কি হচ্ছে লাক্ষাদ্বীপে?

রূপক গায়েন


লাক্ষাদ্বীপ হল আরব সাগরের উপর অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জ এবং একই সাথে ভারতের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। তবে  #SaveLakshadweep  বলে একটি পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। লাক্ষাদ্বীপের মানুষদের স্থানীয় প্রশাসনের উপর ক্ষোভের থেকেই এ ধরনের প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। গত বছরের প্যান্ডেমিকের মধ্যেও সেখানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল কার্যত শূন্য। কিন্তু হঠাৎ করেই কোভিড সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়মনীতি উঠিয়ে দেওয়া হয় ডিসেম্বর মাস থেকে, ফলে এই বছর ওই দ্বীপপুঞ্জের কোভিড আক্রান্তের হার প্রায় ৬৮%। এর পিছনে রয়েছে দ্বীপের বর্তমান অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং গুজরাটের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  প্রফুল্ল প্যাটেল। লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসনিক ব্যবস্থার চিত্র যদি আমরা দেখি তাহলে লক্ষ্য করা যায় যে লাক্ষাদ্বীপে  পঞ্চায়েত রয়েছে, কেরালা হাই কোর্টই এখানকার উচ্চ ন্যায়ালয় (বিচার পেতে সমুদ্র পার হতে হয়!), একজন সাংসদও (বর্তমানে এনসিপি থেকে বিজয়ী) সেখান থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়  নির্বাচিত তবে সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রধান হলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, যিনি রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত,  কেন্দ্রীয় সরকারের স্নেহভাজন এবং তাদেরই  অঙ্গুলিহেলনে ওঠাবসায় স্বভাবসিদ্ধ। এই অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিজে কিছু বিডিও ও ডিএম মনোনীত করে তাদের মাধ্যমেই প্রশাসন চালান। এই  পদগুলি আমলাতান্ত্রিক এবং প্রশাসক নিজেও রাষ্ট্রপতি (পড়ুন কেন্দ্র সরকার) দ্বারা সিলেক্টেড। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই সেখানকার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করে কেন্দ্রের পদক্ষেপগুলিই গৃহীত হচ্ছে। আগে আইএএস অফিসারদের কংগ্রেস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিযুক্ত করলেও বর্তমান বিজেপি সরকার সরাসরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এই অগণতান্ত্রিক পোস্টে বসাতে শুরু করেছে।

প্রথমত,  LDA বা  Lakshadweep Development Authority তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে লাক্ষাদ্বীপের জমি রিয়েল এস্টেটের কাছে বেচে দেওয়ার সিঁদূরে মেঘ দেখতে পাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 

দ্বিতীয়ত, লাক্ষাদ্বীপে  Goonda Act  চালু করা হয়েছে; ক্রাইম রেট প্রায় শূন্য এরকম একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে এই ধরনের আইন চালু করে পুলিশের হাতে  দমন পীড়নের যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়ার ছক কষা চলছে!

তৃতীয়ত, এই দ্বীপটি আদিবাসী মুসলিম অধ্যুষিত। এরা মূলত জেলে। এখানে বিফ ব্যান করা হচ্ছে, তবে অন্যদিকে মদ্যপানের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে সেখানকার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই। তাছাড়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে দুটির বেশি সন্তান না থাকার আইন জারী করা হয়েছে! 

কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে কেন্দ্র সরকারের বর্বরতার এক হিংস্র চিত্রই দৃশ্যমান। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি হয় সেসব জায়গায় যেখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল, প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে বা বাইরের কোনো শক্র দ্বারা আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির প্রধান হয় রাষ্ট্রপতি মনোনীত লেফটেন্যান্ট গভর্নর বা আমলাতান্ত্রিক  অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। দিল্লি ও পুদুচ্চেরি ইউনিয়ন টেরিটরি হলেও তাদের বিধানসভা আছে তবে তা নামমাত্রেই কারণ পুলিশ এবং আইনশৃংখলা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতেই। তাছাড়া সব কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ করা হয় যার স্থানীয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অবজ্ঞা করার সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে সেখানকার বিধানসভা ভেঙে দিয়ে, দুটি ইউনিয়ন টেরিটরি তৈরি করে আঞ্চলিক উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করা হচ্ছে কারণ এসব বোর্ডের আইন প্রণয়নের এবং জনহিতকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো ক্ষমতাই নেই; আসল ক্ষমতা ন্যস্ত হয়েছে লেফটেন্যান্ট গর্ভনরের হাতে, যার পিছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এছাড়া স্বাধীনতার পর ভারতভুক্তির মুহূর্ত থেকে দাদরা এবং নাগর হাভেলি, দামান দিউ, চন্ডীগড়, লাক্ষাদ্বীপ এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে আঞ্চলিক সরকার গঠনের অধিকারটুকু নেই। এই ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে অগণতান্ত্রিক এবং মানুষের রায় বিরুদ্ধ। ভারতীয় সংবিধানের অপব্যবহার করেই কেন্দ্র সরকার এই ধরনের কাজ করছে (আর্টিকেল ২৩৯), তাই দরকার সংবিধান সংশোধনের এবং বর্তমান ফ্যাসিস্ট আক্রমণের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলগুলোকে রাজ্যের স্বীকৃতি দিয়ে বা সেখানকার মানুষের ইচ্ছানুসারে নিকটবর্তী রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ফিরিয়ে আনা যাতে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের হাত থেকে, তাদের যথেচ্ছাচারের হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া যায়। ভারতের প্রত্যেকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাক, এবং মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই কর্তৃত্ব গ্ৰহণ করুক। লাক্ষাদ্বীপের মানুষের উপর প্রফুল্ল প্যাটেল এবং বিজেপির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘঠিত করা দেশের গণতান্ত্রিক পরিমন্ডল রক্ষার্থে একান্ত প্রয়োজন। 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার