চীনের চাউমিন, আমাদের চাউমিন ???
আসল চাইনিজ খেতে অনেকেই টেরিটি বাজার ছোটে কিন্তু সকলের মুখে রোচে না। পানসে, আঁশটে গন্ধ ইত্যাদি অনেকেরই সহ্য হয় না। তাই অনেকের জন্য এই খাবারে এখানকার মশলাপাতি না দিলে তা খাওয়াই যেন দায়… অর্থাৎ অঞ্চল বিশেষে একই খাবারের রন্ধন প্রণালীর পরিবর্তন ঘটে। এবার আসা যাক আসল কথায়… অঞ্চল বিশেষে একই অর্থনৈতিক মতধারার রাজনৈতিক প্রতিফলন ঘটে ভিন্ন ভিন্ন পথে। বিপ্লব কপি-পেস্ট করাটা যেমন কখনও কখনও বিচ্যুতি, আবার অনেক সময়ে ‘রিফর্ম’ কপি-পেস্ট করাটাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বলা ভালো, মেইনস্ট্রীম পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিভিন্ন মোড়, বাঁক, পর্যায় অতিক্রমের চাহিদার তাগিদেই এই অ্যাডজাস্টমেন্ট বা ‘রিস্ট্রাকচারিং’। সাম্প্রতিক সম্পন্ন হওয়া চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছরের এই পরিসরে, এবার দেখে নেওয়া যাক, ২০০১ সালে করণ থাপাড়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর চীন অনুপ্রাণিত এই পলিসিগত ‘রিস্ট্রাকচারিং’ নিয়ে কিছু কথা…
মোদ্দা কথা হল, ‘বাজার’ সমস্ত বাজারী ‘রিস্ট্রাকচারিং-এর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, শ্রমিকরা নিজেদের অধিকারের দাবীতে আর ধর্মঘট করবে না (কর্মসূচীর সংখ্যা কমিয়ে দেবে বা বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করবে), বাজার/কম্পিটিশান ইত্যাদির জন্য মালিকদের কথা শুনে কাজ করবে; বিপ্লব ঠিপ্লব গুলি মারো, নইলে চাকরি-বাকরির বারোটা বাজবে; আর শোষণ-নিপীড়ন নিয়ে ভয় কি, যা হবে তা একটু কমিয়ে ঠমিয়ে দেবে না হয় বামপন্থীরা… এর ফলাফল কি হয়েছে তা সকলের জানা… বিপ্লব করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নেওয়া চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অর্থনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট/বিচ্যুতি/উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিস্ট্রাকচারিং (?!) নকল করতে গিয়ে (বুর্জোয়া ব্যবস্থায়, আদতে তা মিশ্র অর্থনীতি যা অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে বিপ্লবী কর্মসূচীর অভাবে ঘুরে যেতে পারে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের থেকে বেসরকারিকরণের দিকে) কেস খেয়ে লাট হল বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধ অধিকারপ্রাপ্ত একটি আঞ্চলিক বামপন্থী সরকার। কিন্তু গোদাভাবে 'রিস্ট্রাকচার'-এর পলিসিগুলো এখনও বলবত রয়েছে, বামেদের বিভিন্ন ধারার মধ্যেও তা মান্যতা লাভ করেছে। তাই আন্দোলনের দাবী সনদ কিংবা নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে প্রকাশ পায় বামেদের ডান ঝোঁক (ডান পার্টিগুলো যা আরও বলিষ্ঠভাবে বাস্তবায়নে পটু), দিশাহীনতা এবং নিজ ঘরানার নির্মাণ প্রকল্প সম্বন্ধে চিন্তাভাবনায় অনীহা।
আজ বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের সংঘর্ষের ফলে একটা নয়া-শক্তি-সম্পর্ক স্থাপনের দিকে এগোচ্ছে, তখন বাম রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই ‘বাজার অর্থনীতি’-র ডিসেকশান প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে তিনটে রচনার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হল পাঠকদের জন্য। প্রথম অধ্যায় বাজার অর্থনীতির আহ্বান সম্পর্কে, দ্বিতীয় তার সমালোচনা এবং তৃতীয়তে রইল ‘বাজার অর্থনীতি’-র আদি তীর্থ চীনের বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মানচিত্রে অবস্থান সম্পর্কে পর্যালোচনা।
ক. সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি – রতন খাসনবিশ; সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি – চিনা কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক ভাবনা (দেশকাল, ২০১৮); সারসংক্ষেপ
