সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিষয়ীগত শর্ত

বোধিসত্ত্ব রায়

[১৪-১৫ এপ্রিল ২০১২-তে দুর্গাপুরে ‘আলোড়ন’ পত্রিকা আয়োজিত ‘বিপ্লবী দলের প্রয়োজনীয়তা ও সমস্যা’ শীর্ষক আলচনা সভায় র‍্যাডিকাল সোস্যালিস্ট-এর পক্ষে পেশ করা বক্তব্য ] 




ভূমিকা

তিনটে স্বতঃসিদ্ধকে ধরে বিপ্লবী দলের প্রসঙ্গে আলোচনায় ঢুকব । এক, সমাজের অগ্রগতি বা সমাজ বিবর্তনে সামাজিক বিপ্লব অপরিহার্য । দুই, শ্রেণী সংগ্রামই সমাজ বিবর্তনের চালিকাশক্তি। এবং তিন, পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে যেতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিক শ্রেণীর সার্বিক নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ অনিবার্য। এই তিন স্বতঃসিদ্ধকে মেনে নিয়ে আজকের আলোচনার বিষয়টাকে প্রশ্ন আকারে উত্থাপন করে উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করব। শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী দল ছাড়া কী শ্রমিকশ্রেণীর সফলভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে? শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী দল কি অপরিহার্য?

প্রথমে অভিজ্ঞতা ও হাতুড়ে বিদ্যা দিয়ে এটার একটা উত্তর দেবার চেষ্টা করা যাক। আমরা যদি বিশ্ব শ্রমিক অন্দোলন বা আমাদের দেশের শ্রমিক অন্দোলনের ইতিহাস দেখি তাহলে দেখব যে বহু ক্ষেত্রে সংস্কারবাদী বা সুবিধাবাদী দলগুলোর প্রভাবে থেকে বিপ্লবী সম্ভাবনাযুক্ত শ্রমিক অন্দোলন গুলি ক্ষতিগ্রস্ত বা অধঃপতিত হয়েছে। সংস্কারবাদী বা সুবিধাবাদী দলগুলো যদি শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী অন্দোলনের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে বিপ্লবী দলও নিশ্চয় শ্রমিক শ্রেণী ও তার লড়াইয়ে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে। যদিও শ্রমিক শ্রেণীর ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব তৈরি করা আর বুর্জোয়া ব্যবস্থায় তার ওপর বিপ্লবী প্রভাব সৃষ্টি করা আক্ষরিক অর্থে একটা আরেকটার ঠিক বিপরীত ব্যাপার নয়। আর এই ব্যাখ্যা সমাজতান্ত্রিক অন্দোলনের বিপ্লবী দলের অনিবার্যতার প্রমাণ দেয় না।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, শ্রমিকশ্রেণী, মার্কসবাদ

এই প্রসঙ্গে সঠিক ধারনা তৈরি করতে প্রথমে যে দুটো বিষয়কে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে তার প্রথমটা হল শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণী চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার অভাব ও পরস্পরবিরোধীতা এবং তার বিভিন্ন স্তরভেদ। আর অন্যটা হল মার্ক্সীয় তত্ত্বের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর শ্রেণী সংগ্রামের সম্পর্ক। সমাজে শ্রেণী সংগ্রামের অস্তিত্ব একটা বাস্তবতা। কিন্তু মার্কসবাদের আত্মপ্রকাশ হয়েছে স্বাধীনভাবে। যদিও শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশের মধ্যে দিয়েই মার্কসবাদও বিকশিত ও পরিণত হয়েছে বা হয়ে চলেছে,তবে ব্যাপারটা এরকম নয় যে শ্রেণীসংগ্রামের অবধারিত ফলাফল মার্কসবাদ। একটা ভিন্ন জায়গা থেকে শুরু করে মার্কসবাদ সেই একই কেন্দ্রীয় বিন্দুতে উপনীত হয় যেখান থেকে আগেকার সমস্ত সামাজিক বিপ্লবের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পার্থক্য বোঝা যায়। মার্ক্সীয় শিক্ষায় চারটে সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দিয়ে আগেকার বিপ্লব্গুলোর থেকে শ্রমিক বিপ্লবের পার্থক্য রেখা টানা যায়। সেগুলো যথাক্রমে:

১। এই বিপ্লবই প্রথম যা, সমাজের সবথেকে নিচের শ্রেণীর দ্বারা সংঘটিত সামাজিক বিপ্লব। এই শ্রেণীর কাছে কোনও অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকে না। সামাজিক সম্পদের ওপর সব ধরনের মালিকানা থেকে শ্রমিকশ্রেণী বঞ্চিত। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করার অনেক আগেই যেখানে বুর্জোয়া বা সামন্তপ্রভুরা অর্থনৈতিক ক্ষমতার মালিক হয়েছিল।

২। মানব সভ্যতার ইতিহাস এটাই প্রথম সমাজবিপ্লব যেটা সবসময় পুরোন সমাজ ব্যাবস্থাকে উৎখাত করার সচেতন প্রয়াস। এই বিপ্লব আআগের কোনও সামাজিক অবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে না। অথবা আগেই অর্জিত অর্থনৈতিক বন্দোবস্তকে বৈধতা দেবার জন্য প্রয়জনিয় রাজনৈতিক ক্ষমতা বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কাজও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে হয় না। এটা কেবল তত্তগত বা কর্মসূচীগত উপলব্ধি মাত্র, যেটাকে বাস্তবে রুপায়িত করতে হয়।

৩। অন্যান্য সমাজ বিপ্লবে বিজয়ী শ্রেণী রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। অগ্রগতিকে প্রতিহত করে। অন্যদিকে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর শ্রমিকশ্রেণীর আচরণ হবে ঠিক উল্টোটা। বিজয়ী শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখলের পর সমাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লবকে আরও প্রসারিত করবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজেকেই শ্রেণী হিসেবে বিলুপ্ত করছে। তাই শ্রমিক বিপ্লবে এই গতা প্রকিয়াটা শেষ হয় না, বরং শুরু হয়।

৪। অন্যান্য সামাজিক বিপ্লবের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ছরিত্র শুধুই আন্তর্জাতিক। এই বিপ্লবের শুরু কোনও এক্তা দেশ থেকে শুরু হলেও তার সম্পুরন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিজয় সম্ভব শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক স্তরে।

শ্রমিকশ্রেণীর দ্বারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এই বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে এই সিদ্ধান্ত উপনীত হওয়াই যায় যে এটা মোটেই একটা স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া নয়, বরং সচেতন ভাবে এটাকে ঘটাতে হয়। আজ হয়তো পৃথিবীতে কয়েকশো লক্ষ মানুষ পুঁজিবাদ বিরোধী লরাইতে রয়েছে জারা ঐ পরিবর্তনটা ঘটাতে চান। কিন্তু এদের অধিকাংশের মধ্যেই কিভাবে এটা ঘটানো যাবে বা কারা এটা ঘটাবে সেই বিষয়ে প্রচুর অস্পষ্টতা রয়েছে। কেউ কেউ তাকান এন জি ও-দের দিকে, অনেকে এক্তি বা দুটি বিষয়ের ওপর লড়াই সংগ্রামে মনোনিবেশ করে, কেউ বা চাভেজ বা মোরালেসদের মতো প্রগতিশীল সরকারগুলোর দিকে তাকিয়ে। খুব ছোট হলেও একটা অংশ আবার দিশাহীন সশস্ত্র সংগ্রামে ব্যস্ত।

