খেলাধুলো এবং সমাজতান্ত্রিক নির্মাণঃ কিউবা এবং ভেনেজুয়েলার অভিজ্ঞতা

রূপক গায়েন 


পৃথিবীর সবথেকে বড়ো স্পোর্টস ইভেন্ট বলতে আমরা প্রত্যেকেই যা বুঝি তা হলো অলিম্পিক গেমস। অলিম্পিকের আসর বসে প্রত্যেক লিপ ইয়ার বছরগুলিতে, পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক নিয়মেই যাতে খেলায় অংশগ্ৰহণকারীরা নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য অন্তত একটু হলেও সময় বেশি পায়। যদিও করোনার জন্য এবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে টোকিও অলিম্পিক ২০২০। অলিম্পিক মানেই অলিম্পিকের মেডেল কাউন্ট অর্থাৎ দেশগুলোর র‍্যাংকিং। কিন্তু সরকারের ক্রীড়া ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ বা দীর্ঘমেয়াদী বিশেষ পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয় সেই দেশের ব্যাক্তি ক্রীড়াবিদের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির পিছনে কতটা সেই সরকারের ভূমিকা রয়েছে। এবারের অলিম্পিক্সে ভারতের স্থান ৪৮ (১টা সোনা, ২টো রূপো, ৪টে ব্রোঞ্জ); প্যারালিম্পিক্সে ভারতের স্থান ২৪ (৫টা সোনা, ৮টা রূপো, ৬টা ব্রোঞ্জ)। ভারতের কোভিড পূর্ববর্তী ২০২০-২১ বাজেটে (ফেব্রুয়ারীতে ঘোষিত) ক্রীড়া ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ ছিল মাত্র জিডিপি-র ০.০১%! [Budget Details 2020-21] ফলে ভারতের অলিম্পিক্সের পারফর্মেন্সের শ্রেয় কেবল অ্যাথলিটদেরই, সরকারের বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই পোস্টার টাঙানো ছাড়া। এই প্রেক্ষিতে বিগত কয়েক দশকে অনেক পিছন থেকে শুরু করে অনেকটা এগিয়ে আসা দেশগুলোর মধ্যে দুটি, কিউবা এবং ভেনেজুয়েলা নিয়েই এই প্রতিবেদন বিশ্লেষিত হবে। 

প্রথমেই আসি ভেনেজুয়েলার কথায়, ভেনেজুয়েলার ইয়ুলিমা রোজাস, যিনি একজন সেল্ফ ডিক্লেয়ার্ড সমকামী সম্প্রদায়ের সদস্য, ট্রিপল জাম্পে বিশ্বরেকর্ড (পূর্বতন রেকর্ডের ০.১৭ মিটার বেশি) করে অলিম্পিকে স্বর্ণপদক লাভ করেছেন, একই সাথে দেশে মহিলা অ্যাথলিট হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। তবে শুধু এই অলিম্পিকেই নয়, পূর্বতন লন্ডন এবং রিও অলিম্পিকেও রূপো জেতার রেকর্ড আছে তাঁর। ২০১৭ সালে 'বেস্ট ফিমেল অ্যাথলিট অ্যাওয়ার্ড'ও দেওয়া হয় ইয়ুলিমা রোজাসকে, অ্যানক (অ্যাসোসিয়েশান অফ ন্যাশোনাল অলিম্পিক কমিটি)-র তরফ থেকে। এছাড়াও ওয়েট লিফ্টিং-এ জুলিও মেয়োরা, কেডোমার ভ্যালেনিলা, সাইক্লিং-এ ড্যানিয়েল ধারসও অলিম্পিকে রূপো পেয়েছেন এবং মেয়োরা তার পদকটি প্রেসিডেন্ট হুগো সাভেজের নামে উৎসর্গ করেছেন। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে একটা রূপো এবং দুটো ব্রোঞ্জ পাওয়া ভেনেজুয়েলার অবস্থান ছিল ৬৫; সেখান থেকে এইবার ৪৫-এ। এই অভূতপূর্ব সাফল্যের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভেনেজুয়েলার সরকারের পক্ষ থেকে, এ বছরের জয়ী অ্যাথলিটদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ২০২৪-এ প্যারিস অলিম্পিকের জন্য অ্যাথলিটদের তৈরি করার এবং কাঠামোগত প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরকারকে অবগত করার। ২০১২ লন্ডনের প্যারালিম্পিকেও ভেনেজুয়েলার অ্যাথলিটরা ভালো ফল করে, যার প্রধান কান্ডারি ছিলেন হুগো সাভেজ। তিনি রাজধানী ক্যারাকাসের কাছেই বিকলাঙ্গ অ্যাথলিটদের থাকার ব্যবস্থা, আর্থিক অনুদান সহ অন্যান্য বিশেষ ইনফ্রাস্ট্রাকচার যা আগে ছিল না সবকিছুই প্রদান করেন। রুশ খেলোয়াড়দের কোচ হিসেবে নিয়োগ করা হয় যা সোভিয়েত যুগ থেকেই ভেনেজুয়েলায় প্রচলিত ছিল। বস্তুত ১৯৯৯ সালে হুগো সাভেজ ক্ষমতাধীন হওয়ার পর ক্রীড়াক্ষেত্রে সরকারের তরফে একটা মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করা হয় যদিও পরবর্তীকালে মাত্রাতিরিক্ত অর্থনৈতিক মন্দা এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়ে দিতে হয়। ফলে অনেক অ্যাথলিটদের অলিম্পিকে যাওয়ার রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সাভেজ কিউবান অ্যাথলিটদের ডেকে পাঠান নিজের দেশের অ্যাথলিটদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য; কিউবার সাথে তেলের বিনিময়ে এই প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিউবান স্পোর্টস এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বহু সদস্য ভেনেজুয়েলায় ক্রীড়া ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোয় এগিয়ে আসে এবং এরই অংশ হিসেবে প্রচুর স্টেডিয়াম তৈরি করা হয় দেশজুড়ে। ফলে শুধুমাত্র বেস বলের ক্ষেত্র (ভেনেজুয়েলায় একসময় এই খেলাই হতো শুধু) থেকে বেরিয়ে এসে বক্সিং, রেসলিং, ওয়েট লিফ্টিং, ক্যারাটে, ভলিবল -  এইসব খেলাতেও প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। ২০১১ সালে ভেনেজুয়েলান গল্ফার জনাথন ভেগাস, বব হোপ ক্লাসিক টাইটেল জেতেন এবং পরবর্তীতে সান দিয়েগোতে ভেগাস হারিয়ে দেন কিংবদন্তি টাইগার উডসকে। সারা বিশ্বে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। হুগো সাভেজও তার প্রশংসা করেন। তবে বিতর্ক তৈরি হয়, যেহেতু কিছু বছর আগেই সাভেজ গল্ফকে 'বুর্জোয়া খেলা' হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তবে তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং বক্তব্য রাখেন যে কোন ধরনের খেলা এবং সেই খেলা থেকে প্রাপ্ত অর্থের কিছু অংশও যদি দেশের জনকল্যাণমূলক কাজে লাগে সেটার থেকে গঠনমূলক আর কিছুই হতে পারে না। ভেনেজুয়েলার মূল অর্থনৈতিক উৎসই হলো তেল, যা ১৯৯৯-এর আগে মার্কিন কব্জায় ছিল। ফলে দেশ গঠনের কোনো অর্থই পাওয়া যেত না। হুগো সাভেজ ক্ষমতাধীন হওয়ার পর থেকে মার্কিন কোম্পানি এবং খনিগুলোর জাতীয়করণ করা হয়, ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজকোষে জমা হয়। খেলাধুলার ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ বাড়ে, যার সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে এবারের টোকিও অলিম্পিকে একটি সোনা, তিনটে রূপো সহ ৪৫ নম্বর স্থান অর্জন। এবারের প্যারালিম্পিক্সে ভেনেজুয়েলার স্থান ৩৮ (৩টে সোনা, ২টো রূপো, ২টো ব্রোঞ্জ)।  

এবারে আসা যাক কিউবাতে। ১৯৫৩ সালে বিপ্লবের আগে মূলত কক ফাইটিং, হর্স রেসিং সহ যে খেলাগুলো প্রধানত জুয়ার সাথে যুক্ত সে ধরনের খেলারই মূলত চল ছিল। তবে স্প্যানিশ কলোনি থাকার জন্য টেনিসের মত এলিট স্পোর্টসেরও চল ছিল। বক্সিং-এর প্রচলনও ছিল। ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিক থেকে কিউবান খেলোয়াড়রা মেডেল পেলেও, সামগ্ৰিকভাবে সেগুলোর পিছনে কিউবান সরকারের  প্রভাব ছিল না বললেই চলে। ১৯৫৫ সালে বাতিস্তার স্বৈরতান্ত্রিক সরকার সমগ্র বাজেটের মাত্র ০.