পুঁজিবাদ সমাজে শ্রমবিভাগের জটিলতা বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। এর ফলে বিনিময়ের বেড়েছে, এবং ধীরে ধীরে বাজার ব্যবস্থা এক সর্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বাজার ব্যবস্থা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে তৈরি হয়নি; এটি মানুষের ক্রমবর্ধমান জাগতিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠেছে। উৎপাদন বাড়াতে মানুষ শ্রমবিভাগ করেছে, আর শ্রমবিভাগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিময়ের প্রয়োজনও তীব্রতর হয়েছে। এই বিনিময় প্রক্রিয়াকেই সংগঠিত করার জন্য বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, এবং পুঁজিবাদ কেবল সেটিকে আরও সম্প্রসারিত করেছে। তবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও বাজারের সম্পর্কটা একমাত্রিক নয়। প্রাক্-পুঁজিবাদী সমাজেও বাজার ছিল, কিন্তু সরল ও সীমিত শ্রমবিভাগ থাকায় তখন উৎপাদন সরাসরি বাজার নির্ভর ছিল না। পুঁজিবাদ এসে উৎপাদনকে পুরোপুরি বাজার কেন্দ্রিক করে তুলেছে। এর ফলেই শ্রমজীবীর কর্মসংস্থান বাজারের ওঠানামার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে গেছে — বাজার মন্দায় থাকলে কাজ নেই, বাজার তেজী থাকলে কাজ আছে। কারণ উৎপাদনের উপকরণ আর শ্রমজীবীদের হাতে নেই; শ্রমশক্তিও এখন বিক্রিযোগ্য পণ্য। যখন অন্য পণ্যের বাজারে মন্দা আসে, তখন শ্রমশক্তির বাজারও সংকুচিত হয়।
কিন্তু যদি সকলকে কাজ দিতে হয়, তাহলে কেবল বাজারের গতিপ্রকৃতি দেখে উৎপাদন করলে চলবে না। তখন উৎপাদনকে গোটা সমাজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে হবে — অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থাকে বাজারের বদলে পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিচালন করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে এই পরিকল্পিত উৎপাদনের মডেলই গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু উৎপাদনের লক্ষ্য যদি কেবল নির্দিষ্ট টার্গেট পূরণ হয়, তাহলে উৎপাদন দক্ষতা নষ্ট হয়; উৎপাদন ব্যয় ক্রমশ বেড়ে যায়, এমনকি এক টাকার পণ্য তৈরি করতে খরচ পড়ে এক টাকারও বেশি। তখন উৎপাদনে বিনিয়োগ করলে উৎপাদন হ্রাস পায় আর গোটা উৎপাদন ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ে — যেমনটা ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ঠিক আগের পর্বে। বাজারে এই সমস্যা দেখা দেয় না, কারণ বাজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন দক্ষতা বজায় রাখে। বাজারে যে প্রতিষ্ঠান কম খরচে ভালো পণ্য তৈরি করতে পারে, প্রতিযোগিতায় সেই প্রতিষ্ঠানই টিকে থাকে। ফলে বাজার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যয় কমানোর পথ খুলে দেয়। কিন্তু বাজারেরও সীমাবদ্ধতা আছে — সকলকে কাজ দেওয়ার দায় তার নেই, সে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ায় এবং অর্থনীতিকে বারংবার সংকটে ফেলে। তাই সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পিত অর্থনীতি এই বাজারের বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু বিশাল পরিসরে তথ্য সংগ্রহ ও উৎপাদন দক্ষতা রক্ষা করার সমস্যায় তা টেকেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি পণ্যের উৎপাদন ও বন্টন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিল।