মার্কসের সময়ও ছিল এ ধরণের বিভ্রান্তি। উনবিংশ শতাব্দির চারের দশকের আগে তৎকালীন বামপন্থীদের মধ্যে প্রধানত দুটো বিচ্যুতি দেখা যায়। আজকের সমস্ত বিচ্যুতির উৎসগুলোও প্রধানত সেই সময়ের থেকে জন্মেছে এবং পরবর্তীতে অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিকশিত হয়েছে। একটা ধরা জ্যেকোবিনবাদী, জারা মনে করতো জ্ঞানী বুদ্ধিজীবী আত্মত্যাগী মানুষের ছোট এক গোষ্ঠী চক্রান্ত করে রাষ্ট্রক্ষমতা করবে আর মানুসের পক্ষ নিয়ে সমসমাজ তইরি করে ভালো ভালো আইন করবে। আরেকদল যারা কল্পনাবিলাসী সমাজতন্ত্রী । তারা চেয়েছিল জুক্তির সাহাজ্যে ছোট মানবগোষ্ঠীকে নিয়ে উদাহরন হিসেবে আদর্শ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা করে সবাইকে বোঝাবে সেটা কত ভালো ব্যবস্থা। বলা চলে, ল্যবটারীতে তইরি সমাজতন্ত্র। অর্থাৎ, বিপ্লবীরা রুপান্তর এবং সেটা করতে শ্রমিকশ্রেণীর নেত্রিতবদারী ভুমিকার আবশ্যিকতার তত্ত্ব হাজির করে। জ্যেকোবিনবাদী এবং কল্পনাবিলাসীরা সমাজতন্ত্রকে ওপর থেকে ছাপাতে চেয়েছিল। বিপরীতে মার্কসবাদে সমাজতন্ত্র আসতে পারে সমাজের নীচে থেকে। তাই মার্কস লিখেছিলেন ‘শ্রমিকশ্রেণীকেই তার নিজের মুক্তি অর্জন করতে হবে’।

মার্কস শ্রমিকশ্রেণীর শোষণ বঞ্চনার ওপর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব তৈরি করেননি। বরং শ্রমিকশ্রেণীর শক্তির অপরেই দাঁড়িয়ে আছে সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ। শোষণ বঞ্ছনা শ্রমিকশ্রেণীকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঠেলে দেয়, কিন্তু দাস বা কৃষকেরাও হাজার হাজার বছর শোষিত বা বঞ্চিত হয়েছে। ঐ সমস্ত শোষিত শ্রেণী থেকে শ্রমিকশ্রেণী আলাদা তার নিজস্ব ক্ষমতায়। একদিকে পুঁজিবাদকে পরাস্ত করার ক্ষমতা আর অন্যদিকে নতুন সমাজব্যবস্থা তৈরি করার ক্ষমতা । শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিবাদের এক অদ্ভুত সৃষ্টি। পুঁজিবাদ জত বারবে, ততই বাড়বে শ্রমিকশ্রেণী। বুর্জোয়ারা শ্রমিকদ্রে যুদ্ধের পর যুদ্ধে আহারাতে পারে। তার ধর্মঘট  ভাঙতে পারে, ইউনিয়ন ভাঙতে পারে, তার অধিকার খর্ব করতে পারে কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে মুনাফা করতে  পারে না, বুর্জোয়া অরথিনিতি টিকিয়ে রাখতে পারে না। বরং তাদের এক জায়গায় জড়ো করে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে। তাদের মধ্যে এমন সুপ্ত ক্ষমতা দেয় যে তার চাইলে সব কিছু থামিয়ে দিতে পারে। তাদের কাজ ছাড়া পরিবহন বন্ধ হতে পারে, খনিজ উৎপাদন বন্ধ হতে পারে, এমন কি সেনাবাহিনির অস্ত্র উৎপাদনও বন্ধও হতে পারে। শ্রমিকশ্রেণীকে সৃষ্টি করার মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদ সৃষ্টি করে ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শোষিতশ্রেণীকে।

উৎপাদন থেকে সংগ্রাম, সবটাই শ্রমিক শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধভাবে করতে হয়। কৃষকরা জমিদার বা জোতদারের থেকে জমি কেড়ে নিয়ে নিজদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। শ্রমিকশ্রেণী সেটা পারে না। কারখানা দখল করে শ্রমিকশ্রেনী সেটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে পারে না, বরং যৌথ সম্পত্তিতে পরিনত করতে পারে। সেই কারনে শ্রমিকশ্রেনী সমাজতন্ত্রী শ্রেনী। ক্ষমতা দখল করেও শ্রমিকশ্রেণী, শ্রমিক হয়ে ই থাকে উৎপাদক শ্রেণী হয়েই থাকে। তার অধিনে শোষণ করার জন্য বা পরজীবী হয়ে থাকার জন্য কোনো শ্রেণী তৈরি করতে পারে না। উল্টোদিকে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খমতাবলে শ্রমিকশ্রেনী তার তার অপরেও কোন শ্রেণীকে জন্মাতে দেয় না। শ্রমিকশ্রেনী একসাথে হয়ে ওঠে শাসক এবং উৎপাদক। জা প্রকৃত শ্রেণিহীন সমাজের ভিত্তি তৈরি করে। অনেকে বলেন শ্রমিক শ্রেণীর প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে। ঠিক, কিন্তু এতসত্বেও আজও পুঁজিবাদ থেকেই শ্রমিকশ্রেনির জন্ম হয়ে চলছে। আজও শ্রমিকশ্রেনী শুধুমাত্র নিজের শ্রমশক্তি বিক্রি করেই বেচে আছে, শোষিত হচ্ছে আর ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছে। বরং আয়তনে এবং ক্ষমতায় শ্রমিকশ্রেনির অনেক বৃদ্ধি হয়েছে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকশ্রেনীর চেতনা 

জার্মান আইডিওলজি তে মার্কস বলেছিলেন, ‘সমস্ত জুগে শাসক শ্রেনীর মতাদর্শই শাসক মতাদর্শ।‘ অর্থাৎ, শ্রেনিবিভক্ত সমাজে শাসক শ্রেণীর মতাদর্শই প্রধান এবং অধিপত্যকারি মতাদর্শ। জার মানে দারায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় থাকা শ্রমিকশ্রেনীও সাধারনভাবে বুর্জোয়া মতাদর্শেই আচ্ছন্ন থাকে, যেটা সাভাবিকভাবেই বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে তিকিয়ে রাখার আদর্শ। অথচ কিছুক্ষণ আগেই আমরা দেখেছি শ্রমিকশ্রেনীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হল বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে উৎখাত করার একটা সচেতন উদ্যগ। দুটো ব্যখ্যা কি পরস্পরবিরোধী নয়? অবশ্যই তাই। কিন্তু পরস্পরবিরোধী শর্তাধীন এবং চরম বা সারবিক নয়। অর্থাৎ শাসক শ্রেণীর এই মতাদর্শ গত অধিপত্য সমস্ত মানুষের ওপর স্থায়ীভাবে কাজ করে না। করলে সামাজিক বিপ্লব কখনও হত না। সে কারণে গোড়াতেই একজায়গায় বলেছি, যে শ্রমিকশ্রেনীর চেতনায় বিকাশ হয় অসমভাবে, পরস্পরবিরোধিতা নিয়ে এবং তার মধ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা থাকে না। আসলে শ্রমিকশ্রেনী সহ অন্যান্য শ্রেণীর ওপর বুর্জোয়াশ্রেণীর মতাদর্শগত নিয়ন্ত্রনের মানে হল মতাদর্শ উৎপাদনের উপকরণগুলোর ওপর বুর্জোয়া শ্রেণীর নিয়ন্ত্রন; ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, গনমাধ্যম ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বুর্জোয়া শ্রেনীর নিয়ন্ত্রন। আর এই নিয়ন্ত্রনের প্রয়োগ হয় রোজকার জিবনে অর্থনীতি এবং সমাজের ও চেতনার ওপর সেগুলর প্রভাবের মধ্যে দিয়ে। পন্য সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে মানুষে মানুষে সম্পর্ক, শ্রমশক্তির পন্য রুপান্তর, সামাজিক শ্রমবিভাজন ইত্যাদি বাস্তব গুলোর সাহায্যেই এই মতাদর্শগত নিয়ন্ত্রন কাজ করে। শুধু বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে গিলিয়ে দেওয়া ব্যপারটা ঠিক তেমন নয়। শোষণ, বঞ্চনা, অনিশ্চয়তা থেকে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে যে ধরণের অবসাদ তৈরি হয় তাতে তারা মনুস্যপদবাচ্য থাকে না। জেতুকু অবসর সময় তারা পায় সেটা যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনই সেটা কোনোভাবেই গুনগত অবসরও নয়। সেটুকু সময় কোন সুস্থ চিন্তার পক্ষে উপযুক্ত নয়, বরং বুর্জোয়া মতাদর্শ নিরমানের জন্য মাধ্যমগুলর তৈরি করা ধারনা, শিক্ষা, বিনোদন নিয়েই সেই সময়টুকু কেটে যায়। সেই কারণে শ্রেণী সংরামের প্রথম ধাপগুল বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রভাবাধীন থাকে।

