টাটা মোটর্স: ভারতীয় পুঁজিবাদের যা কিছু ভ্রান্তি

থমাস ক্রাউলি

[প্রথম প্রকাশঃ জ্যাকোবিন, ২৫শে জুলাই, ২০২১ 

মূল প্রবন্ধের লিঙ্কঃ https://jacobinmag.com/2021/07/tata-group-indian-capitalism-history-worker-organizing-caste-fortune-wealth-mircea-raianu-review/

বঙ্গানুবাদঃ ডিলিজেন্ট পত্রিকা]


মেগা কর্পোরেশন টাটা ১৫০ বছর ধরে ভারতীয় পুঁজিবাদকে রূপ দিয়েছে। এর সাফল্যকে বুঝতে হবে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়াকে নির্মমভাবে রোধ এবং তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ক বর্ণ ব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর নিরিখে।

ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাইয়ে (পূর্বে বোম্বে) অলঙ্কৃত, পাঁচ তারা তাজমহল প্যালেস হোটেলের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি অবিশ্বাস্য কিংবদন্তি রয়েছে। হোটেলটি ১৯০৩ সালে খোলা হয়েছিল, যখন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন চরম পর্যায়ে ছিল। হোটেলটির উৎপত্তি সম্পর্কে জনশ্রুতি - যখন উদীয়মান শিল্পপতি জামসেদজি টাটা - টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা - একটি ব্রিটিশ হোটেলে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন… জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত এই শিল্পপতি নিপীড়ক ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নিজের হোটেল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেটি ব্রিটিশদের নির্মিত যেকোনো কিছুর চেয়ে বড় এবং আরও চিত্তাকর্ষক ছিল।  

‘টাটা: দ্য গ্লোবাল কর্পোরেশন দ্যাট বিল্ট ইন্ডিয়ান ক্যাপিটালিজম’-এর প্রথম কিছু পাতায় ইতিহাসবিদ মিরসিয়া রায়ানু এই গল্পের অসম্ভবতাকে নোট করেছেন; এটিকে একটি মিথ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে "বোম্বেতে প্রকাশ্যে রঙীনদের পানশালা বিরল ছিল"। তবুও এই পৌরাণিক কাহিনী টিকে আছে, কারণ এটি জাতীয়তাবাদী চিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে টাটা গোষ্ঠী প্রচার করতে চায় - নৈতিক পুঁজিবাদের একটি মডেল, যা জাতির সেবায় মুনাফা অর্জন করে।

জামসেদজি টাটা এবং তার পরিবার বিদেশী বাণিজ্যে জড়িয়ে বাণিজ্যিক পুঁজিপতি হিসেবে তাদের প্রাথমিক সম্পদ অর্জন করেছিল, কিন্তু তারা তাদের জাতীয়তাবাদী খ্যাতি গড়ে তুলেছিল টেক্সটাইল মিল এবং পরে একটি শীর্ষস্থানীয় স্টিল প্লান্টের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নিজেদের তুলে ধরে। তারপর থেকে, এই গ্রুপ ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে, প্রযুক্তিগত এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে রাসায়নিক, বিমান, অটোমোবাইল, তথ্যপ্রযুক্তি এবং ব্যবসায়িক পরামর্শের মতো বিভিন্ন খাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। গত কয়েক দশকে, এটি চা ব্র্যান্ড টেটলি, ইস্পাত একচেটিয়া কোরাস এবং জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার-এর মত আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলি অধিগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় স্বীকৃতি এবং জাতীয়তাবাদী গর্বকে আরও শানিত করেছে।

এই সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে টাটা টিকে গেছে, যেমনটা রায়ানু বলছেন, ভারতে "কর্পোরেট পিরামিডের শীর্ষে"। ব্র্যান্ডিং এবং পরোপকারের দীর্ঘদিনের আগ্রহের মাধ্যমে, টাটা একজন উন্নতমানের এবং নিষ্কলুষ কর্পোরেট হিসাবে তার খ্যাতি রক্ষা করেছে, যা সম্ভবত দেশের অর্থনৈতিক জীবনকে চিহ্নিত করা দুর্নীতির লড়াইয়ের ঊর্ধ্বে।