উৎপাদন কুশলতা বজায় রাখতে হলে পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ তথ্য (নির্দিষ্ট পণ্যের যোগান কত হতে হবে, সর্বনিম্ন কতটা নির্দিষ্ট রসদ ব্যবহার করতে হবে, সর্বনিম্ন কতজন শ্রমজীবীর নিয়োগ প্রয়োজন ইত্যাদি)। এসবই বাজারে ঠিক হয় আন্দাজে। বাজারে চলে তথ্যের আদানপ্রদান। কিন্তু এই কাজটা পরিকল্পনা দপ্তরেও করা যায়। আন্দাজের বদলে অঙ্ক কোষেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তার জন্য দরকার বিপুল পরিমাণ তথ্য। গণিত শাস্ত্রের বর্তমান অগ্রগতি এই বিপুল তথ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু তারপরেও রয়ে যায় আরেকটা সমস্যা।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর পুঁজি ও শ্রমের বাজার লোপ পেলেও শ্রমজীবীরা দশ হাজার বছরের ব্যক্তি সম্পত্তির চেতনায় আচ্ছন্ন এবং বাজার অর্থনীতির কর্মসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত থাকায় উপরের নির্দেশ মেনে কাজের মান ধরে রাখতে পারেনি। ফলে ক্রমশ উৎপাদনশীলতা কমতে থাকে। চীনে মাও ৎসে তুং এই মানসিকতা পাল্টাতে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আহ্বান জানালেও তা আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। অতএব, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ও বাজারজাত চেতনার পরিবর্তন না হলে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পিত অর্থনীতি সফল হবে না। তাই এক ধাপে ব্যক্তিগত মালিকানা বিলোপ না করে, ধাপে ধাপে যৌথ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার পরিসর বাড়ানো দরকার, যাতে ব্যক্তি মালিকানার গুরুত্ব নিজে থেকেই কমে আসে।
বাজার নিজে নিরপেক্ষ — সে উৎপাদন কুশলতা রক্ষা করে। যদি সামাজিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বাজারে উৎপাদন দক্ষতার মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে, তবে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রতিষ্ঠান আপনা থেকেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। এই জন্য বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্র ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা হবে পুঁজিবাদী বাজারের চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতাকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতির পরিচালন করা — মূলত পরোক্ষ পরিচালন কিন্তু মুদ্রা ও রাজকোষ নীতি ফলপ্রসূ না হলে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ। উদ্দেশ্য থাকবে বাজারের মাধ্যমে সামাজিক মালিকানার ক্ষেত্রগুলোর শক্তিকে বাড়ানো এবং উৎপাদন দক্ষতাকে পরিকল্পিত অর্থনীতির উপযোগী করে তোলা। এই দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্র গড়ে উঠতে পারে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি, উৎপাদন দক্ষতা এবং বাজারের মধ্যেই সামাজিক মালিকানার উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রসার — এই তিনটি স্তম্ভই হবে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের ভিত্তি। কারণ আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা দূর করে শ্রমজীবী মানুষকে সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উত্তীর্ণ করতে পারে। তবে এ পথে বিপদও আছে; ভোগবাদ বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অধঃপতন, জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন — সবই সম্ভাব্য ঝুঁকি। তবু বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে বিকল্প সমাজ গড়তে হলে এই কঠিন ও সচেতন পথেই হাঁটতে হবে।
আবেগ নয়, যুক্তি ও পরিকল্পনার মাধ্যমেই পুঁজিবাদের বিকল্প তৈরি করা সম্ভব।
[ডিলিজেন্ট-এর কমেন্টঃ উপরের আলোচনায় যেটা উঠে আসেনি তা হল বাজার অর্থনীতির বিকশিত পর্যায়ে একচেটিয়াদের জন্ম নেওয়ার অবশ্যম্ভাবিতার কথা এবং কিভাবেই বা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা কমিউনিস্ট পার্টি তার মোকাবিলা করবে। তাছাড়া, বর্তমান নয়াউদারবাদী যুগে বিশ্বায়িত বাজার ব্যবস্থায়, কম দামী টেকসই পণ্যের বিপুল সম্ভারের বদলে বেশি দামী ঠুনকো পণ্যের বারংবার উৎপাদনের চরিত্রের সাপেক্ষে বাজার ব্যবস্থার পণ্যের দাম কমিয়ে উৎপাদন কুশলতা রক্ষার তত্ত্বই বা কতটা প্রযোজ্য?]
...
