কর্মহীন বিকাশের আষাঢ়ে গল্পঃ আমাদের জবাব
বাসুদেব নাগ চৌধুরী
[প্রথম প্রকাশঃ জবরদখল পত্রিকা, অষ্টম সংখ্যা, ১৭ই নভেম্বর ২০১৪; মতাদর্শগত কর্ষণের উদ্দেশ্যে ডিলিজেন্টের পক্ষ থেকে পুনঃপ্রকাশ]
এ ধরনের সিদ্ধান্তসমূহের কারণ হলো এ সমস্ত পার্টির নেতৃত্বে থাকা পেতিবুর্জোয়া মধ্যবিত্তদের নিজের শ্রেণীর স্বার্থ, কারণ তাদের নিজের শ্রেণীগোষ্ঠীটাও সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান দশায় অনেকাংশে উপকৃত,যা আবশ্যিকভাবেই আজকের দুনিয়ায় শ্রমের ব্যাপক চায়,আর সমস্যা সমাধানের নামে পার্টি ও শ্রমজীবী জনগণকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় বুর্জোয়াদেরই আশ্রয়ে।
তথ্যের অন্তরালে থাকা সত্যকে খুঁজে বের করতে গেলে আমাদের একটু পরখ করে দেখতে হবে, এই মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন তথা জি.ডি.পি. আসলে কিসের প্রকাশ, উন্নত টেকনোলজির মাধ্যমে মুনাফা তৈরীর পদ্ধতিটা কী এবং 'ডেরিভেটিভ ট্রেডিং'-এর মাধ্যমে পুঁজি বেড়ে ওঠে কীভাবে?
।।এক।।
মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কে প্রকাশ করা হয় অর্থের অংকে তথা টাকায়;অর্থাৎ 'উৎপাদন' বলতে এখানে প্রকৃতপক্ষে 'উৎপাদন'কে নয়, বোঝানো হয় তার 'দাম'-কে। সুতরাং জি.ডি.পি.-র মাধ্যমে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কে নয়, আসলে দেখানো হয়-- সমস্ত উৎপাদনের মোট 'দাম'কেই।
কিন্তু 'দাম' তো সেই সমস্ত কিছুরই থাকে যা বিনিময়যোগ্য --- তা উৎপাদিত হোক বা না হোক ( উদাহরণস্বরূপ, কয়েক বিঘা জমি, কোন উৎপাদিত দ্রব্য নয়, কিন্তু দাম আছে)। অতএব এই 'মোট উৎপাদন দাম'-এর মধ্যে সেই সমস্ত কিছুর 'দাম'-এর ওঠা-নামাও যা আদৌ উৎপাদিতই নয়। তাই 'দাম' বিষয়টার বোঝাপড়া জন্য প্রথমে আমাদের পার্থক্য করতে হবে দুই দামের মধ্যে-- যার উৎপাদন হয় আর যার উৎপাদন হয় না।
যেগুলি উৎপাদিত হয়, তাদের দাম নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা কখনই ধর্তব্যেও আনবো না সেই সমস্ত কিছুকে যাদের 'পুনরুৎপাদন' হয় না, আর তাই অর্থনীতির সাথে তার দামের কোন সম্পর্ক নেই; যাদের দাম ওঠে কেবল আকস্মিকভাবে,যেমন কোন মহান ক্রিকেটারের রেকর্ড করা বা কোনো স্বৈরাচারী শাসকের আঁকা তৈলচিত্র। এগুলির বিক্ষিপ্ততা ও আকস্মিকতার কারণেই জি.ডি.পি.-তে এদের কোন ভূমিকা থাকে না, এদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে পরিলক্ষিত হয় কেবল সমাজের নানা বৃহৎ অপরাধমূলক কাজকর্মে পর্দা টানতে। যাই হোক, আজকের দিনে উৎপাদনে ও উৎপাদিত পণ্যের বানিজ্যে যে বিনিয়োগ হয়, তার একটা বড় অংশ ব্যাঙ্ক বা বিভিন্ন ফিনান্স সেক্টর থেকে লোন নিয়ে খাটানো হয় (১)। আবার পণ্যের বাণিজ্যের মধ্যে পরিবহন এবং অ্যাডভার্টাইজমেন্ট (২) দুটি পৃথক শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্র, এবং স্টোরেজ সিস্টেম (৩)-এরও নিজস্ব খরচ আছে।পণ্যগুলির মোট দাম নির্ধারণ করা হয় এই সমস্ত বিনিয়োগ ব্যয়-এর সুদের হার (যা শোধ করতে হবে) যোগ গড়পড়তা মুনাফার হার অনুযায়ী একটা বাড়তি ধরে নিয়ে। পণ্যগুলো আদৌ বিক্রি হবে কিনা,বা সমস্ত পণ্য বিক্রি হয়ে যাবে কিনা (আর বাস্তবে তা হয়ও না), তার সাথে এই দাম নির্ধারণের কোন সম্পর্ক নেই। বিক্রির বিষয়টা নির্ভর করে বাস্তব সমাজের ক্রয়ক্ষমতা (বুর্জোয়াদের প্রচারিত ভাষায় 'চাহিদা') ও যোগানের ভারসাম্যের ওপর। যেভাবে বুর্জোয়া তাত্ত্বিক ও তাদের স্তাবকেরা প্রচার করে থাকে, তেমন ভাবে 'চাহিদা' ও জোগানের উপর ভিত্তি করে কখনো উৎপাদন-দাম নির্ধারিত হয় না,'দাম'-এর ট্যাগ ছাপা হয়ে যায় বিক্রির বহু পূর্বেই। আর সেজন্যই চৈত্র সেল বা পুজো সেল-এ কত '%' ছাড় হবে, তার সাথে সারা বছরের 'প্রাইস ট্যাগ'-এর কোন সম্পর্ক থাকে না। জি.ডি.পি. প্রকাশ করে মোট 'উৎপাদন-দাম'-কে, তার মধ্যে কত দামের জিনিস বিক্রি হলো, তার পরিমাণকে নয়।
কিন্তু যখন সুদ আর মুনাফার গড়-পড়তা হার অনুযায়ী বাড়তি ধরে নিয়েই 'দাম' নির্ধারণ করে পুঁজিপতিরা, সেক্ষেত্রে তারা তো নিজেরাই আলোচনা করে যত খুশি মুনাফা ও সুদের হার বাড়িয়ে নিতে পারে, আর সেই অনুযায়ী পণ্যের দামও, কারণ তাদের চাহিদা সর্বদাই মুনাফা বাড়ানো, ---আরো বাড়ানো ;কিন্তু তা তো হয় না! এখানে কেউ মনে করতে পারেন যে যেমন- তেমন দাম বাড়ালে পণ্য বিক্রি হবে না। প্রথমত, সে বিষয়ে আগেই বলা হয়েছে যে নানা ধরনের 'সেল' দিয়েও সমস্ত পণ্য ওরা বেচতে পারে না এবং এর সাথে এই দাম নির্ধারণের সম্পর্ক নেই; দ্বিতীয়তঃ, পরে আমরা দেখাবো যে এযুগের উৎপাদনের প্রবণতাই বেশি দামী পণ্য তৈরি। তাহলে কী তা, যা তাদের টেনে ধরে সুদ আর মুনাফার গড়পড়তা হাড়ের একটা নির্দিষ্ট সীমায় এবং বাধ্য করে প্রতিটা পণ্যকে একটা 'MRP' (ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইস, অর্থাৎ সর্বাধিক কত দামে বিক্রি করা যাবে)-তে আটকে যেতে? আসলে এটা বস্তুজগতের সংরক্ষণ সূত্র যে, যেকোনো নিরবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় মোট 'ইনপুট' যতোটা,'আউটপুট' কখনো তার থেকে বেশি হতে পারে না। সুতরাং পণ্যের দামের 'MRP'-তে আটকে যাওয়ার কারণও তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার বস্তুগত 'ইনপুট'-এর নির্দিষ্ট পরিমাণ। কী এই উৎপাদনের বস্তুগত 'ইনপুট'?