কৃষক আন্দোলনঃ যা দেখেছি, যতোটুকু দেখেছি
সৌম্য চট্টোপাধ্যায়
(১৩ই ফেব্রুয়ারি - ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১)
প্রাককথন
আজ দুই মাস হতে চললো প্রায়। কৃষক আন্দোলনকে সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসা। ২৬ শে নভেম্বর শীত যখন উত্তর ভারতে জাঁকিয়ে বসার উপক্রম করছিলো, পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরাও একের পর এক ব্যারিকেড ভেঙে দিল্লির যতোটা কাছাকাছি আসা যায় এসে পড়েছিলেন। তারপর তারাও শীতের সাথে সাথেই জাঁকিয়ে বসলেন সিঙ্ঘু, টিকরি, পরবর্তীকালে গাজীপুর, সাঁজাপুর জুড়ে। এর ঠিক দুই মাস বাদে কৃষকদের রিপাবলিক ডে প্যারেড দেখার জন্য সারা দেশ উন্মুখ। সেইসময় কী হবে কী হবে উত্তেজনা নিয়ে আমরাও একটা দল পৌঁছে গিয়েছিলাম সেইসব বর্ডারে। সেটা ছিল প্রথম দফা আন্দোলনকে সামনে থেকে দেখা। যাওয়া আসা মিলিয়ে দিন সাতেক। সেই দফায় গিয়ে মনে হয়েছিল এই আন্দোলনের যতোটা বড়ো ব্যাপ্তি, তাতে শুধু বর্ডারগুলো দেখতে গেলেই অন্তত এক মাস মতো থাকতে হবে। সেই সুযোগ ছিল না সেবার। প্রথম দফার এই অভিজ্ঞতা আলাদা করে বলতে ঢুকবো না। বলবো দ্বিতীয় বারের কাহিনীই। সেটা বলতে বলতে নিশ্চিতভাবে প্রথমবারের কিছু কথা উঠে আসবে, যেটুকু উঠে আসার মতো।
এই দফায় ফিরে আসার পর থেকেই মনে হচ্ছিল পুরো অভিজ্ঞতাটা লিখে রাখা দরকার। কিন্তু মুস্কিলটা হল একটা আত্মবিশ্বাসের অভাব বোধ করছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল এই কদিনে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে অনেক কিছুই জমা হয়েছে বটে, কিন্তু গুছিয়ে লেখার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। বা বলা ভালো, লেখার গড়নটা ঠিক ভেবে উঠতে পারছি না। ধীরস্থির মস্তিষ্কে যে চর্চা বা গবেষণার প্রয়োজন ছিল তা ব্যতিরেকে এই অভিজ্ঞতাসমূহকে কোনও সুডৌল রূপ দেওয়া যাচ্ছিল না। অত্যধিক শারীরিক ক্লান্তি, করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়া ইত্যাদি সেই প্রকল্পে আরো জল ঢেলে দিল। আজ লিখছি কারণ মনের ভিতর খুঁতখুঁতানিটা রয়ে গেছিল। আজ ভেবে দেখলাম, একে আমার ভুলো মন - এতো কিছু দেখলাম, জানলাম, অল্প হলেও যেটুকু বুঝলাম, সেটুকু লিখে রাখা দরকার। অভিজ্ঞতাজনিত কিছু উপলব্ধি জমা হয়েছে মনে। সেগুলো স্মৃতির সাথে সাথেই ক্ষয় পাচ্ছে। ক্ষয় পাওয়ার আগে স্মৃতিচারণের মাধ্যমে আপনা থেকে যে রূপ পায় সেই রূপই দিই না! কোনও এক ভাবে অন্তত লিপিবদ্ধ থাক। নিজের জন্য, যারা স্বচক্ষে এই আন্দোলন দেখলো না, তাদের জন্য। এই ভেবেই লিখতে বসা।
এই লেখার দৌড়ঃ
কৃষক আন্দোলন দেখাটা আমার কাছে "অন্ধের হস্তীদর্শনে"র মতো। এই লেখাতেও সেই খণ্ডকে হাতড়ে বেড়ানো আছে। তা থেকে কতটা সমগ্রতার আঁচ পাওয়া যাবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান। একটা ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার প্রেক্ষাপটে স্থাপন না করলে, কিছু প্রশ্নের সাপেক্ষে উত্তর খোঁজার চেষ্টা না করলে যে খামতি রয়ে যায়, এই লেখায় তা আছে। এই লেখাকে বলা যায় "অভিজ্ঞতা ও তদজনিত কিছু উপলব্ধির লিপিবদ্ধ রূপ"। কিন্তু পাঠক "অভিজ্ঞতাবাদে" দুষ্ট করতে পারবেন না লেখাটাকে কারণ এতে সীমাবদ্ধ কিছু অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে সাধারণীকরণের কোনও চেষ্টা করা হয়নি। দু'একজায়গায় কিছু চলতি "ধারণা"র কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা "ধারণা" হিসাবেই করা হয়েছে। এগুলো উল্লেখ করেছি কারণ এগুলো বাস্তবে সত্যি হোক বা না হোক, আন্দোলনে উপস্থিত একাংশের মানসিক ঝোঁক বুঝতে তা সাহায্য করবে। এটাও সত্যি যে এই "ধারণা"র সাথে সাথে এই মানসিক ঝোঁকগুলো বাস্তব অবস্থাকেও একভাবে প্রভাবিত করে।
যাওয়ার আগে...
দ্বিতীয়বার দিল্লি যাওয়ার কোনও আগাম পরিকল্পনা ছিল না। হঠাতই দায়িত্ব এসে পড়লো যেতে হবে। দায়িত্ব মানে সুযোগও, একটু বেশিদিন বেশি জায়গা থেকে আন্দোলনটাকে দেখার। কী দায়িত্ব? একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আন্দোলনের খবর করা! মনে হচ্ছিল ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার! অগত্যা ঢাল, তলোয়ার কেনা হল। মানে একটা ছোট্ট নোটবই আর পেন্সিল। সাথে যাবে সৌরভ। একেবারেই নব্যপরিচিত এক কমরেড। ওর মূল দায়িত্ব ছবি, ভিডিও তোলা। অর্থাৎ, দুই জন যাব, যাদের সাংবাদিকতার কোনও না আছে পাঠ, না আছে অভিজ্ঞতা। হাতে ছিল প্রায় ৯ দিন মতো সময়। আন্দোলনের আগু পিছু নিয়ে অল্প কিছু পড়লাম, দেখলাম, যাকে বলে হোম ওয়ার্ক আর কী। পরীক্ষার শেষ কদিনে পড়লে যা হয়, অগভীর বোঝাপড়া সহকারেই রওনা দিলাম। নোটবুক আর পেন্সিল কেনার পরেও পুরো যাত্রাপথটাই মনে হয়েছে "ঢাল নেই তলোয়ার নেই...”।
দিল্লিঃ সিঙ্ঘু ও টিকরি বর্ডার
আগেরবার টিকরিতে ছিলাম। সিঙ্ঘু "দর্শন" করে এসছিলাম, কিন্তু থাকা হয়নি। এবার সিঙ্ঘুতেই থাকা দিয়ে শুরু। ১৪ই ফেব্রুয়ারি। দিল্লির দিক থেকে ব্যারিকেডের ফাঁক দিয়ে অবস্থানের মূল জায়গায় পৌঁছনোর রাস্তা বন্ধ। অনেকটা ঘুর পথে টোটো রিক্সায় (কুণ্ডলী শিল্পাঞ্চল হয়ে) মাঝামাঝি একটা জায়গার কাছে এনে ছেড়ে দিল। সিঙ্ঘুর মূল মঞ্চ (সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার) সেখান থেকে প্রায় দু কিলোমিটার দূর। পিঠের ভারী ব্যাগ রাখতে হবে কোথাও একটা। সামনেই এক আম্বেদকারবাদী ছাত্র সংগঠনের তাঁবুতে গিয়ে ভাব জমালাম। নানা রকম বই রাখা সেই তাঁবুতে। শিখ ধর্মের ওপর বইয়ের সংখ্যাধিক্য। নিয়ম হল যে কেউ তুলে নিয়ে ওখানে বসেই পড়ো। কিছু বই তুমি নিয়েও যেতে পারো। তাঁবুর দায়িত্বে থাকা অল্প বয়েসি ছেলেটার নাম জগভিন্দর। বলছিল পাঞ্জাবে জাতপাতের বিষয়টা জটিল। আপাতভাবে সমাজে এর বাহ্যিক ছাপ কম থাকলেও অর্থনৈতিক সম্পর্কে গভীর ছাপ আছে। যেটুকু যা সংস্কার হয়েছে তাতে শিখ ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা। এখন বাস্তব চিত্রটা কীরকম? মোট জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ এখানে তফসিলি জাতিভুক্ত। অথচ তাদের হাতে মোট জমির পরিমাণ শতকরা ২ ভাগ। ও বলছিল "জমিন প্রাপ্তি সংঘর্ষ কমিটি"র আন্দোলনের কথা। যারা তফসিলি জাতি, উপজাতির ভূমিহীন খেতমজুরদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ সরকারী জমি ভাগ বাটোয়ারা করে দেওয়ার দাবীতে আন্দোলন করছে। আক্ষেপ রয়ে গেছে, শুরুতে পরিকল্পনা থাকলেও সময়ের অভাবে এই সংগঠনটির কারুর সাথে সরাসরি কথা বলা হয়ে ওঠেনি পুরো যাত্রাটায়। তাঁবুতে জগভিন্দরের জিম্মায় ভারী ব্যাগ রেখে ক্যামেরা এবং ছোট ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম মূল মঞ্চের দিকে।
মঞ্চের পিছন দিয়ে মঞ্চে ওঠার রাস্তা। পরিকল্পনা ছিল আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতানেত্রীর সাক্ষাৎকার করা। স্বেচ্ছাসেবকদের বাধা টপকে দুবার মতো ঢোকার ব্যর্থ চেষ্টা করে অবশেষে বুক পকেট থেকে উঁকি মারা নোটবই আর ক্যামেরা ট্যামেরা দেখে রাস্তা ছেড়ে দেওয়া হল আমাদের। মঞ্চের পেছনে সাংবাদিকদের জন্য ঘেরা জায়গা। যাকে বলে ডেরা আর কী! ওখানে ঢুকে বাংলা থেকে এসেছি বলাতেই আপ্যায়ন আর বিস্মিত চোখের ঠেলায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়লাম। একজন ছিলেন যাকে সবাই বেশ মানিগন্যি করছে আর সবচেয়ে আত্মবিশ্বাসী সুরে তিনি বললেন "আপনারা কার কার সাক্ষাৎকার চান বলুন আমায়" , এবং তার পড়েই বললেন "কিন্তু আগে আমি আপনাদেরই সাক্ষাৎকার নেবো।" মজার অভিজ্ঞতা হল। ওই ডেরার মধ্যেই একটা পাঞ্জাবি চ্যানেলের কুড়ি মিনিটের টক শোতে আমরা অতিথি হয়ে গেলাম। সঞ্চালক, অতিথি কারুর ভাষাই হিন্দি নয়। কিন্তু "টুটি ফুটি" হিন্দিতে দু পক্ষ মিলে "হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানের" কারবারিদের শ্রাদ্ধ করলাম। অনুষ্ঠান শেষে সঞ্চালক সাংবাদিকটি যারপরনাই আপ্লুত। আরও বেশ কয়েকজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অদ্ভুত এক আবহ। এনারা সব এখানেই পড়ে আছেন আন্দোলনকে কভার করতে। বিভিন্ন আঞ্চলিক চ্যানেলের সাংবাদিক। কিছু আছে শুধু সোশাল মিডিয়ার পেজ। কতো কী ঘটছে রোজ এখানে। সবকিছু তুলে ধরছেন। বিগ মিডিয়ার সম্মিলিত ব্ল্যাকআউটের উল্টোদিকে এনাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এই কৌমচেতনা এই আন্দোলনের এক অন্যতম স্তম্ভ, যা নানা দিক থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে একে। সাংবাদিকদের এই ডেরায় তার একটা দিক চোখে পড়লো।
আন্দোলনের সমর্থনে এক অবসরপ্রাপ্ত এন এস জি কমান্ডো (কার্গিল যুদ্ধ, ২৬/১১এ লড়া রামেশ্বর সোহরান), অমৃতসর থেকে অনশন করে হেঁটে আসা একজন , হিন্দু মহাসভার এক প্রাক্তন সর্বভারতীয় নেত্রী অদ্ভুত সব মানুষজনের সাথে কথা হল ওই ডেরায়। কিন্তু সবচেয়ে ছুঁয়ে গেল বাংলারই আরেকজন মানুষের সাথে আলাপের ঘটনা। ওখানে সাফাইয়ের কাজ করছেন মঞ্জুরা বিবি । "সর্দারদের লড়াইয়ের পাশে আমরাও আছি। পুলিস এলেও যাইনি সেদিন।" বলছিলেন। পাশেই এক বস্তিতে থাকেন। নগরজীবনে প্রায় "অদৃশ্য" এই পরিযায়ী শ্রমিকদের আর কিছু না হোক দু হাত ভরে কাজ দিয়েছে এই আন্দোলন। ন্যায্য মজুরী আর প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন কি? সেই খোঁজ নিতে গেলে যেতে হত তাদের আস্তানায়। ভবিষ্যতে কোনও দিন সুযোগ পেলে যাব, জেনে আসবো এই কথাটা, যদি না তাদের উচ্ছেদ করে দেওয়া হয় ওখান থেকে।
ওইদিনই ছিল "পুলওয়ামা দিবস"। অর্থাৎ পুলওয়ামায় ভারতীয় আধা সেনা বাহিনীর ওপর "পাক জঙ্গি" আক্রমণের বর্ষপূর্তী। কৃষক আন্দোলনের জায়গাগুলোতে এই দিনকে বিশেষভাবে পালন করার কথা ঘোষণা করে কৃষকদের সংযুক্ত মোর্চা। এটার প্রেক্ষাপট বুঝতে গেলে ২৬ শে জানুয়ারি কৃষক প্যারেডের প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হবে। ২৬শে জানুয়ারিতে দিল্লির বুকে কৃষক প্রজাতন্ত্র প্যারেড ঘিরে নানাকিছু ঘটনা ঘটে। বিশদে ঢুকছি না। কিন্তু ওইদিনটা কৃষক আন্দোলনের যাত্রাপথে উল্লেখযোগ্য দিন। একটা অপ্রত্যাশিত মোড় বলা যায়। চলমান আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই দিনটার ভূমিকা সংক্ষেপে হলেও বলতেই হবে। সেদিন ঘটনা কী কী ঘটেছিল তার ভিতরে ঢুকছি না। তার আগেরদিন রাত্রেই (অর্থাৎ ২৫ জানুয়ারি, প্রথম দফার যাত্রায়) টিকরি সীমান্তে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার একটা বড়ো সংগঠনের অন্যতম সংগঠকদের সাথে কথোপকথন, বিভিন্ন কানাঘুষো এবং সন্ধ্যে নাগাদ মানুষজনের হইহুল্লোরের বহর দেখে বুঝতে পারছিলাম কৃষক প্যারেডের ঘোষণা নেতৃত্বের কাছে শাঁখের করাতের মতো হয়ে গেছে। রাষ্ট্র এই খেলাটা খেলে দিয়েছে তাদের সাথে। অনুমতি পত্র ঝুলিয়ে রেখে একদম শেষ লগ্নে এসে তা দেওয়া, নির্দিষ্ট রুটের ম্যাপ প্রকাশে আরও দেরি করা ইত্যাদি সব কিছুই ইচ্ছাকৃতভাবে করে ফেলেছে যাতে সংগঠকরা যতোই চেষ্টা করুক বিশৃঙ্খলা হবেই হবে! হলোও তাই। আন্দোলনের মুখ পোড়াতে অর্থাৎ তার সামাজিক ন্যায্যতাকে খর্বিত করতে অনেক কিছুই করলো রাষ্ট্র পরিকল্পনা মাফিক। "তার পর ঠিক সাতদিন লেগেছে আমাদের সবকিছু সামলে নিতে, এবং আন্দোলন তার পর আরও বহুগুণ বেশি শক্তিশালী হয়েছে" - ২৬শে জানুয়ারির ঘটনা প্রসঙ্গে আন্দোলনের অন্যতন তরুণ নেতা রাজিন্দর সিং দীপ সিংয়ের বক্তব্য ছিল এরকম।
কৃষক আন্দোলনকে প্রায় যখন খালিস্তানি আন্দোলন, "অ্যান্টি ন্যাশনাল" প্রতিপন্ন করতে সফল হয়ে যাচ্ছিল রাষ্ট্র ঠিক তখন একের পর এক প্রেস কনফারেন্স করে, অত্যন্ত সুচারুভাবে নিজেদের পায়ের তোলার জমি ফিরে পেতে সফল হয় কৃষক নেতৃত্ব। পরবর্তীকালে আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী নানা প্রতীকের ব্যবহার বাড়িয়ে তোলাও এই ডিফেন্স মেকানিজমের অংশ। অস্বীকার করার জায়গা নেই যে আন্দোলনের শুরু থেকেই শিখ মৌলবাদী তথা খালিস্তানি ঝোঁকসম্পন্ন ক্ষুদ্র একটা অংশ আন্দোলনে মাথা তোলবার চেষ্টা করছিল নানাভাবে। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই সেই বিষয়ে সচেতন ছিল এবং নানাভাবে তাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ২৬ শে জানুয়ারির পর এই অংশটিকে জনসমক্ষে চিহ্নিত ও বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই পর্যায়ে ঘটে। আগের মতো আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্ব আর পাঞ্জাবের হাতে থাকে না। উঠে আসেন রাকেশ টিকায়েতের মতো নেতা। "জাট বিরাদরির লাইনে একক নেতৃত্ব হিসাবে টিকায়েতকে প্রতিষ্ঠার ছক?” এরকম আশংকার কথা শুনতে পেয়েছি পরে পাঞ্জাবের এক কৃষক নেতা ও এক বড়ো পত্রিকার সাংবাদিকের মুখে। বিপ্লবী বামদের নেতৃত্ব এই পর্যায়ে খর্বিত হওয়াকে তারা দুজনেই নেতিবাচকভাবে দেখছেন। আবার পাঞ্জাবেরই এক তথ্যচিত্র নির্মাতা সহ আরও কয়েকজনের সাথে সমসাময়িক কথোপকথনেই উঠে এসেছে ভিন্ন মত। তাদের বক্তব্য ২৬ এর পর আন্দোলন পাঞ্জাব, হরিয়ানার গণ্ডী ছাড়িয়ে উত্তর প্রদেশের একাংশে ছড়িয়ে পড়ায় সর্বভারতীয় রাজনীতিতে যতোটা গুরুতকপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেটা অন্যথায় হত না।
যাইহোক, ২৬ পরবর্তী পর্যায়ে হাওয়া বদলে গেছে। কেউই ঠিক জানে না সেই হাওয়া কোনদিকে ঠেলবে আন্দোলনকে। এই প্রেক্ষাপটেই ১৪ই ফেব্রুয়ারির পুলোয়ামা দিবস পালন। সদ্য ঘা খেয়ে উঠে আন্দোলন তখন দেশপ্রেম এর চলতি হাওয়ার পন্থী হয়েও কিছুটা নিজের মতো করেই নিজেকে নির্মাণের পথে। "জয় জওয়ান জয় কিষান" ধ্বনিতে নতুনভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সে বলছে "কৃষক মজদুর পরিবারের সন্তানরাই তো দেশের জওয়ান হয়। পুঁজিপতি আর নেতা মন্ত্রীদের সন্তানরা তো আজকে জওয়ান হয়েও শহীদ হয় না, দেশের স্বাধীনতার জন্যও শহীদ হয়নি। তার ওপর আজকের মোদী সরকার তো আধাসামরিক বাহিনীর জওয়ানদের শহীদের মর্যাদা দিতেও রাজি নয়। আমরা তা দেবো।" মোদী শাহদের উগ্র দেশপ্রেমের নির্মাণের উল্টোদিকে কৃষক আন্দোলনে নিজেদের মতো করে দেশপ্রেমের এই নির্মাণটা লক্ষ্যনীয়। ওরা যেখানে "আন্দোলনজীবি"দের "দেশদ্রোহী" বলার দিকে এগোতে চাইছে, কৃষক আন্দোলন বলছে প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা চিরকাল আন্দোলনজীবিই ছিলেন! সন্ধ্যার অন্ধকারে কয়েক হাজার মোমবাতি আর গোলাপ ফুল এগিয়ে আসছিল সিঙ্ঘুর মূল মঞ্চের দিকে। ভালোবাসা, লড়াই আর আত্মবলিদানের উজ্জ্বল, নরম প্রতীকের মতোই।
