রাজ্যপালের পদটি সিলেক্টেড নয়, ইলেক্টেড হোক, নইলে তুলে দেওয়া হোক !!!
রাজ্যপালের পদ তুলে দেওয়া প্রয়োজন কারণ এই ঔপনিবেশিক পদটি কেন্দ্র সরকারের দ্বারা বারংবার অপব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। কংগ্রেস থেকে অধুনা বিজেপি, দুই দলের দ্বারাই তা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল যে সম্পূর্ণরূপে বিজেপির একজন সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে তা স্পষ্ট। রাজ্যপাল পদটি যদি বজায় রাখতেই হয় তাহলে তার অধিকার সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক এবং রাষ্ট্রপতির মতন নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যপালকেও নির্বাচিত করানো হোক। নইলে কেন্দ্রের সিলেক্টেড প্রতিনিধি কেন্দ্রের পুতুল হয়েই কাজ করবে।
রাজ্য সরকারগুলির ওপর রাজ্যপালের যে আক্রমণ তা মোটেও কাম্য নয়। রাজ্যপাল সাধারণত কেন্দ্রের প্রতিনিধি হয়ে কেন্দ্রের কথা মতন আঞ্চলিক নেতা-নেত্রীদের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করে। এর প্রধান শিকড় কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে আমাদের সংবিধানে, যেখানে রাজ্যপালের কাজ কী কী, তা নিয়ে বিভিন্ন ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়ে রয়েছে বরাবরই। এই ধোঁয়াশাগুলিকে কাজে লাগিয়েই রাজ্যপালরা নিজেদের পদের অপব্যবহার করে চলেছে। প্রধান কথা, এটি কোন নির্বাচিত পদ নয়, এটি একটি আলংকারিক, আনুষ্ঠানিক পদ। পদটির কোনো কার্যকরী ক্ষমতা নেই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অনেক সময়েই তা দেখা যায় না। দেশ স্বাধীনের পর থেকে জাতীয় কংগ্রেস নিজের আঞ্চলিক কংগ্রেস নেতৃত্বদের কিছুটা দমিয়ে রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে এই পদটিকে টিকিয়ে রেখেছিল। এটি অবশ্যই একটি ঔপনিবেশিক পদ, ব্রিটিশ শাসনের সময়ের থেকে যার সূচনা।
বর্তমানে রাজ্যপালের কাজ হল ২৬শে জানুয়ারি পতাকা উত্তোলন করা, নির্বাচনে জয়লাভ করা রাজনৈতিক দলের সরকার গঠনের চিঠি গ্রহণ করা, বিধানসভার সদস্য ও মন্ত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করানো, কোন পার্টি ক্ষমতাধীন হবে সেই বিষয়ে যদি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়া যায় গভর্নর বিধানসভায় ফ্লোর টেস্ট বা সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমানের আর্জি জানাতে পারে, যদিও কাজটি সম্পাদন করেন বিধানসভার স্পিকার,অন্য কেই নন। বিধানসভার অধিবেশন শুরুর সময় রাজ্যপাল তার নিজের বক্তব্য পাঠ করেন। এই সামান্য কাজগুলোকে উপলক্ষ্য করে রাজভবন অধিকৃত করে রাখা হয় এবং তার কর্মচারী, রক্ষণাবেক্ষণ প্রভৃতির পেছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। রাজ্যপাল পদ অপসারিত হলে এই ব্যয়ভার বন্ধ হতে পারে। রাজভবনকে হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে জনগণের দেখতে যাওয়ার জায়গা করলে তা থেকে রাজকোষে কিছু টাকা আসার ব্যবস্থা হতে পারে। ২৬শে জানুয়ারির পতাকা উত্তোলন রাজ্যের কোনো গুণী ব্যক্তিকে দিয়ে করানো যেতে পারে। নতুন সরকার গঠনের চিঠি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে দিয়ে গ্রহণ করানো যেতে পারে। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মুখ্যমন্ত্রী, তার মন্ত্রীসভা, বিধানসভার সকল সদস্যদের শপথ গ্রহণ করাতে পারেন। রাজ্যপালের বদলে স্পিকারই সরকারের বক্তব্য বিধানসভায় পাঠ করে দিতে পারেন। কোনো সঙ্কট পরিস্থিতিতে অর্থাৎ কারা সরকার গঠন করেছে বা করতে পারে, এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি সরাসরি স্পিকারকে বিধানসভায় ফ্লোর টেস্ট করানোর বিষয়টি তুলে ধরতে পারেন; পূর্বতন সরকারের স্পিকারই এই কাজটি করবেন। যদি সরকার কনফিডেন্স হারায়, তাহলে এক্সিস্টিং সরকারই একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করে তিন মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু করতে পারে।
