করোনা আবহে 'আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস'-এর শিক্ষা
অভিজ্ঞান চক্রবর্তী
আজ গোটা বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর ৮ ঘন্টা কাজ, ৮ ঘন্টা প্রমোদ এবং ৮ ঘন্টা বিশ্রামের অধিকারের আওয়াজ মালিকপক্ষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দিন। ১লা মের দীর্ঘ সংগ্রাম পুঁজির দালালি করা সেই চাকরীরত বাবুকেও ৮ ঘন্টা শ্রমদানের অধিকার দিয়েছে যিনি ঠান্ডা ঘরে বসে শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকে গালাগালি করেন এবং তাদের ধ্বংস করতে যথাসম্ভব সচেষ্ট হন। দুঃখের বিষয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস আজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দুর্বিপাকে ও শ্রমিক নেতাদের অযোগ্যতায় পরিণত হয়েছে একটি সামান্য ছুটির দিনে।
১৮৮৬ সালের শিকাগোর হে মার্কেটের ধর্মঘটের কথা ও ১লা মে শিকাগোর সমাবেশ এবং পরবর্তীতে ৩রা ও ৪ঠা মে ধর্মঘটী শ্রমিকদের ওপর পুলিশি বর্বরতার ইতিহাস সকলেরই জানা। ৩রা মে একটি কারখানার শ্রমিকদের পুলিশ দ্বারা হত্যার ঘটনায় পুলিশ ও ধর্মঘটীদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়, যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ফাঁসীর মঞ্চে শ্রমিক নেতা পার্সনস, স্পাইজ, ফিসার এবং এঙ্গেলকে তোলা হয়। এরপর থেকেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশে দেশে। বিশেষত রাশিয়ার বিপ্লবী কর্মধারায় মে দিবসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৮৯৬ সালে জেলে বন্দী থাকাকালীনই লেনিন "মে দিবসের ইশতেহার" রচনা করেন ও ৪০টি কারখানার শ্রমিকদের তা বিলি করার ব্যবস্থা করেন। ১৯০০ সালের নভেম্বরে "খারকভে মে দিবস" পুস্তিকার মাধ্যমে তিনি দেশের জনগণকে মে দিবসের সংগ্রামী ইতিহাসের অনুপ্রেরণা দেন।
কিন্তু ৮ ঘন্টা শ্রমের দাবীতে এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট একদিনে গড়ে ওঠেনি। ১৮২০ - ৪০ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় পূর্বপ্রচলিত সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত কাজ করার জঘন্য নিয়মকে ভেঙে দৈনিক দশ ঘন্টা কাজের দাবীতে শুরু হয় ধর্মঘটের পর ধর্মঘট যার মধ্যে ১৮২৭ সালে ফিলাডেলফিয়ায় মেকানিকদের নিয়ে গঠিত দুনিয়ার প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন-এর ধর্মঘট উল্লেখযোগ্য। এরই মধ্যে ১৮৫৬ সালে সুদূর অস্ট্রেলিয়ায় গৃহনির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যেও ৮ ঘন্টা শ্রম সময় পালনের দাবীতে ধর্মঘট পরিলক্ষিত হয়। ১৮৬৬ সালের ২০শে অগাস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ষাটটি ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত "ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন" একটি সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেয়ঃ "এই দেশের শ্রমিকশ্রেণীকে পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত করবার জন্য এই মুহুর্তে প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন হল এমন এক আইন পাশ করা - যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত রাজ্যেই সাধারণ কাজের দিন হবে আট-ঘন্টা। এই মহান লক্ষ্য পূর্ণ করার পথে সমগ্র শক্তি নিয়োগ করার সংকল্প আমরা গ্রহণ করছি। "
কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর নেতৃত্বে গঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক বিবৃতি দেয় "কাজের দিন আইন করে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার ব্যাপার একটি প্রাথমিক ব্যবস্থা, এই ব্যবস্থা ছাড়া শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি ও মুক্তির সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে"।
১৮৬৭ সালে প্রকাশিত ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে "কাজের দিন" নামক অধ্যায়ে মার্ক্স লেখেন, "কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক যেখানে ক্রীতদাস, শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক সেখানে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। ক্রীতদাসত্বের সমাধির ওপর নবজীবনের অভ্যুদয় ঘটে। গৃহযুদ্ধের প্রথম অবদান হল দৈনিক আট ঘন্টা কাজের আন্দোলন - অবাধ গতিতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে অতলান্তিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত, নিউ ইংল্যান্ড থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অবধি"। এই গ্রন্থের প্রথম খন্ডে মার্ক্স আরো ব্যখ্যা করেন কীভাবে মালিক তার শ্রমিককে ঠিক পরের দিন খাটতে আসার মতো শ্রমশক্তিটুকু অর্জনের মতো মজুরি দিয়ে এবং মেশিনারি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রমিককে দিয়ে অধিক উৎপাদন করিয়ে নেয় এবং তারই সাথে সাথে ছাঁটাই-এর ভয় দেখিয়ে শ্রমিকের শ্রমঘন্টাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে দুতরফা মুনাফা লাভ করে।
এইসময় উত্তর আমেরিকার গৃহযুদ্ধ-এর কারণে ৮ ঘন্টা কাজের আন্দোলনের গতি মন্থর হয়ে পড়লেও, ১৮৯০ সালে আমেরিকা ও ইউরোপ-এর সমস্ত দেশে আন্দোলন সঞ্চারিত হয়। ওই একই বছরে কমিউনিস্ট ইশতেহারের ভূমিকায় এঙ্গেলস লেখেন, "এই লাইনগুলো আমি যখন লিখছি, ঠিক তখনই ইউরোপ ও আমেরিকায় শ্রমিক শ্রেণী তাঁদের শক্তি সামর্থ্যের হিসেব নিকেশ করছেন; ইতিহাসে এই প্রথম শ্রমিকশ্রেণী একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসাবে, একই পতাকাতলে, ৮ ঘন্টা কাজের দাবীকে আইনি প্রতিষ্ঠা দেবার এই লক্ষ্য পূরণের জন্য সংগ্রাম করছেন।”
এর পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বে শ্রমিকশ্রেণী তথা কমিউনিস্ট পার্টিগুলির সংগ্রাম আরো জোরদার হয়। রুশ দেশে লেনিনের দেখানো পথে সমাজতন্ত্র গঠনের কাজ শুরু হয় এবং সর্বোপরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোটা বিশ্বকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে রক্ষা করে লালফৌজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে '২৬ জুলাই মুভমেন্ট' পার্টি কিউবাতে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়। ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৫৯ সালে কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। ভিয়েতনাম হো-চি-মিন-এর নেতৃত্বে ফরাসী ও মার্কিন ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।
এর পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির শক্তি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে, বিনষ্ট হয় বিশ্বব্যাপী শ্রমিক ঐক্য। পুঁজিবাদ এই সময়ে আরো শক্তিশালী, আরো ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। আজকে আমরা এসে পড়েছি পু্ঁজিবাদের নয়াউদারবাদী দশায়। অতিউৎপাদন কমাতে এই ব্যবস্থায় বদলেছে উৎপাদনেরই ধারা। আগের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উৎপাদনের পদ্ধতির সম্পূর্ণ উল্টোপন্থায় প্রচুর পরিমাণে টেকসই সস্তা পণ্য উৎপাদনের জায়গা নিয়েছে অল্প সংখ্যায় বারংবার উৎপাদিত ঠুনকো দামী পণ্য। এই পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা তৈরির জন্য অতিরিক্ত বেতন দিয়ে সুনির্দিষ্ট ক্রেতা তৈরী করা হয়েছে। বাকী অংশকে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে বেকারত্ব ও মিতব্যায়িতার অন্ধকারে। ক্রমাগত কমছে বিনিয়োগ পিছু কর্মসংস্থান এবং একইহারে বাড়ছে ছাঁটাই। টাকা দিয়ে টাকা বাড়ানোর খেলায় পুঁজিবাদ নিজের কারণেই বাড়িয়ে তুলেছে নিজের সংকট, যে সংকটের মেঘ দিনের পর দিন আরো ঘণীভূত হয়ে প্রবল করেছে আসন্ন মহামন্দার সম্ভাবনা। বর্তমান করোনা অতিমারী ও তাকে ঘিরে লকডাউন পুঁজিবাদকে নতুন দিশায় চালিত করেছে। গোটা বিশ্বজুড়ে তৈরী হয়েছে ফ্যাসিজম-এর আবহ। এই করোনা পরিস্থিতি আজ এনেছে এক নতুন কর্মপদ্ধতি যার নাম 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'।
