প্রসঙ্গ ভাঙড়ে নির্বাচনঃ সন্ত্রাস রুখতে গণআন্দোলন না আইডেন্টিটি পলিটিক্স?

সুমিত ঘোষ


রাজ্যের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভা নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে শাসক দল তৃণমূলের সরকার খোয়ানোর আর অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট বিজেপির ক্ষমতাধীন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। দীর্ঘদিন শক্তিশালী গণআন্দোলন সংঘটিত করতে অসফল বামেদের এবারের নির্বাচনের ট্যাক্টিক্সও তাই চূড়ান্ত আপোষকামী। ফ্যাসীবাদকে রোখার নামে এবং দলিলগতভাবে ফ্যাসীবাদের পূর্ণ উত্থান হয়েছে কিনা সে বিষয়ে ধোঁয়াশা রেখে দিমিত্রভ থিসিসকে হাতিয়ার করে বামেরা ফ্যাসীবাদেরই যমজ বোনেদের হাত ধরতে বদ্ধপরিকর। বামফ্রন্টভুক্ত 'ন্যাশনাল লেভেল' পার্টিগুলো দাঁড়িয়েছে জাতীয় দল কংগ্রেসের দুয়ারে আর নকশালপন্থীদের একাংশ নিজেদের সাংগঠনিক বহরের সাথে সাযুজ্য রেখে আঞ্চলিক দল তৃণমূলকে বেছে নিয়েছে বিজেপিকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে; যদিও কংগ্রেস এবং তৃণমূল উভয় থেকেই নির্বাচন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে ফলাফল নির্বিশেষে পদ্মবনে যাওয়ার সম্ভাবনা অতিরিক্ত বেশি। 

ভাঙড়ের পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলন

ভাঙড় পশ্চিমবঙ্গের এই সামগ্রিক পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে না থাকলেও এবারের নির্বাচনে তার গুরুত্ব এখানেই যে এটি এমন একটি কেন্দ্র যেখানকার মানুষ এক ঐতিহাসিক, দীর্ঘ, আংশিকভাবে সফল এবং সদর্থক পরিণতি প্রাপ্ত গণআন্দোলনের অংশগ্রহণকারী। কেন্দ্রের কংগ্রেস এবং পরবর্তীতে বিজেপি সরকারের মদত প্রাপ্ত এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকারের স্নেহধন্য পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পের নামে বিনা ক্ষতিপূরণ এবং বিকল্প জীবিকার আয়োজন ছাড়াই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধেই ছিল এই আন্দোলন। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল 'জমি, জীবিকা, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি'। এই কমিটিতে বিভিন্ন গণআন্দোলনের নেতারা যোগ দেন। বিভিন্ন ব্যাক্তি বিশেষও এই আন্দোলনে যোগদান করেন। আন্দোলন সংঘটিত করার অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন কমঃ অলীক চক্রবর্তী।  

আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত কালপঞ্জিঃ   

২০১৩ঃ তৃণমূল সরকার তৎকালীন কেন্দ্রের পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পের জন্য ভাঙড় ২ নং ব্লকে ১৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে ১৮৯৪ সালের বিতর্কিত জমি অধিগ্রহণ আইনকে হাতিয়ার করে। প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ, বিকল্প জীবিকার নিয়োগ এবং আঞ্চলিক পরিবেশগত প্রভাবের পরীক্ষা (এনভাইরন্মেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা ইআইএ) ছাড়াই এই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত হন এলাকার মানুষ। 

২০১৬ঃ খামারআইট, মাছিভাঙা, টোনা এবং গাজিপুরের গ্রামবাসীদের নিয়ে তৈরি হয় 'জমি, জীবিকা, বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি'। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। 

১৭ই জানুয়ারি, ২০১৭ঃ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন দুই আন্দোলনকারী মোফিজুল ও আলমগীর। বহু আন্দোলনের নেতৃত্বকে কুখ্যাত ইউএপিএ আইনের অজুহাতে গ্রেফতার করা শুরু হয়। 

২০১৮ঃ আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে সরকারের সাথে রফাসূত্র বের করার প্রশ্নে বিবাদ শুরু হল। জমি কমিটি পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল। তৃণমূলের কুখ্যাত গুন্ডা আরাবুল ইসলামের গুলিতে এক আন্দোলনকারী হাফিজুর শহীদ হন। তৃণমূলের ব্যাপক সন্ত্রাসের মাঝেও পোলেরহাটের ৫টি আসনে জয়ী হন জমি কমিটির প্রার্থীরা। 

মে, ২০১৮ঃ রাজ্য সরকার জমি কমিটির প্রতিনিধিদের সাথে সমঝোতায় এসে ট্রান্সমিশন লাইনের সংখ্যা ১৬ থেকে ৪-এ নামিয়ে আনে এবং এলাকার সার্বিক উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত ক্ষতিপূরণের দাবী মেনে নেয়। 

আন্দোলনের সমাপ্তি লগ্নে নেতৃত্বের বিবাদের প্রশ্নে... 