রাজ্যপালের পদকে অনেকসময় কাজে লাগানো হয় কিছু পলিটিশিয়ানদের রিটায়ারমেন্টের পর লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরষ্কার মার্কা সম্মান প্রদানের উদ্দেশ্যে। রাজ্যপালের যে নিজস্ব ক্ষমতাগুলি বা ডিষ্ক্রিশনারী পাওয়ারগুলি রয়েছে, সেগুলিকে অপব্যবহার করার প্রচুর চেষ্টা হয়েছে। রাজ্যপাল ভারতীয় সংবিধানের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ না করে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে বারবার রাজ্য সরকারের স্থায়িত্বকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন রাজ্যে। রাজ্য সরকার যে আইন পাশ করছে, সেটা সামাজিকভাবে সঠিক কিনা তা বিচার্যের বিষয় হিসেবে রাজ্যপালের কাছে উঠে আসে এবং সেগুলিতে সই করার ক্ষেত্রে শুরু হয় গড়িমসি। লোকসভার আইন যেহেতু রাজ্যসভায় পাশ করাতে হয়, সেহেতু অনেক রাজ্যেই বিধান পরিষদ আছে। এই বিধান পরিষদ হল, কেন্দ্রের রাজ্যসভার মতন যেখানে সাধারণভাবে বিধানসভায় যে আইন পাশ হল, সেই আইনের যথার্থতা বিধান পরিষদে ঠিক হয় কিন্তু সংবিধানে বিধান পরিষদ গঠনের কথা বলা থাকলেও তার ক্ষমতা খুবই সীমাবদ্ধ এবং আলংকারিক করে রাখা হয়েছে; সদস্যপদও মনোনীত, নির্বাচিত নয়। তৃণমূল সরকার এই বিধান পরিষদের পুনর্গঠনের তোড়জোড় করলেও এর কোনো মানেই হয়না। বিধান পরিষদ ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজ্য থেকেই তুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও কিছু কিছু রাজ্যে যেমন মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, বিহারে রয়েছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের সরকার বিধান পরিষদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে রাজ্যপালের ক্ষমতাকে সাময়িকভাবে কমিয়ে আনার জন্য। কিন্তু বিধান পরিষদ কোনো রাজ্যে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে সেই অনুমতি লোকসভা থেকে আসা প্রয়োজন। যেহেতু লোকসভায় এই মূহুর্তে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এবং পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি একমাত্র প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে অবস্থান করছে, স্বাভাবিকভাবেই বিধান পরিষদ গঠন করতে বিজেপি যে বাধাদান করবে তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং, আন্দোলন হওয়া উচিত গভর্নর পদকে তুলে দিয়ে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে দিয়ে তার কাজগুলো করানো অথবা তা যদি সম্ভব না হয় তবে পদটিকে সিলেক্টেড নয় ইলেক্টেড পদে পরিণত করা।অন্যদিকে, বিধান পরিষদ ফিরে এলে সেক্ষেত্রে বিধান পরিষদের তার সদস্যদের নির্বাচিত হতে হবে এবং তাদের কিছু অধিকার সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে রাজ্যসভার মতন কারন এর গঠনের প্রক্রিয়াতেও বিভিন্নভাবে কেন্দ্র সরকারের প্রভাব থাকার সম্ভাবনা সংবিধানে দেওয়া আছে। বিধান পরিষদে গভর্নরের বিশেষ প্রভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে; যেমন বেশকিছু সদস্যের নির্বাচন তিনি নিজেই করতে পারেন। এর মাধ্যমে কেন্দ্র সরকারের ক্ষমতা আবার বিধান পরিষদের মধ্যে দিয়ে ফিরেও আসতে পারে। ফলে নতুন করে আপার হাউস তৈরি না করে গভর্নর পদকে সরাসরি তুলে দেওয়া বা ইলেক্টোরাল করে দেওয়া জরুরি। বিধান পরিষদ তৈরি হলে তাকে অপব্যবহার করার সবচেয়ে বড় জায়গা হল, এরপরে কোনো প্রধান নেতা বা নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রী পদে আসীন হতে গেলে তাকে জনতার দ্বারা নির্বাচিত না হয়ে বিধান পরিষদ মারফৎ ক্ষমতাধীন হতে পারবে। এইসমস্ত মানুষগুলোর উপর জনগণের আস্থা আদৌ আছে কিনা তা জিজ্ঞাস্য; বরং আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ব্যবহার করে, সংবিধানকে বেঁকিয়ে কাজে লাগিয়ে এই ধরণের অপকর্ম আগেও করা হয়েছে।উদাহরণস্বরূপ, মনমোহন সিং কোনোদিন ভোটে দাঁড়িয়ে জেতেননি বরং তিনি অসমের তরফে রাজ্য সভায় নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় তার পদ পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। ফলে এই ধরনের সমস্যা ভারতীয় রাজনীতিতে রয়েছে। এই রোগগুলো রাজ্যস্তরে আমদানি হবার সম্ভাবনা আছে বিধান পরিষদ মারফৎ।