--'শ্রম',--কেবল মানবশ্রম, যা সমস্ত পণ্যের উৎপাদনেরই এক ও অভিন্ন বস্তুগত 'ইনপুট', যদিও বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্রে তার পরিমাণ হয় বিভিন্ন, যা সাধারণভাবে মাপা হয় 'শ্রমসময়'-এর এককে, যেমন শ্রমদিবস-এ। সেজন্য একটা পুঁজির চলাচলের সীমানা যতোটা উৎপাদনক্ষেত্রসমূহ পর্যন্ত বিস্তৃত, সেই সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মোট যত শ্রমদিবস ব্যয়িত হয়েছে তার সমতুল্য 'অর্থ' হলো ওই সমস্ত পণ্যের মোট 'M.R.P.'। এখন এক-একটা পণ্য বা তার অংশ তৈরিতে কতটা শ্রম বা শ্রমসময় লেগেছে, তা জানা-বোঝা-মাপার আয়ত্তে না থাকলেও,সমস্ত পণ্য তৈরীতে কত শ্রম বা শ্রমসময় লেগেছে, অর্থাৎ বছরের মত শ্রম দিবস জানা (#)।
এখন প্রশ্ন আসে, যেগুলি উৎপাদিত তথা পুনরুৎপাদিত হয় না, কিন্তু যাদের দাম ঢুকে পড়ে জি.ডি.পি.-র মধ্যে, যেমন জমি,জলাশয়, তরঙ্গ বা কোন বিশেষ টেকনোলজি, তাদের দাম নির্ধারিত হয় কিভাবে? (*) মনে রাখতে হবে এগুলি প্রত্যেকটি কোনো-না-কোনো উৎপাদনের উপায় এবং সেজন্যই উৎপাদন দামের মধ্যে এদের দামও আত্মপ্রকাশ করে, এবং তা করে কেবল এবং কেবল মালিকানা তথা 'দখলদারি'-র জোরে, যে দখলদারি ব্যক্তিগত হোক বা গোষ্ঠীগত হোক, বা এমনকি রাষ্ট্রীয়। টেকনোলজির ক্ষেত্রে একে পেটেন্ট বলা হয় এবং 'কপিরাইট'-এর মাধ্যমে এ দখলদারি প্রতিষ্ঠিত করা হয়ে থাকে (**)। এগুলোর নিজস্ব উৎপাদনশীলতা (যেমন কৃষিজমির ক্ষেত্রে উর্বরতা, নির্মাণ শিল্পের জমির ক্ষেত্রে ধারণক্ষমতা, জলপ্রপাতের স্রোতের বেগ, টেকনোলজির নিজস্ব বিশেষত্ব ইত্যাদি)-র দরুন যতটা বাড়তি উৎপাদন হয়, তথা বাড়তি উৎপাদন-দাম সৃষ্টি হয় একই পরিমাণ শ্রমের খরচে, ততোটাই বার্ষিক খাজনা,বা লিজ-এর টাকা, বা কপিরাইট-এর চার্জ বা সরকারি ক্ষেত্রে রেভিনিউ দিতে হয়। অর্থাৎ শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত পণ্যের দামের একটা অংশ এগুলোর মালিকেরা পায় উৎপাদনে একটা টাকাও খরচ না করেই, কেবল মালিকানা তথা দখলদারির জোরেই। ফলে 'প্রাপ্য' এই টাকাকে ব্যাংক বা কোন ফিন্যান্স সেক্টরে রাখা মূলধনের থেকে পাওয়া সুদেরই সমতুল্য বলেই মনে হয় ;স্বাভাবিক ভাবেই সেই কাল্পনিক মূলধনেরই সমান ধরা হয় এদের দাম, বা প্রচলিত ভাষায় 'এসেট ভ্যালু'। ব্যাঙ্কে রাখা একটা মূলধনের থেকে এর পার্থক্য কেবল এই যে, উৎপাদনের উপায়ের নেই নিজস্ব উৎপাদনশীলতা, যার দরুন তৈরি হচ্ছে এর 'দাম', তা উৎপাদনে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাড়তে পারে বা কমতে পারে বারংবার উৎপাদন চলতে চলতে, প্রকৃতপক্ষেই বা আপাতভাবে অন্যান্যদের তুলনায় (##) এবং তা বাড়তে বা কমতে পারে এই প্রাপ্ত বাড়তি-দামটার উৎপাদনে কোন পুনর্নিয়োগ ছাড়াই। সুতরাং সমস্ত কিছুর 'দাম', য়া উৎপাদিত তথা পুনরূৎপাদিত হোক আর না হোক, সৃষ্টি হয় উৎপাদন ব্যয় করা 'মানবশ্রম' থেকে, কেবল 'মানবশ্রম' থেকেই।
।। দুই ।।
একটা পুঁজিবাদী সমাজে, মোট উৎপাদন দাম আসলে এই
পুঁজির চলাচলের সীমানা ক্ষেত্রের মধ্যে উৎপাদিত সমস্ত পণ্যের জন্য
ব্যয়িত মোট মানবশ্রমের দাম; যদিও এই 'অর্থ'
বিভক্ত হয় মূলত তিন ভাগে -- এক, শ্রমিক একটা
অংশ পায় (কারখানায় বা অন্যান্য শিল্প ক্ষেত্রে বা অন্যের
জমিতে চাষের জন্য মজুরি হিসেবে, অথবা নিজের জমিতে চাষের
ক্ষেত্রে বা স্বনিযুক্ত শ্রমিক হলে পণ্য বিক্রির দাম হিসেবে) ; দুই উৎপাদনের সেইসব উপায় যার উৎপাদন বা পুনরুৎপাদন হয় না তার মালিকেরা
(ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র) খাজনা বা লিজ বা কপিরাইট চার্জ বা রেভিনিউ হিসেবে
পায় একটা অংশ; আর তিন, বিনিয়োগের খরচ
পোষানোর পর পুঁজিপতির ভাগে আসে বাকি অংশ, মোট মুনাফা,
যার একটি অংশ ট্যাক্স হিসাবে তারা দেয় রাষ্ট্রকে এ-ব্যবস্থাকে
টিঁকিয়ে রাখার যাবতীয় বন্দোবস্তের জন্য (যা থেকে প্রশাসনিক, সামরিক এবং অফিস- কাছারি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য এসবের সমস্ত খরচ চলে), আর বাকিটা পুঁজিপতিদের প্রফিট (প্রফিট আফটার ট্যাক্স) এবং ফিনান্স
কারবারের সুদ।অর্থাৎ সমস্ত অর্থই শ্রমিকেরই সৃষ্টি হলেও সে পায় কেবল তার একটা অংশ
মাত্র আর বাকিটা যায় পুঁজিপতি, ফিন্যান্স কারবারী, বিভিন্ন মালিক এবং প্রশাসনিক- সামরিক-পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মরতদের হাতে। এ
তো গেল মোট উৎপাদন দামের তিনটি মূল শিবিরে বিভাজন; কিন্তু
বিভিন্ন উৎপাদনক্ষেত্র গুলোর মধ্যে এই মোট উৎপাদন দাম কীভাবে বিভাজিত হয়? আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, এক-একটা পণ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে
কত-কত শ্রম ব্যয় হয়েছে তার পাই-পাই হিসাব সম্ভব নয়, কারণ গণনার মধ্যে থাকে কেবল বছরের মোট শ্রমদিবস, তাই
এক-একটা পণ্যের দাম তার উৎপাদনে বিনিয়োগ ও গড়পড়তা হারে ধরে নেওয়া মোট মুনাফার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। সরলভাবে
ধারণাটা এরকম--- "যত বেশি বিনিয়োগ ততবেশি লাভ"। দাম নির্ধারণের আর কোনো
মানদন্ড এই উৎপাদন ব্যবস্থায় নেইও। সুতরাং সমস্ত পণ্যের মোট দাম (MRP) তাদের উৎপাদনে মোট যত শ্রম ব্যয় হয়েছে তার দামের সমান হলেও এক-একটা
পণ্যের দাম (বিনিয়োগের আনুপাতিক হারে) তার উৎপাদনে যত শ্রম লেগেছে তার থেকে বেশি
বা কম হয় (যাতে সামগ্রিকভাবে তা কাটাকাটি হয়ে যায়) (৪)। ফলে একজন শ্রমিকের
উদ্ধৃত্ত কেবল তার মালিকের মুনাফা এবং খাজনা সৃষ্টি করে, এমনটা
আদৌ নয়। পুঁজিবাদী সমাজে সমস্ত শ্রমিকের মোট উদ্ধৃত্ত সৃষ্টি ক'রে চলে সমস্ত মালিকের মোট মুনাফা-খাজনা এবং অন্যান্য উদ্ধৃত্তভোগী কর্মীদের
মাইনেও আর এভাবেই ''গোটা সমাজ ক্রমেই বেশি পরিমাণে ভাগ হয়ে পড়েছে
সরাসরি পরস্পরের সম্মুখীন দুটি বিশাল শত্রু শিবিরে" (কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো,
মার্কস ও এঙ্গেলস) (#১)।
অতএব, নিজের জমিতে চাষ করে এমন কৃষক বা স্বনিযুক্ত শ্রমিক, বিনিয়োগ কম বলেই, পণ্য বিক্রি ক'রে তার নিজের ব্যয়িত শ্রমের মূল্যও ফেরত পায় না, তার উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্য স্থানান্তরিত হয় বৃহৎ বিনিয়োগের মুনাফায়, এবং এভাবেই সে এই ব্যবস্থায় হয়ে ওঠে একজন মজুরি শ্রমিকের মতোই উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী শ্রমিক। অন্যদিকে মজুরি শ্রমিক, যে মালিকের সাথে এগ্রিমেন্ট করে কত ঘন্টা খেটে কত মজুরি নেবে এবং তার মধ্যে দিয়ে মালিককে বিক্রি করে প্রতিদিন তত ঘন্টা খাটবার ক্ষমতা (মার্ক্স যাকে 'ক্যাপিটাল'-এর প্রথম খন্ডে ব্যাখ্যা করেন 'শ্রমশক্তি' হিসাবে), তার এই 'শ্রমশক্তি' নিজেই হয়ে উঠেছে একটা পণ্য, তার 'দাম' অর্থাৎ 'মজুরি'- ও এখন নির্ধারিত হয় বিনিয়োগের হিসাবেই। দক্ষ শ্রমিকের মাইনে যে আজ হয়ে দাঁড়ায় 'অদক্ষ' লেবারের মজুরির চেয়ে অনেক বেশি, তা কোন দক্ষতার কারণে আদৌ নয়, বরং ঐ দক্ষতার ডিগ্রী পেতে তাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে ঢের বেশি (পড়াশোনা শিখে বা কোর্স করে যা অর্জিত, তার জন্য যা খরচ হয়েছে, টাকায় বা তার সমতুল্য সময়ে, তাকে দেখা হয় একটা বিনিয়োগ হিসাবেই), সেই জন্যই। বড় বড় কারখানার সুশিক্ষিত সুইচ টেপা 'দক্ষ' শ্রমিকের দক্ষতা নিয়ে যাঁরাই বড়াই করুন না কেন, তার শ্রমশক্তির খরচ অনেক কম এবং দক্ষতাও; আর সেটা নির্লজ্জভাবে আত্মপ্রকাশ করে উৎপাদন চলাকালীন মেশিনপত্র বন্ধ হলে বা তার কোন পার্টস খারাপ হলে, যখন 'অদক্ষ' লেবারেরা অবতীর্ণ হয় উদ্ধারকার্যে, নিজের ব্যাপক খাটুনির বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন জ্ঞান নিয়ে। এইসব সুইচ টেপা 'দক্ষ' শ্রমিকেরা অধিকাংশ শিল্পে কোন উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি তো করেই না (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পালন করে উৎপাদনে ম্যানেজার এর ভূমিকা),উল্টে 'অদক্ষ' শ্রমিকদের উদ্বৃত্তভোগী আর সেজন্যই দিকে দিকে তাদের বুর্জোয়া বনে যাওয়ায় আশ্চর্যের কিছু নেই (৬)। অন্যদিকে প্রকৃত 'দক্ষতা' সম্পন্ন শ্রমিকেরা, যা অর্জনের জন্য তারা প্রায় কিছুই বিনিয়োগ করেনি, উদাহরণ স্বরূপ গাড়ির চালক বা চা-পাতা তোলেন যে শ্রমিকেরা, বা কাপড়ের উপরস সূক্ষ্ম সুতার কাজ করেন ইত্যাদি, তাদের মজুরি আজও তাদের ক্ষুধা মেটানোর জন্য যথেষ্ট হয় না। বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে যদি তুলনা করেন বাড়িতে রান্না করে এমন গার্হস্থ্য শ্রমিকের সাথে কোর্স করা একজন শেফের আয়ের।
এখন বোধহয় স্পষ্ট 'কর্মহীন বিকাশ'-এর হই হই রই রই-এর আসল নির্যাসটা। জি.ডি পি. বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু পড়াশোনা শিখে বেকার হয়ে বসে আছে, 'সন্মানজনক' কাজ পাচ্ছে না, সুতরাং 'কর্মহীন বিকাশ'। অথচ অসংখ্য মানুষ যে প্রতিদিন নানা ক্ষেত্রে, কারখানার ক্যাজুয়াল থেকে ঘরে ঘরে অর্ডারি, ট্রান্সপোর্ট থেকে মাল বওয়া, ক্ষেতমজুরি থেকে ইটভাঁটা বা কৃষি থেকে স্বনিযুক্তি, লাগাতার খেটে আর খাটুনির দাম না পেয়ে উদ্বৃত্ত তৈরি করে চলেছে, আর সেই উদ্বৃত্তই বড় বড় বিনিয়োগের বড় বড় মুনাফায়,অ্যাসেট ভ্যালুতে, ব্যাংক আর ফিনান্স সেক্টরের সুদে এবং প্রশাসনিক-সামরিক- পরিষেবা ক্ষেত্রের মাইনেতে রূপান্তরিত হয়ে জি.ডি.পি বাড়িয়ে চলেছে, তা মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি স্বীকার করে কোন যুক্তিতে! তার কাছে প্রশ্নটা বরং এই যে, "মধ্যবিত্তরা একটা মধ্যবিত্ত স্বরূপ বিনিয়োগ করে তাদের পরিবারের সন্তানকে সুইচ টেপা 'দক্ষ' শ্রমিক তৈরি করেছে, তা কি চাষ করে না খেতে পেয়ে মরার জন্য, না লেবারের মত 'লো-স্ট্যান্ডার্ড'-এ বাঁচার জন্য! তার বিনিয়োগের দাম পেতে চাই সুইচ টেপা শিল্প, চাই বড় বিনিয়োগ!" যে টেকনোলজি মানবশ্রম হটাচ্ছে বলে তারা দাবি করে, হিড়িক তোলে কর্মহীন বিকাশের, অবশেষে সে ধরনের শিল্প এনেই কর্মসংস্থান হবে বলে প্রচার চালায়। আর এভাবেই পুঁজিবাদের বিরোধিতার নামে বড় বড় পুঁজিপতিদের চরণতলেই তারা আশ্রয় নেয়।
।। তিন।।
শ্রমকে হটিয়ে দিয়ে মুনাফা অর্জনের যে তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছে তার
ভিত্তিস্বরূপ একটা বড় সংযোজন ফটকা কারবার। ডেরিভেটিভ ট্রেডিং- এর মাধ্যমেই নাকি
পুঁজি বেড়ে চলেছে, মুনাফা অর্জনের জন্য আজ আর তাই
মানবশ্রমের প্রয়োজন নেই। সুতরাং এই ডেরিভেটিভ এর মাধ্যমে পুঁজি কিভাবে বেড়ে ওঠে ৬
গুণ বা ১০ গুণ (৭) এবার
সেটা আমরা দেখব।
কোন একটি উৎপাদনক্ষেত্রে, কাল্পনিক উদাহরণস্বরূপ
ধরা যাক, একটি প্যারাসিটামল ওষুধের কোম্পানির হাতে আগামী বছরের
মে-জুন মাসে থাকবে ১০০ কোটি টাকার ওষুধ, যার মধ্যে প্রফিট প্রায় ২০ কোটি টাকা (অর্থাৎ
বিনিয়োগ দাম ৮০ কোটি), কিন্তু এক্সপায়ারি
ডেট জুলাই।দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর ওই সময়টাই ডেঙ্গু হচ্ছে ব্যাপকভাবে। কিন্তু এ বছর থেকে বিভিন্ন পৌরসভা
নানা প্রচার-অভিযান চালিয়ে মশার প্রকোপ কমানোর বন্দোবস্ত করেছে,যার ফলে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ওষুধের কোম্পানির ৩০ কোটি টাকার ওষুধ কম বিক্রি হওয়ার। এরকম অবস্থায় তার সাথে চুক্তি হতে
পারে কোন ফাটকা কারবারীর (স্পেকুলেটর 'ক'- এর), যে হয়তো লক্ষ করছে এই প্রচার-অভিযানে আদৌ
সমস্যার সমাধান হবে না এবং ফলত অমন লস ও হবে না; ধরা যাক,
চুক্তি অনুযায়ী এপ্রিল মাসে এই ১০০ কোটি
টাকার ওষুধের মালিকানাস্বত্ব কিনে নেবে স্পেকুলেটর 'ক' ৯০ কোটি টাকায়। এখন ৩০ কোটি টাকার ওষুধ
বিক্রি না হলে কোম্পানি লস্ করতো ১০ কোটি টাকা, কিন্তু সেক্ষেত্রে তারা এখন লাভ করছে ১০ কোটি টাকা। ২০
কোটির বদলে লাভ করছে কেবল ওই ১০ কোটি টাকাই,
কিন্তু ১০ কোটি টাকা লসের রিস্ক সে বেচে
দিয়েছে। স্পেকুলেটর 'ক' লস্ করবে ২০
কোটি টাকা যদি ৩০ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি না
হয়, আর সে লাভ করবে ৩০ কোটি টাকা যদি
সম্পূর্ণ বিক্রি হয়ে যায়। এ ধরনের হাতবদলের পুঁজি বাড়বার বা অতিরিক্ত মুনাফা
অর্জনের কোন সম্ভাবনাই নেই। সর্বাধিক যা হতে পারে, তা হল,
আরো রিস্কি চুক্তির ক্ষেত্রে একজন হয়ে উঠবে, বড়
অঙ্কের অর্থের মালিক আর অন্যজন দেউলিয়া।
স্পেকুলেটর 'ক' এই 'কন্ট্রাক্ট' অন্য একজন স্পেকুলেটর 'খ'- কে বেচে দিতে পারে ৫ কোটি টাকায় যদি অন্য কোনো
সেক্টরে টাকা খাটিয়ে আরো লাভের সন্ধান পায়। এর মধ্যে দিয়ে স্পেকুলেটর 'ক' হারাবে ১০ কোটি টাকা লাভের
সম্ভাবনা, কিন্তু একইসাথে সে মুক্তি পাবে ২০ কোটি টাকা লস এর সম্ভাবনা থেকেও। এখন ধরা যাক, 'খ'
এই ৫ কোটি টাকাটা ধার নিয়েছে একটা ব্যাঙ্ক 'ব'-এর থেকে। অন্যদিকে স্পেকুলেটর 'ক' ওই প্রাপ্ত ৫ কোটি টাকা ধার
দিয়েছে আর এক স্কেকুলেটর 'ঘ'-কে যে
সেই টাকা দিয়ে ঐরকমই কোন একটা কন্ট্রাক্ট কিনেছে 'গ'
-এর থেকে। বিষয়টা ছক কেটে দেখালে দাঁড়াবে এইরকমঃ-
এখন 'খ' ও 'ঘ'-এর ৫ কোটি টাকা করে লাইয়াবিলিটি (অর্থাৎ পরিশোধযোগ্য লোন) আছে (#২), আর আছে 5 কোটি টাকা দিয়ে কেনা 'বন্ড পেপারস্', যার জন্য 'খ' একটা নির্দিষ্ট সময় পর (চুক্তির মেয়াদ অনুযায়ী মে-জুন মাসে) লাভ করতে পারে ১০ কোটি টাকা বা তার হতে পারে ২০ কোটি টাকা লস (এবং 'ঘ'-ও ঐরকমই কিছু একটা )। অথচ তারা ওই কন্ট্রাক্টগুলোকে আবার বেচে দিতে পারে অন্য স্পেকুলেটরদের কাছে।যাই হোক, যেহেতু এই কন্ট্রাক্ট গুলোও এখন আত্মপ্রকাশ করে 'পণ্য' হিসেবে, 'বন্ড পেপারস্ 'গুলো হয়ে দাঁড়ায় বিনিময়ের মাধ্যম (অর্থাৎ টাকার সাবস্টিটিউট) , অর্থাৎ ঐ কন্ট্রাক্ট গুলোর বাজার-দামে কেনা-বেচা চলে, আর সেক্ষেত্রে এবং 'খ' এবং 'ঘ'-এর ইকুইটি হয়ে দাঁড়ায় শূন্য ( ৫ কোটি টাকার কন্ট্রাক্ট আর ৫ কোটি টাকা লাইয়াবিলিটি )। কিন্তু 'ব', 'ক' ও 'গ'-এর প্রত্যেকের ইকুইটি এখন এই প্রক্রিয়ার মধ্যে ৫ কোটি টাকা করে ( 'ব' ও 'ক' এর ক্ষেত্রে তা প্রাপ্য এবং 'গ' -এর তা হাতেই এসে পৌঁছেছে)।এই কেনা-বেচা শুরুর আগে 'ব'-এর ছিল ৫ কোটি টাকা (যা সে লোন দিয়েছে 'খ'-কে) আর 'ক' ও 'গ'-এর কাছে ছিল দুটি কন্ট্রাক্ট মাত্র, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে লাভ বা লোকসান দুই-ই হতে পারে যার ফল আর সেই সম্ভাবনাও এখন ঢুকে পড়েছে বাণিজ্যের আওতায়। আর এই কন্ট্রাক্ট কে বানিয়ে তুলেছে একটা পণ্য। আসলে এই প্রক্রিয়ায় (ছকটা আর একবার দেখুন) ৫ কোটি টাকা 'ব' থেকে 'খ', 'ক', 'ঘ' হয়ে পৌঁছেছে 'গ'-এর হাতে, কিন্তু তাকে বাড়িয়ে তুলেছে ১৫ কোটি টাকায় ('ব', 'ক', 'গ'-এর মোট ইকুইটি), অর্থাৎ ৩ গুণ। এভাবেই আরো আরো ডেরিভেটিভ ট্রেডিং এর মধ্যে দিয়ে তা হতে পারে ৬ গুণ বা ১০ গুণ (৮)।
কিন্তু যেটা দেখার বিষয়, তা হল এই যে,ওই ১০০ কোটি টাকার প্যারাসিটামল ওষুধ উৎপাদন এবং বিক্রি হলে (এবং 'ঘ'-এর কন্ট্রাক্ট-এর উৎপাদন ও বিক্রি আশাজনক হলে), অর্থাৎ 'খ' ও 'ঘ' চুক্তির টাকা পেলে, আর ফলত তারা লোন শোধ করে দিলেই 'ব' ও 'ক'- এর লাইয়াবিলিটি মিটে গেয়ে ইকুইটি হয় শূন্য আর ১৫ কোটির পুঁজি আবার পরিণত হয় ৫ কোটিতেই (যা 'গ'-এর হাতে আছে)।