বুর্জোয়া মতাদর্শের এই সর্বগ্রাসী আচরন কাজ করে অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থাতে। যে পরিমানে এই স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হয়, সেই পরিমানে শোষিত মানুষ, শ্রমিকশ্রেনির একটা অংশ নিজেদের এই বুর্জোয়া মতাদর্শের নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্ত করতে থাকে। তাই গোঁড়ার দিকে শ্রেণী সংগ্রামের পাশাপাশি চলতে থাকে দুই শত্রুমূলক মতাদরশের লড়াই। এই মতাদর্শ সংগ্রামের ফলেও শ্রেণীসংগ্রাম তীব্র হয়, যার মধ্যে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর চেতনাও বিকশিত হতে থাকে। 

শ্রমিক শ্রেণীর এই যে রাজনৈতিক শ্রেণী চেতনার জন্ম হয় টা অসম ও ধারাবাহিকতা বর্জিত, যে কথা আগেও বলা হয়ছে। এই শ্রেণী সচেতনতাই একমাত্র উপাদান জা বিপ্লবী শ্রেণীকে তার অইতিহাসিক কর্তব্য ও লড়াইয়ের প্রকৃত লক্ষ্যের চেতনায় তুলে আনে। শুধুমাত্র বিপ্লবী পরিস্থিতিতেই শোষিত শ্রেণীর বৃহত্তম অংশ নিজেদের বুর্জোয়া মতাদর্শ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারে। একমাত্র তখনই পুরোপুরি বিকশিত হয় শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক চেতনা। অন্যভাবে বললে যার অর্থ হল, চেতনার যে বিকাশ বিপ্লবের অনেক আগেই শুরু হয়েছে টা বিপ্লবের সময় পূর্ণতা পায়।

বিষয়ীগত শর্তের স্তরভেদ

বিপ্লবী রাজনৈতিক শ্রেণী চেতনার বিকাশের প্রক্রিয়ায় আমরা তিনটে সক্রিয় বিভাগ দেখি – 

এক) শ্রেণী হিসেবে শ্রমিকদের ব্যাপক অংশ যারা এখনও বুর্জোয়া মতাদর্শ থেকে মুক্ত হয়ে সমাজ বদলের লড়াইয়ে তার ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পরকে উদাসীন।

দুই) শ্রমিক শ্রেণীর একটা অংশ যারা শুধুই বিক্ষিপ্ত শ্রমিক আন্দলনে অংশ নেয় না, বরং ধারাবাহিকতার সাথে লড়াইয়ের ময়দানে থাকে এবং প্রাথমিক ধাপের সঙ্গথনের মধ্যে সংগঠিত হয়। এরা শ্রমিকশ্রেনীর অগ্রনি অংশ অথবা অগ্রনী শ্রমিক।

তিন) শ্রমিক শ্রেণী ও অন্যান্য শ্রেণীর ছোট অংশ নিয়ে তৈরি বিপ্লবী সংগঠন যার সদস্যরা শ্রেণী সংগ্রামে বিপ্লবী লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য নিয়ে অংশ নেয়, এরা বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ বা মারকসবাদের শিক্ষায় আংসিকভাবে হলেও শিক্ষিত।

প্রথম বিভাগঃ বুর্জোয়া অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অবস্থানের দিক থেকে জাদের আমরা শ্রমিকশ্রেনী বলি, তাদের বৃহত্তম অংশটাই এই প্রথম বিভাগের অন্তর্গত। শ্রেণী সচেতনার মান নিরপেক্ষভাবে, এরাই বিপ্লবের শক্তি যারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। এই অংশের শ্রমিক তারা, যারা তখনও পর্যন্ত নিজের শ্রেণী স্বার্থ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতা অর্জন করে উঠতে পারে নি। এই অংশের শ্রমিকদের চেতনার বিকাশ হয় শুধুমাত্র শ্রেণী কার্যক্রম বা শ্রেণী সংগ্রামে অংশ নেওার মধ্যে দিয়ে।অন্য আর কোন উপায়ই টা সম্ভব নয়। কিন্তু এই চেতনা শুধুমাত্র শ্রেনিগত চেতনা। টা সাধারনভাবে বিপ্লবী চেতনা নয়। একমাত্র ইতিহাসের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাপ্রবাহে তাৎক্ষনিক ভাবে এই বিরাট অংশের শ্রমিকদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটে। বিক্ষিপ্তভাবে ঘটা এই ঘটনায় লাখে লাখে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করে। বিংশ শতাব্দী জুড়ে দেশে দেশে এরকম বিপ্লবী আন্দোলনের অসংখ্য উদাহরন রয়েছে। বস্তুতঃ গত একশো বছরে খুব কম বছর রয়েছে যখন কথাও না কথাও শ্রমিকশ্রেনির বিপ্লবী লড়াইগুলোতে স্বতঃস্ফূর্ততার সীমিত, কিন্তু শক্তিশালি উপাদান থাকে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমস্ত অরথে উপজুক্ত কোনও বিপ্লবী দলও উপস্থিত ছিল না।