১৯৩৫ সালের "গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট"-এর মাধ্যমে আমাদের বর্তমান রাজ্যপাল ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল। এটি ছিল একটি ঔপনিবেশিক আইন যার বলে ব্রিটিশ সম্রাটের অধীনে ডমিনিয়ন সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছিল। দুই প্রকার সরকারঃ একপ্রকার, "ডমিনিয়ন গভর্নমেন্ট" যেটি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মতন; আরেক প্রকার, "প্রভিন্সিয়াল গভর্নমেন্ট" বর্তমানে রাজ্য সরকারগুলোর মতন দেখতে। এই ব্রিটিশ ব্যবস্থা ছিল পূর্ণরূপে ফেডারেল। এই ফেডারেল ব্যবস্থায়, গভর্নর জেনারেল ডমিনিয়ন গভর্নমেন্টের মাথার উপর বসে থাকা ব্রিটিশ সম্রাটের প্রতিনিধি যিনি সরাসরি সম্রাটকে উত্তর দিতে বাধ্য এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নর আঞ্চলিক সরকারগুলোর প্রধান হিসেবে আবারও ব্রিটিশ সম্রাটের প্রতিনিধি এবং তার কাছে উত্তর দিতে বাধ্য। আঞ্চলিক সরকারগুলি সরাসরি ডমিনিয়ন গভর্নমেন্ট অর্থাৎ কেন্দ্র সরকারের কাছে উত্তর দিতে বাধ্য ছিলনা, বরঞ্চ কেন্দ্র সরকার আলাদা করে ব্রিটিশ রাজের কাছে তার বক্তব্য পেশ করত এবং রাজ্য সরকারগুলিও তা আলাদাভাবে করত। কেন্দ্র সরকারগুলির উপর রাজ্য সরকারগুলি নির্ভরশীল ছিল না বরং উভয় সরকারই ছিল ব্রিটিশ রাজমুকুটের অধীনে। এটিই ছিল পূর্ণরূপ ফেডারেল স্ট্রাকচার। দেশ স্বাধীন হবার পর কংগ্রেস বুঝতে পারে যে, ব্রিটিশ সরকার এই ফেডারেল স্ট্রাকচারের মাধ্যমে সারা ভারতের উপর শক্তি কায়েম করে রেখেছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস তার নিজের পার্টির লোকজনকে সারা দেশব্যাপী শক্তিধর করতে চায় এবং কেন্দ্রীয় সরকারগুলিকে অতীব শক্তিশালী এবং রাজ্যের সরকারগুলিকে দুর্বল তৈরি করতে সচেষ্ট হয় যাতে করে রাজ্য সরকারগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। সেই কারণে তারা সংবিধানে নিয়ে আসে কোয়াসি-ফেডারেল স্ট্রাকচার। কোয়াসি- ফেডারেল-এর অর্থ পূর্ণরূপে ফেডারেল নয়, দেখতে ফেডারেল-এর মতন হলেও আসলে রাজ্য সরকারের কেন্দ্রীয় সরকারের উপর যথেষ্ট নির্ভরশীলতা রয়েছে। যেমন, কেন্দ্র সরকার রাজ্য সরকারের সাথে কোনপ্রকার আলাপ-আলোচনা না করেই রাজ্যের সীমানা পরিবর্তন করতে পারে। বহু আইন আছে যার মাধ্যমে কেন্দ্র সরকার রাজ্য সরকারের ওপর নিজের অবস্থানকে চাপিয়ে দিতে পারে।
এই "গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট (১৯৩৫)"-এর আর্টিকেল ৪৯ অনুযায়ী, গভর্নর যদি মনে করেন তার মিনিস্টার যারা সরকারে রয়েছেন তাদের কোন কাজ সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য ভালো নয়, তাহলে গভর্নর সেটিকে বাতিল করতে পারেন। মোদ্দা কথা, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যদি কোন আইন বা বক্তব্য পেশ হয়, তাহলে গভর্নর সেটিকে বাতিল করে দেবে। এই বাতিল করার পরিস্থিতিতে যে সমস্ত মন্ত্রীরা বা সরকারের সদস্যরা কোনভাবেই সমঝোতায় আসতে পারছেন না গভর্নরের সাথে, তাদের বরং পদত্যাগ করার বক্তব্য ছিল এই আইনটিতে।