অর্থাৎ প্রকৃত পুঁজির ৩ গুণ, ৬ গুণ বা ১০ গুণ যতই হোক ডেরিভেটিভ পুঁজির পরিমাণ, সব শোধ হয়ে গেলেই তা চুপসে যাবে আসল অঙ্কে, আর চুক্তি অনুযায়ী দিনক্ষণের মধ্যে শোধ না হলেই ফেটে যাবে বুদবুদের মত (এক্ষেত্রে অবশ্য চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে কিছুটা সামলানোর চেষ্টা হয়)। কিন্তু মোদ্দাকথা এইটাই যে, ৫ কোটি টাকাকে ১৫ কোটি টাকায় পরিণত হওয়ার জন্যও যেতে হয়েছে দু-দুটো কন্ট্রাক্ট এর মধ্যে দিয়ে; এবং এভাবেই যত যত পরিমাণ বাড়িয়ে তুলতে হবে পুঁজিকে, যেতে হবে তত তত দামের কন্ট্রাক্টের মধ্য দিয়ে,দরকার হবে উৎপাদনের তত পরিমান দামের ডেরিভেটিভ গুলোর এবং এর ফলে তাকিয়ে থাকতে হবে সেই সেই উৎপাদন তথা উৎপাদন দামের দিকে। ঐ ঐ উৎপাদন ক্ষেত্রে ঐ ঐ পরিমাণ বিনিয়োগ হলেই, আর গোটা সমাজ জুড়ে মানুষের শ্রমে পণ্য উৎপাদিত হলেই, তত পরিমান শ্রম দিবস এর সমতুল্য দামের থেকে আনুপাতিক মুনাফা যোগ হবে বিনিয়োগ দামের ওপর এবং যা পণ্যের আকারে বাস্তব সমাজে বিক্রি হয়ে সে অর্থ পুঁজিপতির কাছে ফিরে এলেই, কেবল তবেই, লাইয়েবিলিটিগুলো কাটাকাটি হয়ে ডেরিভেটিভ এর আবরণ ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে আসল ক্যাপিটাল; না হলেই ক্রাইসিস। সুতরাং যদিও আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃত ক্যাপিটালের কয়েকগুণ বেশি ডেরিভেটিভ ক্যাপিটালকে এক ফিনান্স কারবারীর কাছে অন্য ফিন্যান্স কারবারীর এবং ফিন্যান্স কারবারীর কাছে বিনিয়োগকারী পুঁজিপতির 'দেনা' বলে মনে হয়,কিন্তু বাস্তবত তা হল 'মানবশ্রম'-এর কাছে পুঁজির দেনা। পরাজয়বাদীর কাছে তাই এ ঘটনা প্রতিভাত হয়ে বাস্তবের ওপর কল্পনার প্রভুত্ব হিসেবে, পোস্ট-মডার্নিস্টের এর কাছে তা দেখা দেয় 'কার্য-কারণ' এর উপর সম্ভাবনার ব্যাপ্তি হিসেবে,কিন্তু মার্কসবাদীদের কাছে তা স্পষ্ট প্রকাশ পায় 'শ্রেণীদ্বন্দ্ব' রূপে। সুতরাং ডেরিভেটিভ ট্রেডিং- এর মাধ্যমে পুঁজির ৬ গুণ বা ১০ গুণ বেড়ে ওঠা আদতে কন্ট্রাক্টগুলোর মেয়াদের মধ্যে ঐ পরিমান উৎপাদন দাম সৃষ্টি ও তার বাস্তব বানিজ্যের বাধ্য বাধকতাকেই ; অর্থাৎ তা দেখায় এই দামের মধ্যে মুনাফার পরিমাণ যতটা, তা যত পরিমান উদ্বৃত্ত শ্রমের (বিনিয়োগ অনুযায়ী) আনুপাতিক হারের সমান,গোটা সমাজে তত পরিমান মোট উদ্বৃত্ত শ্রম ঐ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবশ্য প্রয়োজন। এই সময়কালে সেই অনুযায়ী মোট শ্রমদিবস সৃষ্টি করা মুনাফাখোরদের জন্য অপরিহার্য। ভাবুন, এমতাবস্থায় সমাজের যেকোনো অংশে শ্রমিক ধর্মঘট ভাঙতে এই মুনাফাখোর মালিকশ্রেনী ও তার প্রচারকদের মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে কী!!
।।একটি সামগ্রিক আলোচনা।।
একটা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায়, অর্থাৎ একই
পুঁজির চলাচলের সীমানা ক্ষেত্রের মধ্যে, মোট উৎপাদন দাম হল
মোট বিনিয়োগ যোগ্য পণ্য উৎপাদনে ব্যয়িত মোট দাম না পাওয়া মানবশ্রম (তথা
শ্রমদিবসের) -এর দামের সমান।এই দ্বিতীয় অংশটা অর্থাৎ মোট সামাজিক শ্রমের উদ্বৃত্ত
অংশটায় ভাগ থাকে, প্রথমত বিনিয়োগকারীর মুনাফার,দ্বিতীয়তঃ ফিন্যান্স কারবারীর সুদের, তৃতীয়তঃ
উৎপাদিত বা পুণরুৎপাদিত নয় উৎপাদনের এমন সব উপায়ের মালিকদের এবং শেষ পর্যন্ত
এধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা ধরে রাখার জন্য প্রশাসনিক-সামাজিক- পরিষেবামূলক খরচাপাতির জন্য
ট্যাক্স হিসেবে রাষ্ট্রের। শ্রমিকের দাম না পাওয়া শ্রমের এই ভাগবাঁটোয়ারা হয়
গড়পড়তা মুনাফার হার এবং সুদের হার অনুযায়ী (#৩) মোটের উপর
এই ধারণার ভিত্তিতে, 'যার যত বিনিয়োগ, তার তত লাভ।' কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল
দুটি, এক,মোট যে উৎপাদন-দাম সৃষ্টি হয়,
সমস্তটা বিক্রির মাধ্যমে উপলব্ধ হয় না, এবং
বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদেরা এই উপলব্ধ মুনাফা হার-এর তথ্য দিয়ে বিচার করেন ধরে
নেওয়া গড়পড়তা মুনাফা হার এর তত্ত্বকে আর স্বাভাবিকভাবেই না মেলাতে পেরে হতচকিত
হয়ে যান, ঠিক তেমনি যেমন পুঁজিপতিরা বাস্তব বিক্রি আর
উৎপাদনের পরিমাণ এর মধ্যে ভারসাম্য রাখতে না পেরে (৯); আর
দুটি, দাম নির্ধারণের এ ধরনের পদ্ধতি কোন ধ্রুবসত্য নয়,
চিরকাল তা এরকম ছিলও না, প্রকৃতপক্ষের মানব
সভ্যতার প্রথম যুগে বিনিময় প্রথাই ছিল না ফলন দামের প্রশ্নও ছিল না এবং আজকের
দামের এই নিয়ম নিজেই উৎপাদন ব্যবস্থা আর সেই অনুযায়ী বিনিময় প্রথার দীর্ঘ বিকাশ
ধারার ফল (১০); এবং শোষণমুক্ত পর্যাপ্ত
উৎপাদনশীল সমাজে স্বাভাবিকভাবে বিনিময়প্রথা ও দাম সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে
যাবে এবং ফলে তার অস্তিত্বও।
যেহেতু পুঁজির চলাচলক ক্ষেত্রের মধ্যে সমগ্র মানবশ্রমের উদ্বৃত্ত দাম ভাগ- বাঁটোয়ারা হয়ে যায় ঐ চার ভাগে এবং তা মূলতঃ বিনিয়োগের আনুপাতিক হারে পুঁজিপতিদের ও ফিন্যান্স কারবারিদের মধ্যে গড়-পড়তা মুনাফার হার ও সুদের হার অনুযায়ী, সেজন্যই দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পথ চলা কেন্দ্রীভূত ও বিশ্বায়িত পুঁজির আওতায় সাধারণ করে নতুন একটা দশা। বিপুল মুনাফা অর্জনকারী কেন্দ্রীভূত পুঁজির সাথে তার বশ্যতা স্বীকারকারী পুঁজিসমূহ এবং তার চারপাশে ক্রমশঃ ক্ষুদ্র ও নিঃস্ব হতে থাকা প্রতিযোগিতার পেতি ও ক্ষুদ্র উৎপাদন; আর সেই অনুযায়ী মুষ্টিমেয় বিপুল ধনীর পক্ষে দাঁড়ানো মোটামুটি ভালো অবস্থায় থাকা মধ্যশ্রেণী এবং সর্বহারার পাশে ভিড় করা অসংখ্য গরিব শ্রমজীবী মানুষ। ভাগাভাগি ও সম্পর্কের এই দৃশ্যটা যেমন স্পষ্ট গোটা বিশ্বের দিকে তাকালে দেশগুলোর পলিটিক্যাল স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপের ক্ষেত্রে, তেমনি কোন দেশের মধ্যে মেট্রো শহর, মফস্বল আর গ্রাম গুলোর চেহারায়,আর ঠিক তেমনই শহরের আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোর চারপাশে বসবাসের অযোগ্য বস্তিগুলোর দৃশ্যে, এমনকি, বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-স্বজন- পরিবারবর্গের স্ট্যাটাস অনুযায়ী মেলামেশা চলাফেরার বেলাতেও;যেন একটা গাছের ডালগুলো যেরকম ভাগ হয়েছে, পাতাগুলোও সেভাবে, আর এমনকি পাতার শিরা উপশিরাগুলোও,গণিতের ভাষায় যাকে বলে 'ফ্র্যাক্টাল'। সমাজের যেকোনো ক্ষুদ্র অংশেই গোটা সমাজটাকে যেন দেখা যায়, -- পুঁজি তার নিজের সাথে নিজের সমস্ত বৈশিষ্ট্যের কী বিপুল সামাজিকীকরণ করেছে তা স্পষ্ট হতে থাকে প্রতিদিন। পুঁজির কেন্দ্রীভবনের সাথে সাথে চলতে থাকে ক্রয় ক্ষমতারও কেন্দ্রীভবন,যা একটা প্রবণতা তৈরি করে কম সংখ্যক বেশি দামী ক্ষণস্থায়ী পণ্যের বারংবার উৎপাদন, নতুনরূপে নতুন গুণে সমৃদ্ধ (১১)।