দ্বিতীয় বিভাগঃ শ্রমিকশ্রেনী আর তাদের চেতনা অবশ্যম্ভাবী রুপে বিভিন্ন স্থরে বিভক্ত। সেই কারনেই এই বিভাগের শ্রমিক অর্থাৎ শ্রমিকদের উদ্ভব হয়। শ্রমিকশ্রেনীর বৃহত্তম অংশের মধ্যে একদিকে অসম ও পরিবর্তনশীল শ্রেণী চেতনার বিকাশ হয়, অন্যদিকে শ্রেণীসংগ্রামে তসদের অংশগ্রহণও হয় অসম, বিক্ষিপ্ত এবং অস্থায়ী। শ্রমিকশ্রেনী কখনই স্থায়ীভাবে শ্রেনিসংরামে ব্যপ্ত থাকে না অথবা স্থায়ীভাবে শ্রেণী চেতনার উচ্চতম স্তরে অবস্থান করে না। শ্রমিকরা প্রতিদিন ধর্মঘট করে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সেটা অসম্ভব। প্রতিদিন ধর্মঘট করলে তাদের না খেয়ে মরতে হবে। শ্রেণী কার্যক্রম ও শ্রেণী চেতনার একটা ওপরের স্তরে থাকার কিছু সময়কাল অবধারিত ভাবেই একটা অবস্ত্যহা আসে যখন শ্রেণী চেতনা নিম্নমুখী হয় আর শ্রেণী কার্যক্রম সম্পূর্ণ তলানিতে এসে ঠেকে। কিন্তু এমনকি প্রাথমিক স্তরের শ্রেণী সংগ্রামও চেতনা বা অভিজ্ঞতার কিছু অবশেষ রেখে যায়। চেতনা বা অভিজ্ঞতার এই অবশেষ এক ধরণের স্থায়ী সংগঠনের মধ্যে দানা বাধে বা কেলাসিত হয়। লড়াইয়ে মুহূর্তে অধিকাংশ শ্রমিকই সক্রিয় থাকে। কিন্তু লড়াই থাম্লে দ্রুত তারা ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে যায়। কিন্তু এই শ্রমিকদের একটা ছোট অংশ লড়াই থেমে গেলেও, লড়াইয়ের ময়দান ছারে না। তাদের সক্রিয়তা বজায় থাকে। তারা ধারাবাহিকতা ইউনিয়নের কাজ, প্রকাশনার কাজ ইত্যাদি চালিয়ে যায়।  এক ধরণের স্থায়িত্বের এবং সচেতনতার উপাদান হিসেবে তারা সংগঠিত হয়ে ঠেকে যায়। এরাই অগ্রনী শ্রমীক বা শ্রমিক শ্রেনীর অগ্রণী অংশ। অগ্রণী শ্রমিকরা জানে যে জয় কে রোখা করা, পরাজয় ঠেকে পুনরুদ্ধার পাওয়া এবং আক্রমনের হাথ ঠেকে রক্ষা পেতে ইউনিয়ন তৈরি করা, ইউনিয়ন রক্ষা করা, ইউনিয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া, সর্বোপরি সংগঠিত থাকা কত জরুরী।

এই অগ্রনী শ্রমিকরা কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষার কাজটা করে লড়াইয়ের ময়দানে অরজিত বাস্তবজ্ঞানের কারণে। তত্ত্বগত বিশ্লেষণ, বিজ্ঞানসম্মত পরজালচনা এবং মধাগত অনুশীলনের ভূমিকা এক্ষেত্রে বরং কম। লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে গড়ে অথা তাদের চেতনা মুলতঃ অভিজ্ঞতা নির্ভর ও বাস্তববাদী। তাদের এই চেতনা নিশ্চিত ভাবে শ্রমিকশ্রেনীর সার্বিক শ্রেণী কার্যক্রমকে কিছু পরিমানে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু তত্ত্বগত বিশ্লেষণ বা বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা প্রসুত চেতনার কার্যকরীতার তুলনায় সেটা অনেকটাই নিম্নস্তরের।

তৃতীয় বিভাগঃ এই বিভাগের অন্তর্গত বিপ্লবীরা তারাই যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও মারকসবাদের শিক্ষায় কিছু পরিমান শিক্ষিত এবং বিপ্লবী দিশা নিয়েই শ্রেণী সংগ্রাম ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে অংসগ্রহন করে। কোনো যৌথ কার্যক্রম নয় বরং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাতেই মার্কসবাদকে আয়ত্ত করা সম্ভব। স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যে দিয়ে মারকসবাদের সুবিশাল জ্ঞান ও তথ্যভান্দার এবং প্রয়োগ পদ্ধত্তিকে আয়ত্ত করা বিরাট অংশের শ্রমজিবি মানুষের পক্ষে বাস্তবিক কারনেই সম্ভব নয়। শ্রমিক শ্রেণীর চেতনার সর্বচ্চো রুপ মারকসবাদ। শ্রমিক শ্রেণীর সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি সম্পন্নএবং সবথেকে বেশি সংগ্রামী সদস্যরা এই সর্বচ্চ রুপকে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধিনভাবে এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার আয়ত্ত করতে পারে।

সমস্ত কর্মকাণ্ডে বিপ্লবী দিশার দ্বারা পরিচালিত হওার ফলে বিপ্লবীরা সবসময় চেষ্টা করে শ্রমিকশ্রেনির শ্রেনী কার্যক্রম, সংগ্রামের প্রবণতা ও শ্রেণী চেতনার ক্ষেত্রে অসমতা, খণ্ডতা এবং ধারাবাহিকতার অভাবকে দূর করতে বা কাটিয়ে উঠতে। শ্রমিকশ্রেনী যদি স্থায়ীভাবে সর্বচ্চো চেতনা নিয়ে শ্রেণী সংগ্রাম থাকত তাহলে এই বিপ্লবী অগ্রনীদের প্রয়োজন থাকত না। বিপ্লবিদের অগ্রণীরা সেই অভাবটাই পুরন করে, শ্রমিক আন্দোলনে সর্বচ্চো শ্রেণী চেতনার স্থায়ীরুপ হিসেবে। সবচেয়ে বেশী সংগ্রামী ও নিরবিচ্ছিন্ন রুপ হিসেবে এই অগ্রণী বিপ্লবীরা অবস্থান করে। শ্রেণী চেতনা ও শ্রেণীসংগ্রাম-এর নিম্নগামিতার পর্যায় এই অগ্রণী বিপ্লবিরাই বিগত পর্যায়ের শ্রেণী চেতনা ও শ্রেণী কার্যক্রমের অর্জিত তাত্ত্বিক, কর্মসূচীগত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক লাভ, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। অর্থাৎ সাধারন অর্থে অগ্রণী বিপ্লবীরা প্রথম যে কাজটা করে তা হল, পুঞ্জীভূত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা, বিগত প্রায়ে পৌনে দুশ বছরের প্রকৃত শ্রেণী সংগ্রাম, প্রকৃত বিপ্লব, প্রকৃত প্রতিবিপ্লবের অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষার ধারাবাহিকতাকে সুনিশ্চিত করে, যাতে তা হারিয়ে না যায়ে। এই সমস্ত শিক্ষার মোট যোগফলই সমাজতন্ত্রের কর্মসূচী। খুব কম মানুষই এই বিসাল বিষয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে এবং কেউই একা একা এর সঙ্গে তাল রক্ষা করতে পারে না। সেকারনেই প্রয়োজন সংগঠনের, অগ্রণী বিপ্লবীদের সংগঠন। এই অভিজ্ঞতাগুলোর বিশ্বায়িত চরিত্রের ফলে সংগঠনকে দেশীয় স্তরের বাইরেও বিশ্বাব্যপী হতে হবে।এরকম একটা বিশ্ব সংগঠনের পক্ষেই সম্ভব নিরবচ্ছিন্নভাবে ঐতিহাসিক ও বর্তমান সংগ্রামের অভিজ্ঞতাগুলোকে মুল্যায়ন করে যাওয়া, নতুন সংগ্রামের শিক্ষাগুলো দিয়ে তাকে সমৃদ্ধ করা এবং চলমান ও আগামি সংগ্রামগুলোর জন্য তাকে উপযুক্ত করে তোলা।