রায়ানু তাঁর বইতে যা স্পষ্ট করেছেন তা টাটার পুরাণ কাহিনীর প্রকাশ্য নিন্দা নয়; বরং, তা একটি কোম্পানির ঐতিহাসিক বিকাশের একটি অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ, বিশেষ করে যেভাবে এটি ভারতের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার উত্থান সহ বড় ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। একটি ঐতিহাসিক বৃত্তের একটি যত্নবান কাজ, এই বইটি, টাটাদের নিজস্ব আর্কাইভকে মূল উৎস হিসেবে গ্রহণ করে এবং সাধারণত সমালোচনা থেকে বিরত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, উপসংহারটি কেবল উল্লেখ করে যে সংস্থাটি "পুঁজিবাদের প্রতিশ্রুতি এবং হতাশা" উভয়কেই মূর্ত করেছে। বইটির নিজস্ব নিরপেক্ষতা সত্ত্বেও, পুঁজিবাদের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী পাঠকদের অনেক আগ্রহ জাগাবে। এমনকি তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, রায়ানুর কাজ টাটা গ্রুপের সাবধানে রক্ষণাবেক্ষণ করা ছবিকে ছিদ্র করে এবং ভারতে ও বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের ইতিহাসের উপর আলোকপাত করে।

পৌরাণিক কাহিনী ঊর্দ্ধে

মার্কস বলেছিলেন যে পুঁজি পৃথিবীতে আসে "মাথা থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত চুইয়ে চুইয়ে, প্রতিটি ছিদ্র থেকে, রক্ত ​​এবং ময়লা নিয়ে।" এটি এমন একটি বর্ণনা যা টাটাদের সম্পদের উৎসের ব্যাখ্যার জন্য খুব ভালোভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। আফিম বাণিজ্যে এই কোম্পানির প্রথম দিকের সম্পৃক্ততা থেকে অনেক কিছু তৈরি হয়েছে – ১৮০০ শতাব্দীর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আফিম ছিল ভারতের বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। দুটো রক্তাক্ত আফিম যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয়লাভের মধ্যে দিয়ে আফিম মূলত বন্দুকের নলের ডগায় চীনে ঢোকানো হয়েছিল। রায়ানু "মূলত, রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত মাদক পাচার"-এ টাটাদের সম্পৃক্ততার রূপরেখা দিয়েছেন, কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন যে টাটারা এই ক্রীড়ার অন্যতম বড় খেলোয়াড় ছিল না। রাইয়ানু নোট করেছেন, এই প্রাথমিক ফাটকা বাণিজ্যের একটি অনিবার্য পতনের সময় তাদের ভাগ্য প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

বরং, রায়ানু লিখেছেন, “টাটার ভাগ্যের মূলে আসল কেলেঙ্কারি… ছিল আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এবং মিলিটারি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের দুর্নীতি যা ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যোগসূত্রকে প্রকাশ করে।

টাটাদের ভাগ্য পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল যখন তারা সাবেক ইথিওপিয়ান সাম্রাজ্য আবিসিনিয়ায় একটি ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীকে পণ্য সরবরাহের চুক্তি জিতেছিল এবং তারপরে ব্রিটিশদের কাছে তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য বিক্রি করা সব কিছুর দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল।

অবশ্যই, এটি তাজমহল প্যালেস হোটেল মিথের থেকে অনেক ভিন্ন উৎপত্তি কাহিনী - এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে একটি খুবই ভিন্ন সম্পর্ক তুলে ধরে।

এই প্রাথমিক শিকড়কে অতিক্রম করে, রায়ানুর বইটি ভারতে তীব্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে টাটার বিকাশকে চিহ্নিত করে, যার মধ্যে রয়েছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উত্থান এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি থেকে উদীয়মান জাতি-রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধ অর্থনীতিতে স্থানান্তর। রাইয়ানু যেমন দেখান, টাটা এই পরিবর্তনগুলি কিছুটা নিজের পক্ষে ঘুরিয়ে দিয়েছিল ভারতের অভ্যন্তরে শিল্প প্রকল্পগুলির সাথে তার জাতীয়তাবাদী পরিচয় তৈরির মাধ্যমে। যাই হোক, রায়ানু যুক্তি দেন, কোম্পানির চূড়ান্ত সাফল্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং জ্ঞান উৎপাদনে তার আন্তর্জাতিক সংযোগগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে।