এর ফলে পুঁজিবাদ, তার অতিরিক্ত উৎপাদনের ব্যাধিও,'স্থান'-এর সীমানা পেরিয়ে এগিয়ে চলে 'কাল'-এর যাত্রায়। এখন, একই সাথে প্রচুর কম দামী পণ্যের উৎপাদন, তবুও যা কেনার জন্য একই সময়ে তত মানুষের হাতে টাকার যোগান নেই, পুঁজিবাদের এই অবস্থাটা রূপান্তরিত হয়েছে, যখন বেশী দামী পণ্যের বারবার উৎপাদন যা এই দামী ক্রেতাদের হাতে সেই পরিমাণ টাকার ভবিষ্যৎ যোগানের দাবী রাখে; এবং ফলে একই সময়ে প্রচুর পণ্য উৎপাদনের বদলে ভবিষ্যতের সময়কাল জুড়ে প্রচুর উৎপাদনের চুক্তির প্রবণতা সৃষ্টি করে। ফলে অসংখ্য গরীব মানুষের কিছুটা ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কেন্সীয় তত্ত্ব বর্তমান বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ আদৌ নয়,বরং দামী পণ্যের একটা ক্রেতা শ্রেণীর --- একটা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আপাত স্বার্থ রক্ষাই নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। 'অস্টারিটি' বা 'কৃচ্ছসাধন' তাই কোন পলিসি নয়, বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা, অর্থাৎ পুঁজিবাদের বর্তমান দশার বৈশিষ্ট্য। একে "রাষ্ট্রের পিছু হঠা" বলে আখ্যা দেওয়ার অর্থ তথাকথিত 'কল্যাণকামী' রাষ্ট্রকে বুর্জোয়া শোষণের যন্ত্র বলে স্বীকার না করা ,তার মোহে পড়ে থাকা, বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্রকেই মানুষের গণতন্ত্র বলে প্রচার করা, অথচ যা আসলে পুঁজির তৎকালীন দায়িত্বই পালন করছিল নিষ্ঠাভরে। প্রকৃতপক্ষে এ হলো বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিকাশ --'কল্যাণকামী' থেকে 'নয়াউদারবাদী'-তে রূপান্তর আসলে পুঁজির অতিরিক্ত উৎপাদনের ধরন 'পরিমাণ' থেকে 'গুন'-এ (স্ট্যাটিসটিক্স-এর ভাষায় 'অ্যানসেমবেল' থেকে 'টাইম ভ্যারিয়েশন'-এ) উত্তরণের রাজনৈতিক রূপ। বিপরীতে 'কল্যাণকামী' দাবিসমূহ উত্থাপন করাই আজ পিছু হঠার সামিল। 'পরিমাণ' থেকে এই 'গুন'-এ উত্তরণ অবশ্য বিপুল পরিমানের উৎপাদনকে নাকচ করে হয় না, বরং তাকে চারপাশে রেখেই একটা কেন্দ্রীয় প্রবণতা অনুযায়ী চলে, যেমনভাবে প্রতিযোগিতাকে চারপাশে জিইয়ে রেখেই কেন্দ্রীভূত পুঁজি নিজের গতি নেয়। এখন এই ভবিষ্যৎ উৎপাদনের চুক্তিসমূহ বর্তমানের বিপুল শ্রম (তথা শ্রমদান সৃষ্টি)-কে নাকচ করে নয় বরং তারই সাপেক্ষে ভবিষ্যতের শ্রমশোষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ডেরিভেটিভ ক্যাপিটালের বুদবুদ কেবল তা-ই প্রকাশ করে। 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'-তে মার্ক্স বলেছিলেন, "বুর্জোয়া সমাজে বর্তমানের উপর আধিপত্য করে অতীত।" আজকে তার বিকাশের স্তর পৌঁছেছে সেই মাত্রায়, যখন শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতের ওপরেও আধিপত্য করছে অতীত।
শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী সংগ্রামের আজকের কর্তব্য তাই অতীতে ফিরে যাওয়ার দাবী তোলা নয়, ভবিষ্যতের দখল নেওয়ার। সুতরাং পুঁজির ভবিষ্যতের লক্ষ্যমাত্রার বিরুদ্ধে সংঘাত সৃষ্টিই যে তার একমাত্র কর্তব্য, তা বলাই বাহুল্য।চুক্তিমাফিক ভবিষ্যতে যত শ্রমদাম-এর উদ্বৃত্ত তাদের অর্জন করতে হবে (কন্ট্রাক্টগুলোর মেয়াদ আর ডেরিভেটিভের দামসমুহ থেকে যা অনায়াসে স্পষ্ট হয়), আঘাত আনতে হবে তার ওপরেই। সুতরাং এ আঘাত হানতে হবে তাঁদেরই, যাঁরা তৈরী করছেন এই উদ্বৃত্ত,-- প্রথমতঃ মজদুর শ্রেনী, সংগঠিত হোন বা অসংগঠিত, কেবল নিজের খাটবার ক্ষমতাকেই যাঁরা বেচেন সামান্যতম মজুরির বিনিময়ে, এবং দ্বিতীয়তঃ গরিব কৃষক ও স্বনিযুক্ত শ্রমিক, নিজের তৈরি করা পণ্য বেচেও খাটুনির দাম যাঁরা তুলতে পারেন না। এ বিষয়ে মধ্যশ্রেণী গুলো (শিক্ষক-অধ্যাপক -ডাক্তার, মোটা মাইনের অফিসকর্মী, আজ যাঁরা উচ্চ মধ্যবিত্ত) এবং উদ্বৃত্তভোগী তথাকথিত 'দক্ষ' শ্রমিকদের দিকে হাঁ করে চেয়ে থেকে, এবং তাঁরাই দলে দলে বেরিয়ে এসে শ্রমিক-কৃষক দের সংগঠিত করবেন, এধরনের আশা পোষণ করে কেবল সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিকে ও তার তীব্র শোষণের ব্যবস্থাকে সহায়তায়ই করা যেতে পারে, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম নয়। এদের মাঝে 'অবতার,' খোঁজার পেছনে সময় ব্যয় করা আজ কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষে শুধু বাহুল্যই নয়,ক্ষতিকর।