চীনের চাউমিন, আমাদের চাউমিন ???
আসল
চাইনিজ খেতে অনেকেই টেরিটি বাজার ছোটে কিন্তু সকলের মুখে রোচে না। পানসে, আঁশটে গন্ধ
ইত্যাদি অনেকেরই সহ্য হয় না। তাই অনেকের জন্য এই খাবারে এখানকার মশলাপাতি না দিলে তা
খাওয়াই যেন দায়… অর্থাৎ অঞ্চল বিশেষে একই খাবারের রন্ধন প্রণালীর পরিবর্তন ঘটে। এবার
আসা যাক আসল কথায়… অঞ্চল বিশেষে একই অর্থনৈতিক মতধারার রাজনৈতিক প্রতিফলন ঘটে ভিন্ন
ভিন্ন পথে। বিপ্লব কপি-পেস্ট করাটা যেমন কখনও কখনও বিচ্যুতি, আবার অনেক সময়ে ‘রিফর্ম’
কপি-পেস্ট করাটাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বলা ভালো, মেইনস্ট্রীম পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিভিন্ন
মোড়, বাঁক, পর্যায় অতিক্রমের চাহিদার তাগিদেই এই অ্যাডজাস্টমেন্ট বা ‘রিস্ট্রাকচারিং’।
সাম্প্রতিক সম্পন্ন হওয়া চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছরের এই পরিসরে, এবার দেখে নেওয়া যাক, ২০০১ সালে করণ থাপাড়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজ্যের তৎকালীন
বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর চীন অনুপ্রাণিত এই পলিসিগত ‘রিস্ট্রাকচারিং’ নিয়ে
কিছু কথা…
মোদ্দা কথা হল, ‘বাজার’ সমস্ত বাজারী ‘রিস্ট্রাকচারিং-এর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, শ্রমিকরা নিজেদের অধিকারের দাবীতে আর ধর্মঘট করবে না (কর্মসূচীর সংখ্যা কমিয়ে দেবে বা বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করবে), বাজার/কম্পিটিশান ইত্যাদির জন্য মালিকদের কথা শুনে কাজ করবে; বিপ্লব ঠিপ্লব গুলি মারো, নইলে চাকরি-বাকরির বারোটা বাজবে; আর শোষণ-নিপীড়ন নিয়ে ভয় কি, যা হবে তা একটু কমিয়ে ঠমিয়ে দেবে না হয় বামপন্থীরা… এর ফলাফল কি হয়েছে তা সকলের জানা… বিপ্লব করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নেওয়া চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অর্থনৈতিক এক্সপেরিমেন্ট/বিচ্যুতি/উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিস্ট্রাকচারিং (?!) নকল করতে গিয়ে (বুর্জোয়া ব্যবস্থায়, আদতে তা মিশ্র অর্থনীতি যা অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে বিপ্লবী কর্মসূচীর অভাবে ঘুরে যেতে পারে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের থেকে বেসরকারিকরণের দিকে) কেস খেয়ে লাট হল বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধ অধিকারপ্রাপ্ত একটি আঞ্চলিক বামপন্থী সরকার। কিন্তু গোদাভাবে 'রিস্ট্রাকচার'-এর পলিসিগুলো এখনও বলবত রয়েছে, বামেদের বিভিন্ন ধারার মধ্যেও তা মান্যতা লাভ করেছে। তাই আন্দোলনের দাবী সনদ কিংবা নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে প্রকাশ পায় বামেদের ডান ঝোঁক (ডান পার্টিগুলো যা আরও বলিষ্ঠভাবে বাস্তবায়নে পটু), দিশাহীনতা এবং নিজ ঘরানার নির্মাণ প্রকল্প সম্বন্ধে চিন্তাভাবনায় অনীহা।
আজ বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের সংঘর্ষের ফলে একটা নয়া-শক্তি-সম্পর্ক স্থাপনের দিকে এগোচ্ছে, তখন বাম রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই ‘বাজার অর্থনীতি’-র ডিসেকশান প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে তিনটে রচনার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হল পাঠকদের জন্য। প্রথম অধ্যায় বাজার অর্থনীতির আহ্বান সম্পর্কে, দ্বিতীয় তার সমালোচনা এবং তৃতীয়তে রইল ‘বাজার অর্থনীতি’-র আদি তীর্থ চীনের বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার মানচিত্রে অবস্থান সম্পর্কে পর্যালোচনা।
ক. সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি – রতন খাসনবিশ (নির্বাচিত অংশ); সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি – চিনা কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক ভাবনা (দেশকাল, ২০১৮)
…পুঁজিবাদ শ্রমবিভাগের জটিলতা বাড়িয়েছে। ফলতঃ বিনিময়ের প্রয়োজন বেড়েছে এবং কালক্রমে বাজার ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে সর্বব্যাপী। লক্ষণীয় এই যে বাজার ব্যবস্থা কেউ ষড়যন্ত্র করে সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়নি। মানুষ তার জাগতিক প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে মানুষ শ্রমবিভাগ আবিষ্কার করেছে। শ্রমবিভাগ যত বেড়েছে, বিনিময়ের প্রয়োজন তত বেড়েছে। এই প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে বিনিময় ঘটাবার প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এটির আরও প্রসারণ ঘটিয়েছে মাত্র। পুঁজিবাদী উৎপাদনের সঙ্গে বাজার ব্যবস্থার সম্পর্কটা অবশ্য আর একটু জটিলও বটে। প্রাক্ পুঁজিবাদী উৎপাদনের যুগেও বাজার ছিল, তবে শ্রমবিভাগ কম এবং সরল ধরণের থাকায় সব উৎপাদন বাজারের মুখ চেয়ে হত না। পুঁজিবাদ এই ক্ষেত্রে একটা ভিন্নতা এনেছে। উৎপাদন এখানে হয় বাজারের মুখ চেয়েই।
বাজারের মুখ চেয়ে উৎপাদন হয় বলে পুঁজিবাদ বাজারের ওঠানামার সঙ্গে শ্রমজীবীর কাজ পাবার বা কাজ না পাবার বিষয়টা যুক্ত হয়ে গেছে। বাজার মন্দা থাকলে শ্রমজীবী কাজ পাবে না। বাজার তেজী থাকলে শ্রমজীবী কাজ পাবে। সম্পর্কটা এতটা সরাসরি হত না যদি উৎপাদনের উপকরণগুলো শ্রমজীবীদের নিয়ন্ত্রণে থাকত। পুঁজিবাদ সেটাও নষ্ট করে দিয়েছে শ্রমজীবীদের শ্রমশক্তিকেও বাজারে কেনাবেচার ব্যবস্থা করে। শ্রমশক্তি দরকার হয় অন্য পণ্য তৈরি করতে। কাজেই অন্য পণ্যের বাজার মন্দা হলে শ্রমশক্তি কেনাবেচার বাজারে মন্দা দেখা দেবে। নিয়মটা শেষপর্যন্ত এরকমই দাঁড়িয়ে গেছে…
…তবে এটাও মানতে হবে যে সবাইকে কাজ দিতে হলে বাজার বুঝে উৎপাদন করলে চলবে না; কাজ দিতে হবে সবাইকে। এর ফলে উৎপাদন যা হবে, সেটা সমাজের লাগাতে হবে। চাহিদা নেই কাজেই উৎপাদন হবে না – এটা ঘটবে না এই সমাজে। কীভাবে সেটা সম্ভব? উত্তর হল, সেটা সম্ভব হবে সামাজিক সম্পদকে পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার করার ব্যবস্থা করে। অর্থাৎ বাজার নয়, পরিকল্পনা। শ্রমবিভাগ থাকবে, উৎপাদনে জটিলতা থাকবে। কিন্তু উৎপাদন বাজার নির্ভর হবে না। সেটা হবে পরিকল্পনা নির্ভর। সোভিয়েতে মোটের উপর এটাই করা হয়েছিল।
এভাবে পুঁজিবাদের বিকল্প দাঁড় করাতে গেলে সমস্যা কি হয়, সোভিয়েত ব্যবস্থা তার সাক্ষী। বাজার যখন উৎপাদন করায়, সে উৎপাদন হয় উৎপাদন দক্ষ। অর্থাৎ সবচেয়ে কম খরচে তৈরি হয় এই পণ্য। যদি গসপ্লানের নির্দেশে টার্গেট পূরণ করাটাই হয় উৎপাদনের তাগিদ, তবে উৎপাদন ক্রমশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে…