সেই রাতে ঠাঁই হল দিল্লি গুরুদ্বারা প্রবন্ধক কমিটির এক নৈশ আস্তানায়। এই আন্দোলনে যে কৌম চেতনার ভূমিকার কথা উল্লেখ করছিলাম তার অন্যতম হল আন্দোলনে শিখ ধর্ম সম্প্রদায়ের সম্মিলিত পৃষ্ঠপোষকতা। এখানে একবার কেউ এসে পড়লে থাকা খাওয়ার কোনও অভাব হবে না। লঙ্গর সেবা দিনরাত চলছে। এর পিছনে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া নিবাসী শিখ, উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী শিখদের অনুদান তো আছেই, গুরুত্বপূর্ণভাবে আছে আশেপাশের গ্রামের মানুষের পাঠানো আনাজ, দুধ ইত্যাদির সরবরাহ। শুধু অনুদানে তো লঙ্গর চলে না। আছে শ্রম। শিখ ও অ-শিখ বহু মানুষের "নিঃশর্ত সেবা" নামক শ্রম হল লঙ্গরগুলোর মূল জৈবিক চালিকা শক্তি। অনুদানের প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে। আন্দোলনের এক সংগঠকের মুখে শোনা। পাঞ্জাবে প্রায় ছ মাস হল সমস্ত (হাইওয়ে) টোল প্লাজাকে "মুক্ত" করে দেওয়া হয়েছে আন্দোলনের অংশ হিসাবে। হরিয়ানাতেও কয়েক মাস হল তাই। এই টোলগুলোর মধ্যে এরকম টোলও আছে যাতে দৈনিক প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার মতো আয় হত। এর থেকেই অনুমান করা যায় টোলের দায়িত্ব নেওয়া কোম্পানি ও সরকারকে এখনো অব্দি কতো হাজার কোটি টাকার ধাক্কা দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। পরিবহণ ব্যবসায়ীদের একটা অংশ টোলের নামে এই "জুলুম" বন্ধ করায় খুশি। আন্দোলনকারীদের পাশে তারাও এসে দাঁড়াচ্ছেন কৃতজ্ঞতা ভরে। শুধু আর্থিক অনুদান নয়, এইভাবেই পাঞ্জাব হরিয়ানার সমাজে বিভিন্ন অংশের মানুষের থেকে নৈতিক সমর্থন পেয়ে পুষ্ট হয়েছে এই আন্দোলন।
১৫ ই ফেব্রুয়ারি সকাল। আগের রাতের আস্তানায় পরিচয় হয়েছিল হরিয়ানার এক মানুষের সাথে। পৌঢ় এই মানুষটি আন্দোলনের এক সাধারণ পদাতিক সৈন্য। উত্তর হরিয়ানার কৃষক আন্দোলনের নেতা গুরনাম সিং চারুনির ভক্ত মানুষটি আন্দোলনের শুরু থেকেই এখানে আছেন। সকালে আমাদের নিয়ে গেলেন চারুনির ডেরায়। সেই "প্রধানজী" না থাকলেও আরও অনেক হরেক কিসিমের প্রধান অপ্রধানদের সাথে কথা হল। চারুনির সংগঠন বিকেইউ (হরিয়ানা/ চাড়ুনি)-র কয়েকজন মিলে বিশদে বোঝালেন তিনটে আইনের বিভিন্ন দিক। যথেষ্ঠ ওয়াকিবহাল এনারা। বিহারে ২০০৪ সালে এপিএমসি তুলে দেওয়ার পরে আজকের কী অবস্থা, পাঞ্জাব হরিয়ানাতেও বিভিন্ন ফসলে এম এস পি কীভাবে লুট হচ্ছে ধরে ধরে বোঝালেন। পাশের এক তাঁবুতে কথা হল রাজস্থানের একটা ছোট সংগঠন "গ্রামীণ কিষাণ মজদুর সংগঠন (জি কে এস)" এর প্রধানের সাথে। এই প্রধান শুরু থেকেই সাঁজাপুর বর্ডারের অবস্থানে রয়েছেন। ওখানে রাজস্থানের বিভিন্ন সংগঠনের সংখ্যাধিক্য। কথা হল আরেক জনের সাথে। "বারা খাপ" এর এক প্রধান । কয়েকটা গ্রাম নিয়ে একটা "তাপা" হয়, আর কয়েকটা তাপা মিলিয়ে "খাপ"। খাপের একপ্রকার নামকরণ তার মধ্যে থাকা গ্রামের সংখ্যা দিয়ে হয়। "বারা খাপ" মানে তাহলে দাঁড়ায় বারোটা গ্রাম নিয়ে যে খাপ (এখনো আছে বা আগে ছিল)। খাপ হরিয়ানার সমাজের শতাব্দীপ্রাচীন সামাজিক সংগঠন। রক্ষণশীলতার দুর্গ বলা যায় খাপকে। নিজেদের "সংস্কৃতি"কে অপরের হাত থেকে রক্ষা করা, সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে বিচার করা এগুলো খাপের প্রধান কর্মসূচী। এই "অপর"টা কখনো ইংরেজ, কখনো মুসলমান হয়ে আজকে "পশ্চিমী সংস্কৃতি"। খাপের একটা নীরব ভূমিকা আছে এই আন্দোলনে। খাপের নেতারা মূলত কৃষক। আন্দোলনে "খাপ নেতা" হিসাবে নয়, বরং কৃষক নেতা হিসাবেই তারা থাকছেন। কৃষক সংগঠনের নেতৃত্বে, পিছন থেকে খাপের প্রত্যক্ষ মদতে জনসমাগম হচ্ছে। চাড়ুনির ডেরায় এই খাপ নেতা বোঝালেন কীভাবে নতুন আইনে মান্ডি ব্যবস্থায় কৃষকের "তুল্য ও মূল্য" সংক্রান্ত অধিকার চলে যাবে। অর্থাৎ, ফসলের দাম ও ওজন নিয়ে সংশয় বা অভিযোগ থাকলে তা নিরসনের যে নির্দিষ্ট পদ্ধতি আগে ছিল, প্রাইভেট মান্ডি ব্যবস্থায় তা আর থাকবে না। কেড়ে নেওয়া হল চুক্তিচাষে তার কর্পোরেট মালিকের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার অধিকার। ইনিও তিনটে আইন নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল তা বোঝা গেল। এখানে এলে এনারা কৃষি মন্ত্রীকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে ছাড়তেন এই তিন আইনের "কালো" দিক কোনগুলো। পরের দিন ১৬ ই ফেব্রুয়ারি ছিল স্যার ছোটুরামের জন্মদিন। হরিয়ানার জাট সমাজে ছোটুরামের বিশেষ কদর। এই খাপ নেতাটির কথায় উঠে এল ছোটুরামের ভূমিকার কথা। ১৯৪৮ এ আইন করে মান্ডি ব্যবস্থা প্রবর্তনে ছোটুরামের ভূমিকার কথা। স্বাভাবিকভাবেই, আজকে যখন প্রাইভেট মান্ডি এনে সরকারি মান্ডিকে শুকিয়ে মারার জন্য আইনে আনছে দেশের সরকার, ছোটুরামের প্রসঙ্গ চলেই আসে।
এর পর আরেক জনের সাথে দেখা করার ছিল। গতকাল সন্ধ্যেয় সেই সাংবাদিকের দৌলতে কীর্তি কিষাণ ইউনিয়নের রাজিন্দর সিং দীপ সিংয়ের সাথে পরিচয় হয়। আজকে তার সাথেই কথা বলার কথা। ২৬ শে জানুয়ারির পর সিঙ্ঘুতে পুলিস, হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডার আক্রমণের কিছু ঘটনা ঘটে। রাজিন্দর সিং এর মতো আরও অনেক নেতাকে ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে গুণ্ডারা। এনার সাথে দেখা করতে গিয়ে মনে হল এই সব আক্রমণের কথা ভেবে এনারা সতর্ক ও প্রতিরোধে প্রস্তুত। বিপ্লবী বাম ধারায় বিশ্বাসী বিভিন্ন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল আন্দোলনের শুরু থেকে। আপসহীন এই লড়াইয়ের প্রাথমিক চালিকা শক্তি ছিল পাঞ্জাবের বিকেইউ (একতা উগ্রাহাঁ), বিকেইউ (একতা ডাকোন্ডা), কীর্তি কিষাণ ইউনিয়নের মতো লড়াকু সংগঠনগুলো। কীর্তি কিষাণের রাজিন্দর সিং দীপ সিংয়ের কথায় প্রথম উঠে এল বর্তমান সময়ে কৃষির কাঠামোগত সংকটগুলোর কথা। সার বীজ কীটনাশকের ব্যবসার মধ্যে দিয়ে কিভাবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফার মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠেছে কৃষি, দিনের পর দিন কৃষিতে ইনপুট কস্ট বেড়েছে, তা শুধু এম এস পির মাধ্যমে সমাধান হবে না। সবুজ বিপ্লব এর এই প্রভাবটার কথা একমাত্র সংগ্রামী বামপন্থী চেতনার মানুষ ছাড়া পাঞ্জাবের কেউ সেভাবে বলেন না। এম এস পি কে আইন করার যে দাবী উঠতে শুরু করেছে আন্দোলন থেকে তা কার্যত একটি "সমাজতান্ত্রিক" দাবী, তিনতে আইন ফিরিয়ে নিলেও সরকার কোনওদিন এই দাবীকে মানতে পারবে না - অভিমত রাজিন্দরের।
[লোকমুখে শোনা কিছু চলতি "ধারণা"র কথা বলে যাই এখানে। আগেরবার এসে কয়েকটা নতুন কথা শুনেছিলাম – যার মধ্যে অন্যতম দুটো হল “পাঞ্জাব হরিয়ানা ভাইচারা”, “ছত্তিশ বিরাদরি জিন্দাবাদ”। প্রথমটা দিনের আলোর মতো স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যেকোনও বর্ডারে গেলেই। একটু কথা বললেই আবার সুক্ষ্ম প্রতিযোগিতার সুরও ধরা পড়ে। এ বিষয়ে একটা কথা শুনেছিলাম। খুব সরলীকৃত হয়তো, কিন্তু কিছুটা হলেও সত্যের লেশ থাকতে পারে। হরিয়ানার মানুষ সম্পর্কে চলতি ধারণা হল তারা যেকোনো কিছুকেই যতোটা “জোশ” নিয়ে শুরু করে সময়ের সাথে তা ধরে রাখতে পারে না। “জোশ” যেমনি হঠাত ঝুপ করে উঠেছিল, ওমনিই হঠাত ঝুপ করে নেমে যায়। এটা অবশ্যই প্রচলিত ধারণা – হরিয়ানার বাইরের এক অংশের মানুষের। কৃষক আন্দোলনেও সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম মিছিল হয়েছিল হরিয়ানাতেই। কিন্তু লাগাতার সংগঠিত আন্দোলনের শুরুয়াত হয় পাঞ্জাবের সংগঠনগুলোর হাত ধরেই তার পরে। দিল্লির বিভিন্ন বর্ডারগুলোতেও (বিশেষ করে টিকরিতে) দেখলে দেখা যাবে হরিয়ানার একটা বড়ো জনসমাগমও এখানে হয়েছে তুলনায় অসংগঠিতভাবে। পাঞ্জাব প্রথম থেকেই ছিল মূলত সংগঠিত এবং তার একধরণের নেতৃত্বকারী অবস্থান ছিল ২৬শে জানুয়ারির আগে। বিশৃঙ্খলা যদি হয় হরিয়ানার লোক করবে, এরকমই ভেবেছিল পাঞ্জাবিদের একাংশ। কিন্তু ২৬ শে জানুয়ারি যা যা “বিশৃঙ্খলা”র ছবি পাওয়া গেল সব পাগড়ি বাঁধা সর্দারজি বা শিখ ধর্মীয় প্রতীক সহকারে মানুষদের। পরিস্থিতি ঘুরে গেল এখানেই। “নেতৃত্বকারি দাদা” থেকে নতুনভাবে রূপায়িত ভাইচারায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা ভাতৃত্বের সমান স্তরে প্রতিষ্ঠিত হল। ছত্তিশ বিরাদরি মানে সহজ ভাষায় সব রকমের জাত। আন্দোলনে এর একতার একটা বাহ্যিক অথচ সহজ প্রমাণ পাওয়া যায়। এম্নিতে হরিয়ানার হিন্দু সমাজের রীতি রেওয়াজ হল এক জাতের লোক ভিন্ন জাতের সাথে হুঁকো ভাগাভাগি করে টানেনা। সিঙ্ঘু বা টিকরি বর্ডারে বহু মানুষকে একসাথে হুঁকো খেতে দেখেছি। সেখানে এখন জাত জিগ্যেস করাটা নিয়ম নয়, ব্যতিক্রম।]
১৫ই ফেব্রুয়ারি দুপুর নাগাদ, রাজিন্দর সিং দীপ সিং এর সাথে কথাবার্তা সেরে সিঙ্ঘু ছেড়ে টিকরি এসে পড়া। এই সময়টা বড্ড বিভ্রান্তিকর। রাতে কম্বল নেওয়ার মতো ঠাণ্ডা, দিনে চিড়বিড়ানি রোদ আর গরম। এই কয়েকমাস ঠাণ্ডার দাপটের পর এবার গরমের তীব্রতা - বুঝতে পারা যাচ্ছে অবস্থানকারীদের সামনে আরেকটা কঠিন সময় আসতে চলেছে। টিকরিতে ডাকোন্ডার এক তাঁবুতে আশ্রয় মিলল। টিকরি বর্ডারে বড়ো জমায়েত করেছে এই সংগঠন এবং কীর্তি কিষাণ ইউনিয়ন। মূলত মাঝারি ও ছোট কৃষকদের জমায়েত এখানে। সিঙ্ঘুতে ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। এন আর আই একটা অংশর সাহায্যপ্রাপ্ত বিভিন্ন শিখ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পাঞ্জাবের মাঝা , দোয়াবা অংশের বড়ো কৃষক, নিহাং শিখদের দল, মালেরকোটলার মুসলিম সংগঠন, স্বাস্থ্যকর্মীদের নানা সংগঠন - বিচিত্র সমন্বয় সেখানে। টিকরি অনেক সুসংগঠিত, তুলনায় সমসত্ত্ব। পাঞ্জাবের মালোয়া অংশের কৃষক, হরিয়ানার কৃষকদের চোখে বেশি পড়ে।
এখানেই চার কিলোমিটার মতো দূরে পকোড়া চক বলে একটা জায়গার আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে বিকেইউ (একতা উগ্রাহাঁ) সংগঠনের লোকজন। অত্যন্ত জেদি ধরনের লড়াকু সংগঠন এরা। কৃষক সংগঠনগুলোর সংযুক্ত মোর্চায় নেই, কিন্তু আবার শুরু থেকেই যৌথ লড়াইতে আছে। মোর্চায় নেই কেন? যদি মোর্চা আপস করে বসে, তাহলে যাতে বাইরে থেকে চাপ দেওয়া যায়! এদের সাথে কথাবার্তা হল সেদিনই। সংগঠনটি কিছু বিষয়ে অত্যন্ত নীতিনিষ্ঠ। যেমন, এদের মঞ্চ থেকে কোনও ধর্মীয় স্লোগান ওঠে না। "ওয়াহে গুরু কী ফতেহ, ওয়াহে গুরু কী খালসা" বা "জো বোলে সো নিহাল, সৎ শ্রী অকাল" জাতীয় স্লোগান ধর্মীয় হলেও খুবই প্রচলিত কৃষক আন্দোলনের মঞ্চে। উগ্রাহাঁরা এই বিষয়ে সচেতন – শিখ ধর্মের মানুষ সংখ্যাধিক্য হলেও কৃষক আন্দোলনের ধর্মনিরপেক্ষতা সব ক্ষেত্রেই বজায় রাখার প্রয়োজন তারা মনে করে। এই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ তাদের সচেতন রাজনৈতিক অনুশীলনের অঙ্গ। উগ্র মৌলবাদী তথা খালিস্তানিদের বিরুদ্ধে যে গুটিকয় রাজনৈতিক শক্তি সে সময় সোচ্চার হয়েছিল তাদের মধ্যে এই সংগঠনটির রাজনৈতিক পূর্বসূরীরাও আছে। শাহাদাত দিয়ে তার মূল্য চুকিয়েছেন তারা।
এছাড়া, কৃষক আন্দোলনের মঞ্চ থেকেই এই সংগঠনটি মানবাধিকার দিবসে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবী তুলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। "গোদি মিডিয়া" নামে খ্যাত রাষ্ট্রর প্রচার যন্ত্র সেই সুযোগে এদের "দেশদ্রোহী" সাব্যস্ত করতে অতিতৎপর হয়। এইসব আক্রমণের মুখেও নিজেদের রাজনৈতিক নীতি বিসর্জন দেয়নি এরা। যারা মানুষের কথা বলতে গিয়ে আজ জেলে, তাদের লড়াইকে আমরা আমাদের কাছে শিক্ষনীয় মনে করি - এরকমই একটা ভাবনা বলেছিলেন সংগঠনটির এক কর্মী।
হরিন্দর বিন্দু এই সংগঠনের অন্যতম নেত্রী। বয়স চল্লিশের কোটা ছাড়িয়েছে। অল্প বয়সে খালিস্তানিদের হাতে বাবা শহীদ হন। বড়ো হয়েছেন এই সংগঠনেরই আজকের এক শীর্ষ নেতৃত্বের অভিভাবকত্বে। পরে একদিন গল্পচ্ছলে বলছিলেন ছোটবেলা থেকেই ডাকাবুকো ছিলেন। আত্মরক্ষার পাঠ ইত্যাদিতেই বেশি মনোযোগ ছিল যেই বয়সে বাকিরা পড়াশোনা করে তখন। তখন থেকেই সর্বক্ষণের কর্মী বলা যায়। ৩০ বছর ধরে, লড়াইটাই জীবন হয়ে গেছে, বলছিলেন। রাস্তার লড়াইয়ে পুলিসের সাথে "টক্কর" দেওয়া, ভূমিহীন খেত মজদুরদের সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে শুরু করে আজকের এতো বড়ো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া- এই চ্যালেঞ্জগুলোকে ভালোবাসেন বলেই এই চলমান জীবনটাকে ভালোবাসেন, বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর তাই আর নতুন করে সংসার বাঁধেননি - শুনেছিলাম এসব কথা তার থেকে অন্য একদিন।
সেদিন প্রথমবার উগ্রাহাঁর মঞ্চের জায়গাটায় গেলাম। আগের দফায় আসা হয়ে ওঠেনি। কথোপকথন হল হরিন্দর বিন্দু ও তার দুই সাথীর সাথে। একজন পাশেই থাকেন, আরেকজনের মালেরকোটলায় বাড়ি। দ্বিতীয়জনের সাথে বিন্দুদের সখ্যতার সূত্র সি এ এ বিরোধী আন্দোলন। এইটা একটা বৈশিষ্ট্য। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ, সি এ এ আইন করার সময় থেকেই বহু মানুষকে নিয়ে রাস্তায় নেমেছে উগ্রাহাঁ এবং অন্যান্য সংগঠন। শুধুমাত্র কৃষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকা নয়, লাগাতার বিভিন্ন শ্রমিক বিরোধী আইন থেকে সামাজিক-রাজনৈতিক প্রশ্নেই জনসমাগম করেছে এরা। মালেরকোটলা পাঞ্জাবের মুসলিম প্রধান অঞ্চল। সেখানকার মানুষের লড়াইয়ের সাথে সংযুক্তভাবে কাজ করার ফলে শিখ-মুসলিম যে যৌথতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আজকের কৃষক আন্দোলনেও যা চোখে পড়বে (সিঙ্ঘুতে মালেরকোটলার মুসলিম সংগঠনের লঙ্গরের উল্লেখ করেছি আগে)। দ্বিতীয় মেয়েটি আইনজীবী। আন্দোলনে আইনী সহায়তা করার পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে অন্যান্য কর্মসূচীতেও আছেন।
হরিন্দর বিন্দু বললেন আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের বারনালায় বিরাট জমায়েত হবে, দু'লাখ মানুষের। বারবার যেতে বললেন তাদের সাথে। এটায় থাকার সুযোগ ছাড়া যাবে না মনে হল। যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে এলাম।
সন্ধ্যে বেলায় ডকোন্ডার এলাকায় ফিরে মানজিত সিং ধানেরের সাথে কথা হল। তাঁবুর মৃদু হলুদ আলোয় দশাসই চেহারার মানুষটার থেকে মেহলকলাঁর কাহিনী শুনলাম পুরোটা। অত্যন্ত ডিটেইলে। ভদ্রলোক চোস্ত পাঞ্জাবিতে বলে গেলেন, মাঝে মাঝে হিন্দি। পুরোটা তক্ষুনি বুঝলাম না। পরে তার হিন্দি সারসংক্ষেপ শুনলাম সঙ্গী এক সাথীর থেকে। বোধগম্য হল। আরও একটা ব্যাপার বোধগম্য হয়েছিল ওনার সেদিনের বক্তব্য থেকে। জুন থেকে এই আন্দোলনের শুরুতে পাঞ্জাবে মানুষ রাস্তায় নামা শুরু করে করোনার নামে, লকডাউনের ডাউনে নামে "সরকারী জুলুমে"র বিরুদ্ধে। "লকডাউন নয়, লোক ডাউন" উনি বললেন। অর্থাৎ সরকার লকডাউনের নামে ভয়াবহ সব আইন পাস করে যাবে অন্যায়ভাবে, আর মানুষ যাতে চুপ করে থাকে, রাস্তায় না নামে তাই এসবের বন্দোবস্ত। কিছু কিছু বিশ্বাস, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, বা গুজব - যা হয়তো স্থির যৌক্তিক বিচারে ভিত্তিহীন, তা বিভিন্ন বড়ো গণ আন্দোলন, বিদ্রোহ, অভ্যুত্থানে বিশেষ স্ফুলিঙ্গসম ভূমিকা নেয়। যে প্রাথমিক শক্তির ধাক্কার প্রয়োজন হয় একটা দীর্ঘদিনের জড়ত্বকে কাটাতে তা সবসময় যুক্তিসঙ্গত, সুশীল বোধের সাথে তাল মিলিয়ে হয় না। এই উল্লম্ফন বা ঝাঁকুনিটা ব্যতীত আজকের আন্দোলনে এই বিরাট শক্তির উন্মেষটাকে আমরা বুঝতে পারবো না। ওখানকার বেশিরভাগ মানুষ মনে করেছিল "করোনা অতিমারী" একটা মীথ। করোনা একটা রোগ, ছোঁয়াচেও বটে, কিন্তু তা "অতিমারী" নয়। এটা আসলে "অজুহাত”, যা দিয়ে কৃষক আন্দোলনকে দমাতে চাইছে সরকার। স্বীকার করতেই হবে যে এই প্রাথমিক বিশ্বাসটা, ঠিক হোক বা ভুল হোক, মানুষের ভয় আর আড়ষ্টতাকে কাটিয়ে তাদের রাস্তায় নামতে, কয়েকশো মাইল ট্রাক্টর চালিয়ে এসে একের পর এক ব্যারিকেড ভাঙার সাহস আর শক্তি জোগাতে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল।
