২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর্যালোচনা

সুমিত ঘোষ


১. একদিকে সারা দেশে কর্মসংস্থানের অভাব, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলোর বেসরকারিকরণ, জ্বালানী তেল রান্নার গ্যাস নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের দামের লাগামছাড়া ওঠানামা, মহিলা মুসলমান ও দলিতদের উপর আক্রমণ, লকডাউন চলাকালীন স্বাস্থ্য খাতে ও র‍্যাশন ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে বিশ্বে সর্বনিম্ন সরকারী ব্যয়, দিল্লীতে চলমান কৃষক আন্দোলন এবং রাজ্য স্তরে আঞ্চলিক নেতৃত্বের অভাব, তৃণমূলের দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদের দলে এনে সরাসরি ভোটে দাঁড় করিয়ে দেওয়া, নীচু তলার কর্মীদের অসন্তোষ বিজেপির ২০১৯-এর বিজয় রথকে ২০২১-এ এসে থমকে দিয়েছে।

২. আমাদের দেশের বড় রাজ্যগুলোতে ঐতিহাসিকভাবেই একবারে কোনও নতুন শক্তি সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়নি; নয় জোট করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়েছে, নইলে বিরোধী আসনে অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিজেপি সরকার গঠন করতে না পারলেও রাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ফলে, আগামীদিনে বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতির বিপদ রয়েই গেল।

৩. তৃণমূল তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে পারল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। এর মূলে রয়েছে বিজেপি বিরোধী ভোটের প্রাবল্য; তৃণমূল সরকারের ‘সাফল্য’-এর মাপকাঠিতে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত হয়নি। এই কারণে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের অনুরূপ ২০২১-এ বিজেপি মূলত উত্তর বঙ্গে এবং তৃণমূল মূলত দক্ষিণ বঙ্গে বেশি দাপট দেখাতে পেরেছে।

৪. পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, মালদহ, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং-এ বিজেপি নিজের শক্তি সংহত করেছে। উত্তর ২৪ পরগণা, নদিয়া এবং কোচবিহারে তৃণমূলের শক্তি বৃদ্ধি মতুয়া কিংবা রাজবংশী আন্দোলনের উপর বিজেপির প্রভাবকে খানিক দুর্বল করে দিয়েছে; কিন্তু সমস্যা এখানেই যে দলিতদের ক্ষমতায়ন এবং জাতিসত্ত্বার আন্দোলনগুলিকে ‘ডান’ দিকে টান মারার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে এ রাজ্যে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের জননী তৃণমূল নিজে বিজেপির থেকে কোনও অংশে কম যায়না।

৫. বিজেপিকে রুখতে হিন্দিভাষী বিদ্বেষ এমন চরমে নিয়ে গেছে তৃণমূল এবং তার সহকারী শক্তিগুলো যে আগামীদিনে শিব সেনার ন্যায় বাংলায়ও উগ্র আঞ্চলিক জাতিয়তাবাদের উন্মেষের সম্ভাবনা এ রাজ্যের বিহারী দিনমজুর, উত্তর প্রদেশের দলিত কর্মচারী এবং উর্দুভাষী মুসলমানদের জীবন বিপন্ন করতে পারে।

৬. বিধান সভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নির্বাচনের ফলাফল বের হতে না হতেই বিক্ষিপ্ত আঞ্চলিক সন্ত্রাস, জাতিসত্ত্বার আন্দোলনে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ইত্যাদি আগামীদিনে তৃণমূলকে মহারাষ্ট্রের সরকারের ন্যায় একটি আঞ্চলিক স্বৈরাচারী কর্তৃত্বমূলক শক্তিতে পরিণত করার উপাদান বহন করছে।

৭. সাফল্যের মাঝেই প্রশান্ত কিশোরের পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটিজিস্টের পেশা থেকে অবসর গ্রহণের ঘোষণা একটি সন্দেহের উদ্রেক করছে যে নীচু তলায় কি কি ধরণের সেটিং করা হয়েছে যাতে তার এই পেশা কিংবা নিজের জীবন আগামীদিনে বিপন্ন হতে পারে।

৮. মমতা তামিল নাড়ুর জয়ললিতা মডেলে চলছে; একাধিক প্রকল্পের ঘনঘটা, দুয়ারে সরকার স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি সেই মডেলেরই নকল মাত্র। কিন্তু কাটমানি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেটরাজ, স্বজনপোষণ, ত্রাণ দুর্নীতি, চাকরী প্রদানে অনীহা ও নিয়োগ দুর্নীতি, বিজেপির কৃষি বিলের ন্যায় এ রাজ্যে ২০১৪ ও ২০১৭ সালের কৃষক বিরোধী আইন, শ্রমিকদের অধিকার দমন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুরাবস্থা, কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পে মদত, বস্তি ও হকার উচ্ছেদ ইত্যাদি প্রবহমান ইস্যু আগামীদিনে তৃণমূলকে জেরবার করবে।

৯. কেরালায় ৩০ বছর পর দ্বিতীয়বারের জন্য বাম সরকার ক্ষমতায় ফিরেছে তার কোভিড পরিস্থিতির সময়ে অসাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজের সুবাদে। বামপন্থীরা অসমে ১টা, তামিল নাড়ুতে ৪টে এবং পূর্বতন বিহার নির্বাচনে ১৬টা আসন পেলেও এবার পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনতার পর প্রথম বিধান সভা গঠিত হচ্ছে যেখানে একটিও বামপন্থী প্রতিনিধিত্ব থাকছে না!