এই "গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট", ১৯৩৫-এ বলা হয়েছে যে, গভর্নর মন্ত্রীদেরকে মন্ত্রীত্ব প্রদান করতে পারবেন, তারই ইচ্ছানুসারে সরকার চলবে। কিন্তু ১৯৪৯-এ "কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি" যখন নতুন সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা করতে বসে তখন বিতর্ক শুরু হয়। পন্ডিত ঠাকুরদাস ভারগভ প্রশ্ন তোলেন, ব্রিটিশ আইনকে নকল করে যে নতুন সংবিধান তৈরি হচ্ছে তাতে বলা আছে যে, গভর্নর চিফ মিনিস্টারকে নিয়োগ করবেন এবং চিফ মিনিস্টারের পরামর্শ গ্রহণ করে বাকি মন্ত্রীদের নিয়োগ করবেন। অর্থাৎ চিফ মিনিস্টার তার নিজের ইচ্ছা মতন মন্ত্রীসভা গঠন করবেন যা রাজ্যপাল মেনে নেবেন কিন্তু এই আইনের ফাঁকটি পন্ডিত ভারগভ তুলে ধরলেন যে, এই আইনের কোথাও বলা নেই রাজ্যপালকে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সর্ববৃহৎ পার্টি বা সর্ববৃহৎ জোট ক্ষমতাধীন হয়েছে তাকেই সরকার গঠন করতে বলতে হবে এবং তাকেই মুখ্যমন্ত্রীত্ব প্রদান করতে হবে। ফলে রাজ্যপাল চাইলে অন্য কোনো পার্টি যে সর্ববৃহৎ হয়ে ওঠেনি নির্বাচনে, তাকেও কিন্তু ডাকতে পারে; জোটগতভাবে যে সর্ববৃহৎ নয়, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তাকেও ডাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সাধারণত এটি সম্ভব নয় কারণ এরকম করলে বিশাল জনরোষ তৈরি হবে, জনতার সমর্থন হারাবে রাজ্যপাল এবং কেন্দ্র সরকার। কিন্তু যখন নির্বাচনে বিভিন্ন পার্টিগুলির নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি চলে আসে, তখন এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা থাকে। বারংবার এই সমস্যাগুলিকে ব্যবহার করে, বিভিন্ন রাজ্যে অগণতান্ত্রিক পথে রাজ্যপালরা নিজের ক্ষমতাকে যে চালনা করেছে, তার নিদর্শন ভারতবর্ষে একাধিক রয়েছে। এই সমস্যাগুলি প্রথমদিকে হত না যেহেতু কংগ্রেসেরই সারাদেশ জুড়ে সরকার ছিল। কংগ্রেস রাজ্যপাল পদ ব্যবহার করত আঞ্চলিক কংগ্রেসী নেতাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের অধীনে রাখার জন্য। পরবর্তীকালে যখন কেরালায় কমিউনিস্ট সরকার আসল, ১৯৬৭-এ তামিলনাড়ুতে অ-কংগ্রেসি সরকার আসল, তখন এই সরকারগুলিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। তারপর থেকেই অশান্তি শুরু হয় কারণ কংগ্রেসের রাজ্যপালগুলি কংগ্রেসের আদেশানুসারে আঞ্চলিক অ-কংগ্রেসি নেতৃত্ব এবং পার্টিগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। তখনকার আঞ্চলিক সরকারগুলিকেও রাজ্যপালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
সংবিধানের ড্রাফটিং কমিটি "কন্সটিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি"-র উপর ছেড়ে দিয়েছিল গভর্নর সিলেক্টেড না ইলেক্টেড হবার বিষয়টি। "কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি "র একটি সাব-কমিটি প্রস্তাবনা দেয় যে গভর্নর ইলেক্টেড হোক। সেই সাবকমিটির একজন সদস্য কে.এন.কাটজুকেই কেন্দ্র সরকার জোর করে পশ্চিমবঙ্গের সিলেক্টেড গভর্নর করে পাঠিয়ে দেয়। "কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি"-র আরেক সদস্য ব্রজেশ্বর প্রসাদ একটি প্রস্তাব দেন যে গভর্নরকে অ্যাপয়েন্ট করবে প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ সিলেক্টেড প্রসেস হবে। আম্বেদকর, নেহেরু এবং বল্লভভাই প্যাটেল মারফৎ তা পাশ হয়ে যায়। অর্থাৎ রাজ্য বিষয়ক আইনগুলি একদিনে ঠিক হয় আর বাকি তিন বছর ধরে কেন্দ্রের অধীনে কী কাজ থাকবে তা নিয়ে চর্চা হতে থাকে! গভর্নরের মাধ্যমে কেন্দ্র সরকারের স্বার্থ চরিতার্থ করার মধ্যে দিয়েই একধরনের অগণতান্ত্রিক দ্বিচারিতা দেখতে পাওয়া যায়।
গোয়ার বিজেপি প্রেরিত রাজ্যপাল মৃদুলা সিনহা