প্রবল বিপ্লবী শ্রেণীসংগ্রামের জোয়ারে নিজে থেকেই যে 'অবতার'-রা আসবেন, যেমন এসেছেন বারংবার সমস্ত দেশেই, কিন্তু কেবল 'ওম্যাটোকায়া'- জনগণের লড়াইয়েরই অংশ হতে, 'ওম্যাটোকায়া'-দেরই একজন হতে, নিজের শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে নয়, তাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাতে আমরা দ্বিধাবোধ করি না। শুধু "নয়াউদারবাদী বিশ্বায়নের আওতায় শ্রেণি সম্পর্কের পরিবর্তন হয়েছে", একথা বলার পাশাপাশি ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে এবং বর্তমান উদ্বৃত্ত অর্জন তথা শ্রেণীশোষণের স্বরূপ ঠিক কী, তা সবিনয়ে চেপে যান যে সমস্ত কমিউনিস্ট নেতা ও তাত্ত্বিকেরা, তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে আমরা খোলসা করে দিই শ্রেণীসম্পর্কের পরিবর্তনে এই রূপকে। ১০০ বছর আগে লেনিন যাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন উন্নত দেশগুলোর "ঘুষ খাওয়া" শ্রমিক বলে, তা-ই আজ এক-একটা দেশের গন্ডির মধ্যেও 'দক্ষ' ও ম্যানেজারিয়াল শ্রমিকদের ভূমিকায় পরিণত পরিলক্ষিত হয়। ১০০ বছরের সাম্রাজ্যবাদ বিকশিত হয়েছে এভাবেই যে, লেনিন যা ব্যাখ্যা করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী জাতিসমূহ ও অন্যান্য জাতিগুলোর অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, আজ তা-ই দেখা দিয়েছে এক-একটা জাতিরাষ্ট্রের নিজের অভ্যন্তরেও, পুঁজি যখন জাতিরাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করেছে। শুধু সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতেই নয় এক-একটা জাতিরাষ্ট্রের মধ্যেও আজ পুঁজির একচেটিয়াগুলোর সংঘাত ক্রমবর্ধমান, যা প্রকাশ পায় তাদের প্রোডাক্ট কোয়ালিটি আর অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কে কেন্দ্র করে পরস্পরের বিরুদ্ধে কেস-কারবারির বাড়-বাড়ন্ত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির কেনা-বেচা সংক্রান্ত দুর্নীতি ও নেতা-মন্ত্রীদের জেলহাজতের রমরমা বৃদ্ধির দৃশ্যগুলোতে। ভেতরে ক্যাসার আর বাইরে বিশাল চেহারার পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নামক এই বিশাল রাক্ষসটার প্রাণভোমরা কিন্তু মজদুর এবং কৃষক ও স্বনিযুক্ত শ্রমিক, যাঁরা বাধ্য হন তাদের যথাক্রমে শ্রমশক্তি ও উৎপাদিত পণ্য বেচতে, আপাতদৃষ্টিতে দুর্বল, তাঁদেরই হাতে;তাঁদের এই শ্রমশক্তি ও উৎপাদিত পণ্য বেচবার সম্মতির বিচারে। আজকের পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেক্ষিতে বিপ্লবী আঘাত উপায়ও তাই --লেনিনীয় দৃষ্টিতে, "আঘাত করো সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিতে"।
সূত্রঃ
১. রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ভারতের বেসরকারি শিল্প-পরিষেবা
ক্ষেত্রের সামগ্রিক লোন বৃদ্ধির হার ২০১২-১৩ সালে ১৪.৭%।
২. 'গ্রুন্ডিসে'-তে
মার্কস বিশ্লেষণ করেন "উৎপাদন শুধুমাত্র প্রয়োজন মেটানোর জন্য বস্তুর জোগান
দেয় না, বস্তুর জন্য প্রয়োজনেরও জোগান দেয়।... ভোগের প্রয়োজনীয়তার
অনুভূতি বস্তুর সম্পর্কে ধারণার ভিত্তিতেই তৈরি হয়।... ফলে উৎপাদন শুধুমাত্র
বিষয়ীর জন্য বিষয়ের সৃষ্টি করে না, বিষয়ের জন্য বিষয়ীও
সৃষ্টি করে"।আজকের দিনে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট-এর মাধ্যম ক্রেতা তৈরীর বাহুল্য এ
বক্তব্য দিয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা যায়।
৩. স্টোরেজ সিস্টেমও আজ হয়ে উঠছে একটা ধনতান্ত্রিক
উৎপাদনক্ষেত্র যখন শপিংমলগুলো বেড়ে চলেছে গুণিতক হারে। 'ক্যাপিটাল'-
এর দ্বিতীয় খন্ডে মার্ক্স দেখান,
" সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে, তারা হতে পারে
কেবল ব্যয়, জীবন্ত বা বাস্তবায়িত শ্রমের অনুৎপাদনশীল ব্যয়,
কিন্তু ঠিক সেই কারণেই তারা ব্যক্তি পুঁজিপতির পক্ষে হতে
পারেমূল্য-উৎপাদনশীল, তার পণ্যের বিক্রয় দামে হতে পারে একটি
সংযোজন" এবং তিনি উল্লেখ করেন "সমস্ত শ্রম, যা
মূল্য যোগ করে,তা উদ্বৃত্ত মূল্যও যোগ করতে পারে এবং
পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রণালী তে সবসময়েই উদ্বৃত্ত মূল্য যোগ করবে"। এভাবেই
শপিংমলের কর্মীরাও হয়ে উঠছেন উদ্বৃত্ত সৃষ্টিকারী শ্রমিক।
#. ধরা যাক, একটি শ্রমদিবসের সমতুল্য 'অর্থ' ধরা হয়েছে ১০০০ টাকার সমান।এখন বছরের মোট শ্রম
দিবস যদি হয় ১০ কোটি আর সমস্ত পণ্যের মোট এমআরপি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে ১০,০০০ কোটি (মোট শ্রম এর সমতুল্য 'অর্থ') টাকার বেশি, তাহলে টাকার দাম কমে যাবে (এবং বিপরীত
ক্ষেত্রে বেড়ে যাবে) এবং যদি বাস্তবেই এই রকম পণ্য বিক্রির অবস্থা তৈরি হয়
সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তরফ থেকে বাজার থেকে মুদ্রা তুলে নিয়ে বা বাজারে মুদ্রা
ছেড়ে সমস্যার সমাধান করা হয়।
*. জমি বা তরঙ্গের দামের থেকে খনি বা গ্যাস বেসিনের দাম
গুণগতভাবে আলাদা, কারণ প্রথম দুটি উৎপাদিত বা পুনরুৎপাদিত
হয় না, কিন্তু দ্বিতীয় দুটি খনিজ পদার্থের উৎস এবং মোট যত খনিজ
পদার্থ সেখান থেকে পাওয়া যেতে পারে তার উৎপাদন দামই এদের দাম, ফলে এদের ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণ হবে প্রথম উপাযয়ে। উল্লেখ্য যে সূর্যের
আলোরো দাম তৈরি হতে পারে এবং বড় বড় সোলার প্রজেক্ট তৈরির পরে তা হবেও; কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সূর্যের জেনিদ কোন আলাদা হওয়ার কারণে রশ্মির
তীব্রতা আলাদা, যা ভিন্ন ধরনের উৎপাদনশীলতা তৈরি করবে।
সেক্ষেত্রে সূর্যালোকের দাম নির্ধারিত হবে দ্বিতীয় পদ্ধতিতে।
**. এ ধরনের কপিরাইট-এর জন্য বিগত দশকে কয়েকটি দেশে খরচের
বৃদ্ধির পরিমাণ (কোটি ডলার-এ):
##. যেমন জমির উর্বরতা বৃদ্ধি বা হ্রাস-এর বিষয়টা স্বতঃস্পষ্ট,
টেকনোলজির ক্ষেত্রে তা সম্ভব উৎপাদনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তার
মডিফিকেশন করলে বা উল্টোদিকে অন্য কোন আরও উন্নত টেকনোলজি আবিষ্কৃত হলে।
৪. এভাবেই 'ক্যাপিটাল'-এর ৩য় খন্ডে মার্ক্স 'মূল্য' ও 'দাম'- কে পৃথক করেন।
#১ উদ্বৃত্তভোগী মধ্যশ্রেণীগুলো দুই শিবিরের মাঝে দোলাচলে থাকে,
কিন্তু পুঁজিবাদের বিকাশের সাথে সাথে তারা প্রায় স্থায়ী শিবির
বেছে নিতে থাকে। কিসের ভিত্তিতে এদের প্রবণতা সৃষ্টি হয়, তা-ও
আমরা দেখাব।
৫. থমাস পিকেটি তাঁর 'একুশ শতকে পুঁজিবাদ'
বইতে ইউরোপের প্রধান তিনটি দেশ-- জার্মানি,ব্রিটেন
ও ফ্রান্স এবং মার্কিন দেশের পুঁজির যে লেখচিত্র দেখিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট যে তাদের জাতীয় আয়ের তুলনায় বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগের
পরিমাণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই অত্যন্ত কম , প্রায়ই
৫%।
৬. এঙ্গেলসের 'ইংল্যান্ডে শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থা' এবং লেনিনের 'সাম্রাজ্যবাদ' বইতে এর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা
হয়েছে।
৭. ২০০৮ সালে যখন বিশ্বে আর্থিক মন্দা দেখা দেয়,তখন ডেরিভেটিভ ক্যাপিটাল ছিল ৬৮০ ট্রিলিয়ন ডলার,যেখানে
সমগ্র বিশ্ব উৎপাদন ছিল মাত্র ৬৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং মোট শেয়ার ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার।
#২. হিসাবটা সহজে বোঝানোর জন্য আমরা লোনের উপর সুদটা ধরিনি, যদিও সেটাও পুঁজিকে আরো বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু এতে ঘটনাটার গুণগত পার্থক্য
খুব একটা হয় না,কারণ সুদ মুনাফারই অংশবিশেষ।
৮. ২০০৭ সালে বিশ্বজুড়ে কোম্পানিগুলোর হাত বদলের মোট দাম ছিল
৫১.২ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০০৮-এ তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫৭.৫ ট্রিলিয়ন
এবং ২০১১-তে তা হয় ৫১.৬ ট্রিলিয়ন, যে বছর মোট বিনিয়োগ ছিল
মাত্র ১৫৯.৮ বিলিয়ন ডলার।
#৩. মনে রাখা দরকার, এই গড়পরতা হার মানে নির্দিষ্ট একটা সংখ্যা নয় যে ভুলটা অর্থনীতিবিদেরা প্রায়শই করে থাকেন; এর মানে এই গড়-এর উপর-নীচে একটা বিন্যাস থাকে,সাধারণত যার প্রবণতা থাকে, স্ট্যাটিসটিকস্- এর ভাষায় যাকে বলে 'নর্ম্যাল ডিস্ট্রিবিউশন', তার দিকে। দাম নির্ধারণের সময় ধরে নেওয়া এই গড় মুনাফা হার হল বাস্তবে উপলব্ধ মুনাফার হারের বিন্যাসের গড়,অর্থাৎ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধরে নেওয়া একটা গড়।
৯. উদাহরণস্বরূপ, একটা পুঁজিবাদী দেশের অসাম্য-এর অবস্থাকে পিকেটি তাঁর 'একুশ শতকে পুঁজিবাদ' বইটিতে বিচার করেন এই উপলব্ধ মোট মুনাফা হারের সাথে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারকে তুলনা করে। প্রথমতঃ,মোট উপলব্ধ মুনাফা (যার মধ্যে ধরা হয়েছে উপরে বলা চারটে অংশই) হারকে মার্ক্সের পদ্ধতিতেই তিনি গণনা করেন এবং তার সাপেক্ষে ভুল বলে ঘোষণা করেন 'নির্ধারিত' মুনাফা হারের তত্ত্বকে। দ্বিতীয়তঃ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার যে উৎপাদনশীলতা ও জনসংখ্যা (আসলে হবে পণ্য উৎপাদনে অংশগ্রহনকারী শ্রমিকের সংখ্যা) বৃদ্ধির হারের উপরই নির্ভরশীল, তা উল্লেখের মধ্যে দিয়ে তিনি কার্যতঃ স্বীকার করে নেন মার্ক্সেরই কেবল শ্রম দ্বারা মূল্য সৃষ্টির তত্ত্বকেই, যদিও শ'খানেকবার মার্ক্স-এর তত্ত্বকে খারিজ করেন তাঁর গবেষণার ভিত্তি হিসাবে।কিন্তু সামগ্রিকভাবে শ্রম ও পুঁজির অন্য দেশে চালান-এর বিষয়টাকে পৃথকভাবে গণনা না করে একটা বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্ব খাড়া করতে অসমর্থ হন, বিশেষ করে একুশ শতকে, যখন এটাই পুঁজিবাদের প্রধান বিষয়।
১০. মার্ক্সের 'ক্যাপিটাল'-৩ য় খণ্ডে এঙ্গেলসের মূল্যের নিয়ম' সংক্রান্ত সংযোজনী দেখুন।
১১. উদাহরণস্বরূপ, টয়োটা যা আজকে বৃহত্তম গাড়ি কোম্পানি, ১৯৩৬ সালে যখন প্রথম গাড়ি বাজারে নিয়ে আসে, তা ছিল ফোর্ড বা জেনারেল মোটরস-এর গাড়ির থেকে প্রায় ১০% সস্তা (দশভাগের একভাগ দাম) ; ১৯৮০-র দশকের শেষে সে-ই লঞ্চ করে লাক্সারী গাড়ির একটি আলাদা শাখা 'লেক্সাস'। ৭০-এর দশকেও যার অ্যাডভার্টাইসমেন্টের স্লোগান ছিল "চাইলেই পাবে",২০০০ সালে তার স্লোগান দাঁড়ায় " অনুভূতির আস্বাদ নাও"। এভাবেই পরিমাণ থেকে উৎপাদনের গুণগত ধরণে রূপান্তর স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় এই কোম্পানি গত শতাব্দীর শেষ ৫০ বছরে তৈরী করেছে যেখানে মাত্র ১৬ টি ব্যান্ড, সেই এই শতকের প্রথম ১০ বছরে এনেছে ৪৪ টি ব্র্যান্ড; যার ক্ষনস্থায়িত্ব প্রমান পায় যখন দেখি এই ১০ বছরেই তাকে দিতে হয়েছে ১৬টি 'রিকল'।
Comments
Post a Comment