১০. দীর্ঘদিন গণআন্দোলন সংঘঠিত করতে অনীহা, বিকল্প প্রগতিশীল শক্তিদের আন্দোলনগুলিকে গিলে খাওয়ার প্রবণতা, সরকারের অপদার্থতার বিরুদ্ধে লড়াইকে যুক্ত করার বদলে কেবল দান-খয়রাতির রাজনীতিতে সীমাবদ্ধতা, পার্টি কর্মীদের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে অসফলতা, কর্মসংস্থানের প্রশ্নে ডানপন্থী ঝোঁক, আইডেন্টিটির রাজনীতিকে খামচা মেরে আমদানী, পাকাচুলের প্রাবল্য ঘোচাতে শ্রেণি সংগঠনে কাজ করতে অনভিজ্ঞ কলেজ পড়ুয়া ও যুব নেতাদের প্রার্থী করে অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান, বাম জোট গঠনে অনীহা, ডুবন্ত টাইটানিক কংগ্রেসের প্রতি আনুগত্য এবং মুসলমান মৌলবাদী শক্তির সাথে রাজনৈতিক জোট গঠন বামফ্রন্টকে এই নির্বাচনে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

১১. বাম সংস্কারবাদী বিচ্যুতি থেকেই আইডেন্টিটির রাজনীতিকে গ্রহণ করায় সংযুক্ত মোর্চা একটি পোস্টমর্ডান প্রজেক্ট হিসেবে উঠে এসেছিল। তার সারবত্তাহীনতা এই নির্বাচনের ফলাফলেই স্পষ্ট।

১২. জোটপন্থী হিসেবে খ্যাত এবং আপোষের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত কমঃ(?) তন্ময় ভট্টাচার্য্যের ‘ভোটের রাজনীতি’-র গিমিক আর ধোপে টিকছে না; বামপন্থা থেকে বিচ্যুতির বদলে বামপন্থার প্রতি আনুগত্যই ভরাডুবির কারণ হিসেবে দর্শে এই স্বঘোষিত মার্ক্সবাদী(?) ডানকুনি লোকালে চাপতে চাইছে। অন্যদিকে, পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নওদা কেন্দ্রে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বাম প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে কমঃ শমীক মন্ডল পরাজিত হয়েছেন। সামগ্রিকভাবে বামফ্রন্টের জোট রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান না গ্রহণ করে সিপিআই(এম)-এর সর্বশেষ পার্টি কংগ্রেসে জাতীয় কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী ‘অ্যালায়েন্স’-এর বদলে ‘অ্যাডজাস্টমেন্ট’-এর নামে তাত্ত্বিক কারচুপিকে ঊর্ধে তুলে কেবল আঞ্চলিক রাজনীতির নিরিখে সংযুক্ত মোর্চার বিরোধিতা করে তিনি ‘গোঁজ প্রার্থী’ হিসেবেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছেন। এ বিষয়ে নিজ সহকর্মীদের সাথে তাঁর পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

১৩. রাজনৈতিকভাবে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগান বিজেপিকে সরকারে আসা থেকে রুখতে সাফল্য অর্জন করেছে কিন্তু বিজেপি প্রধান বিরোধী দলের তকমা অর্জন করেছে, অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে রোখা যায়নি, তার গতিকে মন্থর করা গেছে মাত্র। এই সাফল্য এসেছে তৃণমূলের মত এক স্বৈরাচারী শক্তির নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিনিময়ে। সারা রাজ্যে বাম আন্দোলনের বিলুপ্তির দায় যতটা বামফ্রন্টের, ততটা তৃণমূলপন্থী মানিবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং নকশালপন্থীদের একাংশ বামেদেরও। বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকে তুলে ধরার রাজনীতির মূল উৎসই হল নিজেদের সাংগঠনিক অস্তিত্বহীনতা এবং আর্থিকভাবে তৃণমূলের প্রতি নির্ভরশীলতা। আগামীদিনে তৃণমূলের স্বৈরাচার এবং প্রধান বিরোধী বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাম আন্দোলনের দুর্বলতার দায় এই স্লোগানের প্রবক্তাদেরও নিতে হবে।