সাধারন তাত্ত্বিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে গড়ে অথা বিপ্লবী অগ্রণী সংগঠন তার উন্নয়ন চেতনাকে সমৃদ্ধ ও বাস্তবিকই কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করতে পারে তখনই, যখন সে শ্রেনীসংগ্রামের সঙ্গে ভিতর থেকে দীর্ঘমেয়াদি, স্থায়ী এবং গভীর সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ যখন সেই সংগঠন তার তাত্ত্বিক কাজের সথিকতা অনুশীলনের আতস কাঁচের মধ্যে দিয়ে মুল্যায়ন করতে পারে এবং তত্ত্ব ও প্রয়গের ঐক্য ঘটাতে পারে। মার্কসবাদের শিক্ষা হল, অনুশীলনের থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে সঠিক তত্ত্ব উৎপাদন ততটাই অসম্ভব যতটা অসম্ভব ‘বিপ্লবী কর্মকাণ্ড’ যার ভিত বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব নয়। এটা কোনো ভাবেই তাত্ত্বিক বিকাশের অপরিহার্যতা বা তার সর্বচ্চ গুরুত্বকে খোটা করে না। বরং জোর দেয় এই বিষয় যে, শ্রমজীবী মানুষ ও মার্কসবাদী বিপ্লবীরা আলাদা সূচনা বিন্দু থেকে, আলাদা গতি ও উদ্দেশ্য জাত্রা শুরু করে কোন একটা বিন্দুতে ক্রমে তত্ত্ব অনুশীলনের ঐক্য ঘটাতে পারে।

প্রাথমিক স্তরের শ্রেণী সংগ্রাম থেকে শ্রমিকশ্রেনির বিপ্লবী শ্রেণী সংগ্রামের স্তরে উন্নীত হওয়ার এই দীর্ঘ ও স্তরীকৃত প্রক্রিয়া যে তিনটি সক্রিয় বিভাগকে দেখলাম তাদের ভূমিকা আলাদা, আচরণও আলাদা। সেটারই সারাংশ আমারা নিচের চিত্র থেকে বুঝতে চাইব।

শ্রমিকশ্রেনীর বৃহত্তম অংশ

     অনুশীলন

         অভিজ্ঞতা

        চেতনা

অগ্রণী শ্রমিক

        অভিজ্ঞতা

        চেতনা

        অনুশীলন

অগ্রণী বিপ্লবী

        চেতনা

       অনুশীলন

        অভিজ্ঞতা


চলমান শ্রেণী সংগ্রামের বিভিন্ন স্তরে তাদের চেতনার মানের ওপর নিরভর করে শ্রমিকশ্রেনী বিভিন্ন ধরেনের নিজস্ব- সংগঠনের মধ্য নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। শ্রমিকশ্রেনীর সবচেয়ে প্রাথমিক ধরনেরে নিজস্ব- সংগঠন হল তার ট্রেড ইউনিয়ন। এই ট্রেড ইউনিয়ন তাদের অর্থনৈতিক দাবী দেওার আকাংখাকে পুরন করে। যে যে ভাবে শ্রমিকদের চাহিদা অর্থনৈতিক বিষয় থেকে রাজনৈতিক বিষয়ের দিকে এগোতে থাকে, সেই অনুযায়ী শ্রমিকরা গন রাজনৈতিক সংগঠন গুলোতে সংগঠিত হতে থাকে। এটা তাদের চেতনার বিকাশের ওপর ও নির্ভরশীল। বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক দলে শ্রমিকরা জড়ো হয়, যেমন বুর্জোয়া শ্রমিকদল, স্বাধীন শ্রমিকদল, বিপ্লবী শ্রমিকদল ইত্যাদি। চেতনার বিকাশের সর্বচ্চ পর্যায়ে যখন শ্রমিকশ্রেনী শ্রেণী হিসেবে তার রাজনৈতিক খমতার প্রয়োগ করার প্রয়োজন অনুভব করে তারা ওয়ার্কার্স কাউন্সিল জাতীয় নিজস্ব- সংগঠন তৈরি করে। এই ঘটনা তখনই ঘটে যখন বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি, প্রয়োজন হয় পুরনো সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করার, সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তন করার। শ্রমিকশ্রেনির বিভিন্ন স্তরে চেতনার বিকাশের এটাও এক ধরণের বহিঃপ্রকাশ। বিকাশের প্রত্যেক স্তরই আমরা শ্রমিকশ্রেনীর মধ্যে থেকেই ছেঁকে একদল নেতৃত্বদ্বায়ি শ্রমিককে উঠে আস্তে দেখি। এদের কথা আগেও আলোচনা করেছি আমরা। এরা অগ্রণী শ্রমিক। তারা শ্রমিকশ্রেনীর স্বাভাবিক নেতৃত্ব যারা সমস্ত কর্মক্ষেত্রেই উপস্থিত থাকে। এমনকি একটা দাবিপত্র পেশ করার জন্যেও নেতৃত্ব প্রয়োজন হয়। শ্রমিকরা জানে তারা কারা, তাদের নেতৃত্ব মেনে ও নেয়। এই অগ্রণী শ্রমিকরাই ধর্মঘট নেতৃত্ব দেয়। সংগ্রামী প্রতিরধ আন্দলন নেতৃত্ব দেয়। শ্রমজীবী আন্দোলনের অগ্রগতির সঙ্গেই শ্রমিক শ্রেণীর নিজস্ব- সংগঠনের প্রত্যেক ওপরের স্তরে এই অগ্রণী শ্রমিকের মাত্রা বাড়তে থাকে । শ্রমজীবীদের আন্দলনের অগ্রগতির বা বিকাশের সর্বোচ্চ রূপেই শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণীর বড় অংশ তাদের নিজেদের অগ্রণী শ্রমিকের পর্যায়ে তুলে আনতে পারে । এই অগ্রণী শ্রমিকরাই ব্যাপক অংশের শ্রমিককে লড়াইয়ের ময়দানে নিয়ে আসতে পারে । তবে কোন ধরণের সংগ্রামে এই ব্যাপক শ্রমিকের সমাবেশ তারা ঘটাতে পারে সেটা নির্ভর করে অগ্রণী শ্রমিকদের চেতনার ওপরে। গোটা সমাজের তাত্ত্বিক,বৌদ্ধিক,বিজ্ঞানসম্মত বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে যতটা না অগ্রণী শ্রমিকরা পরিচালিত হয়,তার চেয়ে অনেক বেশি পরিচালিত হয় লড়াইয়ের মধ্যে অর্জিত বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে। তারা অগ্রণী বিপ্লবীদের প্রত্যয় দিয়েও পরিচালিত হয় না আবার ব্যাপক অংশের শ্রমিকদের মতো স্বতঃস্ফূর্ততা  দিয়েও পরিচালিত হয় না।

শ্রমিকশ্রেণীর স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকান্ড

এই পর্যন্ত আমরা স্বতঃস্ফূর্ততা আর ক্রমবর্ধমান স্বাভাবিক অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণের  একটা পরিস্থিতি নিয়ে চর্চা করলাম। কিন্ত একটা সফল সমাজ বিপ্লবের জন্যে কি এটা যথেষ্ট? অবশ্যই নয়। এই অবস্থা ব্যাপক অংশের শ্রমিক তো বটেই,এমনকি অগ্রণী শ্রমিকদেরও সাধারণ লড়াইয়ে পরের ধাপের কোন দিশা দেখাতে পারে না। শ্রেণী সংগ্রাম বিকাশের সমস্ত পর্যায়েই এই সমস্যাটা দেখা যায় । সমস্ত সফল, আধা সফল,ব্যর্থ,আংশিক লড়াই এই নতুন দ্বন্দের জন্ম দেয়। কল-কারখানা দখল করার পর কি করতে হবে?বারবার এই নির্ণায়ক পরের ধাপ নিতে না পারার ক্ষেত্রে চেতনার অভাব শ্রমিকশ্রেণীকে থামিয়ে দিয়েছে। ১৯২০ জার্মানী,১৯৩৬ ও ১৯৬৮ ফ্রান্স,১৯৪৮ ইটালী সহ আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে।

