আলাপনকে নিয়ে টানাটানির মাঝে কি আড়াল করা হচ্ছে?

রূপক গায়েন 

হঠাৎ বাংলার আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা... প্রথমে মোদীঝড় মে মাসের দু'তারিখের পর অস্তিত্বহীন হল। কিন্তু তার বদলে উপস্থিত হল ঘূর্ণিঝড় ইয়াশ। চলে গেল পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলের উপর দিয়ে, নিয়ে গেল দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের শেষ সম্বলটুকু, রেখে গেল একরাশ হাহাকার, হতাশা, আর্তনাদ। আগের বছর আমফানের পর রাজ্য সরকারের পক্ষাঘাতগ্রস্থতার শিকার সুন্দরবনের এ বছরের প্রতাড়িত হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হল। 

২০০৭ থেকে বারবার, প্রথমে সিডার, ২০০৯-এ আয়লা, পরের দিকে ফাইলিন (২০১৩), হুদহুদ (২০১৪), বুলবুল (২০১৯), আমফান এবং সবশেষে ইয়াস, সুন্দরবনের উপর বারবার হানা দিচ্ছে ঘূর্ণিঝড়। সুন্দরবনে ভৌগোলিকভাবে ভাগীরথী-হুগলি এবং তার অসংখ্য শাখানদী সাগরে মেশে, ফলে সেখানকার মাটি ক্ষয়িষ্ণু প্রকৃতির। তবে সুন্দরবনের ত্রাতা হলো ম্যানগ্ৰোভ, কিন্তু বালি মাফিয়া এবং প্রোমোটারের আধিক্যের কারণে সেটির উপরও কোপ পড়ছে। প্রাকৃতিক রেচনতন্ত্র হিসেবে পরিচিত পূর্ব কলকাতার জলাভূমি অঞ্চল সুন্দরবনেরই এক্সটেনশন। সমস্ত কোলকাতার বর্জ্য এই অঞ্চলেই ফেলা হয়। ফলে এখানকার উর্বর মাটিতে শাক-সব্জির ফলন যথেষ্ট হয়, কিন্তু এই অঞ্চল বর্তমানে প্রোমোটার-রাজের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ, তাই এই অঞ্চলটিকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। একদিকে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জলের স্তরের ক্রমবর্ধমান আগ্ৰাসন, অন্যদিকে ফারাক্কা বাঁধের কারণে পলি পড়ে পড়ে গঙ্গার নাব্যতা হ্রাস, ফলত যা হচ্ছে, যখনই ব্যারেজ থেকে জল ছাড়া হচ্ছে, নদী হয়ে উঠছে খরস্রোতা এবং পাড়ের ভাঙ্গন দেখা দিচ্ছে; সার্বিকভাবে সুন্দরবনও বন্যা কবলিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। 

এই সমস্ত সমস্যা থেকে বেরোনোর কিছু উপায়ন্তরও আছে, প্রথমত ম্যানগ্ৰোভ রোপণের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে, বালি মাফিয়াদের জঙ্গলরাজ কড়াভাবে বন্ধ করতে হবে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পাকা নদীবাঁধ তৈরি করা, বা যেসব জায়গায় নদীবাঁধ রয়েছে সেগুলি পুননির্মাণ করা। 

আজ অবধি যে রাজনৈতিক দলই সুন্দরবনের বিধান সভা কেন্দ্রগুলিতে ক্ষমতায় এসেছে, নতুন বাঁধ তৈরি, বাঁধের মেরামত বা সেই টাকা তছরূপের কালো ইতিহাসে ফুল মার্কসই পেয়েছে। বর্তমান বিজেপির তরফে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীই হোক বা কোনো দলে থেকেই কাজ করতে না পারা রাজীব ব্যানার্জী, এই পূর্বতন দুই সেচ মন্ত্রীর গায়েও এই কালির দাগ বেশ ভালোভাবেই লেগে আছে, তাই দুর্নীতির এই কর্মযজ্ঞে বিজেপিও আজ প্রাসঙ্গিক। তাছাড়া এই কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থ সাহায্য না করে বরং আমলা বদলের রাজনীতিতেই মেতে রয়েছে কেন্দ্র সরকার। 

কালি লেগে আছে বামফ্রন্ট সরকারের উপরও। ঝড় এলেই এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং "ঝড়ের আগে কান্তি আসে"; বস্তুত উনি যখন সেই অঞ্চলের বিধায়ক এবং বামফ্রন্টের মন্ত্রী ছিলেন, ঝড় তখনও আসতো, কোনো পাকাপোক্ত ব্যবস্থা তখন তিনি নেননি, এমনকি তৎকালীন সেচ মন্ত্রী আরএসপি-র সুভাষ নস্কর, তিনিও সুন্দরবনেরই প্রতিনিধি ছিলেন, কিন্তু পাকা বাঁধ তৈরি নিয়ে এই দুজনেরই ভূমিকা নিন্দনীয়। এখন ঝড়ের আগে কিছু ত্রাণ দিয়ে আর বাঁধ বাধার কাজ করলে তা মানুষ যে খাবে না তা এইবার বিধানসভার ফলাফলেই দৃশ্যমান।