হরিয়ানাঃ মহাপঞ্চায়েত ও কৃষি মন্ত্রীর গ্রাম
টিকরি সীমান্তে বাহাদুরগড় থেকে বাস ধরে ১৬ই ফেব্রুয়ারি সকাল সকাল পৌঁছে গেছিলাম রোহতাক জেলার সাম্পলা গ্রামে। ছোটুরামের জন্মদিনে সেখানে মহাপঞ্চায়েত। দুপুর ১টা নাগাদ হু হু করে এক ঘণ্টার মধ্যে ভরে গেল বিস্তীর্ন মাঠজুড়ে পাতা গালিচা। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার সাতেক মানুষ বা তারও বেশি। ছোটুরামের বিরাট মূর্তি, মিউজিয়ম মিলিয়ে জায়গাটা “স্যার ছোটুরাম জয়ন্তী” পালনের জন্য আদর্শ। একটা জিনিস বুঝেছি কৃষক বলতে এখানে মূলত জাট বিরাদরির মানুষকেই বোঝায়। জাটরা ঐতিহাসিকভাবে কৃষক ও লড়াকু জাত। “জমিদার” মানে যার জমি আছে, মজদুর মানে ভূমিহীন খেতমজুর। জাটরা মুলত সেই অর্থে “জমিদার”। তথাকথিত নীচু জাত, যাদের একটা অংশ বিহার, ঝাড়খন্ড থেকে আসা, তারা এদের জমিতে মজদুরি করে। গালিচায় ভীড় বাড়ার সাথে সাথে সাম্পলার মহাপঞ্চায়েতের মঞ্চে রংবেরঙের পাগড়ির ভীড়ও বাড়ছে তখন। শিখদের পাগড়ি নয়, অন্যরকম এগুলো – অনেকটা “চাচা চৌধুরী”র মতো! মঞ্চের সঞ্চালক খুব কঠোর। বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিরা (বেশিরভাগ খাপ প্রধান) “ভাষণবাজি” করতে গিয়ে পাঁচ মিনিট পেরোলেই সঞ্চালক থামিয়ে দিচ্ছেন অন্য একটা মাইকে বকবক করে। মঞ্চে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি বিভিন্ন খ্যাতনামা শিল্পীদের। খ্যাতনামা মানে হরিয়ানা পাঞ্জাবের যুবসমাজের কাছে জনপ্রিয়। এই কৃষক আন্দোলনে এনাদের ভুমিকা বিশেষভাবে বলার মতো। প্রথম যেবার টিকরিতে এসেছিলাম মধ্যরাতে, ২৬ শে জানুয়ারির দুদিন আগে, একটা রংবেরঙ্গের লাইটিং সহ ট্রাকটর প্রথম চোখে পড়ে মেট্রো স্টেশন থেকে বেড়িয়ে। তারও আগে কানে ভেসে আসে আকর্ষনীয় সুর ও তালের একটা গান। হরিয়ানভি ভাষায় সেই গান তারপর বহুবার শুনেছি। শব্দগুলো জেনেছি, মানেও জেনেছি পরে – “মোদী থাড়ে তোপ কাড়ে হাম দিল্লি আজ্ঞে” (ভাবার্থ করলে দাঁড়ায় - মোদী তোর কামান কোথায় গেলো? আমরা দিল্লি চলে এলাম তো)। অনেক জলকামান পেরিয়ে কৃষকরা হরিয়ানা দিল্লির বর্ডারে পৌঁছবার পর এই গান উঠে আসে। প্রকৃতই লড়াই থেকে উঠে আসা গান। শিল্পী অজয় হুডা। অপরিচিত এক শিল্পী রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই গান গেয়ে। অজয় হুডাকে চাক্ষুস করলাম সাম্পলার মঞ্চে। লম্বা দাড়িওয়ালা শিখ আরেকজনকে দেখি। জানতে পারি ওনার নাম কানোয়ার গ্রেওয়াল (উচ্চারণটা সম্ভবত “কঁওয়ার”। উচ্চারণের খুঁতাখুঁতানিতে ঢুকছি না আর)। সিংঘু, টিকরিতে এনারও কিছু বিখ্যাত গান শুনতে পাওয়া যায় সব সময়। দেখলাম এই প্রথম। বেশ বিখ্যাত। মুলত সুফি গান গাইতেন। আন্দোলনের শুরু থেকে পুরোদমে বিদ্রোহী ভিডিও বানাচ্ছেন গানের একের পর এক। অবস্থানের জায়গাগুলোতে বিভিন্ন জলসায় – কখনো আন্দোলনের মঞ্চে, কখনো বা স্রেফ ভীড়ের মাঝে এনাকে গান গাইতে শোনা যায়। শুধু লড়াইয়ের গান নয়, ভালোবাসার গান, আধ্যাত্মিকতার গান। কয়েকমাস ধরে পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকা মানুষগুলোর কাছে, হয়তো কড়া রোদের মধ্যে বা ঠাণ্ডা শীতের রাত্তিরে, এই গানগুলো সব প্রাণের আরাম। মানুষকে শুনতে শুনতে কেঁদেও ফেলতে দেখবেন।এই কানোয়ার গ্রেওয়ালেরই কিছু ভিডিও ইউ টিউব ব্যান করে দিয়েছিল। ওনাকে জিগ্যেস করায় বললেন “আমি প্রথমত এক কৃষক পরিবারের সন্তান, তারপর একজন শিল্পী। ব্যান করে তো সৃষ্টিশীলতাকে থামিয়ে রাখা যায় না”। আন্দোলনের এই বিপুল প্রাণশক্তিতে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ জীবনধারার সিঞ্চন করে চলেছে এই সৃষ্টিগুলো। সাম্পলাতে একই মঞ্চে ছিলেন সোনিয়া মান। পাঞ্জাবের বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। বলিউডের হুমকির তোয়াক্কা না করেই আন্দোলনের পক্ষ নিয়েছেন সোচ্চারে। এটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যাপার। এতোজন শিল্পী, কেউ বা খ্যাতির চূড়ায় বসে, কেউ বা শিল্পীজীবনের শুরুতেই, সরাসরি, নির্ভীকভাবে পক্ষ নিয়েছে – দেশের এক শক্তিশালী ফ্যাসিস্ট দলের সরকারের বিরুদ্ধে, সেই সরকারকে নাজেহাল করে ছাড়া এক আন্দোলনের পক্ষে। এই আন্দোলনের পরিণতি জানা নেই, কিন্তু নিজেদের ক্যারিয়ারের পরিণতির তোয়াক্কা না করে এই পদক্ষেপ আজ দেশে কতোজন শিল্পী নিতে পারেন?
সেদিনের মঞ্চে গুরনাম সিং চারুনি, রাকেশ টিকায়েত, বলবীর সিং রাজ্জেওয়াল, জগীন্দর সিং উগ্রাহাঁ (হ্যাঁ, এনার নামেই বিকেইউ একতা উগ্রাহাঁ সংগঠনের নাম) উপস্থিত ছিলেন। নেতাদের বক্তৃতা নয়, সেদিনের মূল আকর্ষন ছিল পাশের এক ছোট মঞ্চে অজয় হুডা, গগন হরিয়ানভি, কানয়ার গ্রেওালদের পরিবেশন। পরিবেশন মানে প্রকৃত অর্থেই সঙ্গীত পরিবেশন – গান, নাচ এবং তাল এই তিন সহকারেই তারা মঞ্চ কাঁপালেন। এটাও হরিয়ানার বৈশিষ্ট্য। নৃত্যময় সঙ্গীত পরিবেশন যে কোনও গণজমায়েতের বিনোদনমুলক অংশ, তা সে আন্দোলন হোক বা অন্য কিছু।
মহাপঞ্চায়েত শেষ হওয়ার পর পড়ন্ত রোদে গাছের ছায়ায় বসে নিউজক্লিক এর এক সাংবাদিকের সাথে কথা হচ্ছিল। নিউজক্লিকের অফিস কিছুদিন আগে ইডি দিয়ে রেইড করিয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের নানা অপকর্ম নিয়ে টানা রিপোর্ট করে যাচ্ছিল এরা - তারই পুরষ্কার স্বরূপ। ছেলেটি একটি চমৎকার কথা বললো - “আমাদের এখানে একটা প্রবাদ আছে - শিলনোড়ায় মাথা দিলে আর কী হবে তার চিন্তা রাখতে নেই"।
এরপর রোহতাকের সাম্পলা থেকে ভিওয়ানি জেলার এক গ্রামে গেলাম। হরিয়ানার কৃষি মন্ত্রী জয়প্রকাশ দালাল তার কিছুদিন আগেই এক টিভি চ্যানেলের সামনে খ্যা খ্যা করে হাসতে হাসতে বলছিলেন “ওরা তো ঘরে বসেও মরতে পারতো”। কারা? যারা সিঙ্ঘু, টিকরির বর্ডারে অবস্থানে থাকতে থাকতে শহীদ হয়েছেন। সংখ্যাটা তখন প্রায় ২০০র কাছাকাছি। কৃষি মন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই তুমুল নিন্দার ঝড় ওঠে। ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন তিনি তার পরে পরেই। হরিয়ানায় বিজেপি ও জেজেপি (জননায়ক জনতা পার্টি) দলের জোট সরকার। যে গ্রামে গেলাম সেই গ্রামেরই বাসিন্দা ওই কৃষি মন্ত্রীটি। শুধু এই গ্রামটি নয়, হরিয়ানার অনেক গ্রামেই গ্রামবাসীরা তখন বিজেপি ও জেজেপি দলের নেতা মন্ত্রীদের “সামাজিক বহিষ্কার” এর ডাক দিয়েছেন। ওদের গ্রামে ঢোকা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। সেই মর্মে নোটিস বোর্ডও ঝুলিয়ে দিয়েছেন কিছু গ্রামের মানুষ। জয়প্রকাশ দালালের গ্রাম থেকে ২৫টি ট্রাকটরে করে মানুষ গেছিলেন ২৬শে জানুয়ারির প্যারেডে সামিল হতে। এদের নির্বাচনে জিতিয়ে ভুল করেছিলাম, বলছিলেন গ্রামের এক পৌঢ়া মহিলা । ১৮ই ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার ডাকে “রেল রোকো”তেও সামিল হবেন তারা, জানালেন।
এখানে বলে রাখি, তিন কৃষি আইনের বিরোধিতায় ধর্না বা অবস্থান শুধু দিল্লির বিভিন্ন বর্ডারেই নয়, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের (এবং সদ্য রাজস্থানের একাংশেও শুরু হয়েছিল) বিভিন্ন জায়গাতেও চলছে। টোল প্লাজাগুলো যার অন্যতম। টোল বন্ধ করে দিয়ে টোল প্লাজার একপাশে লাগাতার ধর্ণা চলছিল এরকমই ভিওয়ানি জেলার এক জায়গায় জাতীয় সড়কের ওপর। ২৫ শে ডিসেম্বর থেকে লাগাতার এই ধর্না চলছে । ১৭ই ফেব্রুয়ারি সকালে সেখানে গেলাম। কয়েক শো মানুষ বসে আছেন। একদিকে পুরুষ, একদিকে মহিলা, প্রায় সমান সমান। মঞ্চে “রাগিণী” গাইছেন একজন। রাগিণী যে কেউ গাইতে পারেন, কোনও বিশেষ ধরণের তালিমের প্রয়োজন হয় না। এক ধরণের স্থানীয় লোকগানের জনপ্রিয় ফর্ম। ভাষণ চলছে, গান চলছে - গান চলছে, ভাষণ চলছে। মাঝে মাঝে স্লোগান তোলা হচ্ছে। মঞ্চে রীতিমতো হারমোনিয়াম, তবলা নিয়ে প্রায় জলসার আয়োজন। পিছনের একটি ঘেরা জায়গায় বসে আলাদা করে কথা হল আশা শ্রমিকদের ইউনিয়নের রাজ্য সভাপতি কমলেশের সাথে। শুনেছিলাম এই আন্দোলনে পাঞ্জাব আর হরিয়ানার যুগলবন্দী থেকে হরিয়ানা নাকি দুটো জিনিস শিখেছে পাঞ্জাবের কাছে– এক, লঙ্গর সেবা। দুই, মেয়েদের অংশগ্রহণ ছাড়া আন্দোলন সফল হয় না। কমলেশ বলছিলেন দ্বিতীয়টা ততোটাও ঠিক নয়। হরিয়ানাতেও আগে থেকেই নাকি বিভিন্ন আন্দোলনেই মেয়েদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল। শিক্ষার একটা ভূমিকা রয়েছে এর পিছনে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কিছুদিন আগে বলেছিলেন “মহিলা ও শিশুদের বাড়ি চলে যেতে”। কমলেশের বয়ান প্রধান বিচারপতির অজ্ঞতাকে সামনে এনে দেয়, তার দু’চোখে যে “মনুস্মৃতি”র ঠুলি পড়ানো তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেন কমলেশ। মেয়েরাও কৃষক, এই সহজ সরল কথাটা যারা জানেন না তারা হয় কৃষিকাজ বোঝেন না, বা ইচ্ছাকৃতভাবে সমাজে মেয়েদের ভূমিকাকে খাটো করতে চায়, বলছিলেন তিনি। আরো অনেক কিছু বললেন। “কীভাবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে চাষের খরচ বেড়ে গেছে” থেকে “কীভাবে পর্দাপ্রথার মতো সামাজিক রীতি রেওয়াজ দিয়ে মেয়েদের এগিয়ে আসার পথ, নেতৃত্ব দেওয়ার পথ রুদ্ধ করছে সমাজ”, বললেন বেশ গুছিয়ে। কথা হল আরেক ডাক্তার বাবুর সাথে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে একটা ওষুধ পত্রের টেবিল সামলাচ্ছেন, লঙ্গরেরও দেখভাল করছেন। এই ধর্নার মূল সংগঠকদের মধ্যে আরো দু’তিনজনের সাথে বিস্তারিত কথা হল। একজন এখনো আমায় মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ নেন। এই রাজ্যের চলমান বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে এনারা কতোটা চিন্তিত কথা শুনলেই বোঝা যায়।
রাজস্থানঃ রাইসিং নগরে মহাপঞ্চায়েত
ভিওয়ানি টোল প্লাজা থেকে বেরিয়ে ৬ ঘণ্টা বাসযাত্রা করে রাত্রি ৮টা নাগাদ রাজস্থানের ভাড্রা পৌঁছলাম। পরের দিন শ্রীগঙ্গানগরের কাছে রাইসিং নগরে মহাপঞ্চায়েত। সেদিনই রাতের ট্রেনে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে শ্রীগঙ্গানগর পৌঁছলাম ভোরে। ঘন কুয়াশার আস্তরণ চারপাশে। একটু আলো ফুটতে বাসে করে পৌঁছলাম রাইসিং নগর। এই আন্দোলনে রাজস্থানের প্রথম কিষাণ মহাপঞ্চায়েত হতে চলেছে এখানেই। এই মহাপঞ্চায়েতের প্রেক্ষাপটটা বলি। ২৬শে জানুয়ারির পর সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজীপুর বর্ডারে জনসমাগম বেড়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তারপর সংগঠিতভাবে তা ধরে রাখার নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। জায়গায় জায়গায় মহাপঞ্চায়েত করা যার অন্যতম। মূলত পাঞ্জাব, হরিয়ানার মানুষেরা ছিলেন সিঙ্ঘু, টিকরিতে। উত্তর প্রদেশের উপস্থিতি ছিল মূলত গাজীপুরে, আর রাজস্থানের কৃষকদের উপস্থিতি ছিল অন্য বর্ডার সাঁজাপুর (বা শাহজাহানপুর)-এ মূলত। গাজীপুরে জনসমাগম বাড়াতে যেমনি উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় মহাপঞ্চায়েত হচ্ছিল, সাঁজাপুরে জনসমাগম বাড়াতে ঠিক করা হয় রাজস্থানেও তা করতে হবে। সাঁজাপুরে অবস্থান তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থায় ছিল। গুজরাট, মহারাষ্ট্র অব্দি চলে যাওয়া হাইওয়ের ওপর এই অবস্থান আবার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একে আরও শক্তপোক্ত করার উদ্দেশ্যেই রাজস্থানে একের পর এক মহাপঞ্চায়েতের পরিকল্পনা হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাইসিং নগরের এই মহাপঞ্চায়েতছিল যার শুরুয়াত।
বিরাট এক কিষাণ মান্ডির ভেতরে শেডের তলায় মহাপঞ্চায়েতের আয়োজন। এদিনের কর্মসূচীর অন্যতম মূল উদ্যোক্তা ছিলেন চাড়ুনির ডেরায় আলাপ হওয়া সেই রাজস্থানের জিকেএস সংগঠনটির সভাপতি মশাই। হাজার পাঁচেকের বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিলেন শেড ছাড়িয়েওরোদ্দুরের মধ্যে । এই অঞ্চলটা রাজস্থানের পাঞ্জাব লাগোয়া অংশ। পাকিস্তান বর্ডার ৫ কিলোমিটার হবে বড়োজোর। এখানে বসবাসকারী একটা বড়ো অংশের মানুষ শিখ ধর্মাবলম্বী ও পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বলেন। পুরো অনুষ্ঠানটাও চললো পাঞ্জাবী ভাষায়। এক প্রবীণ নেতা আসার পর বাকিদের নমস্কার করার বহর দেখে বুঝলাম তিনি বেশ গণ্যমান্য। পরে জেনেছি তিনি এ আই কে এস এর নেতা, নাম সম্ভবত হেতরাম বেনিওয়াল। এ আই কে এস এর সংগঠন আছে এখানে। এলাকার বিধায়কও সিপিআই এর। এরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন দর্শন পাল, যোগেন্দ্র যাদবরা। এই মহাপঞ্চায়েতে এখানকার কয়েকটা বৈশিষ্ট্য বেশ চোখে পড়লো। মেয়েদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো কম। মঞ্চে সরাসরি নিহাং শিখরা উঠে "যো বোলে সো নিহাল" এর প্রতিযোগিতা চালালেন। এলাকার বিধায়ক, যিনি কোনও কৃষক আন্দোলনের নেতা পরিচয়ে নয়, বিধায়ক পরিচয়েই মঞ্চে এলেন, ভাষণ দিলেন, চলে গেলেন। জাট সমাজের সংগঠনের নেতারা সেই পরিচয় সহকারেই বক্তব্য রাখলেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কোনও সংগঠিত নেতৃত্বের অভাব বেশ চোখে পড়লো। এইটা নাকি কৃষক আন্দোলনে সমগ্র রাজস্থানেরই বাস্তব অবস্থা। আর সবচেয়ে চোখে পড়লো, একটাও গান কেউ গাইলো না। শুধু ভাষণ আর ভাষণ, তাতেও কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে কেউ বলছেন না। শ্রোতারা কার্যত বিরক্ত হয়ে যখন হাল্কা হতে শুরু করেছেন, যোগেন্দ্র যাদবের বাগ্মিতা চুম্বকের মতো কাজ করলো। লোকজন ভাষণ শেষে তার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া শুরু করে দিয়েছিল। এতোটাই অনুপ্রাণিত যে, এক শ্রোতা ওঠার সময় পাশের জনকে জিগ্যেস করছেন শুনতে পেলাম - “যোগেন্দ্র যাদব ক্যা জাট হ্যায়?” ভাবখানা এই যে - এতো শক্তিশালী বক্তৃতা যখন দিয়েছেন, যতোই তার পদবী যাদব হোক, আসলে তিনি বোধ হয় জাটই!
"আর্থি" শব্দটা বাংলার মানুষের কাছে আরেকটা অপরিচিত শব্দ। আর্থি অর্থাৎ সরকারী মান্ডির লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী বা ব্যাপারী একটা অংশ যারা সুদে টাকাও ধার দেয় কৃষকদের। এদের ভালো রকম উপস্থিতি আছে কৃষক আন্দোলনে। বোঝা যাচ্ছে সরকারী মান্ডির টিকে থাকা না-থাকার সাথে এদের স্বার্থ সরাসরি যুক্ত। আর্থিদের সাথে কৃষকের সম্পর্কটা শুধু টাকার সম্পর্ক নয়। এক রকম (পুঁজিবাদী) অর্থনীতি-বহির্ভূত ভরসা এবং পরস্পরকে চেনাজানার সম্পর্কও বটে। কৃষকের সাথে আর্থির এই সম্পর্কেও শোষণ লুকিয়ে আছে। কিন্তু কর্পোরেট পুঁজির বৃহত্তর গ্রাসের কবলে পড়ার ভয়ে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে আজ একটা লড়াইয়ের ঐক্য তৈরি হয়েছে এই আন্দোলনে। অন্যান্য গণ-আন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনেও অংশগ্রহণকারী সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এই ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্যের গতিময়তাটাকে না বুঝলে আন্দোলনের অন্তর্নিহিত বাস্তব টানাপড়েন ও তার সম্ভাবনার দিকটা বোঝা যাবে না।
"কিষাণ-মজদুর-ব্যাপারী একতা জিন্দাবাদ" - রাইসিং নগরেরে এই মহাপঞ্চায়েতে প্রথম কিষাণ-মজদুরের সাথে ব্যাপারীদের ঐক্যর ডাক শোনা গেল। কিছুটা ঘোরাঘুরি করে, উদ্যোক্তাদের সাথে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারছিলাম এই মহাপঞ্চায়েতের অন্যতম উদ্যোক্তা ব্যাপারীদেরও একটা অংশ। এখানে এ আই কে এস এর সংগঠন থাকলেও আন্দোলন শুরু করতে তারা বিশেষ উদ্যোগ নেয়নি, শুরু হওয়ার পর যোগ দিয়েছে - এরকমই বললেন স্থানীয় এক যুবক।
রাইসিং নগর হল শ্রীগঙ্গানগর জেলার একটি শহর। পাশেই হনুমানগড় জেলায় তার পরের দিনই মহাপঞ্চায়েত ছিল। সেদিনের জমায়েতে এই দুই জেলা থেকেই মানুষ এসছিলেন। শ্রীগঙ্গানগর রাজস্থানের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের এক জেলা। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও সেখানকার রুক্ষ জমি ফসল ফলার উপযুক্ত ছিল না। এখন সেখানে চাষ হয় বছরে দু'বার। সর্ষে, ছোলা, গম, কাপাস তুলো, জোয়ার ইত্যাদি। ইন্দিরা গান্ধী নাহার প্রকল্পে "নাহার" অর্থাৎ খাল কেটে শতদ্রুর জল নিয়ে আসা হয় ৭০'র দশকে। এই জমিতে অন্য জায়গার মানুষ এসে বসত তৈরি করেন। ধীরে ধীরে অনেক ঘাম ঝরিয়ে জমিকে চাষের উপযুক্ত করে তোলে মেহনতকারী কৃষক। এই সময়ে হনুমানগড় বা গঙ্গানগর থেকে বাসে করে রাইসিং নগরের দিকে গেলে রাস্তার দু'ধারে বিস্তীর্ণ সর্ষে, গমের খেত দেখা যাবে। মানুষের অনেক পরিশ্রম আর ধৈর্যের ফসল এগুলো। "নতুন আইন লাগু হলে এক লহমায় এতোদিনের এই পরিশ্রমের ফসল কর্পোরেটদের হাতে চলে যাবে", বলছিলেন সেই যুবক। বুঝতে পারলাম পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের পর রাজস্থানের মানুষও একটু একটু করে জাগছেন।
পাঞ্জাবঃ ক্রান্তিকারী ভূমিতে কৃষক-শ্রমিক মহাসমাবেশ
পাঞ্জাবেরই ৩২টা সংগঠন মিলে আন্দোলনের শুরুতে গড়ে তুলেছিল সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা । এখন যা অন্য রাজ্যেরও বিভিন্ন সংগঠন মিলিয়ে ৪০টার ওপর সংগঠনের যৌথ ফ্রন্ট। বিকেইউ একতা (উগ্রাহাঁ) পাঞ্জাবের একমাত্র সংগঠন যারা এই ফ্রন্টে না থাকলেও শুরু থেকেই যৌথ লড়াইয়ের অংশীদার। আগেই বলেছি এদের কথা। ২১শে ফেব্রুয়ারি এই সংগঠনটি এবং পাঞ্জাব খেত মজদুর ইউনিয়ন বলে একটি খেতমজুরদের সংগঠন মিলে "মহা র্যালির" আয়োজন করেছে। এখানকার চলতি নাম "মহা র্যালি", কিন্তু আসলে কোনও মিছিল নয়, মহাসমাবেশ। নামটা তাৎপর্যপূর্ণ - "শ্রমিক কৃষক একতা মহা র্যালি"। কিষাণ-মজদুর একতার যে স্লোগান এখানে এসে থেকে বারবার শুনেছি, তার বাস্তব শক্তির বহিঃপ্রকাশ একভাবে রূপ পেতে চলেছে এই মহাসমাবেশে।
২০ তারিখ সকাল সকাল পকোড়া চক থেকে গাড়ি করে রওনা দেওয়া হল পাঞ্জাবের বারনালার উদ্দেশ্যে। হরিন্দর বিন্দুর সাথে আমরা তিন কমরেড ও আরেক পাঞ্জাবের সাথী। যাওয়ার পথে হরিয়ানার এক টোল প্লাজার ধর্নার সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হল। উদ্দেশ্য - দুপুরের খাবার খাওয়া ও এনাদের সাথে কথা বলা। হরিন্দর বিন্দুর মধ্যে অদ্ভুত প্রাণশক্তির উচ্ছ্বাস, কে বলবে গতকাল হাসপাতালে স্যালাইন চলেছে তার! আলাদা ভাবে নয়, কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছিলেন এই "ছোটখাটো বিষয়টা", গাড়িতে আসতে আসতে। হরিয়ানার কোনও এক খাপ লঙ্গর দিয়েছে এখানে। খাবার নিতে নিতে দেখলাম মহিলাদের একটা দল স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে ধর্ণা মঞ্চের দিকে। "এটাও পাঞ্জাবের থেকে শিখেছে এরা" - বলছিলেন বিন্দু।
কয়েকঘন্টা বাদে পাঞ্জাবে প্রবেশ করলাম। রাস্তার দু'ধারের দৃশ্য বদলে গেল দেখতে দেখতে। বিভিন্ন শেডের সবুজ ল্যান্ডস্কেপ। প্রথমবার আসছি শুনে বিন্দু আমাদের পাঞ্জাবের মাটিতে স্বাগত জানালেন। "আপনারা ওখানে যখন সিঙ্গুরে লড়ছিলেন, আমাদের এখানেও কর্পোরেট বিরোধী জোর লড়াই হচ্ছিল।" বলতে বলতে আঙুল তুলে রাস্তায় ধারে একজায়গায় নির্দেশ করে বললেন বিন্দু। আরও বললেন- সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের আন্দোলন আমাদের কাছে প্রেরণা ছিল, আমরা লিখেছিলাম তার খবর আমাদের পত্রিকায়। রাস্তার ধারে এই সেই জায়গা, ২০০৭ এ ট্রাইডেন্ট কম্পানি যখন কৃষকদের থেকে জমি ছিনিয়ে নিচ্ছিল, পালটা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন কৃষকরা।"
বারনালার মহাসমাবেশের মাঠে যখন পৌঁছুলাম, দুপুরের রোদ প্রায় নিবু নিবু। এতো বিশাল সমাবেশের আয়োজন আগে কখনো দেখিনি। দু মানুষ সমান উঁচু মঞ্চ। জায়গাটা বারনালার "ধানমান্ডি"। মহাসমাবেশের প্রস্তুতি পর্ব তখন প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে। আড্ডার ছলে অনেকের সাথে কথা হল। জোরা সিং নাসরালি খেতমজদুর ইউনিয়নটির সভাপতি। ২০০০ সাল নাগাদ বিকেইউ একতা উগ্রাহাঁ সংগঠনটি তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকেই ভূমিহীন খেতমজুরদের অধিকারের প্রশ্নে এনারা সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। এই তিন কৃষি আইনে সব থেকে আগে বিপদে পড়বে খেতমজুররাই, কারণ তাদের সবার আগে কাজ চলে যাবে- বলছিলেন জোরা। এর বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে ঘুরে জনপ্রিয় নৃত্য গীত (যেমন ভাঙরা) এর মাধ্যমে এনারা প্রচার করেছেন, যা বেশ সারা ফেলেছিল। বিহার থেকে খেতে কাজ করতে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের কিভাবে সংগঠিত করা যায় তার উত্তর ওনারা এখনো পাননি।আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া খেতমজুরের সংখ্যা পাঞ্জাবে অনেক। আন্দোলন করে তাদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাটুকু অন্তত করাতে পেরেছে খেতমজুরদের এই সংগঠনটি। পরের দিন এই সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক লক্ষণ সিং শেহওয়ালার সাথেও কথা হয়। পরে জেনেছিলাম এনার ভাইকেও ৮০র দশকে খালিস্তানিরা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দ্যায়। সেইদিন রাত্রে তিনজন ছাত্র-যুব কমরেডের সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা হয়। এরা মহাসমাবেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভলান্টিয়ার-ইন-চার্জ। ১৯৭২ এর মোগা থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে "পাঞ্জাব স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (পি এস ইউ)” থেকে আজকের বহুধাবিভক্ত সংগ্রামী ধারার ছাত্র আন্দোলনের কথা শুনলাম। ৮০র দশকের অবিভক্ত ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়ন যেমন আজকে বিকেইউ অমুক, বি কে ইউ তমুক বিভিন্ন আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত, পাঞ্জাবের পি এস ইউ ও তাই।
২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল। মঞ্চের একদম সামনে সাংবাদিকদের সংখ্যা তখন ক্রমবর্ধমান। মঞ্চের ওপর খেতমজুর ইউনিয়নটির নেতারা ছাড়াও জগিন্দর সিং উগ্রাহাঁ ও তার সংগঠনের শীর্ষ নেতা সুখদেব সিং কোকরিকালান, ঝাণ্ডা সিং জেঠুকেরা বসে। নির্দিষ্ট টাইমের আগে প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে সমাবেশের মাঠ ভরে গেল চোখের সামনে। কতো মানুষ হতে পারে? এতো মানুষ একসাথে কোনওদিন চোখে দেখিনি, তাই একে ওকে জিগ্যেস করে উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করলাম। দু’ লাখের কম কেউ বললেন না। এর মধ্যে প্রায় এক চতুর্থাংশ মহিলা। মাঠ জুড়ে এক অদ্ভুত ছক তৈরি হয়েছে - রঙবেরঙের পোশাকের তারতম্য দিয়ে নানান রঙের খোপ। মঞ্চের ওপর থেকে দেখলে সমাবেশের ব্যাপ্তি ও এই রঙের খোপগুলো বোঝা যায়। বাংলার সাথে এটা আশ্চর্য মিল যে সমাবেশ শুরু হল একের এক গণসংগীতের মাধ্যমে। আকর্ষণীয় সুর, তাল, ছন্দে সেইসব লড়াইয়ের গান। প্রায় এক ঘণ্টা চললো সেটা।
