ভারতীয় উপমহাদেশে বিপ্লব প্রচেষ্টায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ইতিহাস
সুমিত গাঙ্গুলি
(সুমিত গাঙ্গুলি প্রাক্তন ছাত্র-যুব আন্দোলনের কর্মী এবং ক্রিকেট ইতিহসবিদ।)
[নিম্নোক্ত প্রবন্ধে উত্থাপিত মতামত লেখকের নিজস্ব। এই রচনা ২০১৭ সালের। ফলে বর্তমান প্রেক্ষাপটের নিরিখে কিছু পরিবর্তন ও সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা আছে। পাঠকদের কাছে আমাদের অনুরোধ, কোনো রাজনৈতিক দল বা গ্রুপের সম্পর্কে তথ্যে ঘাটতি থাকলে আমাদের অবশ্যই জানান। প্রবন্ধ সেই অনুযায়ী আপডেট করা হবে। ]
আজকের এই পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী–নয়াউদারবাদী
দুনিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মেহনতি মানুষের স্বার্থে
লড়াই চলছে। এই লড়াই-এর মূল চালিকাশক্তি হল মেহনতি মানুষের একমাত্র হাতিয়ার মার্কসবাদ–লেনিনবাদের ভিত্তিতে গঠিত দলগুলি। কিন্তু বিভিন্ন
মতাদর্শগত (১) সমস্যার কারনে পৃথিবীর সর্বত্রই তা নানান সমস্যার মধ্যে পড়েছে। তাই প্রয়োজন
রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে এবং ভারতীয়
উপমহাদেশে যে সমস্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চ ও দলগুলি কাজ করছে তাদের
মতাদর্শ, উৎস ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে এই
প্রবন্ধ লেখা। জানিনা কতদূর সমগ্র বিষয়টিকে ছোঁয়া যাবে।
সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটা কথা বলা। এই সামগ্রিক সময়ে সারা পৃথিবীতে মার্কসবাদ
ও লেনিনবাদের ধারাগুলিকে চিহ্নিত করা দরকার, না হলে আলোচনা করতে সমস্যা হবে।
[১] মার্কসবাদী- লেনিনবাদী
ধারা যা পৃথিবীর প্রতিটি কমিউনিস্ট ও লেবারপার্টিগুলির প্রধান ধারা। মূলতঃ মার্কসবাদ ও
লেনিনবাদের পথ ধরে প্রতিটি দেশে এই দলগুলি এগোনোর চেষ্টা করেছে।
[২] মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-মাওবাদী
ধারা। মূলতঃ চীন বিপ্লবের মহান নেতা মাও-ৎসে-তুং-এর লাইনেই দলগুলি লড়াই করে। এই দলগুলি নিজেদের
মতাদর্শে মার্কস-এঙ্গেলস–লেনিনের পর মাওকেই প্রধান তাত্ত্বিক বলে মনে
করে। আবার একটা বড় অংশ মাওবাদ তকমা ব্যবহার করা ভুল মনে করে ও একে অতিবাম বিচ্যুতি বলে মনে করে।
[৩] ট্রটস্কিপন্থী ধারা। এরা স্তালিনবিরোধী,
ফলতঃ মাওবাদের বিরোধী, নিরবিচ্ছিন্ন বিপ্লবের
পক্ষে। বিশ্ববিপ্লবের পক্ষে নিজেদের মত ব্যাক্ত করে থাকে।
[৪] অন্যান্য ধারা। এর মধ্যে পড়ে লেনিন বিরোধী শুধু
মার্কসবাদী, স্তালিনের মতের অনুসারী বেশকিছু রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক
সমাজবাদী, নৈরাজ্যবাদী, আধা-ট্রটস্কিপন্থী, সোশ্যালিস্ট প্রভৃতি অসংখ্য ধারা আছে।
এই প্রবন্ধের প্রথমাংশে আমরা দেখব যে, এইমতগুলির কি কি আন্তর্জাতিক মঞ্চ
আছে এবং তাদের সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব।