আজ মালিকপক্ষ ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর নামে শ্রমঘন্টার তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমত খাটিয়ে নিতে পারে কর্মচারীদেরকে। যেহেতু ঘরে বসেই কাজ, সেহেতু যাতায়াতের বালাই নেই, সেই সময়টুকুকে কাজে লাগিয়ে মালিকপক্ষ আজ একই মাইনেতে ৮ ঘন্টার জায়গায় ১৪-১৫ ঘন্টা পর্যন্তও কাজ করিয়ে নিতে পারছে। আজ এই প্যান্ডেমিক-এর সেকেন্ড ওয়েভে দাড়িয়ে সত্যিই শ্রমিক শ্রেণীর আট ঘন্টার কর্মদিবসের অধিকার প্রশ্নের মুখে। এর সাথে সাথেই গোটা করোনাকালে নির্বিচারে ছাঁটাই হয়েছে প্রোডাকশন ও সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর শ্রমিক। গত লকডাউন জুড়ে প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশী শ্রমিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি হারিয়েছেন। এরই মাঝে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা গৃহীত চারটি শ্রম আইন পার্লামেন্টে পাশ হয়ে যায় বিরোধী দলগুলির প্রতীকী বিরোধিতায়, যা আজ পুঁজিবাদের হাত আরো শক্ত করেছে আর কেড়ে নিতে চলেছে শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত অধিকার। গোটা করোনাকাল জুড়ে যেমন ছাঁটাই হয়েছে অজস্র শ্রমিক তেমন তারই সাথে সাথে কমেছে কর্মীনিয়োগ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্মীনিয়োগ হয়ে পড়েছে কন্ট্রাক্টচুয়াল যার ফলে আজ অধিকাংশ শ্রমিক তাদের শ্রমিকের অধিকার থেকেই বঞ্চিত। অর্থাৎ মালিকপক্ষ তাদের যেভাবে খুশি খাটিয়ে নিতে পারে, যখন খুশি ছাঁটাই করতে পারে। গত বছরের সুইগি-জোমাটোর মতো কন্ট্রাক্টচুয়াল লেবারদের আন্দোলন তাই উল্লেখযোগ্য যদিও তা নেতৃত্বের দুর্বলতায় হোঁচট খেয়েছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেই বিষফোঁড়া হয়ে এসেছে চারটি নতুন শ্রম আইন। এই শ্রম আইনগুলির অন্তর্গত ওয়ার্কিং কন্ডিশন কোড-এর ২৭ নং ধারায় বলা হয়েছে যে "ওভারটাইম"-এর উর্দ্ধসীমা নির্ধারণ করবে সরকার ফলে তা আর শ্রমিকের ঐচ্ছিক বিষয় রইল না। শ্রমিক শ্রেণীকে বিনা বাক্যব্যয়ে খাটিয়ে নেওয়াই এই আইনের 'মন-কি-বাত'। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোডের মাধ্যমে সময়-ভিত্তিক নিয়োগকে আইনী স্বিকৃতি দেওয়া হয়েছে যার ফলে কন্ট্রাক্টচুয়াল লেবার নিয়োগে আর কোনো বাধাই রইল না। সবেধন নীলমণি শ্রমিকের প্রতিবাদের হাতিয়ার ধর্মঘটের অধিকারের ওপরও ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোডের মাধ্যমে চাপানো হয়েছে হাজারো বিধিনিষেধ। তাই ২০২১ সালের ১লা মেতে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে শ্রমিকদের রক্তপাত ও সংগ্রামকে স্মরণ করে যদি আজকের শ্রমিকের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার না আছে সঠিক মজুরীর অধিকার, না আছে বহু সংগ্রামের পরে ছিনিয়ে আনা ৮ ঘন্টা কর্মদিবসের অধিকার, নেই চাকরির সুরক্ষা, নেই কর্মসংস্থানের অধিকার এমনকী ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে ধর্মঘটের অধিকারটুকুও। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সকাল ১০টা থেকে ৩টে এবং বিকেল ৫ টা থেকে পরদিন সকাল ৭ টা এরকম দুই দফায় হিজিবিজি পার্শিয়াল লকডাউন করে স্বাস্থ্য ও খাদ্য সরবরাহের দায়িত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকার শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিতে চাইছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। বহু সংগ্রাম ও রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে পাওয়া এই ৮ ঘন্টা কাজের ও অন্যান্য শ্রমিক অধিকার এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকা বাঁচাতে প্রয়োজন বামপন্থীদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের লকডাউনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা।
#Notolockdown #Notolayoff #Notolabourcode
ভালো লাগলো। ইতিহাস এর নিরিখে বর্তমান কে দেখা, বেশ ভালো।
ReplyDelete