১৪. উল্লেখ্য, সিপিআই(এম.এল)-লিবারেশান বিভিন্ন কেন্দ্রে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে আবার বেশকিছু কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার বাম প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার করে নিজের তৃণমূল তোষণকে আড়াল করতে চেয়েছে। ডান-বাম জোটের বদলে বাম জোটকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে সে নির্লজ্জভাবে তৃণমূলের পক্ষে সওয়াল করে গেছে। আগামীদিনে তৃণমূলকে তোষণের রাজনীতির কারণে ফ্যাসিস্ট আক্রমণের বিরুদ্ধে বাম আন্দোলনের দুর্বলতার দায় এদেরও নিতে হবে।

১৫. ২০১১-এ মমতার হাত ধরে আসন পাওয়া এসইউসিআই(সি) এবারে ১০০-র উপর আসনে প্রার্থী দিয়ে বেশকিছু কেন্দ্রে একমাত্র বাম প্রার্থী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল কিন্তু এই নির্বাচন তার রাজনৈতিক অপ্রাসঙ্গিকতাই তুলে ধরেছে।

১৬. এই রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ ধর্মের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে আব্বাস সিদ্দিকীর ভরাডুবি ঘটিয়েছেন। বিজেপির উগ্র রাজনীতি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তাঁরা তৃণমূলকেই মিত্র হিসেবে বেছে নেওয়ায় অধীর চৌধুরী মুর্শিদাবাদে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।

১৭. নন্দীগ্রাম এবং ভাঙড় রাজ্যের প্রতিক্রিয়ার দুই ভর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। জমি আন্দোলনের এই পুণ্যভূমির মাহাত্ম্য মমতা নিজেই খর্ব করেছে শুভেন্দুদের পরিকল্পিত অস্ত্রসমেত অশান্তি উদ্রেকের তত্ত্ব খাঁড়া করে। সিপিআই(এম) এই সুযোগে নিজেদের কর্পোরেট বান্ধব নীতিকে জাস্টিফাই করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। তাদের ডান উপাদান মিশ্রিত কর্মসংস্থানের স্লোগানকে বিজেপি অ্যাডপ্ট করে ধর্মীয় মেরুকরণের সাহায্যে শুভেন্দুকে ভোট নৌকা পার করিয়ে দিয়েছে। বিজয়ী পার্টির সিটিং মুখ্যমন্ত্রীই নিজের আসনে পরাজিত।

১৮. ভাঙড়ে গণআন্দোলনকে সাবোটাজ করে সিপিআই(এম) ধর্মগুরুর ভাইকে প্রার্থী করেছিল। নওশাদ নির্বাচনের দিন বিজেপি প্রার্থীর সাথেই বুথে বুথে ঘুরল! ওদিকে আরাবুল ভোটে টিকিট না পেয়ে বিজেপি এবং মোর্চার সাথে সেটিং করতে লাগল। সংযুক্ত মোর্চার তরফে একমাত্র একজন ধর্মগুরু এই আসনে জিতে সমগ্র মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রগতিশীলতায় কালি লাগানোর রাজনীতি করল। সংযুক্ত মোর্চার ‘আমরাই ধর্মনিরপেক্ষ’ স্লোগান বঙ্গোপসাগরে ডুব দিল। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই এলাকায় বিজেপি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভোট পেল। আর গণআন্দোলনের প্রতিনিধি রেড স্টারও রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। রেড স্টার সারা রাজ্যে ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র নামে তৃণমূলের পক্ষে সওয়াল করে নিজের ভাঙড় কেন্দ্রে উল্টো সুরে তৃণমূলের দুর্নীতির গান গাইলে সেখানকার মানুষ এই দিশাহীনতাকে প্রত্যাখ্যান করল। দুঃখের বিষয়, রেড স্টার নিজের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বিজেপিকে রুখতে পারার বড়াই করে সিপিআই(এম) নিয়ে খানিক গাল পারলেও নিজেদের রাজনীতির আত্মসমালোচনাই করল না! একটি ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের রাজ্য রাজনীতিতে বৃহৎ দাগ কাটার সম্ভাবনার মৃত্যু হল।

১৯. দিল্লীর কৃষক আন্দোলনকে দেখা যেতে পারে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি এবং তার ভারতীয় পার্টনারদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক পুঁজির অংশীদারদের লড়াই হিসেবে। তেমনই ২০২০-র লকডাউন উত্তর পরিস্থিতিতে তৃণমূলের এই জয় আসলে ওই আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির ভারতীয় পার্টনারদের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক পুঁজিপতি এবং ক্ষুদ্র পুঁজির মালিকদের লড়াই-এরই অংশবিশেষ।

২০. ফ্যাসীবাদের পূর্ণ উত্থান যে সারা দেশজুড়ে এখনও হয়নি তা পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচন থেকেই স্পষ্ট।

২১. পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ডান এবং অতি ডান শিবিরে বিভক্ত।

২২. এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে নতুন বামপন্থী শক্তির উন্মেষের পক্ষে সময় এসে দাঁড়িয়েছে।                  

 

 

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views