আউশভিৎস - ষাট বছর পরে এবং হ্যারির জন্য কন্ডাক্টেড ট্যুর

সুদর্শন রায়চৌধুরী 

[সুদর্শন রায়চৌধুরী একদা বামফ্রন্ট সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী এবং বর্তমানে সিপিআই(এম)-এর রাজ্য কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ৩১শে জুলাই প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্মরণে তাঁরই পূর্ব প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের পুনঃপ্রকাশ করা হল।]

প্রথম প্রকাশঃ গণশক্তি পত্রিকা, উত্তর-সম্পাদকীয়, ২১শে জানুয়ারি, ২০০৫ 

প্রেক্ষাপটঃ ব্রিটিশ যুবরাজ চার্লসের প্রাসাদোপম অট্টালিকায় 'কলোনিয়াল অ্যান্ড নেটিভ'(!) থিমের কস্টিউম পার্টিতে রাজপুত্র হ্যারি স্বস্তিকা চিহ্নের হ্যান্ড ব্যান্ড সমেত নাৎসি ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় সুরাপান করার ছবি সংবাদমাধ্যম তুলে ধরলে বিশ্বজোড়া নিন্দার মাঝে যুবরাজ তার পুত্রকে আউশভিৎস বন্দী শিবির ভ্রমণে পাঠিয়ে 'পাপ খন্ডানো'-র পরিকল্পনা করছিল। উল্লেখ্য, শেষ পর্যন্ত যদিও হ্যারিকে কুমীরের কান্না কাঁদাতে সেখানে আর পাঠায়নি রাজপ্রাসাদের কর্তৃপক্ষ।



বিশাল হলঘর। সারা ঘর জুড়ে আছে, ছাতে এবং চারপাশে, অজস্র খন্ড খন্ড আয়না। আর সেই অগুনতি আয়নায় একটা একটা মুখের ছবি ভেসে ওঠে। ফুটফুটে বাচ্চাদের ছবি। কোন এককোণে জ্বলা একটি মোমবাতির শিখা আয়নাগুলোয় প্রতিফলিত হয়ে অজস্র বাতির শিখা হয়ে থরথর করে কাঁপে সারা ঘর জুড়ে। আর লুকানো লাউডস্পিকারে নিষ্কম্প কন্ঠে বেজে ওঠে একেকটা মুখের পরিচিতি - ইজার, পোল্যান্ড, জন্ম ১৯৩৭, মৃত্যু ১৯৪৩, আউশভিৎসে...। এইরকম একেকটা কচি মুখ, একেকটা নিছক নাম, আর, আউশভিৎস এবং আউশভিৎস, হয়ত বির্কেনাউ, হয়ত ত্রেবলিংকা... বিষাক্ত গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে অথবা গুলিবিদ্ধ হয়ে।

ইয়াদ ভাশেম। জেরুজালেম শহরের বুকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরগুলোয় নাৎসি অত্যাচারে নিহত শহীদদের স্মারক মিউজিয়াম। এই শহীদেরা নানান দেশের, কিন্তু সবাই ইহুদি। হিটলার এই ইহুদি সমস্যার 'চূড়ান্ত ফয়সালা' (Final Solution) করে জার্মানিকে বানাতে চেয়েছিল এক নেতা - এক দল - এক জাতি বীর রাষ্ট্র যা হবে সসাগরা ধরিত্রীর প্রভু। 'চূড়ান্ত ফয়সালা' মানে নির্বিচার হত্যা। সেই নিষ্ঠুর গনহত্যাকান্ড বা হলোকাস্টের সাক্ষ্য বহন করছে ইয়াদ ভাশেমের মিউজিয়াম। আউশভিৎস এবং আরো সব বন্দিশিবিরের অজস্র মর্মন্তুদ ছবি, উপাখ্যান এবং নির্যাতনের স্বার্থ সাক্ষ্যবস্তু - ভাঙা চশমা, ছেঁড়া জুতো, চাবুক, পায়ের বেড়ি... এই সব। ওদিকে মিউজিয়ামের বাইরে খোলা প্রান্তরে নিহতদের স্মৃতিতে স্বজনদের রোপণ করা গাছগুলো বেড়ে উঠেছে। গাছের নীচে প্রস্তরখণ্ডে উৎকীর্ণ আবার একেকটা নাম, তার দেশ আর কোথায় প্রাণ হারালো কোন দিনে তার বিবরণ।

