ফেলুন কড়ি, কিনুন তেল!
রূপক গায়েন
আমার এই প্রতিবেদন হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু আমাদের জীবনের অগ্ৰগতিই হোক বা দেশের অর্থনৈথিক অধঃগতি - যে কোন ধরনের গতিই যে তেলের উপর নির্ভরশীল, সেই পেট্রোল-ডিজেলের প্রসঙ্গটা কিভাবে এড়িয়ে যাই বলুন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের দর বাড়িয়ে চলেছে পেট্রোল-ডিজেল। তবে অনেকে বলছেন যে বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েলের দাম বাড়ছে সেটাই কারণ এই মূল্যবৃদ্ধির, যা অর্ধসত্য। অবশ্যই ক্রুড অয়েলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৪-১৫ সালে এই দাম ছিল ব্যারেল প্রতি প্রায় $৪৬, যা বর্তমানে ব্যারেল প্রতি প্রায় $৬৬; ৪৪% দাম বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে ২০১৪ সালে লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম প্রায় ₹৫৮ ছিল, আর আজকের দিনে কোলকাতায় এক লিটার পেট্রোল প্রায় ₹৯৮, অর্থাৎ ৪৪% ক্রুড অয়েলের দাম বৃদ্ধির সাপেক্ষে প্রায় ৬৭% তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। আবার ডিজেলের দাম প্রায় ₹৪৮ থেকে বর্তমানে প্রায় ₹৯১ হয়েছে; দাম বৃদ্ধি ৮৯%। পেট্রোপণ্যের রিফাইনিং প্রসেসের জন্য কিছু দাম বৃদ্ধি ধরলেও বর্তমান দাম যথেষ্ট বেশি। অর্থাৎ কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ট্যাক্স এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে। কেন্দ্রের সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি, IGST, CGST, কাস্টমস ডিউটি এবং রাজ্য সরকারের ক্ষেত্রে GST, VAT, অক্ট্রোই, এন্ট্রি ট্যাক্স। লক্ষণীয় যে ২০১৪ থেকে ২০২০-তে পেট্রোপণ্যের ব্যবহার বেড়েছে মোটে ২৯%, অথচ রাজকোষের ভাঁড়ারে কেন্দ্র সরকারের আয় ১২৫% বেড়েছে, রাজ্য সরকারগুলির ক্ষেত্রে তা ৩৭.৫%, অর্থাৎ ট্যাক্সের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিই উভয় সরকারেরই আয় এবং পেট্রো পণ্যের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ; তাও একদিন ই-স্কুটি চালিয়ে নবান্নে গিয়ে ফুটেজ খায় কেউ কেউ। ২০১৪ থেকে ২০২১-এ সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি বেড়েছে ১৩৮%, কেন্দ্রের আয় ৯৯,০০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণে আয়ের টাকা জনগণের পরিষেবায় সরকারের ব্যবহারের কোনো অভিপ্রায়ই নেই বরং বড়ো বড়ো কর্পোরেট হাউসের প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা লোন সরকারের তরফ থেকে মেটানো হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তার জায়গাগুলোকে অথৈ জলে ফেলে। গত বছর লকডাউনের রিলিফ প্যাকেজে সারা বিশ্বের সবথেকে কম টাকা ধার্য করেছিল ভারত সরকার, পুরো জিডিপির ১%-ও নয়। আসলে আয়কর চাপাতে চাইছে না সরকার, কারণ আয়কর চাপালে ধনীদের থেকে ট্যাক্স বেশি উঠবে, গরীবের থেকে কম, তাই যথাসম্ভব ঘুরপথে ব্যায়কর চাপিয়ে ইনকাম করতে চাইছে; অর্থনীতির সরল সুতোয় প্রত্যেক খেটে খাওয়া মানুষের উপরই খাঁড়ার ঘা নেমে আসছে। পেট্রল-ডিজেল পরিবহন ও সেচের কাজে লাগে। জ্বালানী তেলের দাম বাড়লে ট্রান্সপোর্ট ক্যাপিটাল যাতায়াতের খরচ বাড়িয়ে নিজের স্বার্থ রক্ষা করে --- ট্রেড ক্যাপিটাল এই দাম বৃদ্ধির দায় চাপায় বিক্রেতার উপর ---- বিক্রেতা পণ্যের দাম বাড়িয়ে তা উসুল করে ক্রেতার থেকে। তাই আমাদের দাবি রাখতে হবে আয়কর বাড়িয়ে ব্যয়করের পরিমাণ যেন কমানো হয়, এবং আয়ের নিরিখে যাতে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। সমাজের চাকা ঘোরাতে জরুরি যে তেল, সেই তেল মহার্ঘ আজ। তেলের দাম হলো ছোটোবেলায় কেসি নাগের বইতে থাকা সেই বাঁদরের মতো, যে তৈলাক্ত বাঁশদন্ডে প্রত্যেক ১৩ সেমি নামার পর ১৪ সেমি উঠে এগোতো, তবে শেষ বার একলাফে অনেকটা লাফিয়ে বাঁশদন্ডের শীর্ষে উঠে যেত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তেলের দামের এই উত্থান কি রোধ হবে?! বাঁদর তো নামেনি, অঙ্ক শেষ হয়েছে তার আগেই।
Comments
Post a Comment