টাটার জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি এবং তার জনহিতকর কাজগুলির নিষ্ঠুর দিকগুলি পড়া খুবই সহজ, ডুমুরের পাতায় ঢাকা মুনাফা এবং ক্ষমতার নগ্নতার মত। রায়ানু এই ধরনের গবেষণা সম্পর্কে সাবধানী এবং টাটা আর্কাইভে তাঁর ডুব দেওয়া দেখায় যে কোম্পানির নেতাদের ও পরিচালকদের কোম্পানির সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা, সমাজে যেভাবে তা অবদান রাখতে পারে বা রাখা উচিত এবং তার রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে বিতর্ক এবং মতবিরোধ ছিল।

উদাহরণস্বরূপ, যদিও জনহিতকর - শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা - কোম্পানির ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড থেকে কিছুটা স্বতন্ত্রতা ছিল, তবুও এটি রায়ানু দেখান টাটার ব্যবসায়িক মডেল হিসেবে এবং মুনাফার উদ্দেশ্যগুলির সাথে সংযুক্ত ছিল। বিশেষ করে ১৯৩৬ সালে উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে প্রতিষ্ঠিত টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স ছিল, রায়ানুর মতে, "সামাজিক সম্প্রীতির নামে ভারতীয় অবস্থার সাথে বিদেশী দক্ষতাকে এবং শেষ পর্যন্ত, সমগ্র শিল্প পুঁজিবাদকে খাপ খাইয়ে নেওয়ানো”। রায়ানু লিখেছেন, শ্রমিকদের অবস্থার উপর গবেষণা "শ্রেণী সংগ্রামের একটি সলিউশান" হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল - মূলত, অস্থির শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি উপায় হিসেবে।

ক্রমবর্ধমান প্রভাব

ভারতের টেক্সটাইল এবং ইস্পাত খাতে তার বিশেষভাবে জড়িত থাকার কারণে, টাটা গ্রুপ জানত যে তার মুনাফা নমনীয় শিল্প কর্মীদের উপর নির্ভর করে। একই সময়ে, তারা উদ্বেগের মধ্যে ছিল যে দ্রুত শিল্পায়নের ফলে জাতপাতের মতো ঐতিহাসিক বন্ধন ভেঙে যাবে, যা পরবর্তীতে শ্রমিকদের মধ্যে অস্থিরতা নিয়ে আসবে। অবশ্যই, পুঁজিবাদের শোষণমূলক অবস্থাকে শ্রমিকদের প্রতিবাদের জন্য কখনোই দায়ী করা হয়নি টাটা আর্কাইভের পাতায়।

মার্কস এবং এঙ্গেলস অবশ্যই পুঁজিবাদের 'প্রতিবাদ গুলিয়ে দেওয়ার শক্তি'কে চিহ্নিত করেছিলেন, কিন্তু টাটার মতো কোম্পানি সহ সিস্টেমের রক্ষকরা এই শক্তিকে ভয় পেয়েছিল।

ভারতে পুঁজিবাদের ইতিহাস অবশ্য ইঙ্গিত দেয় যে মার্কস এবং এঙ্গেলসের পাশাপাশি পুঁজিবাদী সমাজ বিজ্ঞানীরা পুঁজিবাদের জাতপাতের মতো পুরনো সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলার ক্ষমতাকে অতিমাত্রায় সদর্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন। ভারতে পুঁজিবাদের ঘটনাপ্রবাহ দেখায় যে, জাতপাত উবে যাওয়ার পরিবর্তে পুঁজিবাদ দ্বারা রূপান্তরিত হয়েছে, এমনকি পুঁজির সঞ্চয়নকে সমর্থন করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, টাটারা, কেবলমাত্র তার কারখানাগুলিতে নয়, এমনকি তার কারখানা শহরগুলির সংগঠনেও বর্ণ এবং আঞ্চলিকতাঁর ভিত্তিতে পৃথকীকরণের প্রচার করেছিল।