…উৎপাদন যদি ক্রমশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে তাহলে শেষপর্যন্ত দেখা যাবে এক টাকার পণ্য তৈরি করতে খরচ হচ্ছে এক টাকার বেশি। এই অবস্থায় উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করলে শেষপর্যন্ত উৎপাদনই কমে যাবে এবং এর ফলে উৎপাদন ব্যবস্থাটা মুখ থুবড়ে পড়বে। সোভিয়েত রাশিয়াতে শেষ দিকে ঠিক এটাই ঘটছিল। এর তাৎপর্য হল, সবাইকে কাজ দেবার মহান লক্ষ্যে গড়া ব্যবস্থাটি শেষপর্যন্ত সবাইকেই বেকার করে ছাড়বে, যদি না উৎপাদন ব্যয় কমানোর একটা ব্যবস্থা থাকে এই পরিকল্পিত অর্থনীতির মধ্যেই।
বাজার ব্যবস্থায় এই সমস্যা দেখা দেয় না। এই সমস্যা দেখা দেয় বাজার ব্যবস্থা নাকচ করে নির্দেশ চালিত অর্থনীতি গড়লে। কেন এটা ঘটে, সেটা বুঝতে হলে খোলা বাজার অর্থনীতির একটা জোরের জায়গা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বিদ্যমান প্রযুক্তিতে সবচেয়ে কম খরচে উৎপাদন সংগঠিত করার একটা নৈর্ব্যক্তিক ব্যবস্থা আছে বাজার অর্থনীতির মধ্যে। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতি ঘটিয়ে উৎপাদন ব্যয় আরো কমানো অর্থাৎ বিদ্যমান উৎপাদন উপকরণগুলিকে আরো মিতব্যয়িতার সঙ্গে ব্যবহার করার উপায় খোঁজার ব্যবস্থাও আছে বাজার অর্থনীতির মধ্যে। অর্থনীতির একটা কাজ যদি হয় সীমিত সম্পদকে সবচেয়ে কম ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করানোর ব্যবস্থা করা, সে কাজটা অতি স্বচ্ছন্দে করে ফেলে বাজার অর্থনীতি। যদি বলা হয়, অর্থনীতির দায় হল সব কর্মক্ষম শ্রমজীবীকে কাজ দেওয়া তাহলে বলতে হবে বাজার অর্থনীতি সে দায় পালন করার উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়…
…বিদ্যমান প্রযুক্তিতে যে পণ্য উৎপাদন করা হয়, সেটা যদি খোলা বাজারের নিয়ম ধরে চলে তবে পণ্যকে বাজারে এনে বিক্রি করতে হবে। যদি বাজারটা সত্যিই খোলাবাজার হয় অর্থাৎ যার ইচ্ছা সে-ই পণ্যকে তৈরি করে (করিয়ে) বাজারে আনতে পারে, তাহলে পণ্যের দাম নির্ধারিত হবে বাজারী প্রতিযোগিতার নিয়মে। বাজার তার হাতেই চলে যাবে যে পণ্যটি সবচেয়ে কম দামে বিক্রি করতে পারবে। সবচেয়ে কম দামে বিক্রি করতে পারার ক্ষমতা আসে সবচেয়ে কম খরচে আলোচ্য পণ্যটি তৈরি করা এবং বাজারজাত করার ক্ষমতা থেকে। বিদ্যমান প্রযুক্তিতে এই রসদ, কম শ্রমিক, সস্তা শ্রমিক, কম খরচে ভালো বিজ্ঞাপন, দক্ষ বিপণন ইত্যাদি নানা দিক আছে এই খরচ কমাবার যুদ্ধে জয়ী হওয়ার, যার অনেকটা ইদানিং আমরা অহরহ দেখতে পাচ্ছি। খরচ কমাবার আরেকটা উপায় হল প্রযুক্তির উন্নতি ঘটানো, যাতে বিদ্যমান প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনের তুলনায় অনেকটা কম খরচে ওই পণ্যটির চেয়ে ভালো মানের পণ্য তৈরি করা যায়…
…বাজার উৎপাদনকুশল, কিন্তু বাজার আবার উৎপাদন ব্যবস্থা পঙ্গু করার, অর্থাৎ ব্যবস্থাটি উৎপাদনকুশলতা নষ্ট করার প্রতিষ্ঠানও বটে…
…সমস্যা হল, পণ্য উৎপাদন হলেই অর্থনীতির গল্প শেষ হয়ে যায় না। পণ্য বাজারে বিক্রি হতে হয়। বিক্রি হতে হলে পণ্যের চাহিদা লাগে। উৎপাদন বাড়ালেই কি চাহিদা বাড়বে?...
…জোগান যেখান থেকে আসে সেখানে দোকানদারদের যোগানদারদের একটা বড় অংশের (শ্রমজীবী) আয় জোগানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে না - বাড়তে পারে না কারণ তাহলে উদ্বৃত্ত (মুনাফা) থাকে না, যা না থাকলে পরের বার উৎপাদন করা যায় না। ভোগ্য পণ্যের চাহিদা তাই জোগানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে না…
…সমাজতন্ত্র এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ খোঁজার চেষ্টা করেছিল বাজার ব্যবস্থার বিপরীতে একটা পরিকল্পিত অর্থ অর্থনীতির ধারণা নিয়ে এসে, যার বাস্তব রূপ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম সোভিয়েত ব্যবস্থার মধ্যে। বাজারী স্বতঃস্ফূর্ততার রাশ টানার জন্য সোভিয়েতে উৎপাদনের উপকরণ সমূহের পরিকল্পিত ব্যবহারের ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর আবশ্যিক পূর্বশর্ত ছিল বাজারী স্বতঃস্ফূর্ততার এজেন্ট যে ব্যক্তিগত পুঁজি, সেই পুঁজির (প্রায়) বিলোপসাধন করে উৎপাদনের উপকরণ সমূহের সামাজিক মালিকানা নিয়ে আসা। সামাজিক মালিকানাধীন উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিতে উৎপাদনের উপকরণ সমূহ বন্টন করা হত পরিকল্পনা মারফৎ। এর জন্য ছিল একটা বিপুল পরিকল্পনা প্রশাসন – গসপ্লান। সোভিয়েতের পরিকল্পিত অর্থনীতিতে ছিল ১২০ লক্ষেরও বেশি পণ্যের উৎপাদনের ব্যবস্থা, এই ১২০ লক্ষ পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য ছিল ৪৮০০০টি ডিভিশন বা বিভাগ। প্রতিটি বিভাগে ২৫০টি পণ্যের এক একটি জোট তৈরি করে তাদের উৎপাদন, তাদের বন্টন, তাদের প্রযুক্তি সংক্রান্ত ব্যবস্থা - সবকিছু দেখভাল করার ব্যবস্থা করতে হত। প্রশাসনটি ছিল মস্কোকেন্দ্রিক - তাদের নির্দেশে আবার প্রতিটি প্রদেশ এবং তার নীচের স্তরের প্রশাসন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনামাফিক স্বীয় ক্ষেত্রসমূহে উৎপাদন, বন্টন ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত ব্যবস্থা করত। পরিকল্পনায় যা ধরে নেওয়া হত, অর্থাৎ বাঞ্ছিত সমাধান অর্জনের পূর্বশর্ত হিসেব যা থাকত তা হল মানবসম্পদের পূর্ণ ব্যবহার, যার ব্যবহারিক তাৎপর্য হল ব্যবস্থাটিতে সব কর্মক্ষম মানুষের কাজ পাবার নিশ্চয়তা থাকবে। যদিও মজুরির তফাৎ থাকবে।
এ ব্যবস্থা টেকেনি। না টেকার অনেক কারণের মধ্যে এই আলোচনার প্রেক্ষিতে যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল ব্যবস্থাটির উৎপাদন কুশলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি…
…উৎপাদনশীলতা ক্রমাগত হ্রাস পেলে শেষ পর্যন্ত এটাই দাঁড়াবে যে এক টাকার পণ্য তৈরি করতে এক টাকার বেশি খরচ পড়বে। সোভিয়েতের এটাই দাঁড়িয়েছিল পরিস্থিতি। পেরেস্ত্রৈকা করে এ থেকে বেরিয়ে আসার একটা রাস্তা খোঁজা হয়। কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু করার আগেই নমেনক্লাতুরার একাংশ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পুঁজি লুঠ করে ব্যবস্থাটিকে পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় নিয়ে ফেলে। দেশটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির সমস্যার সমাধান করে ফেলে সোভিয়েত শ্রমজীবীদের জন্য একটা পুঁজিবাদী মজুরি ব্যবস্থা চালু করে দেয়। সমাজকল্যাণের জটিল প্রশ্নটি এভাবেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনস্থ হয়ে পড়ে…
…বিপরীত ব্যবস্থাটি টেকেনি, কাজেই এই কথাটি কি মানতে হবে যে মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে, আজকের মুক্তবাজার অর্থনীতি যে বাজারের জয়গান করে এবং অভ্যাস হিসেবে মানুষ যার দাসত্ব করে? এর উত্তর অবশ্যই নেতিবাচক। মূল কারণ দুটি। এক, উৎপাদন কুশলতার সুফল বন্টনে এর সমদৃষ্টিতার অভাব – ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বৃদ্ধিতে যার প্রমাণ থাকে। দুই, ব্যবস্থাটি টেকসই নয়। এটা অর্থনীতিকে ক্রমাগত সংকটে ফেলে। বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ্যাবিদরা এই দুই ‘ত্রুটি’ সম্পর্কে অবশ্যই সচেতন। প্রথম ত্রুটিটি মেরামত করা নিয়ে গড়ে উঠেছে কল্যাণ অর্থনীতির আলোচনার একটা বিশাল ধারা, যে ধারায় অমর্ত্য সেনের একটা উল্লেখযোগ্য অবদান আছে…