প্রথমেই বলি, কার্যকলাপের দিক থেকে না হলেও সংগঠন তৈরি ও ভেঙ্গে যাওয়ার
দিক থেকে সব থেকে বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারা হলো ‘ট্রটস্কিপন্থী’। তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিন্টার্ন
তুলে দিয়ে কমরেড জোশেফ স্তালিন বলেছিলেন যে এবার আর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে কেউ
বিদেশীদের দালাল বলতে পারবে না। কিন্তু কমিন্টার্ন তুলে দেওয়ার
বিরোধীতা করেন ট্রটস্কি। তিনি ১৯২০-এর দশক থেকেই লেনিনের সঙ্গে ছিলেন (২),
যদিও বহুক্ষেত্রেই লেনিন ট্রটস্কির সমালোচনা করেন (৩)। পরবর্তীতে তাঁকে
বলশেভিক পার্টি এবং কমিন্টার্ন থেকে বিতাড়িত করা হয় (৪)। এতদসত্ত্বেও স্তালিনের
সমান্তরাল পথে ট্রটস্কি সারা পৃথিবীর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের একাংশকে
একত্রিত করে একটি মঞ্চ তৈরি করেন, তার নাম দেন ‘চতুর্থ
আন্তর্জাতিক’। পরবর্তীতে সারা পৃথিবীতে ‘চতুর্থ আন্তর্জাতিক’ বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। এমনকি ট্রটস্কিপন্থীরা অর্থোডক্স ও
আনর্থডক্স-এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় (৫, ৬)। প্রায় এক ডজনের বেশী
ট্রটস্কিপন্থী আন্তর্জাতিক মঞ্চ আছে। তার বিবরন দেওয়া হলঃ
১. কমিটি ফর দ্য ওয়ার্কার ইন্টারন্যাশনাল:
মোট ৪৫টি দেশ থেকে এখানে প্রতিনিধিত্ব আছে। ১৯৭৪ সালে এই মঞ্চ তৈরি
হয়। সব
দেশ সার্বভৌম নয়। যেমন আয়ারল্যান্ডে (‘রিপাবলিক অফ
আয়ারল্যান্ড’ এবং ‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড’), দুটি দেশের জন্য
একই দল। আবার একই দেশে দুটি দলও আছে, যেমন কানাডা ও কুইবেকের জন্য আলাদা আলাদা
দল ছিল। ভারত থেকে আছে Neo-Socialist Alternative এবং কাশ্মীরের
জন্য CWI-Kashmir [Committee for a Worker’s International-Kashmir] (এই দলটির
ভারতে সদস্য সংখ্যা ১!)।
২. কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর দ্য ফোর্থ
ইন্টারন্যাশনাল:
পুরোদস্তুর স্তালিন বিরোধী। ভারতের প্রতিনিধিহীন এই মঞ্চ ২০০৪ সালে
বুয়েনস-এয়ার্স শহরে তৈরি হয়।
৩. ফোর্থ ইন্টারন্যাশনাল (La-Verite পত্রিকা গোষ্ঠী):
১৯৭২ সালে
Organizing committee for the Re-Construction of the Fourth International নাহুয়েল মোরেনের লাইন থেকে তৈরি হয় কিন্তু ১৯৯৩ সালে অর্থোডক্স
ট্রটস্কিপন্থী ধারা থেকে বেরিয়ে এসে মাইকেল পাবলো ও আর্নেস্ট ম্যান্ডেলের নেতৃত্বে
কিছু লোক তৈরি করেন FI La-Verite)। কলকাতা ও মুম্বইতে
Indian Supporter of FI নামে
কিছু লোক কাজ করেন। ৪৪টি দেশে সংগঠন আছে।
৪. International
Communist League (Fourth International):
ভারতের প্রতিনিধিহীন ১৩টি দেশের মঞ্চ। ১৯৬৪ সালে ‘স্পার্টাকাসিস্ট’ নামে
জার্মানীর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কমিন্টার্নের নেতৃত্ব রোজা লুক্সেম্বার্গ ও