'পুঞ্জি কমিশান'-এর বক্তব্য অনুযায়ী, গভর্নরের কাজ, নির্বাচনে কোনো পার্টি যদি পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তবে "প্রি-পোল অ্যালাইন্স" অর্থাৎ নির্বাচনের আগে কোনো জোট তৈরি হয়ে থাকলে তাকে আগে সরকার গঠনের জন্য ডাকতে হবে। সে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে না পারলে তখন একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টিকে ডাকতে হবে, তাতেও সমাধান না হলে "পোস্ট-পোল অ্যালায়েন্স" অর্থাৎ নির্বাচন পরবর্তী কোনো জোট তৈরি হলে তাকে ডাকতে হবে। এইভাবেই সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলতে পারে কিন্তু এটা কোনভাবেই মানা হয়না। লক্ষ্যণীয়, গোয়ার ক্ষেত্রে গোয়ার গভর্নর বিজেপির মৃদুলা সিনহা, গোয়াতে কংগ্রেসের জোট আঠারোটা সিট আর বিজেপির তেরোটা সিট পাওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসকে প্রথমে ডাকেননি সরকার গঠনের ক্ষেত্রে। বিজেপি নীতিন গড়কড়ির নেতৃত্বে আগে আগে গভর্নরের কাছে চলে যায় এবং গভর্নরের সিদ্ধান্তে বিজেপি জোট সরকার গঠন করে। এই নিয়ে গভর্নরের চাটুকারি যুক্তি ছিল, বিজেপি যেহেতু প্রথমে রাজভবনে এসেছে সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তাই তিনি কংগ্রেসকে ডাকার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি! পরে 'মুম্বই মিরর' নামক এক পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেন যে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সাথে শলা পরামর্শ করেছিলেন মধ্যরাতে এই বিষয়ে! আইনি পথেও এর সুরাহা হয়নি কারন রাজ্যপালের কথার সুরেই ফ্যাসিস্ট অক্ষে পঙ্গু হয়ে যাওয়া কোর্ট কংগ্রেসের আগে না যাওয়াকে দোষারোপ করে রাজ্যপালের সামনে ধর্না না দেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে কংগ্রেসের আবেদন খারিজ করে দেয়। অন্যদিকে, মণিপুরের গভর্নর নাজমা হেপতুল্লা (কংগ্রেসের নেতৃত্ব থেকে বিজেপিতে যায়) একই ধরনের কান্ড করে। মণিপুরে কংগ্রেস আঠাশটা সিট আর বিজেপি একুশটা সিট পায়। কংগ্রেসের থেকে একজন বিজেপির সাথে হাত মেলালে বিজেপি অন্যান্য কিছু ছোট দলকে হাত করে, আবার আগে আগে গভর্নরের কাছে চলে যায় সরকার গঠনের জন্য। উল্লেখ্য, বিজেপির জোটের মধ্যে মণিপুর থেকে নির্বাচিত তৃণমূল কংগ্রেসের এক সদস্যও ছিল; সে বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছিল। এখানেও একই যুক্তিতে অর্থাৎ বিজেপি কংগ্রেসের থেকে আগে গভর্নরের কাছে চলে যাওয়াতে বিজেপির সরকার গঠন হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, দল পরিবর্তন আইন অনুযায়ী শপথ বাক্য পাঠ করার আগে দল পরিবর্তন করা হলে কিছু নিষেধাজ্ঞা জারী হয় না সেই সদস্যের উপর। শপথ বাক্য পাঠ করার আগে অবধি দল বদলালে এই আইন বলবৎ নয়। তাই শপথ বাক্য পাঠ করার অনেক আগেই দল পরিবর্তনের খেলা শুরু হয়ে যায়। এর ফলে দল পাল্টানো একপ্রকার আইনি স্বীকৃতি পেয়ে যায় এবং বিজেপির মণিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের পথ মসৃণ হয়ে ওঠে। স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, আইনগুলি অতীব ঠুনকো এবং কার্যকরী নয় দল বদল রোধ করার ক্ষেত্রে।
জরুরী অবস্থা ও কংগ্রেস নায়িকা
সার্কারিয়া কমিশনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়, গভর্নর কীরকম হবেন। গভর্নর যিনি হবেন তিনি বেশ কিছুদিন আগে অবধিও যেন পার্টি না করেন, কোনো পার্টির সাথে বিশেষত রুলিং পার্টির সাথে তার কোনো যোগ যেন না থাকে। এটিও মানা হয়না। লক্ষ্যনীয় যে, বর্তমানে যে সমস্ত গভর্নররা রয়েছেন বিজেপির, এর আগে কংগ্রেসের সময়েও যারা ছিল, তারা প্রত্যেকেই পার্টির রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, এমনকি গভর্নর পদে আসীন হবার শেষ সময় পর্যন্ত এরা প্রত্যেকেই রুলিং পার্টির সদস্য ছিল সরাসরি। ফলে তাদের নিরপেক্ষ না থাকার পাল্লাই ভারী হয়ে রয়েছে। উল্লেখ্য, তথাগত রায় পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির নেতা ছিলেন এবং হঠাৎ করেই ত্রিপুরার রাজ্যপাল হয়ে চলে গেলেন। আবার ত্রিপুরা থেকে ফিরে এসে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে নাম লেখানোর জন্য টিভিতে বেশ কিছু আলটপকা বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। যদিও এবারের নির্বাচনে ৭৭-এ বিজেপির রথ আটকে যাওয়াতে এবারের মতন তার স্বপ্ন আর পূর্ণ হল না।
