২০২১-এর ১লা মে
রূপক গায়েন
পয়লা মে, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের সমৃদ্ধ ইতিহাস বহন করে; যদিও "আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস"-এর নামে শুধু একদিনের ছুটিটুকু আমের মতো দিয়ে তার দীর্ঘ ইতিহাসটিকে আঁটির মতো ছুড়ে ফেলে দিতে চাইছে সমগ্ৰ বিশ্বের দক্ষিণপন্থী শাসকশ্রেণী। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। এ প্রসঙ্গে একটি ছোট ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ভারতের সর্ববৃহৎ বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলির নেতৃত্বে সারা দেশে পয়লা মে 'শ্রমিক দিবস' হিসেবে পালিত হলেও, ভারতীয় রাজনীতির এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলির আন্দোলনগত ঐক্যের প্রয়োজনকে ব্যবহার করে ভারতীয় জনসংঘের শ্রমিক সংগঠন 'ভারতীয় মজদুর সংঘ' বা বিএমএস দাবী জানিয়েছিল যে সেই ঐক্য সম্ভব হবে একমাত্র বিশ্বকর্মা পুজোর দিনকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করার মধ্যে দিয়ে!!! এভাবে শ্রমিক ঐক্যে ভাঙন ধরানোর তখন চেষ্টা চললেও তা ধোপে টেকেনি কিন্তু বর্তমানে বিশ্বকর্মা পুজোর সংখ্যা কমতে থাকা এবং হনুমান পুজোর রমরমা এখন ফ্যাসিস্টদের মধুচন্দ্রিমার দিকেই ইঙ্গিত করছে।
১৮৮৬ সালের ৪ঠা মে শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে আট ঘন্টা শ্রমদান, আট ঘন্টা বিশ্রাম এবং আট ঘন্টা সৃজনশীল কাজে সময় কাটানোর দাবীতে ব্যাপক শ্রমিক ধর্মঘট হয় এবং পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধের ফলস্বরূপ শ্রমিক নেতা পার্সন্স, স্পাইজ, এঙ্গেল এবং ফিসারকে ১১ই নভেম্বর, ১৮৮৭-এ ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিতে হয়। ১৮৮৯ সালে প্রথম শ্রমিক আন্দোলনের 'দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক' হে মার্কেটের ঘটনার স্মরণে ১লা মে 'আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস' হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই আন্দোলন কোনো হঠাৎ করে কুড়িয়ে পাওয়া ষোলো আনা নয়। ১৮২০ থেকে ১৮৪০ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক দশ ঘন্টা কাজের দাবীতে ধর্মঘট চলছিল। ১৮৫৬ সালে প্রথম অষ্ট্রেলিয়ায় দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবীতে ধর্মঘট হয়। এই প্রেক্ষাপটে মার্কস ও এঙ্গেলস গঠিত প্রথম "কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক" বিবৃতি দেয়: কাজের দিন আইন করে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার ব্যাপার একটি ব্যবস্থা; এই ব্যবস্থা ছাড়া শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি এবং মুক্তির সকল প্রচেষ্টাই বিফল হতে বাধ্য। মার্কস তাঁর ক্যাপিটালের প্রথম খন্ডে বলেন: যখন মেশিনারি ব্যবহার একচেটিয়া ব্যাপার, তখন মুনাফা হয় অসাধারণ এবং মালিক চেষ্টা করে শ্রমিকের কর্মদিবসকে যথাযথ দীর্ঘায়িত করে মুনাফার আয়তন বাড়িয়ে তুলতে। তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে মেশিনারি ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে বেশি উৎপাদন করে এবং অন্যদিকে শ্রমিকদের যতটা সম্ভব বেশি খাটিয়ে আসলে দু'তরফ থেকেই মুনাফা অর্জন করে মালিক শ্রেণী।