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পক্ষ থেকে বলবীর সিং রাজ্জেওয়াল উপস্থিত হয়েছেন তখন মঞ্চে। ক্রান্তিকারী কিষাণ ইউনিয়ন, অল ইন্ডিয়া কিষাণ ফেডারেশন সহ আরও কিছু কৃষক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও আছেন। শিল্পী কানোয়ার গ্রেওয়ালও হাজির। আগেরদিনের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে অদ্ভুত মায়াবী গলায় গাইলেন বেশ কিছু গান। অনুষ্ঠান কভার করতে এতো কটা সংবাদ মাধ্যমে আগে কোথাও চোখে পড়েনি। বিবিসি, পিটিআই, টাইমস অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন বড়ো সংবাদ মাধ্যম, আঞ্চলিক চ্যানেল থেকে শুরু করে ক্যারাভান, দলিত ক্যামেরা, ওয়ার্কার্স ইউনিটির মতো স্বাধীন সংবাদ সংস্থা - সবাই আছেন। উগ্রাহাঁ সংগঠনের একজনের থেকে শুনছিলাম আন্দোলনের শুরুতে নাকি সংবাদ মাধ্যম পুরোপুরি উপেক্ষা করতো এই সংগঠনটির কর্মসূচী। তার পর টানা একের পর এক বলিষ্ঠ কর্মসূচী, সাংগঠনিক ক্ষমতা আর আপসহীন লড়াইয়ের মানসিকতা নিয়ে সংগঠনটি এই আন্দোলনের যতো নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠেছে, মিডিয়াও নজর দিতে শুরু করেছে এদের দিকে।
এক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক, তথ্যচিত্র নির্মাতার সাথে বহুক্ষণ সময় কাটানোর সুযোগ হয় সমাবেশটির পর। এই আন্দোলনে "কৃষকে"র পাশাপাশি যেমন জাট, শিখ ইত্যাদি সামাজিক বর্গগুলো, সেগুলোকে ঘিরে থাকা কৌমচেতনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, তেমনই আরেকটি কৌমচেতনার অবদান অনস্বীকার্য । সেটা হল "পাঞ্জাবীয়াত"। যা বুঝলাম, এটা আজকের ভারত ভূখণ্ডের ভৌগলিকভাবে চিহ্নিত প্রদেশ "পাঞ্জাব"র ব্যাপার নয়, কয়েক শতাব্দীর সাংস্কৃতিক, ভাষিক একটা একাত্মতার পরিমণ্ডল, যা আজকের পাকিস্তানের লাহোর প্রদেশের মানুষও বহন করেন, আবার ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের মানুষও, সেই একাত্মতার পরিমণ্ডলের নাম "পাঞ্জাবীয়াত"। আজকের ভারতে যখন পাঞ্জাবের কৃষকরা লড়ছেন, পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ভাষী শিল্পীরা একের পর এক সংহতিমূলক গান লিখে চলেছেন, গেয়ে চলেছেন - এই অজানা তথ্য জানালেন সেই সাংবাদিক সাথীটি (পরে তার পাঠানো সেই গানগুলো শুনেছি)। "পাঞ্জাবিয়াত" এর সাথে জুড়ে আছে ভারত রাষ্ট্রের দিল্লি কেন্দ্রিক শাসনের বিরুদ্ধতার চেতনাও। যে চেতনা একভাবে "কাশ্মীরিয়াত" এর সাথে "পাঞ্জাবিয়াতের" জৈবিক যোগসূত্র স্থাপন করে। ভারত রাষ্ট্র কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পরে প্রতিবাদে পাঞ্জাবের বহু জায়গায় রাস্তায় নেমেছিলেন হাজারে হাজারে মানুষ।
সমাবেশ শেষে ফিরছিলাম এনার সাথেই। শেষ রাতে ফেরার ট্রেন ধরতে হবে আম্বালা ক্যান্টনমেন্ট থেকে। হাতে খুব অল্প সময় তখন। বেরোতে দেরি হয়ে গেছিল নানা কারণে। এরই মাঝে টানা কালো হাইওয়েতে হঠাতই নেমে আসতে থাকলো কুয়াশার ঢল। একটা অদ্ভুত দর্শন গাড়ি সেই রাজস্থানে বাসে করে শ্রী গঙ্গানগর থেকে রাইসিং নগর যাওয়ার রাস্তা থেকে দেখে আসছি। বিরাট পশ্চাতদেশ নিয়ে রাস্তা জুড়ে হেলতে দুলতে চলা গাড়ি। আসলে শস্য (অতি-)বোঝাই করা ট্রাক্টর। দেখতে অতিকায় পেটমোটা ল্যাজবিহীন ইঁদুরের মতো। খুবই বিপজ্জনক এদের ওভারটেক করা। সেই রাতে পাঞ্জাবের রাস্তায় একে কুয়াশার ঢল নেমে আসতে থাকা, তার ওপর একের পর এক এই গাড়ি। অতি সতর্কতার সাথে গাড়ি চালাতে চালাতে সাংবাদিক সাথীটি নানা নতুন কথা বলছিলেন। পাঞ্জাবীয়াত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উনি বললেন মালেরকোটলার নবাবের কথা। গুরু গোবিন্দ সিংয়ের সন্তানকে যখন মেরে দিচ্ছে সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সৈন্যবাহিনী , মালেরকোটলার তৎকালীন মুসলিম নবাব সম্রাটের পক্ষের লোক হয়েও গুরু গোবিন্দ সিংয়ের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছেন। এই ঘটনা পাঞ্জাবের ইতিহাসে নজির স্থাপনকারী "Act of Empathy.”- বলছিলেন তিনি। বোঝা গেল পাঞ্জাবে আজকের শিখ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বন্ধুত্বের এটি একটি অন্যতম ঐতিহাসিক উপাদান। আজকের আন্দোলনে যে বন্ধুত্বের নজিরের কথা আগেই বলেছি।
স্থূল পশ্চাৎসম্পন্ন ইঁদুর গাড়িগুলো নাকি হিমাচলের পাহাড়ে যাচ্ছে খাবারের জোগান নিয়ে। সেখানকার মানুষ তাদের অন্নদাতা-অন্নদাত্রীদের এই আন্দোলনকে নিয়ে কি ভাবছেন? সে খবর আর এ যাত্রায় পাওয়া সম্ভব নয়।
অবসন্ন শরীর নিয়ে ফেরার ট্রেনে চেপে পড়ার সময় এসে গেল অবশেষে। তখন মাথা আর শরীর প্রায় কিছুই কাজ করছে না। তবুও বুঝতে পারছি কিছু ছবি মাথার মধ্যে রূপ পেতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। পরে ঠাণ্ডা মাথায় বহুবার ভেবেছি। এই কদিনের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটা উপলব্ধি অস্পষ্টতার জাল ছিঁড়ে বেরিয়েছে।
এক, এই আন্দোলন শুধু মাত্র তিন কৃষি আইনের বিরোধিতায় হঠাৎ করে গড়ে উঠেছে এমন নয়। কৃষিতে পুঞ্জীভূত দীর্ঘ সংকট যতো গভীর হয়েছে, ততো প্রবল হয়েছে কৃষকদের ফুঁসে ওঠার সম্ভাবনা। কোন কৃষক? যারা অন্তত কিছু অধিকার সুরক্ষিত করে রাখতে পেরেছিল, সেটা মান্ডি হোক বা এম এস পি-র নামে একরকম সরকারী সহায়তা হোক, যেটুকু পেরেছে। স্বাভাবিকভাবেই, যারা একবার অধিকারের কিছুটা হলেও স্বাদ পেয়েছে, সেটুকুও ছিনিয়ে নিতে গেলে বিরোধ আসবেই তাদের থেকে। এর থেকে উত্তর পাওয়া যায় কেন সর্বপ্রথম রাস্তায় নামে পাঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা। আজকের পর্যায়ে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে সচেতনভাবে এম এস পি কে দেশজোড়া আইন করার দাবী তুলে আনা হচ্ছে সারা দেশের সব স্তরের কৃষকের সাধারণ দাবী হিসাবে। দুই, পাঞ্জাবে সংগ্রামী ধারার কৃষক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচী চালিয়ে গেছে। বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুতেও তারা একযোগে লড়াইটা লড়েছে। যা আজকের যৌথ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটটা তৈরি করে দিয়েছে। তিন, শিখ ধর্ম, পাঞ্জাবীয়াত, জাট ইত্যাদি নানা কৌম পরিচিতির ও বৃহত্তর সামাজিক সংহতির একটা বড়ো ভূমিকা আছে এই আন্দোলনকে আগলে রাখার ক্ষেত্রে। আছে খাপ এর মতো সামাজিক সংগঠনের ভূমিকাও। ঔপনিবেশিকতার প্রভাব এখানকার সমাজে যতোটা কম, এখানে বামপন্থী চেতনার সাংগঠনিক বিকাশও সমাজের সাথে অঙ্গাঙ্গী যোগাযোগ রেখে হয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এ'গুলোই সব নয় অবশ্যই। কিছু খণ্ডিত খর্বিত অসম্পূর্ণ উপলব্ধি হিসাবেই স্মৃতির ভাঁড়ারে জমা হয়েছে এগুলো। আরো বেশি চর্চা ও কথোপকথন ছাড়া যার আর বিকাশের পথ নাই!
এর পর দুই মাসে ভেতরে ভেতরে নানা চোরাস্রোত বইলেও আন্দোলন বাহ্যিকভাবে নতুন কোনও পরিণতি প্রাপ্ত হয়নি এখনি। আন্দোলন স্থলে থাকা বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বললে এখন যা বুঝছি, দুটি জিনিস নিয়ে তারা খুব চিহ্নিত। এক, পাঁচ রাজ্য, বিশেষ করে বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল এবং দুই, গত এক সপ্তাহে দেশে জটিল হয়ে ওঠা করোনা পরিস্থিতি। এই দুইয়ের সাথেই গভীরভাবে জুড়ে আছে চলমান কৃষক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ।
১৮ই এপ্রিল- ২১শেএপ্রিল, ২০২১
[প্রথম প্রকাশঃ অনীক পত্রিকা; জুন-জুলাই ২০২১]
সূত্র:
১) কৃষক আন্দোলন ও তফসিলি জাতির শ্রমজীবী মানুষঃ https://edeshaamar.com/people-belonging-to-scheduled-castes-are-playing-the-most-militant-role-in-the-movement/
২) কৃষক, শ্রমিক পরিবারের সন্তানরাই শহীদ হনঃ https://edeshaamar.com/why-is-the-son-or-daughter-of-a-capitalist-not-martyred/
৩) আন্দোলন ও কৃচ্ছসাধনঃ http://edeshaamar.com/from-singhu-border/
৪) সিঙ্ঘু বর্ডারে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকঃ https://edeshaamar.com/manjura-bibi-speaks/
৫) কৃষক আন্দোলন ও খাপঃ https://edeshaamar.com/legal-bar-for-the-farmers-to-raise-disputes-in-a-court-of-law/
৬) হরিন্দর বিন্দুঃ https://edeshaamar.com/when-these-laws-were-passed/
৭) মনজিত ধানের ও মেহলকলাঁর আন্দোলনঃ http://edeshaamar.com/mehal-kalan-movement-one-of-the-milestones-of-united-mass-movement-in-the-history-of-punjab/
৮) হরিয়ানার মহাপঞ্চায়েতঃ http://edeshaamar.com/farmers-protest-encompasses-the-villages/
৯) কানোয়ার গ্রেওয়ালঃ https://www.facebook.com/watch/?v=170639624618625
১০) হরিয়ানার কৃষি মন্ত্রীর মন্তব্যঃ http://edeshaamar.com/farmers-protest-in-haryana-over-bjp-agriculture-minister-jayaprakashs-remarks/
১১) হরিনায়ার কৃষি মন্ত্রীর গ্রাম থেকেঃ https://edeshaamar.com/haryana-village-boycotts-bjp-jjp-leaders/
১২) হরিয়ানায় রেল রোকোঃ https://www.facebook.com/watch/?v=178066620435958
১৩) হরিয়ানায় টোল প্লাজায় ধর্ণাঃ http://edeshaamar.com/demonstration-at-haryana-toll-plaza/
১৪) রাজস্থানে মহাপঞ্চায়েতঃ http://edeshaamar.com/numerous-mahapanchayets-in-rajasthan/
১৫) পাঞ্জাবে শ্রমিক কৃষক মহাসমাবেশঃ http://edeshaamar.com/workers-farmers-rally-in-barnala-punjab-in-support-of-peasant-movement/
Comments
Post a Comment