আর্টিকেল ৩৫৬ অনুযায়ী, গভর্নর তার রাজ্যের সরকারকে সংবিধান মেনে কাজ করতে না পারার দোষে অভিযুক্ত করতে পারে বা মুখ্যমন্ত্রী "ভোট অফ কনফিডেন্সে" হেরে গেছে বা যে জোট সরকার ক্ষমতাধীন আছে সেই জোট ভেঙ্গে যাওয়ায় সর্ববৃহৎ পার্টি সংখ্যালঘু হয়ে গেছে, সামগ্রিকভাবে বা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে অথবা যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নির্বাচন করতে দেরী হচ্ছে, এইসব ক্ষেত্রে গভর্নরের নির্দেশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শাসন চাপিয়ে দেওয়া যায়। এখন গভর্নর যদি কোনো নির্দিষ্ট পার্টির তাবেদারি করেন, তবে তিনি রাষ্ট্রপতি শাসন আনতেই চাইবেন যদি রাজ্যে আঞ্চলিক পার্টি এবং কেন্দ্রে গভর্নরের পার্টি ক্ষমতাধীন হয়। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি এমনই। অসাংবিধানিক কার্যকলাপের ইস্যু বিজেপি বা তৃণমূল কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে বলার জায়গায় নেই কারণ উভয় দলই অসাবিংধানিক বহু কাজ করে চলেছে কিন্তু এই লড়াইয়ে বিজেপির শক্তি প্রদর্শনের পাল্লা ভারী। এটাও লক্ষণীয় যে, সার্কারিয়া কমিশান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসন আনার শর্তই হল, সেটাই যখন একমাত্র প্রতিকার আর অন্য কিছু করার নেই। তার আগে অবধি সামগ্রিক ভাবে ঝামেলা মেটানোর চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত করা উচিৎ।
অস্থায়ী সৌহার্দ্য
১৯৫৭-এ কেরালায় যখন কমিউনিস্ট সরকার তৈরি হয় তখন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নাম্বুদিরিপাদ। তিনি দুটো বৈপ্লবিক এবং প্রগতিশীল আইন আনেন। প্রথমটি, ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত এবং দ্বিতীয়টি রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা সংক্রান্ত। ভূমি সংস্কার আইনের মাধ্যমে তিনি তার রাজ্যের আধা-সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। একজন জমিদার কতটা জমির মালিক হতে পারে অর্থাৎ তার জমির সিলিং-এর একটা উর্ধসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং ভাগচাষী আর ক্ষেতমজুর যে জমিতে কাজ করেন, সে জমির উপর তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যে জমির উপর যে চাষী থাকছে, তাকে সেই জমি থেকে উচ্ছেদ না করতে পারার আইন পাশ হয়। শিক্ষাবিল অনুযায়ী, রাজ্যের প্রাইভেট স্কুলগুলির দুর্নীতি থামানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় অর্থাৎ পড়াশোনার খরচের একটা সীমারেখা তৈরি করা হয়, একটা কেন্দ্রীয় পাঠ্যসূচী যাতে তৈরি হতে পারে তার পরিকল্পনা শুরু হয়, আবার অন্যদিকে স্কুলগুলোর ম্যানেজমেন্টকে সরাসরি সরকারের অধীনে আনার বক্তব্যও রাখা হয়। এই আইন দুটির বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও বিরোধী পক্ষ হেরে যায়। এরপর এই আইন দুটির বিরোধিতা করে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ এবং তার সাথে নায়ার সার্ভিসেস সোসাইটি, ক্যাথোলিক চার্চ, জাতীয় কংগ্রেস, সবাই মিলে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ভিমোচনা সমাগম নামক এক আন্দোলন শুরু হয় এই সরকারকে উৎখাতের দাবী নিয়ে। ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শ এবং সিআইএ-র সাহায্যে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু এই পুরো প্রক্রিয়াটা শুরু করেন। সেই সময় কেরালার রাজ্যপাল বরগুলা রামকৃষ্ণ রাও, সরাসরি কংগ্রেসে যোগ না দিলেও কংগ্রেসের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার অবনতির কারণকে দুষে তিনি রাষ্ট্রপতিকে চিঠি পাঠান। ফলে নাম্বুদিরিপাদের সরকারকে ফেলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয় কেরালায়। এটি গভর্নর এবং প্রেসিডেন্টস রুলের একটি কুখ্যাত ইতিহাস হয়ে রয়েছে।
