ফেলুন কড়ি, কিনুন তেল!

রূপক গায়েন


ছোটোবেলায় পড়েছিলাম : তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ করো / তোমরা যে সব বুড়ো খোকা বাংলা ভেঙে ভাগ করো, তার বেলা? হ্যাঁ, বাংলা ভাগের একটা ধুঁয়ো উঠছে, সে নিয়ে আলোচনা হবে তবে বর্তমানে তেলের যা দাম তাতে শিশি ভাঙার জন্য খুকুর উপর রাগ করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। তেলের ঝাঁঝে  নয় বরং দামেই শেলবিদ্ধ হেঁশেল নিম্নবিত্ত বাড়ির। শুধু সর্ষের তেলেরই দাম হয়েছে লিটার প্রতি ১০০ টাকা যা গত বছরের থেকেও বেশি। পাম, সোয়া বা রাইস ব্র‍্যান অয়েলের দাম বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। 'সেন্ট্রাল অরগানাইজেশন অব অয়েল ইন্ড্রাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড'-এর রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের সর্ষের উৎপাদন গতবছরের থেকে ১৯.৫% বৃদ্ধি পেয়েছে, আবার গতবছরে লকডাউন হওয়ায় হোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকায় আন্তর্জাতিকভাবে তেলের চাহিদা কমেছে; অর্থাৎ জোগান বেশি, চাহিদা কমের অর্থনৈতিক নিয়মেই তেলের দাম কমার কথা, কিন্তু তা হচ্ছে কই? একটু গভীরে গেলে বোঝা যাবে যে সমস্যার ভিত্তি ঝুলে রয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) খুঁড়োর কলে। ভারতকে আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভোজ্য তেলের প্রায় ৭০%-ই বিদেশ (মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) থেকে আমদানি করতে হয়। WTO-র শর্ত অনুযায়ী আমদানি করা তেলের সংশ্লিষ্ট তৈল বীজ জাতীয় স্তরে উৎপাদন করতে হলে কেন্দ্র সরকার উৎপাদনকারী চাষীদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) প্রদান করতে পারবে না। এর ফলে দেশে যে ৩০% তৈলবীজ উৎপাদন হয় তার পরিমাণ, চাষীর পক্ষে একা বাড়ানো সম্ভব নয়। তাই শুরু হয়েছে কর্পোরেটের দহরম মহরম। তারা বর্তমানে কিছু উৎসাহ মূল্যের বিনিময়ে চাষীদের অর্থনৈতিক রক্ষাকবচ 'MSP' বন্ধ করে দিতে চাইছে; একই সাথে 'অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন'-এ পরিবর্তন আনার মধ্যে দিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমত ফসল মজুত করার উপায়ও বের করে নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়তে থাকার সুবাদে ব্যাপক মুনাফার অধিকারী কর্পোরেটগোষ্ঠী WTO-এর শর্ত উল্লঙ্ঘন না করে তৈল বীজের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিজেদের মুনাফার একাংশ চাষীদের উৎসাহ মূল্য হিসেবে দান করছে। এর ফলে গত বছরের কুইন্টাল প্রতি ৪০০০ টাকার তুলনায় চাষীরা বর্তমানে কুইন্টাল প্রতি ৭৫০০ টাকা পাচ্ছে (MSP ছাড়াই!)। কিন্তু এই ব্যবস্থা স্থিতধী হয়ে গেলে এই উৎসাহ মূল্য চাষীরা আর পাবে না এবং কৃষক বিরোধী কৃষি আইনগুলির দৌলতে তৈলবীজের দাম থেকে শুরু করে মজুত, সবই কর্পোরেটরা নিয়ন্ত্রণ করবে। ফলে তেলের দাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি এবং চাষীরা ন্যায্য মূল্য না পেলেও কেন্দ্র সরকার সেই দায় নিতে বাধ্য থাকবে না। তাই এই কালা কানুনগুলো সর্বাগ্ৰে বাতিল করতে হবে, এবং WTO-র নিয়ম অগ্রাহ্য করেই এগিয়ে আসতে হবে কেন্দ্র সরকারকেই; তবেই সুরাহা বাতলানো যাবে। 

আমার এই প্রতিবেদন হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু আমাদের জীবনের অগ্ৰগতিই হোক বা দেশের অর্থনৈথিক অধঃগতি - যে কোন ধরনের গতিই  যে তেলের উপর নির্ভরশীল, সেই পেট্রোল-ডিজেলের প্রসঙ্গটা কিভাবে এড়িয়ে যাই বলুন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের দর বাড়িয়ে চলেছে পেট্রোল-ডিজেল। তবে অনেকে বলছেন যে বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েলের দাম বাড়ছে সেটাই কারণ এই মূল্যবৃদ্ধির, যা অর্ধসত্য। অবশ্যই ক্রুড অয়েলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৪-১৫ সালে এই দাম ছিল ব্যারেল প্রতি প্রায় $৪৬, যা বর্তমানে ব্যারেল প্রতি প্রায় $৬৬; ৪৪% দাম বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে ২০১৪ সালে লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম প্রায় ₹৫৮ ছিল, আর আজকের দিনে কোলকাতায় এক লিটার পেট্রোল প্রায় ₹৯৮, অর্থাৎ  ৪৪% ক্রুড অয়েলের দাম বৃদ্ধির সাপেক্ষে প্রায় ৬৭% তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। আবার ডিজেলের দাম প্রায় ₹৪৮ থেকে বর্তমানে প্রায় ₹৯১ হয়েছে; দাম বৃদ্ধি ৮৯%।  পেট্রোপণ্যের রিফাইনিং প্রসেসের জন্য কিছু দাম বৃদ্ধি ধরলেও বর্তমান দাম যথেষ্ট বেশি। অর্থাৎ কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ট্যাক্স এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে। কেন্দ্রের সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি, IGST, CGST, কাস্টমস ডিউটি এবং রাজ্য সরকারের ক্ষেত্রে GST, VAT, অক্ট্রোই, এন্ট্রি ট্যাক্স। লক্ষণীয় যে ২০১৪ থেকে ২০২০-তে পেট্রোপণ্যের ব্যবহার বেড়েছে মোটে ২৯%, অথচ রাজকোষের ভাঁড়ারে কেন্দ্র সরকারের আয় ১২৫%  বেড়েছে, রাজ্য সরকারগুলির ক্ষেত্রে তা ৩৭.৫%, অর্থাৎ ট্যাক্সের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিই উভয় সরকারেরই আয় এবং পেট্রো পণ্যের দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ; তাও একদিন ই-স্কুটি চালিয়ে নবান্নে গিয়ে ফুটেজ খায় কেউ কেউ। ২০১৪ থেকে ২০২১-এ সেন্ট্রাল এক্সাইজ ডিউটি বেড়েছে ১৩৮%, কেন্দ্রের আয় ৯৯,০০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণে আয়ের টাকা জনগণের পরিষেবায় সরকারের ব্যবহারের কোনো অভিপ্রায়ই নেই বরং বড়ো বড়ো কর্পোরেট হাউসের প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা লোন সরকারের তরফ থেকে মেটানো হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তার জায়গাগুলোকে অথৈ জলে ফেলে। গত বছর লকডাউনের রিলিফ প্যাকেজে সারা বিশ্বের সবথেকে কম টাকা ধার্য করেছিল ভারত সরকার, পুরো জিডিপির ১%-ও নয়। আসলে আয়কর চাপাতে চাইছে না সরকার, কারণ আয়কর চাপালে ধনীদের থেকে ট্যাক্স বেশি উঠবে, গরীবের থেকে কম, তাই যথাসম্ভব ঘুরপথে ব্যায়কর চাপিয়ে ইনকাম করতে চাইছে; অর্থনীতির সরল সুতোয় প্রত্যেক খেটে খাওয়া মানুষের উপরই খাঁড়ার ঘা নেমে আসছে। পেট্রল-ডিজেল পরিবহন ও সেচের কাজে লাগে। জ্বালানী তেলের দাম বাড়লে ট্রান্সপোর্ট ক্যাপিটাল যাতায়াতের খরচ বাড়িয়ে নিজের স্বার্থ রক্ষা করে --- ট্রেড ক্যাপিটাল এই দাম বৃদ্ধির দায় চাপায় বিক্রেতার উপর ---- বিক্রেতা পণ্যের দাম বাড়িয়ে তা উসুল করে ক্রেতার থেকে। তাই আমাদের দাবি রাখতে হবে আয়কর বাড়িয়ে ব্যয়করের পরিমাণ যেন কমানো হয়, এবং আয়ের নিরিখে যাতে ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। সমাজের চাকা ঘোরাতে জরুরি যে তেল, সেই তেল মহার্ঘ আজ। তেলের দাম হলো ছোটোবেলায় কেসি নাগের বইতে থাকা সেই বাঁদরের মতো, যে  তৈলাক্ত বাঁশদন্ডে প্রত্যেক ১৩ সেমি নামার পর ১৪ সেমি উঠে এগোতো, তবে শেষ বার একলাফে অনেকটা লাফিয়ে  বাঁশদন্ডের  শীর্ষে  উঠে যেত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,  তেলের দামের এই উত্থান কি রোধ হবে?! বাঁদর তো নামেনি, অঙ্ক শেষ হয়েছে তার আগেই।

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views