অন্তর্দৃষ্টি লাভের সাথে সাথে ভারতে একটি প্রগতিশীল সামাজিক শক্তি হিসাবে পুঁজিবাদের দাবির ফাঁকফোকরগুলি দেখতে পাওয়া সহজ। কিন্তু তবুও, সম্ভবত আধিপত্য গড়ে তোলার জন্য তাদের প্রচেষ্টার পরিশীলিততার কারণে (তাদের জনহিতকর এবং শিক্ষাগত উদ্যোগ সহ), টাটার মতো সংস্থাগুলি কেবল সাধারণ জনগণের কাছেই নয়, বামপন্থীদের কিছু অংশের মধ্যেও বৈধতা পেতে সক্ষম হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে, রায়ানু যেমন উল্লেখ করেছেন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)-তে প্রধান বিতর্ক ছিল ঠিক কিভাবে দেশের বুর্জোয়া শ্রেণীর মূল্যায়ন করা যায়; রাষ্ট্রের সাথে তার সম্পর্কই বা কি? পার্টি একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিল - যা উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারত রাষ্ট্রকে সমর্থন করেছিল, মূলত ঠাণ্ডা যুদ্ধের রাজনৈতিক কারণে - বুর্জোয়া শ্রেণীর অন্তত কিছু অংশের একটি সম্ভাব্য প্রগতিশীল দিক দেখার চেষ্টা করেছিল; ইতিমধ্যে, পার্টির অন্য পক্ষ, শীঘ্রই সিপিআই(মার্কসবাদী) হয়ে উঠবে - সাধারণত চীনের সাথে সম্পর্কযুক্ত - ভারতীয় পুঁজিকে অনিবার্যভাবে মুৎসুদ্দি হিসাবে দেখেছিল, অর্থাৎ যা কেবল আন্তর্জাতিক পুঁজির পুতুল [*]। 

রায়ানুর বই আমাদের দেখায়, টাটার মতো কর্পোরেশনগুলি এই দুই মতধারার সাথে খুবই খারাপভাবে ফিট করে। তারা সমাজে আংশিক বৈধতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল কারণ তারা নিছক সাম্রাজ্যবাদের পুতুল ছিল না; তারা ভারতের অভ্যন্তরে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিল, এবং যখন তারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, জাতীয় পরিসরে তারা একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভারতীয় বুর্জোয়া ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই ধরনের স্বদেশী পুঁজিপতিদের সাথে সমঝোতার অক্ষমতা এবং প্রকৃতপক্ষে, বামপন্থীদের কিছু অংশের দ্বারা তাদের প্রগতিশীল কার্যকারিতা সম্পর্কে অত্যধিক সদর্থক মূল্যায়ন সিপিআই-সিপিএম বিভাজনের বাইরেও অব্যাহত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, যেমন অনেক বাম বিশ্লেষক লক্ষ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কয়েক দশক ধরে সিপিআই(এম) শাসনের পতনের সূচনা হয়েছিল গণবিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে – সিপিআই(এম) সরকার বিক্ষোভের বিরুদ্ধে হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল – টাটার ‘পিপল’স কার’ ন্যানোর জন্য জোর করে জমি অধিগ্রহণে রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল একুশ শতকের প্রথম দশকের গোড়ার দিকে।

এই ধরনের উন্নয়ন কাহিনীর কেবল রায়ানুর বইয়ের উপসংহারে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৭০-এর দশকের আর্কাইভের মত উত্সের উপর অধ্যয়নের কিছু সীমাবদ্ধতার উঠে এসেছে এর মধ্যে দিয়ে। আনুষ্ঠানিক টাটা আর্কাইভগুলিতে কর্পোরেশনের ১৯৭০-এর দশকের পরের সাম্প্রতিকতম, বিতর্কিত কীর্তির কোন চিহ্ন নেই, এবং সেগুলোতে জামসেদজি টাটা এবং তার ছেলেদের ব্যক্তিগত কাগজপত্রও অন্তর্ভুক্ত নেই। পরিবর্তে, এগুলি প্রচারের একটি অনুশীলনের সমান, একই সাথে কোম্পানির ভাবমূর্তি উন্মুক্ত করা এবং নৈতিকতা তুলে ধরতে সক্ষম যখন তার ইতিহাসের মূল অংশগুলি অস্বচ্ছ।

রায়ানু এই ধরনের একটি আর্কাইভের সাথে কাজ করার চ্যালেঞ্জ স্বীকার করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর সীমানার মধ্যেই নিজেকে রেখে তিনি তাঁর বইটি যে বড় প্রশ্নগুলি উত্থাপিত করে তার কিছু উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, প্রথম দিকে, তিনি পরামর্শমূলকভাবে নোট করেছেন: "টাটার ঐতিহাসিক গতিপথ কেবল [ভারতীয় পুঁজিবাদের] বাণিজ্য থেকে শিল্প পরিষেবাগুলিতে বিস্তারের রূপান্তরকে প্রতিফলিত করে না, এটিতে সমস্ত ঐহাসিকি পর্যায়গুলি একইসাথেই রয়েছে, অতীতের ভার খুব কমই নষ্ট হওয়ার পরিবর্তে"।

