আবদালা ও সোবেরানাঃ কিউবার ভ্যাক্সিন গবেষণা নিয়ে একটি পর্যালোচনা

অনন্যা দেব



বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় করোনা মহামারীর মাঝে আবারও কিউবা নতুন স্থান অর্জন করে নিল। কিউবা মাত্র ১৩ মাসের মধ্যে দু'খানা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি করতে পেরেছে। একটার নাম আবদালা, আরেকটার নাম সোবেরানা-০২। এর ফলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি এবং দেশের রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল ডায়েজ ক্যানাল ঘোষণা করেছেন যে এই  ভ্যাকসিনগুলি দরিদ্র দেশগুলিতে খুবই অল্প দামে তাঁরা বিক্রি করবেন এবং বিক্রির টাকা দিয়ে তাঁরা নিজেদের ধ্বসে পড়া অর্থনীতিকেও নতুন করে চাঙ্গা করার চেষ্টা করবেন, এমন একটা সময়, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিউবার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে। অর্থাৎ কিউবা এটাই শেখায় যে, দরিদ্র দেশের মুক্তির উপায় হচ্ছে যে সম্ভব হলে সে তার নিজের জিনিস নিজেই তৈরি করে বিশ্ববাজারে সেটা কম দামে বিক্রি করে একদিকে নিজের দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাবে এবং অন্যদিকে অন্য দেশের মানুষকেও সাহায্য করবে।

আবদালা ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে কিউবা পেটেন্ট না নেওয়ায় ভেনেজুয়েলা এবং ভিয়েতনাম নিজেদের দেশে এই ভ্যাক্সিন তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে, অন্যদিকে ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের সময় ইরানও তা নিজের দেশে ব্যবহার করেছে। এই মূহুর্তে, ইরান কিউবার থেকে একটা বিশাল পরিমাণ ভ্যাকসিন আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোও কিউবার সাথে সম্পর্ক রেখে চলছে এই ভ্যাকসিন নিজেদের দেশে আমদানি করার পরিকল্পনা হিসেবে। কিউবার স্বাধীনতা সংগ্রামী হোসে মার্তির একটি দেশাত্মবোধক কবিতার নামে আবদালা ভ্যাক্সিনের নামকরণ করা হয়েছে। এই ভ্যাক্সিনটি তৈরি করেছে সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি, যার প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো। এই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর মার্তা আলভিস-এর বক্তব্য অনুযায়ী, এই ভ্যাক্সিন শুধুমাত্র প্রধান সার্স কোভি-২ অর্থাৎ DG614G স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কাজ করছেনা,  উপরন্তু আলফা, বিটা, গামা মিউট্যান্ট যেগুলো আস্তে আস্তে সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও কার্যকরী হিসেবে দেখা গেছে। এবং আবদালা ভ্যাক্সিনের ৯২.২৮% কার্যকারীতা পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম কার্যকরী মাত্রা হল ৫০%। স্পষ্টতই, আবদালার ক্ষেত্রে এই কার্যকারীতা অনেক বেশি মাত্রার এবং সফলও বটে। এই ভ্যাক্সিনের ফেজ-৩ ট্রায়াল সমাপ্ত। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে কিছুটা ইরানে এবং কিউবার মধ্যে স্যান্টিয়াগো দি কিউবা, হাভানা, গুয়ান্তানামো, বায়ামো অঞ্চলের ৪৮,০০০ ভলান্টিয়ারদের মধ্যে। আবদালা ভ্যাক্সিন হল ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাক্সিন যা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জেনেটিক ইনফর্মেশন ইস্ট 'পিছিয়া প্যাস্টরিস'- এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে।ফলে শরীরে ইঞ্জেক্ট করলে এই ভ্যাক্সিনে থাকা জেনেটিক ইনফরমেশনের মাধ্যমে স্পাইক প্রোটিন তৈরি হবে শরীরে, যার বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিষেধক হিসেবে অ্যান্টিবডি তৈরির প্রক্রিয়া কার্যকরী হয়ে উঠবে। এটা আবদালা ভ্যাক্সিনের কার্যপদ্ধতি। আবদালা ভ্যাক্সিনের তিনটে ডোজ, যা ১৪ দিন অন্তর নিতে হবে।

সোবেরানা-০২ (সভেরিন বা সার্বভৌম শব্দ থেকে অনুপ্রাণিত) ভ্যাক্সিনের দুখানা ডোজ। দুখানা ডোজের কার্যকারীতা ৬২%। এটিও হু-এর ৫০%-এর মাত্রার থেকে বেশি। এই দুখানা ডোজের পর আরো একটা বুস্টার ডোজ হিসেবে "সোবেরানা প্লাস" দিলে এফিকাসি আরও বাড়ে কিনা তা নিয়ে ট্রায়াল এখনো বাকি আছে। এটি তৈরী করেছে ফিনলে ইনস্টিটিউট। এই ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ভিনসেন্ট বেনকম্বোর বক্তব্য অনুযায়ী সোবেরানা-০২ মাত্র ১৩ মাসে প্রস্তুত হয়েছে। আবদালা ভ্যাক্সিনের মতো বিভিন্ন মিউটেন্টের বিরুদ্ধেও এটি কার্যকর। এই ভ্যাক্সিনটি ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেনের সাথে টিটেনাস টক্সওয়েডকে জুড়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে। এই ভ্যাক্সিনের ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনো বর্তমান যা ২০২২-এর জানুয়ারি মাস অবধি চলবে। অন্যদিকে, এই জুন মাসেই কিউবার জুয়ান ম্যানুয়েল পেডিয়াট্রিক হস্পিটাল ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে পিতামাতার অনুমতিপ্রাপ্ত ২৫জন ভলেন্টিয়ারের ওপর ভ্যাক্সিনটির ট্রায়াল চালিয়েছিল এবং তাদেরকে ৫ দিন অবধি নজরে রাখা হয়েছিল। এখনো পর্যন্ত বিশেষ খারাপ প্রভাব দেখা যায়নি।

রাষ্ট্রপতি মিগুয়েল ডায়েজ ক্যানালের মতে, ফিদেল ক্যাস্ট্রোর যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দেশের উন্নতিসাধনে এবং কিউবান বিপ্লবের কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, তা সৃষ্টি করেছে আজকের এই ভ্যাক্সিনগুলিকে। যেখানে সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে ভ্যাক্সিন তৈরি হয়েছে এবং সকলের উপর ঠিক করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করেই তা বাজারে বিক্রী হচ্ছে, সেখানে স্বল্প আর্থিক ব্যয়ে মাত্র ১৩ মাসের মধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ফেজ-৩ সমাপ্ত করে আবদালা ভ্যাক্সিনকে বাজারে আনতে এবং দরিদ্র পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে কিউবা। তাছাড়া ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এত তাড়াতাড়ি সম্ভবপর হয়েছে কারণ কিউবার মানুষ তাদের বিপ্লবী সরকারের ঐতিহাসিকভাবে সফল গবেষণামূলক কাজকর্মের প্রতি ভরসা রাখে। দীর্ঘদিন ধরে এইডস, হেপাটাইটিস বি বা অন্যান্য স্নায়ু রোগের বিরুদ্ধে  বিস্ময়কর ওষুধগুলো বারবার তৈরি করতে সফল হয়েছে কিউবা। সেই ভরসা থেকেই দেশের মানুষ নিজেরা এবং নিজেদের সন্তানদের ভলেন্টিয়ার হিসেবে এগিয়ে নিয়ে আসতে দ্বিধা করেনি। 

Comments

  1. As usual Cuba is the Vanguard in playing important roles in the service of mankind !

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views