আন্দোলনের সমাপ্তি লগ্নে সরকারের সাথে রফাসূত্র বের করার প্রশ্নে সিপিআই(এম.এল)-রেড স্টারের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আপোষের লাইন গ্রহণের অভিযোগ তোলেন বাকি নেতৃত্বরা। যে কোনও গণআন্দোলনেই যেহেতু বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যাক্তি অংশগ্রহণ করেন, সেহেতু অংশগ্রহণকারীদের সাধারণ মানুষের মধ্যে আন্দোলন সংঘটিত করার তীব্রতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে একটা দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। আন্দোলনের সমাপ্তি লগ্নে এক বা একাধিক সংগঠন নিজেদের রাজনৈতিক বিস্তারে সফল হয় এবং পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদান করে। ভাঙড়ের ক্ষেত্রে এই অন্তর্যুদ্ধে রেড স্টারের সফলতা ও জনগণের মাঝে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার আন্দোলনের বাকি নেতৃত্বের মাঝে বিবাদের সূচনা করে। অনেক সংগঠনই আন্দোলন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিত্যাগ করলেও রেড স্টার বাকি লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে চলেছে আজও। ভাঙড়ের আন্দোলনরত মানুষদের বিপ্লবী রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তারা এলাকায় সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের দাবীতে আন্দোলন, লকডাউন ও আম্ফানের সময়ে সরকারী অনুদান সরবরাহে তৃণমূলের কারচুপি রোধ এবং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। 

রঙ্গমঞ্চে আব্বাস সিদ্দিকী

ফুরফুরা শরিফের পারিবারিকসূত্রে হয়ে ওঠা ধর্মগুরু আব্বাস সিদ্দিকী একজন আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক চরিত্র। 'ফুরফুরা শরিফ আহালে সুন্নাতুল জামাত (আব্বাস)'-এর এই একনায়ক একদিকে যেমন করোনা মহামারীতে প্রচুর মানুষের মৃত্যুকে রসিকতার ছলে আল্লার দোয়া বলে বিশাল জনসংখ্যার হ্রাসের ফলে বিশ্বে শান্তি ফেরার আশ্বাস দেয়, অন্যদিকে আবার আল্লার ছবি আঁকা ফ্রান্সের এক শিক্ষককে নৃশংসভাবে হত্যাকারী জেহাদীদের সে আল্লার দূত হিসেবে স্বীকৃতী দেয়! তার জলসায় মুসলমান মহিলাদের আসা যেমন নিষেধ (তুলনামূলকভাবে উল্লেখ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়ী ৫জন জমি কমিটির প্রার্থীদের মধ্যে ২জন মহিলা - জাহানারা বিবি এবং সালোয়ারা বিবি), তার সাথে সাযুজ্য রেখেই পার্ক স্ট্রীট কান্ডে ধর্ষণকারীকে পালাতে সাহায্য করায় অভিযুক্ত তৃণমূল সাংসদ নুসরতের বিরুদ্ধে আব্বাসের ফতোয়া - মুসলমান হয়ে হিন্দু মন্দিরে যাওয়ায় তাকে বাঁশ দিয়ে পেটানো উচিৎ! সংখ্যালঘুদের বহু বছরের ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক অবস্থান, তৃণমূলের ধর্মগুরুকেন্দ্রিক তোষণের রাজনীতি, বিজেপির উত্থান এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সংগঠন বিস্তারের চেষ্টায় বামপন্থীদের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে বর্তমান নির্বাচনে বিহারের রাষ্ট্রীয় সেকুলার মজলিস পার্টির নাম ভাড়া করে আব্বাস ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা উড়িয়ে আইএসএফ-কে ভোট ময়দানে অবতীর্ণ করেছে; অর্থনৈতিক দোসর বিজেপির বি-টিম আইমিম অর্থাৎ আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। কিছু দলিত ও আদিবাসীদের ভিড়িয়ে এবং বেশ কিছু কেন্দ্রে সিপিআই(এম) কর্মীদের নিজেদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আব্বাস আসলে নিজের রাজনৈতিক ফায়দার বাস্তবায়নের কথা ভাবছে; তাই তার প্রকাশ্য উক্তি যে সংযুক্ত মোর্চায় তার যোগদান সাময়িক এবং সময় এলে বাম-কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও সে নাকি প্রতিশোধ নেবে। আব্বাসের রাজনীতি নতুন কিছু নয়। এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের নামে শুধু মুসলমান, আদিবাসী এবং দলিতদের সংঘটিত করার বিপজ্জনক এবং সংকীর্ণ রাজনৈতিক লাইন বাস্তবায়নে তৃণ-মাও মানিক ফকির এবং কিছু নকশালপন্থীদের 'দামাল' সংগঠন আগেই  সচেষ্ট হয়েছিল। আব্বাস বুদ্ধিটা হাইজ্যাক করেছে মাত্র এবং এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়াতে বিজেপির পথ আরও মসৃণ হয়ে উঠেছে।  