…দ্বিতীয় ত্রুটির প্রেক্ষিতে আসে সমষ্টিগত অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ভূমিকা। জন মেনার্ড কেইনস্ যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা। ইদানিং, এই বিশ্বায়িত সংকটে আবার দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠন (যথা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জি-২০)-এর গুরুত্ব বাড়ছে। মোটের ওপর কথাটা হচ্ছে, এই সব সংকট নিয়েই চলতে হবে; তবে বাড়াবাড়ি হলে নানা ধরনের ‘বেইল আউট প্যাকেজ’, ‘স্টিমুলাস’ - এসবের কথা ভাবতে হবে…
…বাজারের যে স্বতঃস্ফূর্ততা, যা থেকে আসে উৎপাদনের সংকট (যার কথা আমরা আগে আলোচনা করেছি) সেটা রোধ করে চাহিদা-যোগানে ভারসাম্য যদি সত্যিই আনতে হয় তাহলে প্রয়োজন হয় পরিকল্পিত বিনিয়োগ, যেটা করা সম্ভব হয় সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত অধিকার খর্ব করতে পারলে। সমাজতন্ত্র সেজন্যই চায় ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান (কমিউনিস্ট ইসতেহারের শেষ লাইনটি দ্রষ্টব্য)।
সোভিয়েত এবং চীনের অভিজ্ঞতা বুঝিয়েছে, এ কাজটি এক ধাপে করা যাবে না। এটা করতে হবে ধীরগতিতে, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে। কেন করা যাবে না? করা যাবে না কারণ, এভাবে অর্থনীতি গড়তে গেলে বাজারের বদলে যে বিকল্প প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করতে হয়, স্বল্প সময়ের মধ্যে তা গড়ে উঠতে পারে না। বিকল্প প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে আছে পরিকল্পিত অর্থনীতি সংক্রান্ত ব্যবস্থাগুলি, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যা থেকে আসে বিশাল চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ-এর মূল জায়গাটা হল উৎপাদন দক্ষতা আনার চ্যালেঞ্জ - বাজার যেটা স্বচ্ছন্দে করে ফেলে। সোভিয়েতের গসপ্লানের সমস্যা ছিল, ১২০ লক্ষেরও বেশি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঠিকমতো তথ্য সংগ্রহ করার সমস্যা (কতটা উৎপাদন করতে হবে, কোন রসদ কতটা লাগবে, কোন প্রযুক্তিতে খরচ সবচেয়ে কম পড়বে, ইত্যাদি)। আজকের যন্ত্রগণক প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি এই সমস্যাটা অবশ্যই কমিয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা আছে, ব্যাপকভাবেই আছে। তাছাড়া সমস্যাটা কি শুধু তথ্য সংগ্রহের সমস্যা? বাজার ব্যবস্থার উৎপাদন কুশলতা অর্জিত হয় প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে খরচ সাশ্রয়ের মধ্যে দিয়ে। সেটার কিভাবে সুরাহা হবে পরিকল্পিত অর্থনীতিতে? এর উত্তর এভাবে দেওয়া যায় যে বাজার পণ্যের দামকে আনে উৎপাদন ব্যয় (+লাভ)-এর কাছাকাছি। উৎপাদন সংক্রান্ত সব তথ্য জানা থাকলে সবচেয়ে কম উৎপাদন ব্যয় কিভাবে অর্জন করা যায়, সেটার সমাধান করা যায়…
…ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে, পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে, পুঁজির বাজার লোপ পায়। লোপ পায় শ্রমের বাজারও। কিন্তু থেকে যায় দশ হাজার বছরের পুরনো ব্যক্তি সম্পত্তির চেতনা, থেকে যায় বাজার অর্থনীতিজাত সংস্কৃতি। গসপ্লানের মত পরিকল্পনা সংস্থা যদি ওপর থেকে নির্দেশ বা হুকুম দেয় আর যার ওপর নির্দেশ দেবে সেই শ্রমজীবী যদি বাজার অর্থনীতিজাত কর্মসংস্কৃতির চেতনায় আচ্ছন্ন থাকে, তবে চাকরি যাবার ভয় নেই বলে এবং ভালো কাজে বেশি টাকা পাওয়া যায় না বলে এই নির্দেশ পালন করার আভ্যন্তরীণ তাগিদ থাকে না তার দিক থেকে। ফলে যা দাঁড়ায় তা ভয়াবহ। তথ্যে ভেজাল আসবে, কাজের মান বজায় থাকবে না এবং উৎপাদন দক্ষতা ক্রমাগত কমবে। ব্যবস্থাটি অধঃপতিত হবে।
এই সমস্যা থেকে সমাধানের উপায় কি? মাও-সে-তুঙ এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্লোগান তুলেছিলেন…
…অভিজ্ঞতা হল, সেটা আরো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ব্যবস্থাটিকে অচল করে দেবার পথে নিয়ে যায়…
…চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দশম পার্টির কংগ্রেসেই উল্টোযাত্রা শুরু হয়ে যায়, দেং-শিয়াং-পিং-এর প্রত্যাবর্তন ঘটে দশম কংগ্রেসের অব্যবহিত পরেই (১৯৭৫ সালে) এবং চীন অবশেষে পুরনো সোভিয়েত সূত্রায়ন মেনে নিয়ে উন্নততর উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে পশ্চাদপদ উৎপাদন শক্তির দ্বন্দ্বকেই প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেয়…
…বুঝে নেওয়া দরকার, উৎপাদন কুশলতা রক্ষা করা একটা পরিকল্পিত অর্থনীতির পক্ষে সম্ভব কিনা। বাজার যেটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে, পরিকল্পনা করে সেটা অর্জন করা সম্ভব কিনা, সবার আগে সে প্রশ্নটা উত্তর চাই…
…কোন পণ্য কতটা যোগাতে হবে, বিদ্যমান প্রযুক্তিতে কোন পণ্য তৈরি করতে কোন রসদ সর্বনিম্ন কতটা ব্যবহার করতে হবে, সর্বনিম্ন কত সংখ্যক শ্রমজীবী নিয়োগ করতে হবে এসব বাজার ঠিক করে আন্দাজে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে এ নিয়ে। আন্দাজের বদলে বিষয়টা অঙ্ক কষে ঠিক করে দেওয়া যায়, সে ধরনের অঙ্কশাস্ত্রে ইদানিং যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে কান্তারভিচের গোড়ার কাজটা থেকে শুরু করে। প্রয়োজন হয় পণ্য সংক্রান্ত যাবতীয় অর্থনৈতিক তথ্যের। বাজারে আসলে যা হয় তা হল তথ্য বিনিময়। এই কাজটা পরিকল্পনা দপ্তরেও হতে পারে। তথ্য যদি বিপুল হয় তাতেও সমস্যা নেই। ইদানিং যন্ত্র গণকের অবিশ্বাস্য অগ্রগতি তথ্য মজুদ সে তথ্য কাজে লাগানোর বিষয়ে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি ঘটিয়েছে…
…সোভিয়েত এটা পারেননি, চীনও এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে কারণ দশ হাজার বছরের ব্যক্তি সম্পত্তি ভিত্তিক চেতনা এবং বাজার অর্থনীতিজাত কর্মসংস্কৃতির বিপুল বাধা অতিক্রম করা নূতন ব্যবস্থার অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে সম্ভব হয়নি…
…শুরু করতে হবে তাই ব্যক্তি সম্পত্তি ভিত্তিক চেতনার অবসান ঘটানোর বাস্তব ভিত্তি তৈরি করা। এটা করার জন্য উৎপাদনের উপকরণগুলো থেকে ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটাতে হবে। সে কাজটাও এক ধাক্কায় করা যাবে না। করতে হবে ধাপে ধাপে, রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও যৌথ মালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানা রেখেই এবং এই ব্যক্তিমালিকানার গুরুত্ব ক্রমশ যাতে কমতে পারে তার বস্তুগত ভিত্তি মজবুত করে।