আমাদের দেশে ১৩৩ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছে। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে জারি হয়েছে চারবার। কারণ, প্রথমবার একজন মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন, দ্বিতীয়বার একজন মুখ্যমন্ত্রী মারা যান, বাকি দুবার হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের ফলে।
আমাদের দেশের ২৬ জন গভর্নরের মধ্যে মাত্র চারজন সরাসরি বিজেপি পার্টির সদস্য নন, বাকিরা সবাই বিজেপি পার্টির সদস্য। এই চারজনের মধ্যে একজন অরুণাচল প্রদেশের গভর্নর বি.ডি.মিশ্র, তিনি একজন মিলিটারি জেনারেল। বিজেপির সাথে মিলিটারির উচ্চপদস্থ কর্তাদের বর্তমান সুসম্পর্কের কথা বলাই বাহুল্য। গুজরাটের গভর্নর আচার্য দেবব্রত আর্যসমাজের সঙ্গে যুক্ত। এই আর্যসমাজ সঙ্ঘ পরিবারের মধ্যেই পড়ে। নাগাল্যান্ডের গভর্নর আর.এন.রবি কেন্দ্রীয় সরকারি আমলা ছিলেন, ফলত কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক বর্তমান। মিজোরামের গভর্নর শ্রীধরণ পিল্লাই ব্যাক্তিজীবনে একসময় এবিভিপি করতেন। ফলে ২৬ জন গভর্নরের ২৬ জনেরই বিজেপি যোগ রয়েছে। গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আনন্দীবেন প্যাটেল দু'টো রাজ্যের গভর্নর হয়ে রয়েছেন। বর্তমানে গুজরাট থেকে দু'জন বিজেপির প্রাক্তন নেতা গভর্নর হয়ে বসে আছেন। হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যাকে ইন্সটিগেট করেছিলেন মোদী সরকারের মন্ত্রী বন্দারু দাত্তত্রেয়। তাকে হিমাচল প্রদেশের গভর্নর করে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর একসময় কিষানগড় বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে রাজস্থানে জয়ী হয়েছিলেন এবং ঝুনঝুনু কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়ে লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন। লোকসভার সদস্য থাকাকালীন তিনি চন্দ্রশেখর সরকারের অধীনে 'মিনিস্টার অফ স্টেট' ছিলেন। জগদীপ ধনকর যে বিজেপির এজেন্ট সেটা এভাবেই বোঝা যায় যে, এনআরসি প্রশ্নে তিনি কোনো সদর্থক অবস্থান নেননি। রাজ্য সরকারের অবস্থান জানা সত্ত্বেও তিনি চুপ থাকেন। বিজেপির দালাল হিসেবে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো, বিভিন্ন সময়ে কুরুচিকর মন্তব্য করা, ছাত্র-ছাত্রীদের উপর পুলিশি অত্যাচার নামিয়ে আনার পরেও গভর্নর সেই উপাচার্যের পক্ষেই সওয়াল করে যান, ২০২০ সালের অক্টোবরে তিনি নিজে সারা রাজ্যে আল-কায়েদা জঙ্গীর উত্থানের কথা তুলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন (এনআইএ আল-কায়েদা জঙ্গীর অপবাদ দিয়ে গরিব মুসলমানদের আটক করলেও কিছু ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টের মধ্য দিয়ে জানা গেছে যে এগুলো সবই ফ্রেমড), সাম্প্রতিক নির্বাচন পরবর্তী তৃণমূলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যখন তিনি কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে বেরিয়েছেন, তখনও তিনি বিজেপির এমপি নিশীথ প্রামাণিকের সাথে শীতলকুচিতে গেছেন (সেই শীতলকুচি যাকে কেন্দ্র করে বিজেপির নেতারা সওয়াল করেছিল আরও আরও শীতলকুচি হওয়ানোর পক্ষে)।