সাম্প্রতিক অকুপাই অন্দোলনের দিকে আমরা তাকালেও  সমস্যার প্রকৃত রূপটা বুঝতে পারব 0। প্রবল সক্রিয়তা,কর্মশক্তি নিয়ে প্রাণবন্ত সূত্রপাত হলেও এই লড়াই এখনই তার সীমাবদ্ধতাকে প্রকাশ করতে শুরু করেছে।পার্ক,স্কোয়ার,রাস্তা দখল করা অকাট্য বিবৃতি হতে পারে কিন্তু ইতিবাচক কোথাও এনে দাড় করাতে পারে না। শাসকশ্রেণী হয়ত শুরুতেই এই দখলদারদের বলপ্রয়োগ করে উচ্ছেদ করতে পারে না। কিন্তু ততক্ষণ অপেক্ষা করতেই পারে যতক্ষণ না লড়াইয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটছে যখন তারা অনায়াসে এই বিশৃঙ্খলাকে দূর করে দিতে পারে । অকুপাই-এর আন্দলনকারীরা যেমন দাবি করে,সেভাবে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া বিপ্লব উদ্ভাবন করা যায় না। জেনারেল এসেম্বলি থেকে সেটা সীমিত সংখ্যক কিছু কর্মকর্তার অক্ষম বিতর্কসভায় ,স্থায়ী এসেম্বলিতে পর্যবসিত হয়েছে।এরকম একটা ব্যাপার পুঁজিবাদ ব্যবস্থার বিপদের কারণ হতে পারে না,বড় জোর ছোটখাটো অসুবিধার কারণ হতে পারে । এরকম প্রস্তাবও এসেছিল যে বলপ্রয়োগ করে ভেঙে দেবার বদলে ব্যাঙ্কররা,পুঁজিপতিরা নিজেরা গিয়েই বিতর্কে অংশগ্রহণ করবে,বিক্ষুব্ধদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করে বোঝাবে শোষকরা আসলে ততটা খারাপ নয়।এভাবেই প্রতিবাদ আন্দোলগুলো  তাদের বিপ্লবী সত্ত্বা হারিয়ে ধীরে ধীরে সেই সমাজিক ব্যবস্থারই অঙ্গ হয়ে যায়,যেটাকে চ্যালেঞ্জ করে সে যাত্রা শুরু করেছিল।

গ্রীস, স্পেন, চিলির শ্রমজীবিরা আবার 'সমাজতন্ত্রী' নামধারীদের বিশ্বাস করে তাদের নির্বাচিত করেছিল। এটা সেইসব দেশের শ্রমিকদের সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহেরই প্রকাশ। এখন তারাই ওই সরকারগুলোর বিরুদ্ধে লাখে লাখে পথে নেমে বীরত্বের সাথে লড়াই করছে। তার ঠিক করেছে যে তারা তাদের স্বার্থ রাজনীতিবিদদের ভরসায় আর ছেড়ে রাখব না,নিজেরাই রক্ষা করবে। এটা অবশ্যই একটা সঠিক বিপ্লবী ভাবনা । যারা এই লড়াইগুলোকে শুধুমাত্র স্বতঃস্ফূর্ততা বলে অবজ্ঞা করছে,তারা প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবের   অর্থ সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতারই প্রকাশ করছে। রাজনীতিতে ব্যাপকতম  অংশের মানুষের হস্তক্ষেপই বিপ্লবের সারমর্ম।এটাই বিপ্লবের আসল শক্তি। কিন্তু ওই দেশগুলোতে বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই কম।অন্ততঃ  তাই মনে হচ্ছে। কারণ শুধুই স্বতঃস্ফূর্ততা দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয় না। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব একটা সামগ্রিক অর্থে একটা সচেতন প্রয়াস।

বিপ্লবের কর্মসূচী 

এইখানেই বিপ্লবের কর্মসূচী, শ্রমিকশ্রেণী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার রণনীতি, উত্তরণকালীন দাবীসমূহের ভুমিকা ও কার্যকারীতা। কর্মসূচি একটা তাত্ত্বিক উৎপাদন। আধুনিক বিপ্লবের ইতিহাসের চারশো বছর,শ্রমিক অন্দোলনের ইতিহাসের প্রায় পৌনে দুশো বছর এবং বর্তমান অভিজ্ঞতাকে মার্কসীয় পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করে কর্মসূচী তৈরী হয়। নতুন প্রজন্মের শ্রমিক অন্দোলনকে শিক্ষিত করতে, সঠিক দিশা দিতে এই কর্মসূচীর কোনও বিকল্প নেই।শ্রেণীসংগ্রামে সুনির্দিষ্ট ভাবে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে, তাকে সঠিক অভিমুখ দিতে এই কর্মসূচী প্রয়োজন। যাতে এখনকার শ্রেণীসংগ্রামকে নতুন করে শুরু করতে না হয়, সঠিক শিক্ষা অর্জন করতে বারবার পুরোন ভুলের মধ্যে যেতে না হয়। জীবন্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে কি নতুনভাবে বিপ্লবী রাজনীতির উদ্ভাবন করা যায় না?নিশ্চয় যায় ।কিন্তু তার জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। বিপ্লবী পরিস্থিতি খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাই উদ্ভাবন করতে গিয়ে খেসারত দিতে হয় অনেক বেশী। এই  তত্ত্বের যারা প্রচারক তারা আসলে একটি শিশুকে তার শৈশাবাবস্থাতেই রেখে দিতে চায়।

আগেই বলেছি, কয়েক শতাব্দীর বিপ্লবের অভিজ্ঞতার যে বিশাল ভান্ডার,তার শিক্ষাকে মার্ক্সীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করে,সুনির্দিষ্ট অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচী রচনা সম্ভব একমাত্র একটা সংগঠনের পক্ষেই যেটা মার্ক্সীয় পদ্ধতি সঠিকভাবে প্রয়োগে সক্ষম এবং অবশ্যই যার ব্যাপ্তি হবে আন্তর্জাতিক স্তরে। সেটা অগ্রণী বিপ্লবীদের সংগঠন। এতদূর এসেও কিন্তু এই  সংগঠনকে অগ্রণী বিপ্লবীদের দল বা অগ্রণী দল বলা যায় না।এই অগ্রণী সংগঠন এই কাজ করার জন্য এক অপরিহার্য হাতিয়ার। কিন্তু এই হাতিয়ার শুধু তার কাজটুকুই করবে। কোনভাবেই শ্রেণীশ্রেণীর ওপর ঐতিহাসিক ভাবে বর্তানো দায়িত্ব এই সংগঠন পালন করতে পারে না।এই সংগঠন কোনভাবেই শ্রমিকশ্রেণীকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না।সঠিক বিপ্লবী কর্মসূচীকে  যে সংগঠন সঠিকভাবে দক্ষতার সাথে কার্যকর করতে পারে,শ্রেণী-সংগ্রামে সেই সংগঠনই নির্ণায়ক সুবিধা ভোগ করে। কর্মসূচীর সঠিক প্রয়োগ আসলে সমস্ত ভিন্ন পরিস্থিতির নিজস্বতার যে অসংখ্য শর্তাবলী থাকে তাকে যুক্ত করতে পারার পারদর্শীতা। উপরন্তু বহু নতুন ঘটনা  ঘটে যার বৈশিষ্ট্যগুলোকে আয়ত্ত্ব করে,মূল্যায়ন করে কর্মসূচীর অঙ্গ করতে পারার দক্ষতা থাকা প্রয়োজন।সে কারণেই অগ্রণী সংগঠনের সাথে শ্রমিকশ্রেণীর সম্পর্ক শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের চেয়েও অনেক জটিল।অগ্রণী সংগঠনকে প্রতিমুহূর্তে শিখতে হয় আর অগ্রণীদের শিক্ষা সঠিক হতে পারে শুধুমাত্র শ্রমিকশ্রেণী ও তার ভিতরে থেকে শ্রেণীসংগ্রামে অংশ নিয়েই কারণ সেখানেই নতুন পরিস্থিতিগুলোর সৃষ্টি হয়ে চলেছে,নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়ে চলেছে । দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামে অগ্রণী বিপ্লবীরা মানুষের থেকে, শ্রেণীসংগ্রাম থেকে যে পরিমাণ শিক্ষা অর্জন করে, সেই পরিমাণে রাজনৈতিক দিশা সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিতও করে। এর থেকে এ জাতীয় কোনও সুবিধাবাদী অবস্থান নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে একটা নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমজীবিদের অধিকাংশের ভাবনা বা বিশ্বাসের সাথে মানিয়ে নেবে অগ্রণীরা।অধিকাংশের ভাবনা বা বিশ্বাসেরও পরিবর্তন হয় এবং কখনো সেটা হয় অত্যন্ত দ্রুততার সাথে।