ইয়াদ ভাশেমের প্রাঙ্গণে, সেখান থেকে ফেরার পথে সবচেয়ে চঞ্চল সবচেয়ে প্রগলভের মুখেও কথা সরে না। পূর্ব ইউরোপ জোড়া নাৎসি বন্দি শিবিরগুলো বিশেষত আউশভিৎসের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই আউশভিৎস যেখানে ৪০ লক্ষ ইহুদিকে ঠান্ডা মাথায় বিষ গ্যাসে খুন করা হয়েছিল। ১৯৪২-এর জুন থেকে ১৯৪৪-এর অক্টোবর পর্যন্ত। মানবতার বিরুদ্ধে ইতিহাসের সম্ভবত নিষ্ঠুরতম অপরাধী সাক্ষী আউশভিৎস। সেই আউশভিৎস, যা শেষ পর্যন্ত মুক্ত হয় সোভিয়েত বাহিনীর হাতে। ২৭শে জানুয়ারি, ১৯৪৫। এবছর আউশভিৎসের মুক্তির ৬০তম বার্ষিকী। ধনতন্ত্রের সবচেয়ে হিংস্র, সবচেয়ে নিষ্ঠুর রূপ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানবতার সবচেয়ে বড় বন্ধু সমাজতন্ত্রের জয়ের স্মৃতি বহন করে আনবে এবারের ২৭শে জানুয়ারি।

বিলেতের যুবরাজ চার্লস তাঁর ছোট ছেলে হ্যারিকে বলেছেন, ২৭শে জানুয়ারি ঘুরে এসো আউশভিৎস থেকে। দেখে এসো নাৎসি বর্বরতার সাক্ষ্য। চার্লসের আশা হ্যারির চেতনার উন্মেষ হবে। লন্ডনের পার্টিতে নাৎসী পোশাক পড়ে এসে মজা লুটতে গিয়ে কুড়ি বছরের হ্যারি ইতিহাস বিস্মৃতির যে পাপ করে ফেলেছে তা খণ্ডন হবে আউশভিৎসে চোখের জল ফেলে।

আউশভিৎসে কি ঘটেছিল? একসময়ের দাগি অপরাধী রুডলফ হেসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেখানকার বন্দী শিবিরের পরিচালনা করার। কোন ধরনের বিষাক্ত গ্যাসে বন্দীদের নিশ্চিতভাবে খুন করা যাবে তা নিয়ে হেস রীতিমতো চর্চা করেছিল। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছিল জিকলন-বি নামে হাইড্রোজেন সায়ানাইডের ভয়ঙ্কর মারণ বড়ির সন্ধান। গ্যাস চেম্বারে ঢোকানো ২০০০ মানুষকে একসঙ্গে খুন করা যাবে জিকলন-বি থেকে নির্গত বিষবাষ্পে। সময় লাগবে ৩ থেকে ১৫ মিনিট। এইভাবেই আউশভিৎসের চারটে বিশাল গ্যাস চেম্বারে রোজ অন্তত ৬০০০ বন্দীকে খুন করা হবে।

সারা ইউরোপে ছড়ানো নাৎসী দখলদারির অঞ্চলগুলো থেকে প্রধানত ইহুদি বন্দীদের ধরে আনা হতো আউশভিৎসের বন্দী শিবিরে। দক্ষিণ পোল্যান্ডের এক শহরে ১৯৪০-এর মে-জুন মাসে এই বন্দী শিবির খোলা হয়। বছর দেড়েকের মধ্যেআউশভিৎসের তিন কিলোমিটার দূরে বির্কেনাউতে গড়ে তোলা হয় আরেকটা বন্দী শিবির। আউশভিৎস-বির্কেনাউ সেই থেকে দুনিয়ার ঘৃণ্যতম জোড়া নাম।

নুরেমবার্গ আদালতের সামনে রুডলফ হেস বলেছিল রেল ওয়াগনে বোঝাই করে শিবিরে নিয়ে আসা বন্দীদের প্রথমেই পরখ করে নেওয়া হতো। যারা একটু কর্মক্ষম তাদের লাগানো হত বাধ্যতামূলক শ্রমে। বাদবাকিদের সিধে পাঠানো হতো গ্যাস চেমারে। মায়েদের কোল থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হত বাচ্চাদের। তাদেরকেই প্রথম নিকেশ করা হবে যেহেতু তারা কোন কাজ করতে পারে না। আর স্বামীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হত মেয়েদের যেহেতু তারাও তেমন খাটতে পারবে না। বৃদ্ধরা তো বটেই।

কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না গ্যাস চেম্বারের তুমি ব্যবস্থা কর ভেতর কি নিষ্ঠুর পরিণাম অপেক্ষা করছে। সামনের বাগানে ফুল ফুটেছে। বন্দী শিবিরের ভেতর থেকেই বেছে নেওয়া "সাদা ব্লাউজ আর সাগরনীল স্কার্ট পড়া অল্পবয়সী সুন্দর মেয়ে"-দের অর্কেস্ট্রায় শোনা যাবে লঘু সংগীতের মূর্ছনা। বন্দীদের বলা হয়েছে দীর্ঘ দুঃসহ যাত্রার শেষে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্নানাগারে। বিস্ময় বিহল বন্দীদের বলা হলো স্নানের আগে পোশাক ছাড়তে।