কিভাবে সেটা করা যাবে সেটা আলোচনা করা যেতে পারে। উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার গুরুত্ব কমার বস্তুগত ভিত্তি মজবুত হবে মালিকানার অন্য দুটি রূপের (সারের দিক থেকে যা সামাজিক মালিকানা) গুরুত্ব বৃদ্ধি হলে…
…বাজার হল পণ্য বিনিময়ের প্রতিষ্ঠান। পণ্যটি পুঁজি ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে আসছে, নাকি সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে আসছে, বাজারের তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। ইস্পাতের বাজারে স্টিল অথরিটির ইস্পাত এবং টাটা স্টিলের ইস্পাতে কোনো ভেদ নেই, যেটা সমান-গুণমান বজায় রেখে বেশি সস্তা (অর্থাৎ যে প্রতিষ্ঠানটি বেশি উৎপাদন কুশল) বাজার তার দিকেই ঝোঁকে। সামাজিক মালিকানাধীন উৎপাদন ব্যবস্থা যদি বাজারের নিয়মে বেশি উৎপাদন কুশল হয়, ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎপাদন ব্যবস্থাকে জোর করে বন্ধ করে দেবার দরকার হবে না। সেটা আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যাবে। ব্যক্তি সম্পত্তি ভিত্তিক চেতনা দুর্বল হবার বস্তুগত ভিত্তি এভাবেই গড়ে উঠতে পারে।
বাজারকে যদি চলতে দেওয়া হয় এবং ব্যবসাটিতে যদি ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে তাহলে বাজার অর্থনীতিটি কি পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতিতে পরিণত হবে না। বলা দরকার, এই ব্যবস্থাটিতে পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির উপাদান অবশ্যই থাকবে…
…এই অর্থনীতির দিশা সমাজতন্ত্রমুখী হতে হলে রাষ্ট্র এবং কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে অর্থনীতিতে। পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি যে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতায় ভোগে, প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ মারফৎ সেটাকে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। মুদ্রানীতি ও রাজকোষ (fiscal) নীতি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সরাসরি নিয়ন্ত্রণ যতটা সম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে, তবে বাজারী স্বতঃস্ফূর্ততার দরুণ অর্থনীতি বিপন্ন হয়ে পড়লে এবং মুদ্রা ও রাজকোষ নীতি যথেষ্ট ফলপ্রসূ না হলে সরাসরি নিয়ন্ত্রণও অবশ্যই করতে হবে…
…লক্ষ্য থাকবে বাজারের অস্ত্র প্রয়োগ করে সামাজিক মালিকানাধীন ক্ষেত্রগুলিকে উৎপাদন দক্ষ করে তুলে সামাজিক মালিকানাকেই উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য আনা, যাতে কালক্রমে মালিকানার রূপ হিসেবে ব্যক্তি মালিকানা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। উৎপাদন দক্ষতা যখন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হবে, তখন ধীরে ধীরে বাজার ব্যবস্থার বিপরীতে তথ্যনির্ভর একটা পরিকল্পনা ব্যবস্থা চালু করাও সম্ভব হবে। বাজার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষিত না হয়ে উৎপাদন দক্ষতা নিয়ে আসার কোন শর্টকাট পথ নেই, এই জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে এই কারণেই। এ ভাবে চলতে গিয়ে ব্যবস্থাটি অধঃপতিতও হতে পারে। কিন্তু সমাজতন্ত্র গড়ার অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এছাড়া কোনো পথও নেই…
…কিন্তু সামাজিক মালিকানার প্রসার যেহেতু বাজার ব্যবস্থার নিয়ম মেনেই করতে হবে, বাজার অর্থনীতি ভিত্তিক কর্মসংস্কৃতিও মজবুত হবে এর ফলে…
…কিভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করা যাবে? মনে রাখা দরকার সমাজতান্ত্রিক চেতনা আসলে উন্নততর সাংস্কৃতিক চেতনা…
…সে চেতনা সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উত্তরণ ঘটতে পারে পাল্টা সমাজে তার নিরাপত্তাহীনতা দূর হবার প্রাথমিক শর্ত পূরণ হলেই। নিরাপত্তাহীনতার মূল উপাদান আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা। এই নিরাপত্তাহীনতা বোধো দূর হবার বস্তুগত ভিত্তি তাই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি। যে মানুষ আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করে, সে মানুষই পারে উন্নততর সংস্কৃতিক চেতনা অর্জন করতে…
…বিপ্লব পরবর্তী সমাজে তাই জোর পড়তে হবে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করার ওপর। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, উৎপাদন বৃদ্ধির হার যাতে ধরে রাখা যায়, তার জন্য উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে হবে, বাজার ব্যবস্থার সাহায্য নিয়েই এই উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে হবে…
…সমাজের দিশা সমাজতন্ত্রমুখী করার জন্য বাজার ব্যবস্থার মধ্যেই সামাজিক মালিকানাধীন উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রসার ঘটাতে হবে একই সঙ্গে। একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এভাবেই সমাজতন্ত্র গড়ে উঠতে পারে।
প্রক্রিয়াটি অবশ্যই ঝুঁকিবহুল। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি ভোগবাদের প্রসার ঘটিয়ে সমষ্টির বদলে ব্যক্তিকেই প্রাধান্য আসতে পারে। উৎপাদন দক্ষতা অর্জনের যুদ্ধে সামাজিক মালিকানাধীন ক্ষেত্রগুলি পরাস্ত হতে পারে। রাজনৈতিক দল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমজীবী বা সর্বহারা চরিত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা দেশটির রাষ্ট্র জঙ্গী জাতীয়তাবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠতে পারে। ঝুঁকির তালিকাটি আরো লম্বা করা যায়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, সমাজতন্ত্র গড়ার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিবহুল পথটির কোনো বিকল্প নেই। স্রেফ আবেগ দিয়ে পুঁজিবাদের বিকল্প ব্যবস্থা গড়া যাবে না…
…সমস্ত প্রাক-সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে উঠছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সমাজতন্ত্রের পিছনে থাকে সচেতন প্রয়াস…
[ডিলিজেন্ট-এর কমেন্টঃ উপরের আলোচনায় যেটা উঠে আসেনি তা হল বাজার অর্থনীতির বিকশিত পর্যায়ে একচেটিয়াদের জন্ম নেওয়ার অবশ্যম্ভাবিতার কথা এবং কিভাবেই বা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা কমিউনিস্ট পার্টি তার মোকাবিলা করবে। তাছাড়া, বর্তমান নয়াউদারবাদী যুগে বিশ্বায়িত বাজার ব্যবস্থায়, কম দামী টেকসই পণ্যের বিপুল সম্ভারের বদলে বেশি দামী ঠুনকো পণ্যের বারংবার উৎপাদনের চরিত্রের সাপেক্ষে বাজার ব্যবস্থার পণ্যের দাম কমিয়ে উৎপাদন কুশলতা রক্ষার তত্ত্বই বা কতটা প্রযোজ্য? আর, সমাজতন্ত্র নির্মাণে সচেতন প্রয়াসের সাথে সাথে সামাজিক স্বতঃস্ফূর্ততাকে একেবারেই না ধরা বাজার ব্যবস্থার প্রতি একটু বেশিই আবেগতাড়িত হয়ে পড়া নয় কি?]
খ. আগামী সমাজ গড়বার লড়াই, না বিকল্পের দিকে হাতড়ানো? – বাসুদেব নাগ চৌধুরী (নির্বাচিত অংশ); জবরদখল শারদ সংখ্যা, ২০১৩
মার্কেট সোস্যালিস্ম্: বিপ্লব পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের সময়, তথা পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উৎক্রমণের পর্বে শ্রেণীসংগ্রাম পৌঁছায় তার সর্বোচ্চ তীব্রতায়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির টানাপোড়েনই এই পর্বের বৈশিষ্ট্য। কখনও ‘এক পা আগে' (সমাজতন্ত্রের পথে), কখনও 'দুইপা পিছে' (পুঁজিবাদের দিকে)—এটাই হতে বাধ্য হয় প্রলেতারিয়েতের শ্রেণী সংগ্রামের কৌশল। সোভিয়েত ইউনিয়ন সফল “নেপ’ (নয়া অর্থনৈতিক কার্যক্রম) প্রয়োগে তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, যেখানে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নির্মাণের বৈষয়িক অবস্থা সৃষ্টির জন্য কিছুটা পুঁজিবাদী বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কৃষিক্ষেত্রে ও ছোটখাটো ব্যবসায়ে। লেনিনের মত ছিল যে এটাই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা রাশিয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের বুনিয়াদ তৈরী করবে এবং ব্যক্তিগত পুঁজিবাদ স্থানচ্যুত হবে। "নেপ” প্রবর্তনের মাত্র একবছর পরে একাদশ পার্টি কংগ্রেসে লেনিন ঘোষণা করেন যে পিছু হঠবার পালা শেষ হয়েছে এবং আহ্বান জানান : “ব্যক্তিস্বত্বমূলক পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য তৈরী হোন।” সমাজতন্ত্র নির্মাণকারী সমস্ত দেশকেই এই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। চীন ও ভিয়েতনামেও এখন এধরনের প্রয়াস চলছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে কেবল শ্রেণী বিলোপের মাধ্যমেই, তার সাথে উত্তরণের এই পর্ব যা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের তীব্র শ্রেণী দ্বন্দ্বমূলক উপাদানসমূহে ভরা, তাকে গুলিয়ে দেওয়ার সচেতন বা অচেতন লক্ষ্য নিয়েই পেটি বুর্জোয়ারা যে কথাটার প্রচার শুরু করেছে, তা হল “মার্কেট সোস্যালিসম্'। এই তত্ত্বের বিরোধী পল সুইজি বলেন, "'মার্কেট সোস্যালিসম' কথাটা স্ব-বিরোধী, মার্কেট পুঁজিবাদী সমাজের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে আর সমাজতন্ত্র একটা সমাজ হিসাবে যা অন্ধ স্বয়ংক্রিয়তার বদলে আনে সচেতন নিয়ন্ত্রণ” (“চেকোশ্লোভাকিয়া, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র")। প্রথমত, মার্কেট বা বাজার পুঁজিবাদের একমাত্র বা প্রধান কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং চাঙ্গা হওয়া আর মন্দা যাওয়ার ব্যাপক পীড়ায় সে ধুঁকতে থাকে। পুঁজিবাদের প্রধান কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হল তার রাষ্ট্র, সামাজিক শ্রমকে শোষণের ব্যবস্থা কায়েম রাখার পাশাপাশি যে বাজার নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে (যেমন জনকল্যাণকর রাষ্ট্র যা গরীব মানুষের হাতে কিছু পয়সা দেওয়ার ব্যবস্থা করে যাতে কমদামী কিন্তু প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত পণ্যের বাজার প্রসারিত হয়, অথবা তথাকথিত 'উদারনৈতিক' রাষ্ট্র যা সরকারী চাকুরেদের মাইনে বাড়ায় বিশাল সংখ্যার মানুষকে ন্যূনতম আয়ের সীমানায় পৌঁছে দিয়ে, যাতে বেশি দামের তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণে উৎপাদিত পণ্যের বাজার চাঙ্গা হয়)। দ্বিতীয়তঃ, ‘অন্ধ স্বয়ংক্রিয়তার বদলে সচেতন নিয়ন্ত্রণ' একশ শতাংশ পেটিবুর্জোয়া দর্শন। আসলে ‘নিয়ন্ত্রণ’-এর বিষয়টাই কাঠামোর খোলনলচেটা বদলে ফেলার পরিবর্তে কাঠামোটাকে যতটা সম্ভব অক্ষত রাখা নিয়ন্ত্রিত করবার নামে এবং সংকট থেকে বাঁচবার সময়-সুযোগটা গুছিয়ে দেওয়ার বাসনা মাত্র (সংকট যদিও তার নিত্যসঙ্গীই থাকে) যদিও সুইজি বলছেন, "এই অন্তর্বিরোধটা (অর্থাৎ মার্কেট আর সোশ্যালিজম) মূলত সেটাই যা বাজার সমাজতান্ত্রিক সমাজগুলোকে বাধ্য করে পুঁজিবাদের দিকে যেতে”, এই কথাটাও ধোপে টিকছে না, কারণ মার্কেট আর সোস্যালিসম-এর দ্বন্দ্ব কেন কেবল পুঁজিবাদের দিকেই নিয়ে যাবে, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম-এর দিকে নয় কেন তার উত্তর মেলা ভার। তাহলে কি এ দ্বন্দ্বে সোস্যালিসম-এর পরাজয় নিশ্চিত? সেক্ষেত্রে দর্শনগতভাবে কি একথাই মানতে হবে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব কেবল পিছু হঠায়, বিকাশের অভিমুখে তার কোন ভূমিকা নেই! যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র নির্মাণকারী দেশগুলোর পতনের অভিজ্ঞতার সাথে এ বক্তব্য মেলেও এবং যদি এমনকি আগামী দিনে চীন ও ভিয়েতনামেরও এমন পতন ঘটে, তাতেও এটা একটা সাধারণ ব্যাখ্যা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না, কারণ প্যারি কমিউনের পতনের ক্ষেত্রে এর (মার্কেট ও স্যোসালিসম-এর দ্বন্দ্বের) কোন ভূমিকাই ছিল না। আসলে দ্বন্দ্বটা মার্কেট আর স্যোস্যালিসম্-এর নয়, দ্বন্দ্বটা পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক আর সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের, মালিকানার শেষ অস্তিত্বরক্ষা আর মালিকানার শেষ চিহ্নটুকুও লোপ করার সংগ্রামের, প্রকৃতি ও শ্রমের শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ক্রিয়াশীল রাষ্ট্র আর সমস্ত প্রকার শোষণের অবসানের মধ্যে দিয়ে নিজেকেও চিরতরে লুপ্ত করার প্রক্রিয়ায় থাকা রাষ্ট্রের। আর সেজন্যই সাধারণ ব্যাখ্যাটা হল উত্তরণকালে প্রলেতারিয়েতের একাধিপত্য কতটা শক্তি নিয়ে পুঁজিবাদের অবশেষগুলোকে ধবংস করতে পারছে তার ওপরই নির্ভর করছে সমাজতন্ত্রের চুড়ান্ত বিজয় - আর সেজন্যই সাধারণ ব্যাখ্যাটা হল, উত্তরণকালে প্রলেতারিয়েতের একাধিপত্য কতটা শক্তি নিয়ে পুঁজিবাদের অবশেষগুলোকে ধ্বংস করতে পারছে তার ওপরই নির্ভর করছে সমাজতন্ত্রের চুড়ান্ত বিজয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং তার সাথে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল সাম্যবাদী সমাজ গড়বার মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সমাজতন্ত্র নির্মাণের লড়াই চলছে কি না। মিখাইল লেবওটেজ সঠিকভাবেই বলেছেন, “আমাদের স্পষ্ট করা উচিৎ সমাজতন্ত্র নির্মাণের সেই ঘাটতিকে যা গুরত্ব দেয় না সংহতির ভিতের ওপর গড়া পৌরসমাজকে।" কিন্তু উৎক্রমণকালীন সংগ্রামের এই বৈশিষ্ট্যকে সামনে রেখে যারা বাজারভিত্তিক সমাজতন্ত্রের প্রচার শুরু করেছেন, তারা বন্টনব্যবস্থা দিয়ে সমাজ বুঝতে চাইছেন। মার্স বহু পূর্বেই গোথা কর্মসূচীর সমালোচনায় (১৮৭৫) তার উত্তর দিয়েছেন— "উৎপাদন-পদ্ধতি থেকে স্বাধীনভাবে বন্টনের বিচার ও আলোচনা এবং সেহেতু, প্রধানত বন্টনের ওপরেই নির্ভরশীল বলে সমাজতন্ত্রকে দেখতে যাওয়াটা ইতর সমাজতন্ত্রীরা (এবং আবার তাদের কাছ থেকে গণতন্ত্রীদের একাংশ) বুর্জোয়া অর্থতত্ত্ববিদদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অনেকদিন আগেই যখন প্রকৃত সম্পর্কটা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, তখন আবার পিছু হঠা কেন?”
আসলে বাজার হল ভিন্ন ধরনের ভোগ্যবস্তুর বিনিময় ব্যবস্থা। এই বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যবস্তুগুলি হল আখেরে প্রকৃতির থেকে পাওয়া বিভিন্ন দ্রব্যের উপর প্রযুক্ত গুণগতভাবে ভিন্ন প্রকারের শ্রমের সমন্বয়। যখন এ ধরণের ভোগ্যবস্তুর রকমফের ছিল কম, তুলনায় বিনিময়কারীদের জন্য তার পরিমাণ ছিল বেশি, তখন বিনিময়ে পরিমাণগত সমতার গুরুত্ব ছিল কম, সমানে সমানে বিনিময় হতও না। যখন ভোগ্যবস্তুর গুণগত রকমফের বাড়তে লাগল, বিনিময়কারীদের জন্য পরিমাণে তা পর্যাপ্ত নয়, তখনই বিনিময়ের ক্ষেত্রে পরিমাণগত সমতার গুরুত্ব বাড়ল সমান তালে। শ্ৰম তার দ্বৈতচরিত্র লাভ করল–গুণগত আর পরিমাণগত পণ্যের মূল্যের আকারে—যথাক্রমে ব্যবহারিক মুল্য আর বিনিময়মূল্য রূপে। এ ঘটনাটা ঘটেছিল পুঁজিবাদের বিকাশের আগেই, যখন ব্যক্তি উৎপাদক নিজেই বেচত তার পণ্য। কিন্তু পুঁজিবাদ পুরনো বাজারের রূপান্তর ঘটায়। যখন উৎপাদক নিজে একটা পণ্য তৈরী করে অন্যদের বেচে, তখন তার ব্যক্তিগত নির্দিষ্ট ধরনের শ্রম সেই পণ্য রূপে সমাজকে দেয় বিভিন্ন ক্রেতা মারফৎ; আর অন্যান্য উৎপাদনের তৈরী করা পণ্য তাদের থেকে কেনে, তখন নানা ধরনের শ্রম সমাজ থেকে পায় সেই সেই পণ্যরূপে সেই সেই বিক্রেতা মারফৎ। অর্থাৎ, বিভিন্ন ধরনের শ্রমের বিনিময় হয় পরোক্ষে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি মারফৎ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেহেতু উৎপাদনটা সামাজিক (বহু শ্রমিক মিলে একটি পণ্য তৈরী করেন) আর উৎপন্নের দখলটা ব্যক্তিস্বত্বমূলক (মালিকদের), শ্রমিক তার শ্রম সমাজকে দেয় পরোক্ষভাবে তার মালিক মারফৎ, আর ভোগ্যবস্তু সমাজ থেকে পায় ব্যাক্তি (সেই সেই পণ্য উৎপাদনের মালিক) মারফৎ পরোক্ষে। পুঁজির কেন্দ্রীভবনের সাথে সাথে, কার্টেল-সিন্ডিকেট ট্রাস্ট-রাষ্ট্রীয় মালিকানা তৈরীর সাথে সাথে এই লেনদেনটাও হয়ে ওঠে ক্রমাগত আরও সামাজিক ও প্রত্যক্ষ, মাঝে পরোক্ষরূপে থেকে যায় পুঁজিটা। এখন সমস্ত শ্রমিক মোট সামাজিক শ্রমে যে অনুপাতে তার শ্রমশক্তি দেয় (উদ্বৃত্ত শ্রম যা দেয় তার থেকে রাষ্ট্রীয় পরিষেবা রূপে কিছুটা পায়, বাকি বেশিরভাগটা পুঁজি হিসাবে আবার বিনিয়োগ, পুঁজিপতি এখন প্রায় মাইনে পাওয়া ম্যানেজার), মোট সামাজিক উৎপন্নের সেই অনুপাতে মোট পণ্য পেতে পারে। সমস্ত শ্রমিক ও মোট পণ্যের বিষয়েই এই অনুপাত তুল্যমূল্য রক্ষিত হয়, প্রতিটি আলাদা ক্ষেত্রে নয়। এটাই এই সময়ের বাজারের বৈশিষ্ট্য। একদিকে ব্যাপক হারে বেড়ে চলা পণ্যের পরিমাণ আর অন্যদিকে ততোধিক হারে বেড়ে চলা ক্রয়ক্ষমতাহীন মানুষের সংখ্যা এ বাজারকে ভরিয়ে তোলে নৈরাজ্যে।
সমাজতন্ত্রে বিষয়টার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। উৎপাদনের সামাজিক মালিকানা ধ্বংস করে মুনাফা লাভের ব্যবস্থা, আর তার সাথে আলাদা আলাদা ধরনের পণ্যের মধ্যে মুনাফাকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাও। “উৎপাদন-উপায়গুলির উপর সাধারণ মালিকানার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমবায়ী সমাজের মধ্যে উৎপাদকেরা তাদের উৎপন্নের বিনিময় করে না; ঠিক তেমনি, উৎপন্নে নিয়োজিত শ্রমও এখানে সেই উৎপন্নের মূল্যরূপে, তার এক বৈষয়িক গুণরূপে দেখা দেয় না, কেননা পুঁজিবাদী সমাজের বিপরীতে এখানে ব্যক্তিগত শ্রম আর পরোক্ষ নয়, থাকছে প্রত্যক্ষভাবে সমগ্র শ্রমের অঙ্গাঙ্গী অংশরূপে”। (গোথা কর্মসূচীর সমালোচনা, মার্কস, ১৮৭৫)। ফলে এখন পণ্য সমাজে নিজের দেওয়া শ্রমের অনুপাতেই কেবল পাওয়া যায়, আর লেনদেনটা হয় প্রত্যক্ষভাবে গোটা সমাজের সাথে। যেহেতু দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে তুল্যমূল্যের বিচারই চলছে, তাই এটি পণ্য ও বাজারের বৈশিষ্ট্যই বহন করছে। সমাজতন্ত্রে বাজার থাকতে পারে কেবল এই অর্থেই। স্বাভাবিকভাবেই তা আজকের পণ্যবিনিময় ও বাজারের মতো মোটেই নয়। এ বাজার সেই অর্থে নৈরাজাহীন বাজার। এই ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকে সামগ্রিকতার অর্থে আবশ্যক করে তোলে। এর ফলে উৎপাদন শক্তির বৃদ্ধি হবে অব্যাহত এবং ক্রমশই পণ্য হয়ে উঠবে পরিমাণে প্রত্যেক ব্যক্তির ভোগের তুলনায় পর্যাপ্ত; বিনিময়ের ক্ষেত্রে পরিমাণগত সমতার গুরুত্ব হারিয়ে যেতে থাকবে; অর্থাৎ, পণ্য হারাতে থাকবে তার পণ্যধর্ম আর বাজার ক্ষয় পেতে পেতে অবলুপ্ত হবে। সমাজ পৌঁছাবে কমিউনিজম-এর উচ্চস্তরে। এখন "প্রত্যেকে দেবে তার সাধ্য অনুসারে, প্রত্যেকে পাবে তার প্রয়োজন মতো।”
কিন্তু সমাজতন্ত্রে বাজারের অর্থ যদি হয়, রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মেয়েরা চীনাবাদাম বিক্রী করবে, আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসে মানুষ জুতো সেলাই করবে—সেই অর্থে যারা সমাজতন্ত্রে বাজারের কথা বলছেন, কমিউনিস্ট বা সোস্যালিস্ট দূরের কথা, নিজেদের প্রগতিশীল বুর্জোয়া বলার অধিকারও কি তাঁদের আছে!
গ. চীন: পূর্ণরূপে সাম্রাজ্যবাদী নাকি আধা-পরিধির অংশ? - মিনকি লি (নির্বাচিত অংশ); মান্থলি রিভিউ, ১লা জুলাই ২০২১; বঙ্গানুবাদ – ডিলিজেন্ট পত্রিকা
লিঙ্কঃ https://monthlyreview.org/2021/07/01/china-imperialism-or-semi-periphery/
…একদিকে, যদি একটি দেশ স্থানান্তরিত করার চেয়ে বাকি বিশ্বের কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে উদ্বৃত্ত মূল্য নিজে শুষে নিতে পারে, তবে সেই দেশটি পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘শোষক’ হিসেবে স্পষ্টতই একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। অন্যদিকে, যদি কোন দেশ বাকি বিশ্বের থেকে নিজের প্রাপ্ত পরিমাণের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্য স্থানান্তরিত করে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে, তাহলে সেই দেশটি আদতে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার পরিধি বা আধা-পরিধিতে থাকা সদস্য…
…তুলনামূলকভাবে, ১৯৯০-এর দশকে চীন ছিল সাধারণভাবে এই পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার পরিধিতে থাকা দেশ। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, চীনের ‘লেবার টার্মস অফ ট্রেড’ ছিল প্রায় ০.০৫। অর্থাৎ, বিদেশী শ্রমের এক ইউনিট চীনা শ্রমের প্রায় বিশ ইউনিটের সাথে বিনিময় করা যেতে পারত। তারপর থেকে, চীনের ‘লেবার টার্মস অফ ট্রেড’ ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। ২০১৬-১৭-এর মধ্যে, চীনের ‘লেবার টার্মস অফ ট্রেড’ প্রায় ০.৫-এ বেড়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, প্রায় দুই ইউনিট চীনা শ্রমের সাথে এক ইউনিট বিদেশী শ্রমের বিনিময় করা যেতে পারা যাচ্ছিল। ভারসাম্য বজায় রেখে, চীন পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির দ্বারা শোষিত একটি অর্থনীতি হিসেবে রয়ে গেছে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শোষণের মাত্রা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে…
…এটা বেশ কৌতূহল উদ্রেককারী, যে ১৯৯০ সাল থেকে চীনের মোট শ্রম ক্ষতি মোট মার্কিন শ্রম লাভের সাথে সমানভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৯০-তে মোট মার্কিন শ্রম লাভ ছিল তিনশো চল্লিশ লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্স এবং চীনের মোট শ্রম ক্ষয় ছিল তিনশো নব্বই লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্স। ১৯৯৭ সালে, মোট মার্কিন শ্রম লাভ ছিল পাঁচশো কুড়ি লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্স এবং চীনের মোট শ্রম ক্ষতি ছিল পাঁচশো সত্তর ওয়ার্কার-ইয়ার্স। ২০০৫ সালে, মোট মার্কিন শ্রম লাভ আটশো চল্লিশ লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্সে পৌঁছেছিল। ২০০৭ সালে, চীনের মোট শ্রম ক্ষতির পরিমাণ ন’শো চল্লিশ লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্সে পৌঁছেছিল। ২০১৪ সালের মধ্যে, চীনের মোট শ্রম ক্ষতি কমে গিয়েছিল পাঁচশো আশি লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্সে এবং মোট মার্কিন শ্রমের লাভ পাঁচশো ষাট লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্সে নেমে এসেছিল। তারপর থেকে, মোট মার্কিন শ্রম লাভ এবং চীনের মোট শ্রম ক্ষতির পরিবর্তনের চরিত্র আলাদা আলাদা দিকে চলে গেছে। ১৯১৭ সালে, মোট মার্কিন শ্রম লাভ ছিল ছয়’শো তিরিশ লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্স এবং চীনের মোট শ্রম ক্ষতি কমেছিল চারশো সত্তর লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্সে।
অতএব, নয়াউদারবাদী যুগে, চীনা পুঁজিবাদ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেছে, লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মূল্য সাম্রাজ্যবাদী দেশে স্থানান্তর করে। ২০০৭ সালে, সর্বোচ্চ পর্যায়, চীনের মোট শ্রম ক্ষতি ছিল চীনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেবার ফোর্সের ৪৮ শতাংশের সমান। অসমান বিনিময় যদি না থাকত, তাহলে চীনের রপ্তানি সেক্টর থেকে ন’শো চল্লিশ লক্ষ শ্রমিককে সরিয়ে নেওয়া যেত চীনের বস্তুগত ভোগের মাত্রা না কমিয়েই এবং এই অতিরিক্ত ন’শো চল্লিশ লক্ষ শ্রমিক চীনের শিল্প উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ করতে সাহায্য করতে পারতো…
…(মোট মার্কিন শ্রম লাভকে হিসেব করা হয় আমদানি করা পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্নিহিত মোট শ্রম থেকে রপ্তানি করা পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্নিহিত মোট শ্রমকে বিয়োগ করে। এইভাবে হিসেব করা মোট শ্রম লাভের মধ্যে কেবল অনুকূল ‘লেবার টার্মস অফ ট্রেড’ থেকে জাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা উপভোগ করা মোট লেবার ট্রান্সফারই থাকে না, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের "বাণিজ্য ঘাটতি"-র মধ্যে অন্তর্নিহিত শ্রমও থাকে।
চীনের জন্য, মোট শ্রম ক্ষতি গণনা করা হয় চীনের রপ্তানি করা পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্নিহিত মোট শ্রমের থেকে চীনের আমদানিকৃত পণ্য ও সেবার মধ্যে অন্তর্নিহিত মোট শ্রমকে বিয়োগ করে। এর মধ্যে কেবল চীনের প্রতিকূল থেকে ‘লেবার টার্মস অফ ট্রেড’ থেকে জাত মোট স্থানান্তরিত শ্রমই থাকে না, বরং চীনের "বাণিজ্য উদ্বৃত্ত"-এর মধ্যে অন্তর্নিহিত শ্রমও থাকে।)…
…১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে, চীন স্পষ্টতই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পরিধির একটি অংশ ছিল। চীনের শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উচ্চ আয়ের দেশ নয়, বরং কম ও মধ্য আয়ের দেশগুলির সাথেও প্রতিকূল লেবার টার্মস অফ ট্রেড ছিল। তখন থেকে, চীন প্রতিটি জোটের থেকে নিজের লেবার টার্মস অফ ট্রেড উন্নত করতে সফল হয়েছে। ২০১৫-১৭-র মধ্যে, যদিও তখনও চীনের পাঁচ ইউনিট শ্রমের সাথে এক ইউনিট মার্কিন শ্রমের বিনিময় করা যেত এবং চার ইউনিট চীনা শ্রমের সাথে অন্যান্য উচ্চ আয়ের দেশের এক ইউনিট শ্রম বিনিময় করা যেত, চীন স্পষ্টভাবে নিজের শোষণমূলক অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছিল দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকায়। এখন, এক ইউনিট চীনের শ্রমের সাথে সাব-সাহারান আফ্রিকার দুই ইউনিট কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার চার ইউনিট শ্রমের বিনিময়ে করা যায়। লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, মধ্য প্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর এক ইউনিট শ্রমের সাথে এক ইউনিট চীনা শ্রম মোটামুটি সমান। উপরন্তু, চীন অন্যান্য পূর্ব এশিয়ার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।
যদি কেউ দক্ষিণ এশিয়া, সাব-সাহারান আফ্রিকা এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পূর্ব এশিয়ার (চীন বাদে) জনসংখ্যা যোগ করে, তা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ। সুতরাং, চীন বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বিরুদ্ধে শোষণমূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় চীনকে তাই কেবল আর একটি পরিধিতে থাকা দেশ হিসেবে গণ্য করা যাবে না…
...বিশ্ব-ব্যবস্থা তত্ত্ব অনুসারে, পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা তিনটি কাঠামোগত অবস্থানে বিভক্ত: কেন্দ্র, আধা-পরিধি এবং পরিধি। কেন্দ্রে থাকা দেশগুলি আপাত-একচেটিয়া, উচ্চ-লাভজনক উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলিতে বিশেষজ্ঞ এবং পরিধিতে থাকা দেশগুলি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক, কম লাভজনক উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলিতে বিশেষজ্ঞ। উদ্বৃত্ত মূল্য পরিধির উৎপাদকদের থেকে কেন্দ্রের উৎপাদকদের কাছে স্থানান্তরিত হয়, যার ফলে বিশ্ব সম্পদের অসম বিনিময় এবং কেন্দ্রে তার পুঞ্জীভবন হতে থাকে। তুলনামূলকভাবে, আধা-পরিধিতে থাকা দেশের কেন্দ্র এবং পরিধির মতো উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলির “মিশ্রণ” থাকে…
…(লেখক এখানে একই ধরনের ধারণা ব্যবহার করেছেন। এক ডজন পশ্চিমী অর্থনীতিগুলির গড় মাথাপিছু জিডিপি গণনা করার পরিবর্তে তিনি চারটি প্রধান ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর মনোনিবেশ করেছেনঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউনাইটেড কিংডম, ফ্রান্স এবং জার্মানি। উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, চারটি দেশ সাম্রাজ্যবাদীদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল এবং ১৮৭০ সাল থেকে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার ধনী দেশগুলোর মধ্যে ধারাবাহিকভাবে অবস্থান করছিল। এই কারণে, এটা বলাই যায় যে এই চারটি দেশ একত্রিতভাবে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার ‘ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ড’।
…তাই পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্র এবং আধা-পরিধির মধ্যে আনুমানিক সীমা হিসাবে ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ড’-এর ৭৫ শতাংশকে ব্যবহার করা যুক্তিসঙ্গত।
…লেখক পরিধি এবং আধা-পরিধির মধ্যে আনুমানিক সীমা হিসাবে ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ড’-এর ২৫ শতাংশকে ব্যবহার করেছেন।) [মূল নিবন্ধ প্রথম পুরুষে লেখা]…
…১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত, বিশ্ব আয় বিভাজনের ধরণগুলি মূলত ১৮৭০ থেকে ১৯৭০ সালের মতোই অনেকটা ছিল। ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ৭৫ শতাংশের বেশি মাথাপিছু জিডিপির দেশগুলিতে বসবাসকারী জনসংখ্যার অংশ ১৩ থেকে থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করত। ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ২৫ শতাংশেরও কম মাথাপিছু জিডিপির দেশগুলির মধ্যে বাস করত জনসংখ্যার ৬৮ থেকে ৭১ শতাংশ।
যাই হোক, ১৯১৭ সালের মধ্যে, যেহেতু চীনের মাথাপিছু জিডিপি ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ৩১ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল, বিশ্ব আয় বন্টনের কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। জনসংখ্যার যে অংশ ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ২৫ শতাংশেরও কম মাথাপিছু জিডিপির দেশগুলির মধ্যে বসবাস করত, তা ৫০ শতাংশে নেমে আসে (১৮৭০ সালের পর সর্বনিম্ন)। ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ৭৫ শতাংশেরও বেশি মাথাপিছু জিডিপির দেশগুলিতে বসবাসকারী জনসংখ্যার অংশ ১২ শতাংশে সংকুচিত হয়েছে। একই সময়ে, জনসংখ্যার যে অংশ ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ মাথাপিছু জিডিপির দেশগুলিতে বসবাস করত, তারা ৩৮ শতাংশে বেড়ে যায় (ঐতিহাসিকভাবে আধা-পরিধিতে থাকা বিশ্ব জনসংখ্যার অংশের প্রায় দ্বিগুণ)।
যেহেতু চীনের মাথাপিছু জিডিপি ইম্পিরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ২৫ শতাংশের উপরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শ্রম স্থানান্তর সম্বন্ধে প্রাপ্ত তথ্য দেখাচ্ছে যে চীন বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের উপর শোষণমূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, চীন এখন স্পষ্টতই পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার একটি আধা-পরিধির দেশ হিসাবে যোগ্যতা অর্জন করেছে…
…চীন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের সব গোষ্ঠীকে রপ্তানি করা পণ্যের মধ্যে একক বৃহত্তম শ্রম সরবরাহকারী; তার রপ্তানির মধ্যে ন’শো লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্স মূর্ত থাকে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া সম্প্রতি চীনকে পেছনে ফেলে বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মোট শ্রম স্থানান্তরের সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সালে, দক্ষিণ এশিয়া সাড়ে ছয়’শো ওয়ার্কার-ইয়ার্সের মোট শ্রম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। সমস্ত নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশ মিলে ২০১৭ সালে মোট আঠেরো’শো চল্লিশ লক্ষ ওয়ার্কার-ইয়ার্সের মোট শ্রম স্থানান্তর করেছে…
…বর্তমানে উপলব্ধ তথ্যগুলি এই যুক্তিকে সমর্থন করে না যে চীন একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত হয়েছে এই অর্থে যে চীন বিশেষাধিকারযুক্ত ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত যারা বিশ্বের জনসংখ্যার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠকে শোষণ করে। সামগ্রিকভাবে, বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী শ্রম বিভাগে চীন শোষিত হিসেবে নিজের অবস্থান অব্যাহত রেখেছে এবং পরিধি থেকে প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত মূল্যের অধিক উদ্বৃত্ত মূল্য স্থানান্তর করে পুঁজিবাদের কেন্দ্রে (ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি)। যাই হোক, চীনের মাথাপিছু জিডিপি পুঁজিবাদী পরিধির আয়ের মাত্রার থেকে যথেষ্ট উপরে উঠে গেছে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম স্থানান্তর প্রবাহের ক্ষেত্রে, চীন বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের সাথে (আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ সমেত) শোষণমূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছে)। অতএব, পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় চীনকে আধা-পরিধির দেশ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আসল প্রশ্ন হল চীন পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকবে কি না এবং সারা বিশ্বে এর কি প্রভাব হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে, কেন্দ্র বা ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে বসবাসকারী ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের দ্বারা বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের শোষণের উপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বিপুল জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্ব ব্যবস্থার ধনীদের শীর্ষ স্তরে জনসংখ্যার ভাগ নাটকীয়ভাবে সম্প্রসারিত না করে চীনের পুঁজিবাদী কেন্দ্রের দেশে পরিণত হওয়ার কোনও উপায় নেই। বাকি বিশ্বের কাছে দাবী রাখা শ্রম নিষ্কাশন (বা উদ্বৃত্ত মূল্যের স্থানান্তর) এত বড় হতে হবে যে জনসংখ্যার আকারে হ্রাস পাওয়া অবশিষ্ট পরিধির দ্বারা এই শর্ত পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তদুপরি, চীনের আশান্বিত কেন্দ্রে অবস্থানের সাথে সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় জ্বালানি সম্পদ (বিশেষত তেল)-এর চাহিদা ভবিষ্যতে বিশ্ব তৈল উত্পাদন বৃদ্ধি বা অর্জনযোগ্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তন বাস্তবিকভাবে পূরণ করতে পারবে না। অসম্ভব হলেও চীন যদি পুঁজিবাদী কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হয়, সংশ্লিষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বিশ্বের অবশিষ্ট নির্গমন বাজেটের দ্রুত অবসানে অবদান রাখবে, যা বিশ্ব উষ্ণায়নকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস কম করা অসম্ভব করে তুলবে।
ভবিষ্যতে বেশ কিছু দৃশ্যপট তৈরি হতে পারে। প্রথমত, চীন ঐতিহাসিক আধা-পরিধির দেশগুলির পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারে। আগামী কয়েক বছরে চীনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে, এই বৃদ্ধি প্রক্রিয়া বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে (সম্ভবত ১৯৭০ এবং ’৮০-এর দশকের পূর্ব ইউরোপীয় এবং ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলির মতো) এবং চীনের দ্রুত বৃদ্ধি একটি বড় অর্থনৈতিক সংকটের পথ অনুসরণ করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দ্বারা শেষ হয়ে যাবে। যদি এই ধরনের দৃশ্যপট দেখা দেয়, তাহলে চীন তখন পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার গতিবিধি ঐতিহাসিক নিয়মের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আধা-পরিধির স্তরে আটকে থাকবে।
দ্বিতীয় সম্ভাব্য দৃশ্য হল, চীন অধিকাংশ আধা-পরিধির দেশগুলির ঐতিহাসিক পরিসীমা অতিক্রম করে বিশ্ব আয়ের ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগে এগিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের মাথাপিছু জিডিপি ইম্পেরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডের ৫০ শতাংশের উপরে উঠতে পারে এবং ৭৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে যেতে শুরু করে। যদি এই ধরনের দৃশ্যপট বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বিশ্বের বাকি অংশের থেকে চীনের শ্রম এবং শক্তি সম্পদের শোষণ এত ব্যাপক হয়ে উঠতে পারে যে চীনের শোষণ আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার অংশগুলির মতো পুঁজিবাদী পরিধি অঞ্চলে অসহনীয় বোঝা চাপিয়ে দেবে। ফলস্বরূপ, সাধারণ অস্থিতিশীলতা এই অঞ্চলগুলিতে শুরু হবে যা বিপ্লবী রূপান্তর বা এই ব্যবস্থার সাধারণ পতনের পথ প্রশস্ত করতে পারে। যাই হোক, চীনের ব্যাপক শক্তির চাহিদা অন্যান্য প্রধান জ্বালানি আমদানিকারকদের সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণ হতে পারে, যা ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে তুলতে পারে; চীনের অর্থনীতি নিজেই সম্ভবত এই ধরনের অস্থিতিশীলতার (উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরবে বিপ্লব) কাছে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
[ডিলিজেন্ট-এর কমেন্টঃ চীনের জনসংখ্যা তার সাম্রাজ্যবাদী (?) নেতৃত্বের পুঁজিবাদের কেন্দ্রে প্রবেশ করার আকাঙ্ক্ষার পথে অন্তরায় হওয়ার কথা নয়। সে দেশের সাম্রাজ্যবাদী নেতৃত্ব সম্পূর্ণ জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে অন্ধকারে রেখে, একটা নব্যনির্মিত অভিজাত শ্রেণীর উপর ভর করেই নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। তাছাড়া, চীন আধা-পরিধির থেকে পুঁজিবাদের কেন্দ্রে অগ্রসর হতে থাকলে, সেই কেন্দ্রের বর্তমান সদস্যদের সাথে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। সেই যুদ্ধের ফলাফল নয়া-শক্তি-সম্পর্ক ও নয়া-শোষণ ব্যবস্থার জন্ম দেওয়ারও সম্ভাবনা বয়ে চলে…]
…………………………………
[উদ্ধৃত প্রবন্ধাংশগুলির বক্তব্য সংশ্লিষ্ট লেখকদের নিজস্ব মতামত। ‘বাজার অর্থনীতি’-র তাত্ত্বিক বিতর্ককে ত্বরান্বিত করতেই এই সংকলনের অবতারণা।]
Comments
Post a Comment