এই সমস্ত রাজনৈতিক এবং তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে যদি সমস্ত ধরণের বিধিবদ্ধ,গঠনতান্ত্রিক, বস্তুগত ও প্রায়োগিক রক্ষাকবচ দিয়ে টিকিয়ে না রাখা যায় তাহলে আমলাতান্ত্রিক বিচ্যুতির দীর্ঘ মেয়াদী কোন সমাধান নেই। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার উল্লেখ করব।শ্রমজীবীদের সমস্ত সংগঠনের সমস্ত স্তরে,এমনকি ভবিষ্যত শ্রমিক রাষ্ট্রের সমস্ত আইনি,প্রশাসনিক,রাজনৈতিক সংগঠনের সমস্ত স্তরে শ্রমজীবি মানুষের নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্যকে বাধ্যতামূলক ভাবে সুনিশ্চিত করতে হবে।

অগ্রণী বিপ্লবী সংগঠন ও বিপ্লবের বিষয়,অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণীর বৃহত্তম অংশের মধ্যে যে দ্বন্ধপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তার থেকে মূলত দুই ধরণের প্রধান বিচ্যুতি দেখা যায়। সংস্কারবাদী,সুবিধাবাদীদের কাছে বিপ্লবের বিষয় হল 'প্রতিদিনের শ্রমিক'। শ্রমিকশ্রেণী মধ্যেকার ওই মনোভাব বা আচরণকে অলংকৃত করে সুবিধাবাদীর তাদের পশ্চাদপদতাকেই আরাধ্য করে তোলে। তাদের কাছে, 'মানুষ সবসময় সঠিক'। যদি মানুষ বিশুদ্ধ ট্রেড ইউনিয়নবাদী বা উগ্র দেশপ্রেমী মনোভাবের দ্বারা মোহগ্রস্ত থাকে তাহলেও। কিন্তু মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন হয় এবং কখনো তা বিপরীতমুখীও হয়। আজ হয়ত তারা মালিকপক্ষের সাথে নেতৃত্বের দহরম-মহরমকে মেনে নিচ্ছে, কিন্তু পরেই হয়তো ব্যাপকতম ধর্মঘটের রাস্তায় নেমে পড়বে । সুবিধাবাদীরা তখন মানুষের বিরূদ্ধেই প্রতিরোধ খাঁড়া করে। তখন তাদের অজুহাত হয় যে মানুষ ভুল করছে এবং দ্রুতই তারা ফিরে আসবে তাদের পুরোন জীবনে। অনেক সময়েই বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তারা তাদের তত্ত্বের সঠিকতার প্রমাণ দেবার চেষ্টাও করে।

সংকীর্ণতাবাদীদের কাছে বিপ্লবের বিষয় একমাত্র 'আদর্শ শ্রমিক' যে একজন বিপ্লবী মতো আচরণ করবে। শ্রমিকরা যদি তেমন আচরণ না করে তবে তারা আর বিপ্লবের বিষয় থাকেনা, বুর্জোয়া বা শ্রেণীশত্রুতে অধ:পতিত হয়। কিন্তু ব্যাপক শ্রমিক যখন সংগ্রামী  মানসিকতা নিয়ে লড়াইতে নামে, এই সমস্ত সংকীর্ণতাবাদী নেতৃত্ব বা সংগঠনের মুখাপেক্ষী না হয়েই তখন সংকীর্ণতাবাদী নেতৃত্ব বা সংগঠন-রা নিজেদের নি:সঙ্গতাকেই আবিষ্কার করে এবং ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে না। তখন তাদের অজুহাত হয় বিপ্লবী গোষ্ঠীর আয়তনের অতি ক্ষুদ্রতা। উদ্দেশ্যের দিক থেকে বিপ্লবী গণসংগ্রামে ব্যাপক জনগণ পরস্পবিরোধী চেতনা নিয়েই অংশগ্রহণ করে। এই সত্যকে অস্বীকার করে শেষ বিচারে চরম বিষয়বাদী আর চরম বিষয়বাদীরা একই বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। শ্রমিক অন্দোলনের রাজনীতিতে এই দুই ঝোঁককে বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। এই দুটোই পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিমূলক ঝোঁক। সুবিধাবাদীরা গণসংগঠনের এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যেকার শ্রমিক আমলাতেন্ত্রর প্রতিনিধিত্ব করে।অন্যদিকে সংকীর্ণতাবাদীরা শ্রেণীচ্যুত বুদ্ধিজীবি যারা প্রকৃত সংগ্রামে না থেকে সাইডলাইনে বসে থাকে । অনুশীলন ও তত্ত্বের মধ্যেকার বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে মাননসই হয় পরস্পরবিরোধী কিন্তু অখণ্ড শ্রেণীর বস্তুগত ও চিন্তাগত বিচ্ছিন্নতার যা সুবিধাবাদী অনুশীলন এবং বাস্তববর্জিত তত্ত্বের সচেতনতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়।

কর্মসূচীর একটা সাংগঠনিক দিকও রয়েছে, যদিও সেটা পুরোপুরি সাংগঠনিক নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক। আমরা কেন্দ্রীকতার প্রসঙ্গে আলোচনা করব। প্রাথমিক অর্থে এই কেন্দ্রিকতা সাংগঠনিক নয়,প্রশাসনিক তো নয়ই। এই কেন্দ্রিকতা আসলে অভিজ্ঞতার কেন্দ্রিকতা,অর্জিত জ্ঞানের কেন্দ্রীকতা, প্রকৃত শ্রেণীসংগ্রামের শিক্ষার কেন্দ্রীকতা। এই কেন্দ্রিকতা না থাকাটা অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণী বা শ্রমিক অন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকর কারণ, সেটা না হলে শ্রমিক আন্দোলনের ভারসাম্য বিশেষ অংশের অভিজ্ঞতার শিকার হতে পারে, খণ্ডিত হবার বিপদ আসতে পারে । ছাত্র, মহিলা, শ্রমিক, নিপীড়িত জাতির মানুষ, ভিনদেশে চলে যাওয়া শ্রমিক, বেকার, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মী সবাই তাদের নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে, নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে লড়াই সংগ্রাম করছে। প্রত্যেকে যদি আলাদাভাবে লড়াই করে এবং সেটাই সাধারণত হয়ে  থাকে, তাহলে প্রত্যেকে শুধু নিজেদের ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতাই অর্জন করবে। সামগ্রিকতার নিরিখে আলাদাভাবে কেউই সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারবে না। অর্জিত হবে খণ্ডিত লড়াই,খণ্ডিত অভিজ্ঞতা, খণ্ডিত আংশিক সচেতনতা। তার শুধু সমগ্রের অংশই দেখতে পাবে। ফলে তাদের সিদ্ধান্ত অবধারিতভাবে আংশিক ভুলের স্বীকার হবে কারণ তারা সমগ্র বাস্তবতার অংশমাত্র থেকেই তাদের শিক্ষা গ্রহণ করে । একই ঘটনা ভৌগলিক প্রশ্নেও আসে। পূর্ব ইউরোপের শ্রমিকের শিক্ষা, পশ্চিম ইউরোপের শ্রমিকের থেকে আলাদা হবে। যেমনভাবে ল্যাটিন আমেরিকার শ্রমিকদের অভিজ্ঞতার সাথে সাযুজ্য থাকবে না উত্তর আমেরিকার শ্রমিকের, ভারতের শ্রমিকের সমস্যা চীন, জাপানের শ্রমিকের পক্ষে বোঝা বেশ কঠিন হবে। একমাত্র সঠিক বিপ্লবী কর্মসূচী পারে এই সমস্ত অভিজ্ঞতা কেন্দ্রীকরণ সাধারণীকরণ করতে, তাদের আংশিক লড়াইয়ের তুল্য মুল্য বিচার করতে, উপজুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে, কর্মসূচীর ও রাজনৈতিক লাইনের প্রত্যেক বিষয়ের শর্তযুক্ত মুল্যায়ন-পুনরমুল্যায়ন করতে। এভাবেই পাওয়া যেতে পারে সমাজ ও দুনিয়ার একটা সামগ্রিক প্রকৃত চিত্র ও তাদের গতিপ্রকৃতি, সাধারন সমাজতান্ত্রিক দিশা ও সেটাকে অর্জন করার নীতি, কৌশল এবং উত্তরনকালীন দাবিসমুহ। একেই আমরা বলি সঠিক কর্মসূচী, সঠিক স্ট্রাটেজি।

এটা তাদের পক্ষেই করা সম্ভব যারা নিজেদের বাছাই করা সেরা উৎকর্ষের অংশ বলে মনে করে এই কারণে যে তারা বিপ্লবী দিশা নিয়ে গণআন্দোলন স্থায়ীভাবে এবং ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় থাকে। তাদের দাবির সঠিকটা বাস্তবের মধ্যে দিয়েও প্রমানিত হয়। জাদের এই গুন নেই তারাও তাদের অস্থায়িত্ব, অধারাবাহিকতা, শ্রেনিসংরামে সমস্ত রুপের মধ্যে গভিরভাবে একীভূত হবার ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে প্রমান করে দেয়। ব্যপক অংশের শ্রমজীবী যখন লড়াই সংগ্রামে থাকে না তখনও এই সেরা অংশের বিপ্লবীরা লড়াই ও চেতনা বৃদ্ধির কাজ, রাজনিতি ও তত্ত্ব সৃষ্টির কাজ চালিয়ে যায়। তারাই সংগঠিত হয় অগ্রণী বিপ্লবী সংগঠনে। কিন্তু এই অগ্রণী সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের সংগঠনকে বিপ্লবী দল বলে দাবী করলেই তা বিপ্লবী দল হয় না। কারন শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী দল স্বঘোষিত হয় না, যদি না প্রকৃত শ্রেণীর, গরিব কৃষকদের, বিপ্লবী ছাত্র, মহিলাদের, শোষিত জাতির মানুষের, অত্যাচারিতা সংখ্যালঘুদের, নিম্নবর্ণের মানুসদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সেটা মনে না করে অথবা বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দিশায় সচেতনভাবে অংশ না নেয়। ততক্ষণ পর্যন্ত এই অগ্রণী সংগঠন বড়জোর ভবিষ্যৎ বিপ্লবীদলের একটা নিউক্লিয়াস বা নিউক্লিয়াস অংশ হতে পারে অথবা এই সংগঠনের অগ্রণী বিপ্লবীদের চেতনায় বিপ্লবী দল হয়ে থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এও দেখা যায় এই বিপ্লবীরা গ্রহন করতে অক্ষম ব্যপক মানুষের ওপর জোর করেই তাদের অগ্রণী দল হওয়ার অধিকার চাপিয়ে দেয়।

বিপ্লবী অগ্রণী দল ও শ্রমিকশ্রেনীঃ আন্তঃসম্পর্ক

সবশেষে সারসংক্ষেপ করলে যা দারায় তা হল বিপ্লবের অগ্রণী সংগঠনের সঙ্গে অগ্রণী শ্রমিক ও অন্যান্য অগ্রণী অংশের মানুষের চেতনাগত ঐক্যের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী দল তৈরি হয়। প্রাক বিপ্লবী অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন, যখন মানুষের বিরাট অংশের অনুশিলনে আকাঙ্খা মিলিত হয় অগ্রণী শ্রমিকদের অনুশীলন পদ্ধতির সঙ্গে। বিপ্লবী পরিস্থিতি, অর্থাৎ বিপ্লবী শ্রেণীর ক্ষমতা দখলের অবস্থা তৈরি হয় তখন, যখন অগ্রণী শ্রমিক আর জনগণের অনুশীলনের সঙ্গে অগ্রণী শ্রমিক আর বিপ্লবীদের চেতনার ঐক্যর পর্বটা সম্পূর্ণ হয়।

আগের চিত্রটাকে পূর্ণগঠন করে দেখা যাক কি দাঁড়ায়ঃ 

শ্রমিকশ্রেনীর বৃহত্তম অংশ

     অনুশীলন

         অভিজ্ঞতা

        চেতনা

অগ্রণী শ্রমিক

        চেতনা

        অনুশীলন

        অভিজ্ঞতা

অগ্রণী বিপ্লবী

        অভিজ্ঞতা

       চেতনা

        অনুশীলন


পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কটের মধ্যে থেকে তৈরি হওয়া সাময়িক দাবীর ভিত্তিতে প্রাথমিক স্তরের শ্রেণীসংগ্রামের সুত্রপাত হয়। সমস্ত গণসংগ্রামের শুরু এইভাবেই হয়। প্রাথমিক স্তরের এই শ্রেণীসংগ্রামের বিপ্লবী সংগ্রামে উত্তরণ শুধুমাত্র একটি পরিমাণগত নয়, গুণগত উত্তরণও বটে। গণ সংগ্রামের মধ্যে অগ্রণী অংশের শ্রমিকের যথেষ্ট উপস্থিতি এর জন্য একান্ত প্রয়োজন। কারণ তারাই একমাত্র ব্যাপক অংশের মানুষকে সংগ্রামের ময়দানে টেনে আনতে পারে। উপরের চিত্র থেকে বোঝা যায় যে, অগ্রণী শ্রমিকরা অনুশীলনে আসে অনেক বেশী বিবেচনা করে, ভেবে চিন্তে। তাদের চেতনার বিকাশই তাদের দ্বিধা দ্বন্দ্বকে কাটাতে পারে। সেই কাজে তাদের নিয়ে আসার পূর্ব শর্ত হল বিষয়গত অবস্থার নিরিখে, বিষয়ীগত চাহিদার ভিত্তিতে উত্তরণকালীন দাবীর ভিত্তিতে তৈরি কর্মসূচী, যা একটা বিপ্লবী সংগঠনই তৈরি করতে পারে। এই সমস্ত শর্তকে সঠিকভাবে মেলাতে পারলেই সম্ভব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সাফল্যের জায়গায় নিয়ে আসা।

[মতাদর্শগত কর্ষণের উদ্দেশ্যে পুনঃ প্রকাশিত। লেখকের মতামত তাঁর একান্ত নিজস্ব।]

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views