গভর্নর পদ তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাটি হল, বেশকিছু স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বা অটোনমাস রিজিয়নের ক্ষেত্রে সংবিধানের সিক্সথ শিডিউলে গভর্নরকে কিছু বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে (যেমন-অসম)। সেই বিশেষ অধিকারের ক্ষেত্রে, গভর্নর পদটিকে নিবার্চিত করে দেওয়া যায় নতুবা পদটিকে তুলে দিয়ে সেই বিশেষ ক্ষমতা আবারও হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির উপর দেওয়া যেতে পারে। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদটিও একটি অনির্বাচিত পদ, কিন্তু আইনের রক্ষক হিসেবে যেহেতু তার কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে, তাকে গভর্নরের সাবস্টিটিউট হিসেবে মানা যায়। আবার অন্যদিকে লক্ষণীয় যে, গভর্নর পদটিকে যদি সিলেকশনের বদলে ইলেকটোরাল করে দেওয়া হয় অর্থাৎ নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর আসীন হয়, তার পদের লেজিটিমেসি বা আইনসম্মতি প্রদর্শন করা সম্ভব।
২০১৯ সালে মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে বিজেপি সর্ববৃহৎ পার্টি হিসেবে উঠে এলেও সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সংখ্যা তার ছিল না। সেখানকার রাজ্যপাল ভগৎসিং কোশিয়ারী প্রথমে বিজেপিকে ডাকেন। তারা প্রথমে এনসিপির সাথে বেশ কিছু ফন্দি এঁটে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে ব্যর্থ হলে, আলাদা করে শিবসেনা এবং এনসিপি সরকার গড়তে অক্ষম হওয়ায় প্রথমে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেন কোশিয়ারী। এরপরে এনসিপি, কংগ্রেস এবং শিবসেনার জোট রাজ্যপালের কাছে আবেদনের ভিত্তিতে সরকার গঠন করে। এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হয় শিবসেনার পক্ষ থেকে উদ্ধব ঠাকরে যে আসলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। এরকম পরিস্থিতিতে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সরাসরি বিধানসভার সদস্যপদ পেতে হয় নইলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকতে পারবেন না। এমন সময় চলে আসে কোভিড মহামারী। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে (অন্য সময়ে গ্রহণযোগ্য নয়) উদ্ধব ঠাকরে রাজ্যপালকে বারবার মহারাষ্ট্র-এর বিধানসভার আপার হাউস অর্থাৎ বিধান পরিষদে রাজ্যপালের সদস্য নির্বাচনের নিজস্ব ক্ষমতাবলে তাকে সদস্য করে দেওয়ার কথা বলেন যাতে করে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার চালাতে পারেন। কিন্তু বিজেপির এই গভর্নর সেটা করতে রাজি হননা বরং চুপ থাকেন। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই বারংবার সরকার ফেলে দেওয়ার একটা পরিস্থিতি তৈরী করা হয়। যদিও উদ্ধব ঠাকরে পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এবং সারা দেশজুড়ে কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে প্রধানমন্ত্রী তখন রাজ্যপাল মারফৎ নির্দেশিকা জারি করে যে, কিছু বাই ইলেকশান হোক। এর মধ্যে দিয়ে উদ্ধব ঠাকরে প্রতিদ্বন্দ্বীহীনভাবে জিতে আসে। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই হেঁটেছে (কত গণতান্ত্রিক!), রাজ্যপালের মারফৎ বিধান পরিষদের সদস্য করে তাকে আপাতত মহামারী রোধের কাজে নামাতে চায়নি। এই মহামারীর মাঝে কেন্দ্রীয় সরকার বারংবার উদ্ধব ঠাকরের সরকার ফেলে দিতে চেয়েছে এবং রাজ্যপালকে এই কাজে লাগানো হয়েছে।
গুজরাটের প্রাক্তন বিজেপি নেতা ভাজুভাই ভালা, যিনি কর্নাটকের রাজ্যপাল, তিনি নির্বাচনে কুমারস্বামীর নির্বাচনী জোট বেশি সংখ্যা পেলেও এককভাবে সর্ববৃহৎ দল বিজেপিকেই আগে ডেকে পাঠায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনদিনের মধ্যে যখন ইয়েদুরাপ্পা সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে অসফল হয়, তখন কুমারস্বামীকে ডাক পাঠানো হয়। প্রথমত, এটি পুঞ্জি কমিশনের নির্দেশনা না মেনে করা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য রাজভবনের সামনে প্যারেডিং করানোর নির্দেশিকা; স্পিকারের অধীনে বিধানসভার ভেতরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটিং করে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ লক্ষ্য করা বেশি জরুরি।
Comments
Post a Comment