কাউকে কাউকে আবার তোয়ালে পর্যন্ত দেওয়া হলো। এবার তাদের ঢোকানো হলো স্নানের জায়গায়, শাওয়ারের তলায়। আর বন্ধ করে দেওয়া হল ভারী ধাতব দরজা। উইলিয়াম শিরার লিখছেন, "সম্ভবত এই প্রথম বন্দীরা সন্দেহ করল যে কোথাও একটা গোলমাল হয়ে গেছে নইলে তাদের হাজার দুয়েককে যে সার্ডিন মাছের গাদার মত গুঁজে দেওয়া হল চেম্বারে, তো স্নানের সুযোগই নেই...।" শাওয়ার দিয়ে জল পড়ে না। মেঝেয় নর্দমা নেই। এবং এইবার যৎসামান্য ভেন্টিলেটরের ফোঁকর দিয়ে গলিয়ে ফেলা হলো জিকলন-বির নীলাভ মারণ বড়ি। কয়েক মিনিট। ভেসে উঠল বিষবাষ্প। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বাঁচবার শেষতম তাগিদটা নিয়ে সন্ত্রস্ত মানুষ কেঁপে উঠছে। চেষ্টা করছে কোনোক্রমে যদি ভেন্টিলেটরের কাছে উঠে যাওয়া যায়। যদি একটু বাতাস মেলে। ধীরে ধীরে সবাই নিস্পন্দ হয়ে আসে।

বিশ-পঁচিশ মিনিট। গ্যাস চেম্বারের দরজা খুলে দেওয়া হয়। নগ্ননিথর মৃতদেহের স্তূপকে বার করে নেওয়া হয়। কোন মৃতদেহের সোনা দিয়ে বাঁধানো দাঁত। সোনার খন্ডটুকু উপড়ে নেওয়া হয় ওগুলো যাবে চোরাই সোনার কারখানায়। এবারে এই লাশগুলোর গন্তব্য বন্দী শিবিরের বিশাল দাহচুল্লি। একেক দিনে ৬০০০ লাশ সেখানে পুড়বে। চিমনীর ধোঁয়ার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে দগ্ধ দেহের ছাইয়ের কণা। স্পিলবার্গের শিন্ডলারস লিস্ট ছবিতে দাহচুল্লির চিমনীর মুখে লেলিহান আগুন আর উড়ে আসা ছাইয়ের দৃশ্য কেউ ভুলতে পারবেনা। তবু কিছুই বর্জ্য নয়। যা কিছু দগ্ধাবশিষ্ট চর্বি তা দিয়ে ভালো সাবান বানাবে ড্যানজিগের সাবান কারখানা। মানুষের চর্বির সঙ্গে পরিমাণমতো জল আর কস্টিক সোডা মিশিয়ে ঘন্টা দু-তিন ফুটিয়ে তারপর ঠান্ডা করলে মিলবে সাবান। আর পুড়ে যাওয়া পরে থাকা ছাই যাবে আবাদের ক্ষেতে সার হিসেবে।

রাজপ্রাসাদে বড় হয়ে ওঠা হ্যারি কি স্পিলবার্গের ছবি দেখেছে? হ্যারি অথবা তার দাদার উইলিয়াম কি পড়েছে শিরারের বই - 'দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য থার্ড রাইখ'? হয়তো দেখেছে, হয়তো পড়েছে। কিন্তু বিস্মৃতিপ্রবণ এই যৌবনে মনে রাখেনি কিছুই। আউশভিৎসের শহীদ স্মরণের ষাট বছর পরেও ফ্যাসিবাদের নিষ্ঠুরতার প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন শার্টের আস্তিনে অক্লেশে আঁকা হয়েছে। লন্ডনের মহার্ঘ বিপণীতে চড়া দামে তা বিকোচ্ছে। আর হ্যারির মতো যুবকেরা উইলিয়ামের মত বড় দাদাদের সস্নেহ প্রশ্রয়ে সেই শার্ট কিনে গায়ে দিয়ে পানপাত্র নিয়ে ফ্যান্সি পার্টিতে যোগ দিচ্ছে একচোট মজা লুটবে বলে। অন্ধ ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসের তুঙ্গ এই সময়কালে ফ্যাসিবাদও কেমন চমৎকার বৈধতা পায়!

বাবার হুকুমে হ্যারিকে হয়ত যেতে হবে আউশভিৎসে।

২৭শে জানুয়ারি। শ্রদ্ধা জানাতে হবে শহীদদের। তারপর সে কোথায় যাবে? ইয়াদ ভাশেমে? অথবা আজকের নব্যফ্যাসিবাদের পীড়ন লাঞ্চিত গুয়ান্তানামো বে'র বন্দীশালায়? আবু ঘ্রাইবে অথবা বসরার কাছে 'ব্রেড বাস্কেট' পীড়ন কেন্দ্রে? হ্যারির জন্য কোন কন্ডাক্টেড ট্যুরের আয়োজন করা হবে? কুম্ভীপাক থেকে দৌড়োবে - যতক্ষণ না হাঁটু গেড়ে চোখের জলে ভেসে সে না বলবে - আমায় ক্ষমা করো। 

ইতিহাসবিস্মৃত আত্মকন্ডুয়নের এই নির্বোধ সময়কালে চোখের জল আর ক্ষমা প্রার্থনা কি এমনই সহজলভ্য? 

 


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!