খ. আগামী সমাজ গড়বার লড়াই, না বিকল্পের দিকে হাতড়ানো? – বাসুদেব নাগ চৌধুরী (নির্বাচিত অংশ); জবরদখল শারদ সংখ্যা, ২০১৩
মার্কেট সোস্যালিস্ম্: বিপ্লব পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের সময়, তথা পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উৎক্রমণের পর্বে শ্রেণীসংগ্রাম পৌঁছায় তার সর্বোচ্চ তীব্রতায়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির টানাপোড়েনই এই পর্বের বৈশিষ্ট্য। কখনও ‘এক পা আগে' (সমাজতন্ত্রের পথে), কখনও 'দুইপা পিছে' (পুঁজিবাদের দিকে)—এটাই হতে বাধ্য হয় প্রলেতারিয়েতের শ্রেণী সংগ্রামের কৌশল। সোভিয়েত ইউনিয়ন সফল “নেপ’ (নয়া অর্থনৈতিক কার্যক্রম) প্রয়োগে তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, যেখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নির্মাণের বৈষয়িক অবস্থা সৃষ্টির জন্য কিছুটা পুঁজিবাদী বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কৃষিক্ষেত্রে ও ছোটখাটো ব্যবসায়ে। লেনিনের মত ছিল যে এটাই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা রাশিয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বুনিয়াদ তৈরী করবে এবং ব্যক্তিগত পুঁজিবাদ স্থানচ্যুত হবে। "নেপ” প্রবর্তনের মাত্র একবছর পরে একাদশ পার্টি কংগ্রেসে লেনিন ঘোষণা করেন যে পিছু হঠবার পালা শেষ হয়েছে এবং আহ্বান জানান : “ব্যক্তিস্বত্বমূলক পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য তৈরী হোন।” সমাজতন্ত্র নির্মাণকারী সমস্ত দেশকেই এই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। চীন ও ভিয়েতনামেও এখন এধরনের প্রয়াস চলছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কেবল শ্রেণী বিলোপের মাধ্যমেই, তার সাথে উত্তরণের এই পর্ব যা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের তীব্র শ্রেণী দ্বন্দ্বমূলক উপাদানসমূহে ভরা, তাকে গুলিয়ে দেওয়ার সচেতন বা অচেতন লক্ষ্য নিয়েই পেটি বুর্জোয়ারা যে কথাটার প্রচার শুরু করেছে, তা হল “মার্কেট সোস্যালিসম্'। এই তত্ত্বের বিরোধী পল সুইজি বলেন, "'মার্কেট সোস্যালিসম' কথাটা স্ব-বিরোধী, মার্কেট পুঁজিবাদী সমাজের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে আর সমাজতন্ত্র একটা সমাজ হিসাবে যা অন্ধ স্বয়ংক্রিয়তার বদলে আনে সচেতন নিয়ন্ত্রণ” (“চেকোশ্লোভাকিয়া, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র")। প্রথমত, মার্কেট বা বাজার পুঁজিবাদের একমাত্র বা প্রধান কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং চাঙ্গা হওয়া আর মন্দা যাওয়ার ব্যাপক পীড়ায় সে ধুঁকতে থাকে। পুঁজিবাদের প্রধান কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হল তার রাষ্ট্র, সামাজিক শ্রমকে শোষণের ব্যবস্থা কায়েম রাখার পাশাপাশি যে বাজার নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে (যেমন জনকল্যাণকর রাষ্ট্র যা গরীব মানুষের হাতে কিছু পয়সা দেওয়ার ব্যবস্থা করে যাতে কমদামী কিন্তু প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত পণ্যের বাজার প্রসারিত হয়, অথবা তথাকথিত 'উদারনৈতিক' রাষ্ট্র যা সরকারী চাকুরেদের মাইনে বাড়ায় বিশাল সংখ্যার মানুষকে ন্যূনতম আয়ের সীমানায় পৌঁছে দিয়ে, যাতে বেশি দামের তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণে উৎপাদিত পণ্যের বাজার চাঙ্গা হয়)। দ্বিতীয়তঃ, ‘অন্ধ স্বয়ংক্রিয়তার বদলে সচেতন নিয়ন্ত্রণ' একশ শতাংশ পেটিবুর্জোয়া দর্শন। আসলে ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর বিষয়টাই কাঠামোর খোলনলচেটা বদলে ফেলার পরিবর্তে কাঠামোটাকে যতটা সম্ভব অক্ষত রাখা নিয়ন্ত্রিত করবার নামে এবং সংকট থেকে বাঁচবার সময়-সুযোগটা গুছিয়ে দেওয়ার বাসনা মাত্র (সংকট যদিও তার নিত্যসঙ্গীই থাকে) যদিও সুইজি বলছেন, "এই অন্তর্বিরোধটা (অর্থাৎ মার্কেট আর সোশ্যালিজম) মূলত সেটাই যা বাজার সমাজতান্ত্রিক সমাজগুলোকে বাধ্য করে পুঁজিবাদের দিকে যেতে”, এই কথাটাও ধোপে টিকছে না, কারণ মার্কেট আর সোস্যালিসম-এর দ্বন্দ্ব কেন কেবল পুঁজিবাদের দিকেই নিয়ে যাবে, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম-এর দিকে নয় কেন তার উত্তর মেলা ভার। তাহলে কি এ দ্বন্দ্বে সোস্যালিসম-এর পরাজয় নিশ্চিত? সেক্ষেত্রে দর্শনগতভাবে কি একথাই মানতে হবে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব কেবল পিছু হঠায়, বিকাশের অভিমুখে তার কোন ভূমিকা নেই! যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র নির্মাণকারী দেশগুলোর পতনের অভিজ্ঞতার সাথে এ বক্তব্য মেলেও এবং যদি এমনকি আগামী দিনে চীন ও ভিয়েতনামেরও এমন পতন ঘটে, তাতেও এটা একটা সাধারণ ব্যাখ্যা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না, কারণ প্যারি কমিউনের পতনের ক্ষেত্রে এর (মার্কেট ও স্যোসালিসম-এর দ্বন্দ্বের) কোন ভূমিকাই ছিল না। আসলে দ্বন্দ্বটা মার্কেট আর স্যোস্যালিসম্-এর নয়, দ্বন্দ্বটা পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক আর সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের, মালিকানার শেষ অস্তিত্বরক্ষা আর মালিকানার শেষ চিহ্নটুকুও লোপ করার সংগ্রামের, প্রকৃতি ও শ্রমের শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ক্রিয়াশীল রাষ্ট্র আর সমস্ত প্রকার শোষণের অবসানের মধ্যে দিয়ে নিজেকেও চিরতরে লুপ্ত করার প্রক্রিয়ায় থাকা রাষ্ট্রের। আর সেজন্যই সাধারণ ব্যাখ্যাটা হল উত্তরণকালে প্রলেতারিয়েতের একাধিপত্য কতটা শক্তি নিয়ে পুঁজিবাদের অবশেষগুলোকে ধবংস করতে পারছে তার ওপরই নির্ভর করছে সমাজতন্ত্রের চুড়ান্ত বিজয় - আর সেজন্যই সাধারণ ব্যাখ্যাটা হল, উত্তরণকালে প্রলেতারিয়েতের একাধিপত্য কতটা শক্তি নিয়ে পুঁজিবাদের অবশেষগুলোকে ধ্বংস করতে পারছে তার ওপরই নির্ভর করছে সমাজতন্ত্রের চুড়ান্ত বিজয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং তার সাথে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল সাম্যবাদী সমাজ গড়বার মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সমাজতন্ত্র নির্মাণের লড়াই চলছে কি না। মিখাইল লেবওটেজ সঠিকভাবেই বলেছেন, “আমাদের স্পষ্ট করা উচিৎ সমাজতন্ত্র নির্মাণের সেই ঘাটতিকে যা গুরত্ব দেয় না সংহতির ভিতের ওপর গড়া পৌরসমাজকে।" কিন্তু উৎক্রমণকালীন সংগ্রামের এই বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে যারা বাজারভিত্তিক সমাজতন্ত্রের প্রচার শুরু করেছেন, তারা বন্টনব্যবস্থা দিয়ে সমাজ বুঝতে চাইছেন। মার্স বহু পূর্বেই গোথা কর্মসূচীর সমালোচনায় (১৮৭৫) তার উত্তর দিয়েছেন— "উৎপাদন-পদ্ধতি থেকে স্বাধীনভাবে বন্টনের বিচার ও আলোচনা এবং সেহেতু, প্রধানত বন্টনের ওপরেই নির্ভরশীল বলে সমাজতন্ত্রকে দেখতে যাওয়াটা ইতর সমাজতন্ত্রীরা (এবং আবার তাদের কাছ থেকে গণতন্ত্রীদের একাংশ) বুর্জোয়া অর্থতত্ত্ববিদদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অনেকদিন আগেই যখন প্রকৃত সম্পর্কটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, তখন আবার পিছু হঠা কেন?”
আসলে বাজার হল ভিন্ন ধরনের ভোগ্যবস্তুর বিনিময় ব্যবস্থা। এই বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যবস্তুগুলি হল আখেরে প্রকৃতির থেকে পাওয়া বিভিন্ন দ্রব্যের উপর প্রযুক্ত গুণগতভাবে ভিন্ন প্রকারের শ্রমের সমন্বয়। যখন এ ধরণের ভোগ্যবস্তুর রকমফের ছিল কম, তুলনায় বিনিময়কারীদের জন্য তার পরিমাণ ছিল বেশি, তখন বিনিময়ে পরিমাণগত সমতার গুরুত্ব ছিল কম, সমানে সমানে বিনিময় হতও না। যখন ভোগ্যবস্তুর গুণগত রকমফের বাড়তে লাগল, বিনিময়কারীদের জন্য পরিমাণে তা পর্যাপ্ত নয়, তখনই বিনিময়ের ক্ষেত্রে পরিমাণগত সমতার গুরুত্ব বাড়ল সমান তালে। শ্ৰম তার দ্বৈতচরিত্র লাভ করল–গুণগত আর পরিমাণগত পণ্যের মূল্যের আকারে—যথাক্রমে ব্যবহারিক মুল্য আর বিনিময়মূল্য রূপে। এ ঘটনাটা ঘটেছিল পুঁজিবাদের বিকাশের আগেই, যখন ব্যক্তি উৎপাদক নিজেই বেচত তার পণ্য। কিন্তু পুঁজিবাদ পুরনো বাজারের রূপান্তর ঘটায়। যখন উৎপাদক নিজে একটা পণ্য তৈরী করে অন্যদের বেচে, তখন তার ব্যক্তিগত নির্দিষ্ট ধরনের শ্রম সেই পণ্য রূপে সমাজকে দেয় বিভিন্ন ক্রেতা মারফৎ; আর অন্যান্য উৎপাদনের তৈরী করা পণ্য তাদের থেকে কেনে, তখন নানা ধরনের শ্রম সমাজ থেকে পায় সেই সেই পণ্যরূপে সেই সেই বিক্রেতা মারফৎ। অর্থাৎ, বিভিন্ন ধরনের শ্রমের বিনিময় হয় পরোক্ষে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি মারফৎ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেহেতু উৎপাদনটা সামাজিক (বহু শ্রমিক মিলে একটি পণ্য তৈরী করেন) আর উৎপন্নের দখলটা ব্যক্তিস্বত্বমূলক (মালিকদের), শ্রমিক তার শ্রম সমাজকে দেয় পরোক্ষভাবে তার মালিক মারফৎ, আর ভোগ্যবস্তু সমাজ থেকে পায় ব্যাক্তি (সেই সেই পণ্য উৎপাদনের মালিক) মারফৎ পরোক্ষে। পুঁজির কেন্দ্রীভবনের সাথে সাথে, কার্টেল-সিন্ডিকেট ট্রাস্ট-রাষ্ট্রীয় মালিকানা তৈরীর সাথে সাথে এই লেনদেনটাও হয়ে ওঠে ক্রমাগত আরও সামাজিক ও প্রত্যক্ষ, মাঝে পরোক্ষরূপে থেকে যায় পুঁজিটা। এখন সমস্ত শ্রমিক মোট সামাজিক শ্রমে যে অনুপাতে তার শ্রমশক্তি দেয় (উদ্বৃত্ত শ্রম যা দেয় তার থেকে রাষ্ট্রীয় পরিষেবা রূপে কিছুটা পায়, বাকি বেশিরভাগটা পুঁজি হিসাবে আবার বিনিয়োগ, পুঁজিপতি এখন প্রায় মাইনে পাওয়া ম্যানেজার), মোট সামাজিক উৎপন্নের সেই অনুপাতে মোট পণ্য পেতে পারে। সমস্ত শ্রমিক ও মোট পণ্যের বিষয়েই এই অনুপাত তুল্যমূল্য রক্ষিত হয়, প্রতিটি আলাদা ক্ষেত্রে নয়। এটাই এই সময়ের বাজারের বৈশিষ্ট্য। একদিকে ব্যাপক হারে বেড়ে চলা পণ্যের পরিমাণ আর অন্যদিকে ততোধিক হারে বেড়ে চলা ক্রয়ক্ষমতাহীন মানুষের সংখ্যা এ বাজারকে ভরিয়ে তোলে নৈরাজ্যে।
সমাজতন্ত্রে বিষয়টার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদনের সামাজিক মালিকানা ধ্বংস করে মুনাফা লাভের ব্যবস্থা, আর তার সাথে আলাদা আলাদা ধরনের পণ্যের মধ্যে মুনাফাকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাও। “উৎপাদন-উপায়গুলির উপর সাধারণ মালিকানার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমবায়ী সমাজের মধ্যে উৎপাদকেরা তাদের উৎপন্নের বিনিময় করে না; ঠিক তেমনি, উৎপন্নে নিয়োজিত শ্রমও এখানে সেই উৎপন্নের মূল্যরূপে, তার এক বৈষয়িক গুণরূপে দেখা দেয় না, কেননা পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে এখানে ব্যক্তিগত শ্রম আর পরোক্ষ নয়, থাকছে প্রত্যক্ষভাবে সমগ্র শ্রমের অঙ্গাঙ্গী অংশরূপে”। (গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা, মার্কস, ১৮৭৫)। ফলে এখন পণ্য সমাজে নিজের দেওয়া শ্রমের অনুপাতেই কেবল পাওয়া যায়, আর লেনদেনটা হয় প্রত্যক্ষভাবে গোটা সমাজের সাথে। যেহেতু দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে তুল্যমূল্যের বিচারই চলছে, তাই এটি পণ্য ও বাজারের বৈশিষ্ট্যই বহন করছে। সমাজতন্ত্রে বাজার থাকতে পারে কেবল এই অর্থেই। স্বাভাবিকভাবেই তা আজকের পণ্যবিনিময় ও বাজারের মতো মোটেই নয়। এ বাজার সেই অর্থে নৈরাজাহীন বাজার। এই ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে সামগ্রিকতার অর্থে আবশ্যক করে তোলে। এর ফলে উৎপাদন শক্তির বৃদ্ধি হবে অব্যাহত এবং ক্রমশই পণ্য হয়ে উঠবে পরিমাণে প্রত্যেক ব্যক্তির ভোগের তুলনায় পর্যাপ্ত; বিনিময়ের ক্ষেত্রে পরিমাণগত সমতার গুরুত্ব হারিয়ে যেতে থাকবে; অর্থাৎ, পণ্য হারাতে থাকবে তার পণ্যধর্ম আর বাজার ক্ষয় পেতে পেতে অবলুপ্ত হবে। সমাজ পৌঁছাবে কমিউনিজম-এর উচ্চস্তরে। এখন "প্রত্যেকে দেবে তার সাধ্য অনুসারে, প্রত্যেকে পাবে তার প্রয়োজন মতো।”
কিন্তু সমাজতন্ত্রে বাজারের অর্থ যদি হয়, রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মেয়েরা চীনাবাদাম বিক্রী করবে, আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে মানুষ জুতো সেলাই করবে—সেই অর্থে যারা সমাজতন্ত্রে বাজারের কথা বলছেন, কমিউনিস্ট বা সোস্যালিস্ট দূরের কথা, নিজেদের প্রগতিশীল বুর্জোয়া বলার অধিকারও কি তাঁদের আছে!
...
এবার দেখে নেওয়া যাক, বাজার অর্থনীতি প্রয়োগ করে চীনের রাষ্ট্রীয় চরিত্রে কি পরিবর্তন এসেছে এবং তার প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিতে কিরকমভাবে পড়তে পারে...
গ. চীন: পূর্ণরূপে সাম্রাজ্যবাদী নাকি আধা-পরিধির অংশ? - মিনকি লি (নির্বাচিত অংশ); মান্থলি রিভিউ, ১লা জুলাই ২০২১; সারসংক্ষেপ
লিঙ্কঃ https://monthlyreview.org/2021/07/01/china-imperialism-or-semi-periphery/
পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা তিনটি কাঠামোগত স্তরে বিভক্ত: সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র, আধা-পরিধি এবং পরিধি। উদ্বৃত্ত মূল্য পরিধির উৎপাদকদের থেকে কেন্দ্রের উৎপাদকদের কাছে স্থানান্তরিত হয়। আর আধা-পরিধিতে থাকা দেশ কেন্দ্র এবং পরিধির মতো উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলির মিশ্র রূপ বহন করে। (উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, চারটি দেশ - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউনাইটেড কিংডম, ফ্রান্স এবং জার্মানি, সাম্রাজ্যবাদীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল এবং ১৮৭০ সাল থেকে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার ধনী দেশগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে অবস্থান করছিল। এই কারণে লেখক এই চারটি দেশকে একত্রিতভাবে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার ‘ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ড’ বা সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রের প্রধান সদস্য হিসেবে গণ্য করেছেন।লেখক পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্র ও আধা-পরিধির মধ্যে আনুমানিক সীমা হিসাবে ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ড’-এর ৭৫ শতাংশ মাথাপিছু জিডিপিকে ব্যবহার করেছেন আর পরিধি ও আধা-পরিধির মধ্যে আনুমানিক সীমা হিসাবে ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ড’-এর ২৫ শতাংশ মাথাপিছু জিডিপিকে ব্যবহার করেছেন।)
১৯৯০-এর দশকে চীন পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার পরিধিতে ছিল। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, চীনের ‘লেবার টার্মস অফ ট্রেড’ ছিল প্রায় ০.০৫। অর্থাৎ, বিদেশী শ্রমের এক ইউনিট চীনা শ্রমের প্রায় বিশ ইউনিটের সাথে বিনিময় করা যাচ্ছিল। কিন্তু ২০১৬-১৭-এর মধ্যে চীনের ‘লেবার টার্মস অফ ট্রেড’ প্রায় ০.৫-এ বেড়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, প্রায় দুই ইউনিট চীনা শ্রমের সাথে এক ইউনিট বিদেশী শ্রমের বিনিময় করা যাচ্ছিল। ১৯৯৭ সালে মোট মার্কিন শ্রম লাভ ছিল পাঁচশো কুড়ি লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্স এবং চীনের মোট শ্রম ক্ষতি ছিল পাঁচশো সত্তর ওয়ার্কার-ইয়ার্স। ২০১৪ সালে চীনের মোট শ্রম ক্ষতি কমে দাঁড়াল পাঁচশো আশি লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্সে এবং মোট মার্কিন শ্রমের লাভ ছিল পাঁচশো ষাট লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্স।ফলে চীন পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির দ্বারা শোষিত হলেও সাম্প্রতিককালে সেই শোষণের মাত্রা অনেকটা কমেছে। (মোট মার্কিন শ্রম লাভকে হিসেব করা হয় আমদানি করা পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্নিহিত মোট শ্রম থেকে রপ্তানি করা পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্নিহিত মোট শ্রমকে বিয়োগ করে। চীনের ক্ষেত্রে মোট শ্রম ক্ষতি গণনা করা হয় চীনের রপ্তানি করা পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্নিহিত মোট শ্রমের থেকে চীনের আমদানিকৃত পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্নিহিত মোট শ্রমকে বিয়োগ করে।)
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে চীনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উচ্চ, মধ্য ও কম আয়ের দেশগুলির সাথে প্রতিকূল লেবার টার্মস অফ ট্রেড ছিল। কিন্তু তখন থেকে আজ পর্যন্ত চীন নিজের লেবার টার্মস অফ ট্রেড উন্নত করতে সচেষ্ট থেকেছে। আর বর্তমানে চীন নিজের শোষণমূলক অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে। তাই এখন এক ইউনিট চীনের শ্রমের সাথে সাব-সাহারান আফ্রিকা কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার যথাক্রমে দুই ইউনিট ও চার ইউনিট শ্রমের বিনিময় করা যায়। যেহেতু চীনের মাথাপিছু জিডিপি ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ২৫ শতাংশের উপরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শ্রম স্থানান্তর তথ্য অনুযায়ী চীন বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের উপর শোষণমূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তাই সে এখন স্পষ্টতই পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার আধা-পরিধির সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
এখন প্রশ্ন হল, চীন পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে কি না এবং সারা বিশ্বে এর কি প্রভাব পড়বে। ঐতিহাসিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে বসবাসরত ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের দ্বারা বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের শোষণের ভিত্তিতে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তাই কেন্দ্রে প্রবেশ করতে গেলে, চীনের বিপুল জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে, বাকি বিশ্বের থেকে নিজের দিকে উদ্বৃত্ত মূল্যের স্থানান্তর এত বেশি হতে হবে যে পরিধির দ্বারা এই শর্ত পূরণ করা অসম্ভব। তাই চীন ঐতিহাসিক আধা-পরিধির দেশগুলির পদাঙ্ক অনুসরণ করে আগামী কয়েক বছরে নিজের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখলে, বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে যা একটি বড় অর্থনৈতিক সংকটের পথে এগিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে নিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে চীন আধা-পরিধির স্তরেই আটকে থাকবে। আরেকটা সম্ভাবনা হল, চীনের মাথাপিছু জিডিপি ইম্পেরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ৭৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে বিশ্বের বাকি অংশের উপর চীনের শোষণ এত ব্যাপক হয়ে উঠবে যে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা শোষিত অঞ্চলগুলিতে বিপ্লবী রূপান্তর বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতনের পথ প্রশস্ত করবে।
[ডিলিজেন্ট-এর কমেন্টঃ চীনের বিপুল জনসংখ্যা তার সাম্রাজ্যবাদী (?) নেতৃত্বের পুঁজিবাদের কেন্দ্রে প্রবেশ করার আকাঙ্ক্ষার পথে অন্তরায় হওয়ার কথা নয়। সে দেশের সাম্রাজ্যবাদী নেতৃত্ব সম্পূর্ণ জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে অন্ধকারে রেখে, একটা নব্যনির্মিত অভিজাত শ্রেণীর উপর ভর করেই নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। তাছাড়া, চীন আধা-পরিধির থেকে পুঁজিবাদের কেন্দ্রে অগ্রসর হতে থাকলে, সেই কেন্দ্রের বর্তমান সদস্যদের সাথে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। সেই যুদ্ধের ফলাফল নয়া-শক্তি-সম্পর্ক ও নয়া-শোষণ ব্যবস্থার জন্ম দেওয়ারও সম্ভাবনা বয়ে চলে…]
…………………………………
[উদ্ধৃত প্রবন্ধাংশগুলির বক্তব্য সংশ্লিষ্ট লেখকদের নিজস্ব মতামত। ‘বাজার অর্থনীতি’-র তাত্ত্বিক বিতর্ককে ত্বরান্বিত করতেই এই সংকলনের অবতারণা।]
Updated: 13.11.2025

Comments
Post a Comment