১৭ শতাংশ ক্রীড়াক্ষেত্রে বরাদ্দ করেছিল। তবে পরবর্তীকালে ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবী সরকার তৈরির সময়ও স্পোর্টস সেক্টরে মার্কিন অর্থনীতির জুয়াড়িদের প্রভাব ছিল। মার্কিন কোম্পানি জাতীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু করে বিপ্লবী সরকার। সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক বলয়ে কিউবা ঢুকে পড়ে এবং ১৯৬১ থেকেই ইউএসএ-এর সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কিউবান সরকার 'ইন্ডার' (দ্য ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ স্পোর্টস, ফিজিক্যাল এডুকেশান অ্যান্ড রিক্রিয়েশান) নামে একটি সংস্থা তৈরি করে, যারা ঠিক করে যে দেশের  স্কুলগুলোতে খেলাধুলা ও শরীরচর্চার একটা কোর্স শুরু করা হবে এবং বিভিন্ন স্থানীয় অ্যাথলেটিক কম্পিটিশনে উৎসাহ দান করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়। একদিকে দেশের সৈন্যবাহিনীতে শারীরিকভাবে সবল ব্যাক্তিদের অন্তর্ভুক্তির জন্য স্পোর্টসে ইন্ধন দেওয়া, একই সাথে সাধারণ ব্যাক্তিদের মধ্যে স্পোর্টসে আগ্ৰহ বাড়ানোর জন্য সরকারি মিডিয়াকেও ব্যবহার করা হয়। সোভিয়েতের বিভিন্ন স্যাটেলাইট দেশগুলিতেও ইন্ডার কর্তৃক কিউবান খেলোয়াড়দের পাঠানো হয় যাতে তারা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়। ইন্ডার দেশের বিভিন্ন স্কুলগুলি থেকে ভালো 'আইডি' (অ্যাথলিটদের ডিপার্টমেন্ট ফর ইনিসিয়েশান অফ স্কুল স্পোর্টস)-তে পাঠায় এবং সেখান থেকেও যারা ভালো ফলাফল করে তাদের 'এস্পা' (হায়ার স্কুল ফর অ্যাথলেটিক ইম্প্রুভমেন্ট), আর সেখান থেকে হাভানার স্পোর্টস সিটিতে পাঠায়, যেখানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফিজিক্যাল এডুকেশনের প্রশিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় 'এপেফ' (প্রভিনশিয়াল স্কুল অফ ফিজিক্যাল এডুকেশান)-এ। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে খেলাধুলার জুড়ি মেলা ভার।  পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের খেলাধুলার নামে স্পন্সরশিপের জমকালো ছটা এবং বিজ্ঞাপনকেন্দ্রিক প্রচারসর্বস্বতাই যেখানে মুখ্য সেখানে দাঁড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে খেলাধুলার উন্নতি আদতে  জণগণের সামগ্ৰিক উন্নতিরই দ্যোতক। তবে ১৯৯১তে সোভিয়েতের পতন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা - এইসবের ফলে কিউবার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সাময়িক কিছুটা খারাপ হয়। তারপরেও ২০০০ সাল থেকে নিয়মিতভাবে অলিম্পিকে ভালো ফল করে চলেছে কিউবা। কিউবা আজ অব্দি ৮৫টি সোনা, ৭১টি সিলভার, ৮৫টি ব্রোঞ্জ সহ ২৪১টি মেডেল পেয়েছে। টোকিও অলিম্পিকেও ৭টি সোনা, ৩টি রূপো এবং ৫টি ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছে (স্থান ১৪)। এবারের প্যারালিম্পিক্সে কিউবার স্থান ৩৫ (৪টে সোনা, ১টা রূপো, ১টা ব্রোঞ্জ) অনেক সময়ই বলা হয় সমাজতান্ত্রিক নির্মাণে ব্যাক্তির থেকে গোষ্ঠীর গুরুত্ব যথেষ্ট বেশি, কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, গোষ্ঠীর উন্নতির মাঝেই আসলে ব্যাক্তিরও উন্নতি সূচিত হয়। কিউবা এবং ভেনেজুয়েলা - এই দুটি দেশ সেই ধারণারই পরিচায়ক ও বাহক। 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views