বুদ্ধিজীবীতা ও শঙ্খ ঘোষ

অত্রি ভট্টাচার্য্য 



প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার এই ' বুদ্ধিজীবীতা ' শব্দটি আমার উদ্ভাবন নয় । এই শব্দটি আমার অন্তত প্রথম শোনা টেলিভিশনে টক শো গুলির অনিবার্য বাতেলাবাজ চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের বক্তব্যে । শঙ্খ ঘোষের মৃত্যু এই শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করবে এরকমই আমার বিশ্বাস । কারণ সম্ভবত শঙ্খবাবুর মৃত্যু প্রকটভাবে জানিয়ে দিচ্ছে আমাদের ইতিহাসবিহীনতা । আমাদের পক্ষে একইসঙ্গে গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ ও রাস্তা জুড়ে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকার কথা কেউ বলবেনা । শঙ্খবাবুর মৃত্যু আদপে এই শহরে মিছিল ডাকার লোককে কেড়ে নিলো । 

সময়ের চাকা যদি খানিক পিছনেই গড়িয়ে নিয়ে যাই তবে ১৯৭২ সাল নাগাদ একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ' বুদ্ধিজীবী ও নানা প্রশ্ন ' নামে । সংকলনটি সম্পাদনা করেছিলেন লতিকা মুখোপাধ্যায় । কলকাতাতেই ১৯৭২ সালে ' বুদ্ধিজীবী ও নানা প্রশ্ন ' বইটি নিয়ে আলোচনার সূত্রে সিপিআইএমএল দলের সর্বক্ষণের গ্রামাঞ্চলের কর্মী নকশালপন্থী ' শান্তনু ' অর্থাৎ সৌমেন গুহর সাথে তার পরিচিতি ঘটে । পরবর্তীতে তারা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন । কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের স্পেশাল সেলের প্রধান রণজিৎ গুহ নিয়োগীর পুলিশবাহিনী, দমদমের বাড়ি থেকে লতিকা , সৌমেনের দিদি অর্চনাকে ১৯৭৪ সালের ১৮ই জুলাই গ্রেপ্তার করে । দীর্ঘ ২৭দিন লালবাজারের পুলিশি হেফাজতে রেখে অকথ্য অত্যাচারের পর ১৩ই আগস্ট তারা প্রেসিডেন্সী জেলে বন্দী হন । পরে একে একে তাদের ' নকশালপন্থী ' হওয়ার অভিযোগে ' মিসা ' যা আজকের ইউএপিএ-র নামান্তর তা দিয়ে বিনা বিচারে প্রায় তিন বছর বন্দী করে রাখা হয় ।  পুলিশের অত্যাচারের ফলস্বরূপ অর্চনার নিম্নাঙ্গ পঙ্গু হয়ে যায় । ১৯৭৭ সালে সৌমেন জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর , পরিবারের সবথেকে বড় দুটো লড়াইয়ে , পঙ্গু অর্চনার চিকিৎসা ও পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ' অর্চনা গুহ মামলা ' গড়ে তোলা; সুদীর্ঘ ২৭ বছরের বেশি সময় ধরে সৌমেনের পাশে ছিলেন লতিকা , আদালতে ' অর্চনা গুহ মামলার ' একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী ।

যাইহোক লতিকার সম্পাদিত সেই গ্রন্থটির স্মৃতিচারণায় সৌমেন গুহ লিখছেন - ' হারাধনের দশটি বাঙালি বুদ্ধিজীবী রত্ন - মানে বিনয় ঘোষ , সমর সেন , শঙ্খ ঘোষ, অমিতাভ দাশগুপ্ত, নিত্যপ্রিয় ঘোষ , নারায়ণ চৌধুরী , আতাউর রহমান , রণেশ দাশগুপ্ত , মায় ছোকরা সঞ্জয় মুখার্জি সমেত দশ পিস গা-ছমছম করা রোমহর্ষক আঁতেলদের মার-কাটারি বাত্তেলার সংকলন ! শ্রীমতী লতিকার ' বুদ্ধিজীবী ও নানা প্রশ্ন ' পড়তে গিয়ে ভাবছিলাম, এই দশ রত্ন ও তাদের প্রজাতির সকলে ভাগ্যিস্ বিপ্লব করতে নামেনি ! না হলে ভয়ঙ্কর বিপদ বাড়তো ! এ সব কেসে আমার তো সোজা উত্তর- বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা কখনো বিপ্লব -বিদ্রোহ-প্রতিবাদের মতো ইতরের কাজে জড়িত থাকে না , কোনো বাজে ঝুটঝামেলায় নিজেদেরকে জড়ায় না । যদি অবিশ্যি  , তাদের আখেরে লাভ হয় , পয়সা - প্রতিপত্তি -ক্ষমতা-খাতির ইত্যাদির সুবিধে হয়, তারা ঠিক সময়মতো ফোড়ণ কাটবে -ঠিক সময়মতো 'নকশাল ' , 'মার্ক্সিস্ট' ,' কম্যুনিস্ট' , ' বিপ্লবী ' বনে যাবে । বিপ্লবী বন্দী বা শহীদদের চোদ্দোগুষ্ঠির সাথে , তখন তাদের সাহিত্যে রোদনভরা এ বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ । আমার সারা জীবনে দেখেছি, বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবীরা খারাপ থাকেনি । ঠিক করে বললে - যে খারাপ থাকে সে বুদ্ধু ' বঙ্গীয় বুদ্ধিজীবী ' কখ্খনো নয় । '

সৌমেন গুহর এরূপ বক্রোক্তি হয়তো অনেককেই মনে করাবে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনী আবহে জনৈক এসএফআই ক্যাডারের পেচ্ছাপবিবৃতি । ছেলেটি শঙ্খ মহাশ্বেতাদের লেখার মূত্রত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে । অথবা বিজেপি আইটি সেলের লাগাতার  ' বুদ্ধিবিচি '  শনাক্তকরণ । অথবা আমবাঙালির কাউকে ' ও তো আঁতেল ' বলে ওঠা । অপ্রয়োজনীয় ও অমঙ্গলের ধারক কিছু তাত্ত্বিকেরা চেতন ভগৎ পাঠরত প্রজন্মের এই প্রবণতাকে 'অ্যান্টি ইন্টেলেকচুয়ালিজম ' বলে অভিহিত করছেন । ইহা বর্তমানে একটি ট্রেন্ড । সৌমেনের যুগে যা ছিল সহজাত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ । যাই হোক লতিকা নিজে বইটির একটি চমৎকার ভূমিকা লিখেছিলেন যেখানে তিনি সেসময়ের সবার মতই মাও সে তুংয়ের শরণাপন্ন; লিখছেন-' অথচ একথা অনস্বীকার্য যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে ' worker and peasant cadres will at  the same time become intellectuals , while the intellectuals will at the same time become workers and peasants ' ( Mao -Tse -Tung )'.......

বইটিতে শঙ্খবাবুর লেখাটির নাম ছিল ' শব্দজীবীর ভয় ' । সেখানে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার খানিক খন্ডচিত্র তিনি তুলে ধরছেন । যেখানে সেইসময়কার রাজনৈতিক দোলাচলে যুবকর্মীদের অবস্থা হয়েছিল অন্ধকে ছুঁয়ে বসে থাকা আরেক অন্ধ পুতুলের মত । এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে এখানেই শঙ্খ ঘোষ একটি প্রতর্ক তৈরী করছেন পার্টিজানপন্থার বিপক্ষে অথচ লতিকা -সৌমেনদের মত হাজার হাজার ছেলেমেয়ের অ্যাক্টিভিস্ট হিসাবে প্রাণাতীত সততা মেনে নিয়েই । খানিক পড়া যাক : ' কিছুদিন আগে এক তরুণী বেশ রাগ করে উঠে যান আমার ঘর ছেড়ে, খানিকটা -বা তাচ্ছিল্যভরে । কেননা ১৯৭৩ সালের মধ্যেই দেশে যে বিপ্লব ঘটে যেতে বাধ্য আর তারপর দেখা দেবে পরম সুদিন, তাঁর এই অটুট বিশ্বাসে অল্প একটু সংশয় জানিয়েলাম আমি ।.....এই মেয়েটির তুলনায় অনেক বেশি কর্মোৎসুক এক যুবকের সঙ্গেও কথা হয়েছিল অল্প আগে । কোন কোন অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন যে দেশে বিপ্লবের জমি একেবারে প্রস্তুত , কী লক্ষণ থেকে তিনি ধরে নিয়েছেন যে আমাদের শোষক সমাজের পতন আসন্ন , এই প্রশ্ন করতেই তার মুখ থেকে নিবারণহীন বেরিয়ে আসে লেনিন এবং মাওসেতুঙের উদ্ধৃতি। '

এই লেখাটির একটি স্মরণীয় দিক হল যে শঙ্খ ঘোষ আসলে নিজের একজন সমাজসচেতন বুদ্ধিজীবী ইমেজের সঙ্গেও যে সেইসময় লড়ছেন একথা লুকানোর চেষ্টা করেননি ; অকপট লিখেছেন: ' মেট্রোপলিস মাত্রেই আজ হৃদয়বর্জিত এক করোটি মাত্র । সেই করোটি যেন শুনতে পায় : বাইরের জগতে প্রকান্ড এক শব্দতরঙ্গ উঠছে নামছে , বধির হয়ে আসে আমাদের সমস্ত চেতনা, ট্রামলরির কর্কশ ঝংকার, বেঁচে থাকার দুঃসহ প্রতিযোগিতায় ধাবমান চিৎকার , হিসেবি এক বুঝে -পড়ে -নেওয়ার স্বার্থসংসারে সবাই সবাইকে ঠেলছে আর তার থেকে বেজে উঠছে একটা টাকাপয়সা লেনদেনের ঝ্নঝ্ন , - এই জটিল শব্দরাজি থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যেই যে আপাতবিরোধী এক কান্ড করে বসেন আমাদের বুদ্ধিজীবী মানুষ,তিনিও তার চারদিকে ছুঁড়ে দিতে চান শব্দ , শব্দ, শব্দচিহ্ন -এই দিয়ে তিনি প্রবল এই দ্বন্দ্বের বিশ্বে অলক্ষ্য এক বর্ম তৈরী করে নেন, অর্থহীন শব্দবর্ম । শব্দ দিয়ে শব্দের সঙ্গে লড়াই শেষ করে শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফেরেন তিনি , সারাদিনের যুদ্ধশেষে খানিকটা হয়তো আত্মধিক্কার নিয়ে চুপ করে থাকেন রাত্রিবেলা ।.......আর এইভাবে, বুদ্ধিজীবী জানতেও পারেন না কখন একদিন তিনি হয়ে উঠেছেন নিস্ফল এক শব্দজীবী মাত্র, কখনোই তারা জানতে পারেন না যে নিজের চারপাশে ঘেরা মিথ্যা এই শব্দগুলো চিনে নিতে না পারলে শেষ পর্যন্ত কোনো মুক্তি নেই আমাদের ভাবনায় ।'........

এই লেখাটির সমাপতন আমি টানতে চাইছি এমন এক সুইসাইড পয়েন্টে যেখানে আকাশভরা দেবতাদের অভিমান ও ভস্ম ; নকশালপন্থী ছাত্র শহীদ তিমিরের এপিটাফ লেখা শঙ্খ বাবুর অতিমানবীয় অবয়ব থেকে মেঘ খানিক সরে আসবে । তিনি নেমে আসবেন মাটির কাছাকাছি । যখন তার বাড়ির আড্ডায় যাবে বলে  কবিসম্প্রদায় নির্লজ্জ আকুলিবিকুলি করবেনা । ১৯৮৫ -র শরৎকালে একটি জনপ্রিয় পত্রিকাতে ' বিখ্যাত নকশাল দমনকারী পুলিশ কমিশনার ' এই অভিধায় ভূষিত করে মহামান্য পুলিশপ্রধান রঞ্জিত গুপ্তের একটি লেখা ছাপা হয় । এধরণের শিরোনামের প্রতিবাদে ওই পত্রিকার ডিসেম্বর সংখ্যায় চিঠি লেখেন শঙ্খ ঘোষ । যে চিঠি প্রসঙ্গে সৌমেন গুহ বলছেন ' যদিও জানি ১৯৮৫ সালের এ রকম চিঠি , ১৯৭২ সালে শঙ্খ ঘোষ লিখতে পারতেন না , লিখতে জানতেন না , লিখতে চাইতেন না '.....

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views