এই ধরনের বিবৃতি থেকে বোঝা যায় যে ভারতীয় পুঁজিবাদের ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন টাইম পিরিয়ডে ভাগ করা যায় না। কিন্তু এটি আজকের ভারতীয় পুঁজিবাদকে যে শক্তি বা সেক্টর সংজ্ঞায়িত করে এবং এই সবের মধ্যে টাটা কী ভূমিকা পালন করে তার সামান্য ধারণা দেয়। বইয়ের উপশিরোনাম থেকে বোঝা যায় যে টাটা "ভারতীয় পুঁজিবাদ গড়ে তুলেছিল", কিন্তু ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদন, স্ব-কর্মসংস্থান এবং অর্থনীতিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে কি টাটার মতো একটি কর্পোরেশনকে প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিকভাবে ভারতীয় পুঁজিবাদের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে দেখা যেতে পারে?

এই ধরনের প্রশ্নের জন্য, কেউ স্পষ্টভাবে ভারতীয় পুঁজিবাদের মার্কসীয় বিশ্লেষণের দিকে ফিরে যেতে পারেন। রায়ানু নিজেই জাইরুস বনাজি এবং তাঁর বিশ্লেষণের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে ভারতে আফিমের বাণিজ্য রাষ্ট্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত মূলধন আহরণের একটি বৃহত্তর নেটওয়ার্কের অংশ ছিল। লন্ডনে অগণিত অর্থায়নকারী এবং ফাটকাবাজদের একত্রিত করে এবং ভারতীয় কৃষকদের ক্রমবর্ধমান ঋণগ্রস্থ করে তোলার মাধ্যমে এই নেটওয়ার্ক বাণিজ্যিক পুঁজির দ্বারা প্রভাবিত ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যক্তি কৃষকদের কাছে আফিম চাষকে চাপিয়ে দিয়েছিল, যার ঋণ প্রায়ই শোধ করতে অক্ষম ছিল কৃষকরা।

বনাজির বিশ্লেষণ প্রসারিত করে, আদিত্য বাল সম্প্রতি উল্লেখ করেছেন যে এই ধরণের বাণিজ্যিক পুঁজিবাদ আবার শক্তি সংগ্রহ করতে পারে, সাম্প্রতিক বিতর্কিত কৃষি আইনের মাধ্যমে যা কর্পোরেট খাতে ভারতীয় কৃষির দরজা খুলে দিতে চায়' এর মধ্যে রয়েছে চুক্তি চাষের প্রচার। এটি কৃষকদের ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে যারা আশঙ্কা করছে যে বড় কর্পোরেটদের স্বার্থগুলি বড় আকারের সাপ্লাই চেইন স্থাপন করতে সক্ষম হবে, কৃষিপণ্যের মূল্যের উপর তারা দাদাগিরি করবে এবং কৃষকদের আরও ঋণের দিকে ঠেলে দেবে।

টাটা অবশ্য এই গল্পে অনুপস্থিত নয়, কারণ তারা অনলাইন বাণিজ্যে তার শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা সম্প্রতি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম বিগ বাস্কেটের (একটি জনপ্রিয় খাদ্য বিতরণ পরিষেবা) সিংহভাগ শেয়ার কিনে নিয়েছে। এদিকে, মিডিয়ার কাজে নিজেদের গুরুত্ব হারালেও, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকরা ব্যাপক বিক্ষোভ করছে।

টাটা আর্কাইভের একটি ধারাবাহিক থিম, যেমন রায়ানু আমাদের দেখায়, শ্রমিক অস্থিরতা নিয়ে উদ্বেগ। কেউ ভাবতে পারেন তাহলে, পুঁজিবাদ সম্পর্কে ভবিষ্যতের কোনও ইতিহাসবিদ ভারতীয় ইতিহাসের এই বর্তমান, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত সম্পর্কে কী লিখবেন, কারণ ধারাবাহিক প্রতিবাদ পুঁজিবাদের জাতির হিতসাধনী মুখোশকে জোরালোভাবে প্রশ্ন করে। 

............

[*] লেখকের বক্তব্যে ভ্রান্তির সম্ভাবনা; বিশদে জানতে ক্লিক করুনঃ https://www.youtube.com/watch?v=IiIiGm5KOAM&t=390s

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার