মারুতি কারখানার শ্রমিক আন্দোলন এবং সদ্য প্রয়াত জিয়ালালের লড়াইয়ের কাহিনী

রূপক গায়েন 


গত ৫ই জুন জিয়ালালের মৃত্যু ফের একবার উসকে দিলো মারুতি কারখানার শ্রমিক ও মালিকপক্ষের দ্বন্দ্বের ইতিহাসকে। হরিয়ানার মানেসরে রয়েছে মারুতি কোম্পানি কারখানা যা ভারতের প্রথম সারির গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা; নিজেদের কর্পোরেটীয় চালে হয়ে উঠেছিল শ্রমিক শোষণের শিরোমণি। ২০১১ সালে এই কোম্পানি শ্রমিকদের বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের মুখে পড়ে এবং এই আন্দোলন প্রায় চারমাস চলে। মারুতির অধিকাংশ স্থায়ী শ্রমিকই আইটিআই থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রতি শিফ্টে প্রায় ছশো গাড়ি পিছু কাজ করে তারা সমবেতভাবে; আট ঘন্টা কাজের মধ্যে সাড়ে সাত ঘন্টা কাজ করতেই হবে, কুড়ি মিনিট টিফিন খাওয়া, সাত মিনিট চা খাওয়ার জন্য ছেড়ে দিলে হাতে পড়ে থাকে মোটে তিন মিনিট। এইভাবেই কারখানার গোলামে পরিণত হয়েছে তারা মাসিক ৮০০০ টাকা পার্মানেন্ট ওয়েজের বিনিময়ে।পুরোনো এবং দক্ষ শ্রমিক হলে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪-১৫ হাজার টাকা। স্থায়ী শ্রমিক ছুটি নিলে দিনে ১৫০০ টাকা মজুরী কাটা যায়, ফলে ছয় দিন ছুটি নিলে পুরো টাকাটাই তার কাটা যায়! কারখানার ৬৫% নিযুক্ত শ্রমিককে অস্থায়ী। শ্রম আইনকে উপেক্ষা করেই এরকম মজুরী ব্যবস্থা চালানোর প্রতি শ্রমিকদের ক্ষোভ বাড়ছিলই, ক্ষোভ ছিল তাদের নিজস্ব ইউনিয়ন-মারুতি সুজুকি ইউনিয়ন (মেসু) তৈরি করতেও কোম্পানি বাধা দিচ্ছিল। কোম্পানির হাতে থাকা মারুতি উদ্যোগ কামগার ইউনিয়ন বা  মুকু আসলে শ্রমিকদের সমস্যাকে পাত্তাই দেয়না। চারবছর ধরে চলা এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিকরা ফেটে পড়ে এবং দুহাজার শ্রমিক একত্রিত হয়ে ধর্মঘট শুরু করে। ধর্মঘটের তৃতীয় দিনে প্রায় ১১ জন শ্রমিক (যার মধ্যে আটজন হল মেসু-র নেতা)-কে ছাঁটাই করা হয়। মারুতির মালিকপক্ষের সাথে হরিয়ানার শিল্পমন্ত্রী সুসম্পর্কের দরুণ তিনি চতুর্থ দিনে জানান যে এই ধর্মঘট ঠিক নয় এবং আন্দোলনকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু সেই অঞ্চলের অন্য ৬৫টি কারখানার শ্রমিকরাও এই আন্দোলনকে সমর্থন জানায় এবং সংহতি প্রদর্শনের জন্য তারা একদিন না খেয়ে কাজ করে। CITU, AITUC, HMC, AIUTUC প্রভৃতি সংগঠনও শ্রমিকদের হয়ে প্রতিবাদ, ধর্না, মিটিং, মিছিল করে এবং সরকার ও মালিকপক্ষের যৌথ উদ্যোগে হওয়া এই দুর্বৃত্ত কার্যকলাপের বিরোধিতা করে। ইতিমধ্যে  কোম্পানি হাস্যকর কিছু নিয়ম শৃঙ্খলার বিধি নিয়ে আসে এবং সেই আচরণবিধিতে সই করলে তবেই কোম্পানিতে কাজ করতে পারবে, এরকম এক মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রদর্শন করে। শ্রমিকদের জন্য চালু বাসের ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেক কর্মী ছাঁটাই এবং কিছু কর্মী পুনর্বহালের এই  সমীকরণে মারুতি কোম্পানি চলতে থাকে। এইভাবে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় ধর্মঘট ও চলে। তৃতীয় দফার শেষে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যে অবশেষে চুক্তি হয় এবং কোম্পানি কিছু লোককে বাদ দিয়ে স্থায়ী, অস্থায়ী বাকি সকল কর্মীকে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হয় এবং ২০১১-র ডিসেম্বর থেকে পুনরায় কারখানার কাজ চালু হয়ে যায়। 

এরপর ২০১২ সালের ১৮ই জুলাই, জিয়ালাল নামের এক কর্মচারীকে তার ফ্লোর সুপারভাইজার তার নীচুজাত নিয়ে গালমন্দ করে। প্রতিবাদ করতে গেলে জিয়ালালকেই সাসপেন্ড করা হয়। এর ফলস্বরূপ সেখানকার কর্মচারীরা প্রতিবাদ করলে কোম্পানি তার পোষা গুন্ডা (বাউন্সার)-দের দিয়ে মারধর শুরু করে। কাকতালীয়ভাবে প্ল্যান্টের একাংশে সেদিন আগুন লেগে যায় এবং কারখানার জেনারেল ম্যানেজার অবনীশ কুমার মারা যায়। জেনারেল ম্যানেজার মারা যাওয়াতে কোম্পানি সেই মৃত্যুকে শ্রমিকদের হিংসার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে  যদিও প্রায় ১০০ জন শ্রমিকও গুরুতর আহত হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে হরিয়ানা সরকার এবং ইন্ডিয়ান মিডিয়াও মারুতি কোম্পানির স্তাবকতা এবং চাটুকারের ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হয়। ফলে ২০১৭ সালে জিয়ালাল সহ প্রায় ১৩ জনকে একপেশে তদন্তের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। জিয়ালাল ক্লাস এবং কাস্ট অপ্রেশনের স্বীকার; ভারতের প্রতিটি উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় এরকম ভাবেই অত্যাচার চলে। সম্প্রতি Ajeeb Dastan নামের একটি সিরিজের Geeli Pucchi নামক চিত্রনাট্যে এরকম একটা চিত্র আমরা দেখতে পাই। জিয়ালাল আসলে আমাদের এই পচে যাওয়া সিস্টেমটার পরিবর্তন চায়, শ্রেণীসংগ্রাম চায়, তাই সাসপেন্ড হয়ে যাওয়ার ভয় নিয়েও প্রতিবাদ করে। স্টেজ ফোর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে জিয়ালালের তবে দিন পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে হাজার হাজার জিয়ালাল..... 

Picture Courtesy: Worker's Unity

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views