অসম্ভবের আখ্যান ও নবারুণ ভট্টাচার্য
অত্রি ভট্টাচার্য্য
'No social order ever perishes before all the productive forces for which there is room in it have developed; and new , higher relations of production never appear before the material conditions of their existence have matured in the womb of the old society itself . '
কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স নিজের 'A contribution to the critique of political economy' গ্রন্থের ভূমিকায় বলছেন পুরাতন সভ্যতার গর্ভযন্ত্রণার কথা । এশীয় , প্রাচীন, সামন্ততান্ত্রিক এবং আধুনিক বুর্জোয়া উৎপাদনপদ্ধতির সঙ্গে সমাজের অর্থনৈতিক গড়নের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির টানকে ধরছেন তুখোড় প্রজ্ঞায় । বুর্জোয়া সভ্যতার গর্ভ থেকেই উৎক্ষিপ্ত হবে এই সভ্যতার অপর অথবা এই বুর্জোয়া সভ্যতার প্রতি বৈরীচেতনাময় বস্তুগত পরিপ্রেক্ষিত । নবারুণের পেট্রোলখেকো বেবি কে অথবা বেবি খানকি ও পারিজাতের আখ্যান যেন সেই ' অ্যান্টাগনিস্ট ' ।
যেখানে নবারুণ সত্তর দশকের গোড়ার সময়টিকে বলছেন '...ওপরে ঝড় থাকলেও নিচে এক নিথর মর্গ । এই মর্গে ইঁদুর নেই । হাঙর আছে । ' যেখানে একদল মানুষ; যারা অবশ্যই আমাদের ভদ্রলোকেদের সাংস্কৃতিক অপর । তাদের সম্পর্কে নবারুণ আমাদের সোচ্চারে জানিয়ে দেন মোটরগাড়ির টিন পিটিয়ে যারা ছন্দ শেখে ও মুকেশের গান গায় তারা আমাদের ন্যাকামিকে ঘেন্না করে । যারা দশমীর বিকেলে ' এক সন্ধেবেলার জন্য লুম্পেন সাজার আপ্রাণ চেষ্টা করা বড়লোকের লালুখোকাদের ' পিছুপিছু ঢাক ও কাঁসর বাজাতে বাজাতে হাঁটে । নবারুণের এরূপ প্রলেতারিয়েত পর্যবেক্ষণ - ' কলকাতায় এভাবেই গেঁয়ো মানুষেরা আসে ও বাংলার ইজ্জত, বঙ্গসংস্কৃতির রোয়াব কায়েম করে ফের আফ্রিকাতে ফিরে যায় যা ফিবছরেই হয়ে থাকে , হয়ে আসছে । ' তাদেরই মুখে নবারুণ আমাদের শোনান সহস্র বৎসর ধরে জমিয়ে রাখা ভারতবর্ষের শ্রমিকশ্রেণীর অশেষ উপলব্ধি: ' গরিবদের এরকম হয় জানেন ? চলচে , ফিরচে , সব করছে , ফট করে শালা মরে গেল । আমি দেকেচি । ' অবশ্য এখন আমরাও তাই দেখছি । লাশ ভাসছে গঙ্গায় । প্রধানসেবক কুমিরের কান্না কাঁদছেন । ফট করে মরে যাওয়া সর্বৈব ভবিষ্যত হয়ে দাঁড়াচ্ছে । কথার ভাঁজে কথা লুকিয়ে রাখার সময় এটা নয় । এসব পলিটিক্যাল বাত্তেলা ছেড়ে আসি পেট্রোলখেকো বেবি - কে-র কথায় । যাকে লালবাজার চেনে । সে যখন কথা বলে তার জিভে নীল লাইট হলকা দেয় । তাকে নিজের লজঝড়ঝড়ে মোপেডে চেপে সারা শহরে খোঁজে পারিজাত । পেট্রোলখেকো বেবি খানকির - চরিত্রগঠনে যে অসম্ভবের ছাপ তাকে আরেক চরিত্র ফায়ারম্যান তুলনা করছে পুলিশের দ্বারা জ্যোতি বসুর এটিএম কার্ড চুরির অলীক মেটাফরের সঙ্গে । এবং অদ্ভুতভাবেই নিস্পৃহ ফায়ারম্যান যখনই বাড়ি ফেরে তার গোটা গুষ্টিসুদ্ধ সক্কলে বসে থাকে টিভির সামনে । নবারুণ আমাদের ইঙ্গিত দেন এক সামাজিক প্রপঞ্চের দিকে । যেখানে টেলিভিশন গিলে খাচ্ছে মহাভারতের জনতাকে । গোটা নব্বইয়ের দশক । ফ্যাশান টিভি । রামানন্দ সাগর।
ত্রিপুরার গণকবি বুধুদাস পানিকা লিখেছিলেন:
' দোষটা বল দিব কারে ?
চুষে নিচ্ছে চিত্রহারে ।
সিনেমা , ভিডিও, টিভি
দেখতে বড় চমৎকার
যুবা - যুবীর হাড়-মাংস
চিবিয়ে খায় চিত্রহার ।
প্রতিক্রিয়া রুখবে যারা
হবে যারা ক্ষুরধার
তাদের বিপ্লবী চেতনা
করছে ভোঁতা চিত্রহার ।
মাথা টনটন গা - ঝিমঝিম
চলতে চরণ টলছে যার
দেশকে দেবে কোথা শক্তি
নিংড়ে নিলো চিত্রহার। '
' আমেরিকান পেট্রোম্যাক্স ' আখ্যানটিতে নবারুণ প্রায় ব্ল্যাক কমেডি মার্কা একটি গল্প ফেঁদেছেন । - যেখানে ফ্ল্যাশব্যাকে প্রথমে একটি আষাঢ়ে গল্প শোনানো হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালকে প্রেক্ষিত রেখে । যেখানে এক বাঙালি কবির স্ত্রীকে অপহরণ করে মার্কিন সৈন্যরা নিয়ে যায় । পরে তাকে ফেরতও দেয় । নবারুণের টিপ্পনি অনুযায়ী : ' ঘটনাটি অন্যরকম হলে বাংলা কবিতার ইতিহাস যে অন্যরকম হত তাতে ওয়াকিবহাল মহল নিঃসন্দেহ । ' এবার এই ঘটনাটিকে আবার এক আষাঢ়ে কায়দায় রিপিট করছেন নবারুণ । এ যেন মার্ক্সের প্রতিসন্দর্ভ । ইতিহাস বার বার ফিরে ফিরে আসে; প্রথমবার তা শোকগাথা দ্বিতীয়বার ভাঁড়ামো একথাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নবারুণ যেন বলতে চাইছেন : ইতিহাসের বারবার ফিরে আসা ইতিহাসের বারংবার ভাঁড়ামো । কল্পিত এক চৌরঙ্গী চত্বরে ; যেখানে ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে ইউ.এস.আর্মির খাঁকি জাঙ্গিয়া , ডিলডো ও ছোটো হেভি কিউট ডাইনোসরের বাচ্চা । সেখানেই পারিজাতের সামনে দিয়ে বেবি কে অপহৃত হয় । আমেরিকান সৈন্যরা তাকে নিয়ে যায় একটা বারে । তুমুল হুইস্কি খাওয়ায় । নাচানোর জন্য তুলে দেয় টেবিলের উপর । ইরাকফেরত সৈন্যরা চিয়ারলিডারের মতো রণধ্বনি দেয় ' ফাক হার ', ' ফাক হার ' । যদিও এরা জানতোনা বেবি -কে -এর একমাত্র খাবার পেট্রোল । এক সোলজার তার মুখে কিংসাইজ মার্লবোরো গুঁজে দিতেই যা হয় - '....ভস্মীভূত ওই বারে ৩৭ জন সোলজার, ৩জন ওয়েটার এবং পুড়ে ছোট হয়ে যাওয়া একটি পিগমি ফিমেল বডি -মোট ৪১টি তন্দুর মড়া ঘেঁটেঘুঁটে ইউ.এস আর্মির মিলিটারি ফরেন্সিক ব্যুরো রিপোর্টে বলেছিল যে বিস্ফোরণটি চার পাঁচটা মলোটভ ককটেলের মতোই । '
খুব অস্বাভাবিকভাবেই নবারুণ প্রতিষ্ঠানবিরোধীতাকেও বোধহয় একটা সময়ের পর ভাঁড়ামোই ভাবছেন । তাই ' ফায়ারফাইট ' গল্পে লিখছেন ' কুচোকাচা হাবিজাবি দল যারা ঘরোয়া আড্ডার নাম দিয়েছে বিকল্প পরিসর । ' এ যেন ক্রমাগত ঘটতে থাকা স্পেকটাকলের বিরুদ্ধে অসহায় এক চিৎকার । তাই তিনি ভাবছেন কোনো অসম্ভবের প্রত্যাবর্তনের কথা । ' ব্ল্যাক সোয়ান ' - এর কথা ।
'একদম মেগা একটা ঝামেলা । যেটার কথা কেউ কখনও ভাবেনি । আচমকা এসে পড়বে । মানুষ ভাববে সব কিছু বুঝে গেছে । ভূত ভবিষ্যি সব তার পকেটে । বেমক্কা একটা ঝামেলা এসে পড়বে যে পুরো চোদু বনে যাবে । আচমকা ঘাপ ! আগে কোনও মিঞা বুঝতে পারবেনা । '
নবারুণ ভুলতে পারেননা গ্লাসনস্ত । পেরেস্ত্রৈকা । ক্রেমলিনের শয়তানের মুখ ।
তাই পারিজাত যখন ফায়ারম্যানকে দেখে সে বলে : ' কোনও কোনও সময় সাইড থেকে দেখলে বা দেওয়ালে জাম্বো ছায়াটা পড়লে ফায়ারম্যানকে সোভিয়েত আমলে তৈরী স্ট্যাচুগুলোর মতো দেখায় । আকাট আকাট , হিরো হিরো । '
হিতোপদেশ অথবা বাইবেলের উপদেশের থেকে জরুরী উপদেশ দেন নবারুণ । বলেন অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যাকারী আমেরিকান নেভি সিলদের দলের পান্ডা এরিক স্মিথ ও টম শ্যানকের বই পড়ার কথা । আরো বলেন আমাদের প্রতি ; আমরা যারা সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায় তাদের প্রতি : ' আখড়ায় যখন নামতেই হবে তখন কাছা খুলে নামাই ভাল । হাফজান্তার এলোমেলো দিয়ে কড়াই তাতিয়ে লাভ নেই । '
Picture Courtesy: antiserious.com
Comments
Post a Comment