সিপিআই(এম)-এর রাজনীতি 

বিভিন্ন আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত ও সংকীর্ণ সামাজিক প্রতিনিধিত্বের (আইডেন্টিটি) জোড়াতাপ্পি মেলবন্ধন ঘটিয়ে বিজেপিকে হারানোর সিপিআই(এম)-ইয় লাইনের মূল সারবত্তা হল সরল সমীকরণে আলাদা আলাদা করে যোগ করতে থাকো একটার পর একটা সামাজিক ফ্যাক্টরের প্রতিনিধিকে; অর্থাৎ সরলার্থে উত্তর-আধুনিকতার তত্ত্বকে হাতিয়ার করে আইডেন্টিটি পলিটিক্সকে তুলে ধরো! এই লাইনের সমস্যা এখানেই যে এই আলাদা আলাদা করে ধরা এক একটা ফ্যাক্টরের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও মিথষ্ক্রিয়াকে এই সরল সমীকরণ নিজের গাণিতিক জটিলতার মধ্যে গ্রাহ্যই করেনি। শ্রমিক কৃষকের আন্দোলন থেকে শত হস্ত দূরে অবস্থানকারী সিপিআই(এম) শ্রেণি আন্দোলনের মধ্যেই উদীয়মান প্রত্যেকটা সামাজিক ফ্যাক্টরকে অন্তর্ভুক্ত না করে, বরং শ্রেণি রাজনীতিকে বাদ দিয়েই ফ্যাক্টরগুলোকে আলাদা আলাদা করে অ্যাড্রেস করতে উদ্যত। তাই সে একদিকে প্রান্তিক লিঙ্গের আন্দোলনকে বার্তা দিতে গরীব হিজড়ে সম্প্রদায় ও গরীব প্রান্তিক লিঙ্গের প্রতিনিধিদের বদলে মূলত আর্থিকভাবে স্বচ্ছল রূপান্তরকামী এবং বিভিন্ন এনজিও (এদের কিছু আবার তৃণমূলের প্রসাদ তুষ্ট)-দের নিয়ে সভা করতে ব্যস্ত, আবার অন্যদিকে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হিসেবে সে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ধর্মগুরু ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না।  

ভাঙড়ে এবারের নির্বাচন    

ভাঙড় আন্দোলনের আইনী লড়াইয়ের অন্যতম প্রতিনিধি বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে সামনে রেখে সিপিআই(এম) জমি কমিটির আন্দোলনের প্রসাদ নিজের মুখে তুলে নিতে পেরেছিল গত লোকসভা ভোটে। সারা রাজ্যে শোচনীয় পরাজয়ের পরেও তারা যাদবপুর কেন্দ্রে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার লজ্জা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এখনও বহরে বড় হওয়ার সুযোগে গণআন্দোলনকে সিপিআই(এম)-এর গ্রাস করার কৌশলের ফাঁদে পা দিয়েছিল জমি কমিটি ও রেড স্টার নিজেদের প্রার্থী না দাঁড় করিয়ে। নেকড়ে রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়ে তাই এবারের বিধান সভা নির্বাচনে ভাঙড়ে আব্বাসের ভাইকে দাঁড় করিয়ে আইডেন্টিটি পলিটিক্সকে কার্যত গণআন্দোলনের ঊর্ধ্বে বসিয়ে সমগ্র বাম আন্দোলনকেই ক্ষতিগ্রস্থ করতে উদ্যত হয়েছে। অন্যদিকে, বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকে অপ্রধান শত্রু নির্ধারণের লাইন বামপন্থী আন্দোলনগত ফ্রন্ট তৈরির সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দিয়েছে। এ বিষয়ে নির্বাচন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট গণআন্দোলনের নেতৃত্বের নিজ অবস্থানের পর্যালোচনা করা উচিৎ। 

বিগত কিছু বছরে সারা রাজ্যে একমাত্র ভাঙড়ে বৃহৎ গণআন্দোলন সংঘটিত করতে সফল হয়েছিল জমি কমিটি, তাই তার নেতৃত্বের উপরই এই দায়িত্ব বর্তায় যে সে সমগ্র বাম আন্দোলনের প্রতিনিধিদের আন্দোলনগত ঐক্যবদ্ধতার ডাক দেবে। পূর্বতন ভাঙড় আন্দোলনের শরীকদের একাংশ জমি কমিটি সমর্থিত সিপিআই(এম.এল)-রেড স্টার প্রার্থী মির্জা হাসানের সমর্থনে প্রচার করেছে। বামপন্থীদের নেতৃত্বে খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে শক্তিশালী করা গেলেই ফ্যাসীবাদকে রোখা সম্ভব।  এই নির্বাচনে তাই বিপ্লবী বামপন্থী প্রতিনিধিদের হাত শক্ত করার লড়াই জারী থাকবে... 

ইনকিলাব জিন্দাবাদ!!!

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?