধী পদক্ষেপ ও আপোষকামী অবস্থানঃ
১. সরকারী কর্মচারীদের প্রতি হুমকি :
সরকারী কর্মচারীরা নির্বাচনের কাজে যোগ দেওয়ার বিষয়ে নিমরাজি হলে চাকরী থেকে বরখাস্ত করার ভয় দেখিয়ে তাদেরকে বলপূর্বকভাবে নির্বাচনের কাজে নিযুক্ত করা হচ্ছে। কর্মচারীদের মারফত এও জানা গেছে যে অসুস্থতা, বয়সজনিত সমস্যা বা পারিবারিক সমস্যাগুলোকে তোয়াক্কাই করেছে না এই নির্বাচন কমিশন।
২. রাজনৈতিক সন্ত্রাস রুখতে ব্যর্থতা ও সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি দায়বদ্ধতাহীনতা :
কোচবিহারের শীতলকুচির একটি বুথের বাইরে কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে ৫ জন সাধারণ ভোটার খুন হওয়ার ঘটনা আদতে নির্বাচন কমিশনের নিজেদের ইচ্ছেমতো গুলি চালানোর অধিকার দেওয়ারই ফলাফল। গতকাল সকাল ৯:৩০ নাগাদ কোচবিহারের শীতলকুচি অঞ্চলের আমতলি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র নামের ১২৬ নং পোলিং বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দুর্ব্যবহারের ফলে এক ভোটারের অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেই হাঙ্গামাকে সামাল দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ জওয়ানরা সাধারণ নিরস্ত্র ভোটারদের পরোয়া না করেই ৫ রাউন্ড গুলি চালিয়ে বসে, যাতে নিহত হন ৪ জন সাধারণ ভোটার।
এই একই বিধানসভার অন্তর্গত বুথ নং ২৯৫ তে রাজনৈতিক সংঘর্ষ রুখতে প্রথমবার ভোট দিতে আসা এক যুবককে হত্যা করে কেন্দ্রীয় বাহিনী। 'আত্মরক্ষা'-র তত্ত্ব ফেঁদে এখন দায় এড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে।
এই গোটা ঘটনায় তৃণমূল ও বিজেপি একে অপরের দিকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করলেও আদতে নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী ও ভোটের দায়িত্বরত বেঙ্গল পুলিশের স্পেশাল ফোর্সের অপদার্থতা ও দায়িত্মহীনতা ঢাকা পড়ে যায় না।
ডোমজুড়, খানাকুল, উলুবেড়িয়া সহ অন্যান্য অঞ্চলে রাজনৈতিক সন্ত্রাস রুখতে কমিশনের ব্যর্থতা আর শীতলকুচিতে নির্বিচারে গুলি চালানোর ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আদতে তারা কেন্দ্রের অঙ্গুলি হেলনেই চলছে। প্রশ্ন ওঠে, তথাকথিত গণতন্ত্রের উৎসবকে সাধারণ মানুষের রক্তে ভাসাতে কি এই কমিশন বদ্ধপরিকর?
৩. রাজনৈতিক আপোষকামীতা :
কিছুদিন আগেই 'জনগণমন' নাট্যদলের "ইঁদুরকল" নামের একটি ফ্যাসিস্ট বিরোধী নাটকের পরিবেশনায় আর.এস.এস. বাহিনীর জঘন্য আক্রমণের ঘটনায় সম্পূর্ণ নিশ্চুপ থেকেছে নির্বাচন কমিশন যা তার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রতি আপোষকামীতাকে স্পষ্ট করে দেয়।
৪. গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গলা টিপে ধরা :
'লকডাউনের ভরপাই'-এর দাবীতে আন্দোলনের ক্ষেত্রে কনভেনশনের জন্য হল বুকিং-কে কেন্দ্র করে টালবাহানা শুরু করে কমিশন। তাদের দোসর রাজ্য পুলিশ, যারা কিছুদিন আগেই নবান্নের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের মিছিল নির্মমভাবে দমন করেছিল (যদিও একই জায়গা থেকে কেন্দ্র বিরোধী কৃষক মহাপঞ্চায়েত এবং 'নো ভোট টু বিজেপি'-র মিছিল করতে দেওয়া হয়েছে!)।
কমিশনের বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট দল ভোটে না দাঁড়িয়ে আন্দোলন করছে কেন?! তবে কি ভোট পরিচালনার নামে ভোটে অংশগ্রহণ না করা কিন্তু গণতান্ত্রিক।আন্দোলনের পথে চলা বামপন্থী দলগুলোকে উগ্রপন্থী আখ্যা দিয়ে ভোটের আবহে রাস্তার আন্দোলনকে ঢাকতেই বেশী ব্যস্ত এই কমিশন?!
একদিকে সুস্থ নির্বাচন পরিচালনার কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থতা, একইসাথে কেন্দ্রীয় ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর প্রতি আপোষকামীতা ও অন্যদিকে রাস্তার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গলা টিপে মারার এই অপচেষ্টা নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার উপরই প্রশ্ন তোলে।
কমিশনার পদত্যাগ করে সরাসরি গেরুয়া ঝান্ডা ধরলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়।
Picture Courtesy: Business Standard
সহমত
ReplyDelete