এইবার আসা যাক বর্তমান তৃণমূল সরকারের দশ বছরের কিছু খতিয়ান নিয়ে। আয়লা পরবর্তী সময়ে দুর্গত মানুষরা তৃণমূলকে মসিহা ভাবা শুরু করেছিল, তবে যত দিন গেছে, যত ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়েছে, তত চাল চুরি, ত্রিপল চুরি করে তৃণমূলের ভাড়ার পূর্ণ হয়েছে। দশ বছর সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী ছিলেন মন্টুরাম পাখিরা, উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গেছেন কিনা জানিনা তবে মাননীয়া  নিজেও জেলাগুলোর আসল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চেপে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ঘূর্ণিঝড় হলে যেহেতু নোনাজল উপরে উঠে আসে তাই চাষযোগ্য জমি সাময়িকভাবে অকেজো হয়ে পড়ে। তাই তিনি নিদান দিচ্ছেন স্বর্ণধান এবং মৎস্যধান নামক দুই প্রকার ধান চাষের। কিন্তু দেখা গেছে, ২০২০-তে এই স্বর্ণধান চাষের পর চাল (বীজ) ঠিকমত তৈরি না হওয়ায় বর্ধমানের গলসি ১ নং ব্লকের চাষীরা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার দায়িত্ব দেওয়া হয় চিফ সেক্রেটারি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে যিনি নিজে আসলে আগের বছর আমফান দুর্নীতির একটা এপিটোম। নিজে এবং নিজের পেটোয়া আমলাদেরকে নিয়ে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির একচ্ছত্র কান্ডারি। প্রতি ঘূর্ণিঝড়েই প্রায় পঞ্চাশ হাজার থেকে একলাখ মানুষ ক্ষতিগ্ৰস্থ হন, তাই বর্তমানে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আমলাদের বলছেন সুন্দরবনের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের সুন্দরবন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখতে। কিছু বঞ্চিত বাম (তৃণমূলপন্থী) এই ভাবনাকে সমর্থনও জানায় কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার আছে, এতোগুলো মানুষকে উচ্ছেদ করলে তারা যাবে কোথায়? আর তাদেরকে নিজেদের নরম মাটির জমি হয়তো খুব স্বল্পমূল্যে বেচে দিতে হবে, না হলে ফেলে চলে আসতে হবে এবং উঁচু ডাঙায় যেখানে জমির দাম অনেক বেশি সেখানে তারা কিভাবে জমি কিনবে, এই প্রসঙ্গও কিন্তু আসবে, ফলে তাদেরকে ওখান থেকে উচ্ছেদ না করে বরং ম্যানগ্ৰোভ অরণ্যের বৃদ্ধি এবং শক্তপোক্ত বাঁধ তৈরিই হল একমাত্র সমাধান। মমতা ব্যানার্জী মুখে ম্যানগ্ৰোভের কথা কপচালেও নতুন চরে বালি মাফিয়াদের সাথে তোলাবাজ ভাইপোর যোগসাজশ রয়েছে, তাই ওনার পক্ষে এটা সোনার পাথরবাটি গোছের প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই নয়। 

আয়লার পর তৎকালীন ইউপিএ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের তৎপরতায় 'আয়লা টাস্ক ফোর্স' তৈরি করে ২০১২ সালে রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে 'সুন্দরবন এমব্যাঙ্কমেন্ট রিকনস্ট্রাকশন প্রোজেক্ট'-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়; ৫০৩২ কোটি টাকা পশ্চিমবঙ্গের সেচ দপ্তরের জন্য ধার্য করা হয়। কিন্তু ব্যাপক দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই হয়নি, উল্টে ভঙ্গুর মাটির বাঁধের উপর প্লাস্টিক দিয়ে সেখানকার জীববৈচিত্র্যকেই বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় টাস্ক ফোর্স প্রকল্পের রিপোর্ট চাইলেও এই দশ বছরেও সরকারের পক্ষে তা পেশ করা সম্ভব হয়নি। এই বাঁধগুলো  তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় নেতাদেরকে তুষ্ট করা কিছু নির্দিষ্ট সংস্থাদেরই, যেমন ইসিআই ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএলএ প্রজেক্ট, নাগার্জুন কনস্ট্রাকশন (যারা ঠিক করে বাঁধ নির্মাণ তো করেইনা, উল্টে গোসাবা, সোনাখালি, বাসন্তী সহ বেশ কিছু জায়গা থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু করে, বিনা ক্ষতিপূরণেই)। 

বর্তমানে কিছু জায়গায় কংক্রিটের বাঁধের বেস বাড়ানো চলছে কিন্তু মাথায় রাখতে হবে এইরকম কংক্রিটের বেস বাড়ালে নরম মাটি তা ধরে রাখতে পারবে না। দরকার স্বল্প বেসের মাটি ও কংক্রিটের মিশ্র বাঁধ। ত্রাণ সর্বস্ব রাজনীতি নয়, পায়ে পড়ে যাওয়ার ভন্ড ছিচকাদুনির ক্যানোপি নয়, চাই আন্দোলন সর্বস্ব দিকচেতনা।

Picture Courtesy: KhaborOnline

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার