পেরুর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনঃ ক্যাস্টিলো ক্ষমতাধীন হলে কি নয়াউদারবাদকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারবে?

রূপক গায়েন

লাতিন আমেরিকার একটি দেশ পেরু। সমগ্ৰ বামপন্থী মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের মনচিত্রে  এবং বামপন্থী সরকার চালিত দেশগুলোর মানচিত্রে  আশ্বাসের এক নতুন জমি তৈরি করল পেরু। নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এগিয়ে থাকা পেদ্রো ক্যাস্টিলোর উত্থান পর্ব। তবে এই উত্থানের সাথে সাথে উঠে আসে কিছু প্রশ্ন। তবে সেগুলো বোঝার আগে পেরুর সাংবিধানিক গঠনতন্ত্রটা জানা আবশ্যক। পেরুর সরকার সেমি-প্রেসিডেন্সিয়াল অর্থাৎ দেশের প্রেসিডেন্টই সর্বেসর্বা নয়, বরং সে দেশের কংগ্রেস (আমাদের দেশের লোকসভার মতো) এবং প্রেসিডেন্ট প্রায় সমান ক্ষমতাশালী, তবে কংগ্রেসের পূর্ণরূপে অধীনেও নয় প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ  কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের একটা টানাটানি চলে; উভয়েরই নিজস্ব কিছু ক্ষমতা আছে এবং নিজেদের মধ্যে আপোষ ও সম্মতিক্রমে বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়। পেরুতে দীর্ঘদিন ধরেই নয়াউদারবাদী জনবাদ বেশ শক্তিশালী এবং জনবাদী ডানপন্থী পার্টিগুলি বহু বছর ধরেই ক্ষমতাসীন। তারাই নয়াউদারবাদকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সে দেশের নবনির্বাচিত কংগ্রেসে (লোকসভায়) প্রচুর ডান এবং অতি ডান পার্টির প্রতিনিধি রয়েছে, কিন্তু এই ডানপন্থী পার্টিগুলির মধ্যে মতানৈক্য এবং বিরোধ থাকলেও তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান যেহেতু একই, তাই পেদ্রো ক্যাস্টিলো ক্ষমতাধীন হলে পলিসিগত যে রিফর্মগুলো আনতে চাইবে, সেগুলোতে কংগ্রেস থেকে সার্বিকভাবে বাধা দেওয়ার একটা  সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। একই সাথে কংগ্রেসে থাকা নুয়েভো পেরুর মত বামপন্থী দলগুলোর সাথে ঐক্য তৈরি করে তাদের সমর্থন আদায় করতে ক্যাস্টিলোর নেতা হিসেবে পটুতাও পরীক্ষিত হবে। পেদ্রো একজন আদিবাসী নেতা; বিগত কিছু লাতিন আমেরিকান দেশগুলির মধ্যে বলিভিয়া, কলম্বিয়া বা পেরুতে, আদিবাসী নেতারা নির্বাচনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। লাতিন দেশগুলির আদিবাসীরা বহুকাল ধরেই নিপীড়িত, অত্যাচারিত, তাই তাদের একটা পলিটিকাল অ্যাসারশান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ক্যাস্টিলো নয়াউদারবাদী অর্থনীতিকে যদি চ্যালেঞ্জ করতে পারে, তবেই বোঝা যাবে তার পার্টির শ্রমিক এবং কৃষক কেন্দ্রিক রাজনীতির একটা ধারার প্রতিফলন ঘটছে, অন্যথায় প্রথমদিকে সফ্ট-নিওলিবারাল এবং পরবর্তীতে উগ্ৰ-নিওলিবারালে পরিণত হবে তারা (যেমনটা হয়েছিল বামপন্থী পেরুভিয়ান ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা অল্যান্টা হুমালার রাষ্ট্রপতিত্বকালে)। যদি নয়াউদারবাদী প্রক্রিয়াকেই জায়গা দেওয়া হয় তবে শ্রমিক-কৃষক রাজনীতি বর্জন করে আদতে এই আদিবাসী আন্দোলন একটি সাব-অল্টার্ন আন্দোলনের মতই এগিয়ে যাবে; লক্ষণীয় যে উত্তর-আধুনিকতার প্রাবল্য দেখা দিচ্ছে লাতিন দেশের বাম দলগুলোর মধ্যে এবং সেটাকে কাজে লাগিয়ে সাময়িক রাজনীতিতে ফল পেলেও একটা বিকল্প অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে অসফল হচ্ছে বামপন্থীরা। 

ক্যাস্টিলোর প্রেসিডেন্ট পদে এগিয়ে থাকার প্রেক্ষাপটও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে করোনার চরম প্রভাব (একদা সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সংক্রমণের শিরোপা প্রাপ্ত), অন্যদিকে গভীর অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতি; পেরুর সাধারণ মানুষ বিকল্প রাজনীতির সন্ধানে ছিলই তাই ক্যাস্টিলোর তরফে ভোটের আগে যোগ স্লোগান: “No more poor in a rich country”। ফলে,  পেরুর নিষ্কাশন কেন্দ্রিক চরম দারিদ্র কবলিত কারখানা এলাকাগুলি থেকে ক্যাস্টিলো সবথেকে বেশি ভোট পেল। তবে ক্যাস্টিলোর ইলেকশন ম্যানিফেস্টো দেখলে বোঝা যায় দুটো জায়গা ছাড়া খুব একটা কংক্রিট কোনো কথাই বলা হয়নি। প্রথমত, ক্ষমতায় এলে নতুন কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি তৈরি করে দেশের সংবিধানকে পাল্টিয়ে প্লুরি-ন্যাশনাল রাষ্ট্র তৈরি করতে উদ্যত হবে সে, যা যদি শ্রেণি রাজনীতি বর্জন করা হয় তাহলে আইডেন্টিটি পলিটিক্সেরই অংশ হিসেবে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা। দ্বিতীয়ত, পেরুর সমস্ত খনি এলাকার নিষ্কাশন কেন্দ্রিক কারখানার মালিকদের উপর কর চাপিয়ে সেই উপার্জনে সেখানকার দারিদ্র প্রবণ অঞ্চলের মানুষের উন্নতি করবে সে, যা তার বামদিক ঘেঁষা পলিসিসমূহের অংশ। 

ক্যাস্টিলোর বিপক্ষে থাকা পপুলার ফোর্স পার্টির কেইকো ফুজিমোরি হল অতি ডান রাজনীতির প্রতিনিধি; নির্বাচনী ফলাফলে পিছিয়ে থাকলেও পারিবারিকভাবে ক্ষমতায় থাকার ইতিহাসের দৌলতে লিমা শহরের বিভিন্ন স্টক মার্কেট বিনিয়োগকারীদের সাথে আঁতাত করে, বিভিন্ন বিজনেস হাউসগুলোর সাথে স্বজনপোষণের মাধ্যমে কংগ্রেসে তাদের প্রভাব বজায় রেখেছে এবং একই সাথে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই কারণে নির্বাচনী প্রচারে ক্যাস্টিলোকে  কমিউনিজমের প্রশ্ন বারংবার নাকচ করতে হয়েছে এবং কিছুক্ষেত্রে ভেনেজুয়েলার বিরোধিতাও করতে হয়েছে (কেবলই নির্বাচনী ট্যাক্টিক্স কিনা তা ভবিষ্যতে দেখা যাবে)। ক্যাস্টিলোর দল ‘ফ্রি পেরু’ পার্টিতে দুধরনের নেতা রয়েছে, যারা নিজেদের মতবাদের দিকে  ক্যাস্টিলোকে টানার চেষ্টা করবে। এই পার্টির সেক্রেটারি ভ্লাদিমির সেরন মার্কসবাদী মতবাদের দিকে টানার চেষ্টা করবে তাকে, আবার অপরদিকে রয়েছে পেদ্রো ফ্র্যাঙ্কে, যে একসময়কার ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ এবং যার উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন কয়লা খনির মালিকদের উপর কর চাপানোর পরিবর্তে সমঝোতায় আসা, কোনোভাবেই জিনিসপত্রের দামের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ কায়েম না করে এবং ধুঁকতে থাকা ইন্ডাস্ট্রি বা ব্যাঙ্কগুলোর রাষ্টায়ত্ত্বকরণ না করা। ফলে ডানদিকে থাকা ফ্র্যাঙ্কো এবং বামদিকে থাকা  সেরনের লড়াইয়ে তাদের উভয়ের মতবাদের মাঝখানে ক্যাস্টিলো হল লাল কাপড়ের জয়নির্ধারণী সূচক। কিন্তু, ফুজিমোরি নির্বাচনী পরাজয় স্বীকার করলে এবং ক্যাস্টিলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, এই লাল কাপড়ের ঝোঁক কি আদৌও বামপন্থী ধারার অধীনে থেকে নয়াউদারবাদের প্রশ্নে অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ার দিকে যাবে নাকি নিছক শ্রেণি বিশ্রুত সাব-অল্টার্ন ধারার দিকে ঘুরে যাবে?... ভাসমান কিছু উত্তর থাকলেও এখনই তা খাতায় লেখার সময় আসেনি ।

 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views