স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান নয়াউদারবাদী যুগেও শ্রমকে সস্তা করার প্রয়াস চলছে। আমাদের দেশেও একাধিক নতুন শ্রমিক বিরোধী আইনকে কার্যকর করে শ্রমিকদের পিষে মারার এক নোংরা খেলায় সামিল হয়েছে মালিকপক্ষের স্তাবক আচ্ছে দিনের সরকার ।
এই কালাকানুনগুলি (শ্রম কোড ইত্যাদি) লাগু করার মাধ্যমে,
প্রথমতঃ ন্যুনতম মজুরি নির্ধারণ একপ্রকার তুলেই দেওয়া হচ্ছে,
দ্বিতীয়তঃ ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার খর্ব করার আইনি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে,
তৃতীয়তঃ সময় ভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে যার ফলে মালিকপক্ষ এখন কাউকে স্থায়ী নিয়োগপত্র না দিয়ে একবছরের জন্য নিয়োগ করতে পারবে, এবং তিনশোর কম শ্রমিক থাকা কারখানায় মালিকরা ইচ্ছেমতো ছাঁটাই করতে পারবে,
চতুর্থতঃ শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ এককথায় মালিকপক্ষ যাই করুক ধর্মঘট করা যাবে না,
পঞ্চমতঃ দৈনিক শ্রমদানের সময় ৮ থেকে ১২ ঘন্টায় উন্নীত করার চক্রান্ত চালানো হয়েছে...
এছাড়া, সপ্তাহের কাজের দিন ৪ দিন করার প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্র সরকার, অর্থাৎ তিনদিন ছুটি থাকবে। স্বভাবতই সেটা অনেকের কাছে বেশ দারুণ পদক্ষেপ কিন্তু এর পিছনে রয়েছে এক বিরাট ষড়যন্ত্র। আসলে এর মধ্যে দিয়ে ঘুরপথে দিনে বারো ঘন্টা কাজের সময়কে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, কারণ ৬ দিনের ৮ ঘন্টার কাজ (৬X৮=৪৮ ঘন্টা) ৪ দিনে করতে হলে দৈনিক ১২ ঘন্টা (৪৮/৪=১২) শ্রমদান প্রয়োজন, কিন্তু কোনো শিল্পক্ষেত্রেই সপ্তাহে তিনদিন ছুটি দেওয়া সম্ভব নয়, তাই কিছুদিন এই ব্যবস্থা চালিয়ে আবার পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে গিয়ে ১২ ঘন্টা শ্রম সময়কে স্বাভাবিক করতে চাওয়া হচ্ছে।
এছাড়াও, এই দেশে করোনা পরিস্থিতি বাড়লে সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর ব্যাপারে নীরব দর্শক হয়ে থেকেছে, ছাঁটাই বন্ধের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি এবং লকডাউনে তাদের আর্থিক সহায়তা নিয়েও টুঁ শব্দটি অব্দি করেনি। 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এর নামে এমনিতেই আট ঘন্টা কাজের নিদানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সারাদিন খাটানোর নীলনকশা বাস্তবায়িত হয়েছে। লকডাউন পরিস্থিতিতে দেশে একটার পর একটা কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে সরকারের সাথে সেটিং করে; শ্রমিকদেরকে আইনি জটিলতার টানাপোড়েনে রেখেই। শ্রমিকদের কথা এবার শ্রমিকদের নিজেদেরই ভাবতে হবে। শক্তিশালী শ্রমিক সংহতিই একমাত্র পারে এই অচলায়তনে পঞ্চকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। সমূলে উৎখাত করতে হবে এই শোষণের ব্যবস্থাকে। মনে রাখবেন দাড়িবেশে ভিক্ষুসেজে রাবণও এসেছিল সীতাকে হরণ করতে, আর 'উনি' তো বলেই দিয়েছেনঃ 'হাম তো ফকির আদমি হে জি, ঝোলা লেকে চল পড়েঙ্গে'।
শ্রমিক একতা জিন্দাবাদ!!!
Comments
Post a Comment