কার্ল লাইবনেখটের লাইনে চলে এই মঞ্চ।
৫. ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার্স লিগ:
নাহুয়েল মোরেমের কিছু সমর্থক আমেরিকান সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি
ভেঙ্গে বের হন ১৯৬৩ সালে। তৈরি করেন ICFI [International Committee of Fourth International]। ১৯৬৯ সালে তৈরি হয় United Secretariat of Fourth International
(USFI)। লাতিন আমেরিকার গেরিলা যুদ্ধ তাঁরা সমর্থন করলেও মোরেনের
কিছু গ্রুপ এদের বিরোধিতা শুরু করে। মোরেনের গ্রুপগুলি
সমালোচনা করলেও সাইমন বলিভারের দলকে সমর্থন করে। নিকারাগুয়াতে সাহায্য
পাঠায়। যাই হোক, মোরেনের মৃত্যুর পর তৈরি হয় International Centre of Orthodox Trotskyism (স্প্যানিশে ITO)। পরে ২০০৫ সালে তৈরি হয় IWU
[International Worker’s Unity]। কিন্তু কিছু অংশ অবশ্য তৈরি করে ISL [International Socialist
League]। ২৬টি দেশে সংগঠন থাকলেও ভারতে অস্তিত্ব নেই।
৬. International
Workers’ Unity (Fourth International):
লাতিন আমেরিকা,
পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি জায়গায় ১৯৯৫ সালে তৈরি হয় এই সংগঠনটি। এরা মোরেনবাদী আরেকটি
আন্তর্জাতিক মঞ্চ যারা মাত্র ৪টি দেশে আছে। International League for Reconsolidation of Fourth
International বর্তমানে IWU (FI)-তে যোগ দিয়েছে।
৭. International
Workers’ League (Fourth International) [IWL (FI)]:
এর ভিতরেই তৈরি হয়েছিল International Bolshevik Fraction, যারা বর্তমানে ট্রটস্কাইট
ফ্রাকশনের একটি গ্রুপ বানিয়েছে। ভারতে এদেরও অস্তিত্ব নেই।
৮. International Committee of
Fourth International:
পাবলো ও ম্যান্ডেলের সমর্থকেরা International Secretariat of Fourth International-এর মতাবলম্বনে এই সংগঠনটি তৈরি করেন। এতে ১১টি দেশের প্রতিনিধি আছে। ভারতে ‘সোশ্যালিস্ট
লেবার লীগ’ নামে একটি ছোট ট্রটস্কিপন্থী দল এদের সাথে যুক্ত।
৯. ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট টেন্ডেন্সি:
এই আন-অর্থোডক্স ট্রটস্কাইট গোষ্ঠী ২৯টি দেশের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত
কিন্তু পরে ৩টি দল এই মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেছে।
১০. International Marxist:
টেড গ্রান্ট-এর তৈরি দল। ৩০ টি দেশের প্রতিনিধি আছে।
১১. Third Camp:
সমান্তরালভাবে সংগঠন করা এই মঞ্চটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই
চলছে। ‘কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি’ একদা
এদের ক্যাম্পে ছিল।
১২. Fourth International (Re-Unionist):
২৯টি সদস্য নিয়ে গঠিত এই সংগঠন। এছাড়া ১২টি অবজারভার সংগঠন আছে। ভারতের
‘র্যাডিকাল সোশ্যালিস্ট’ সংগঠন স্থায়ী অবজারভার। এছাড়া এদের সহমর্মী কিছু দল আছে।
মোট ২৯টি মঞ্চ এখন আর কাজ করে না। ১৮টা এখনও আছে। তিনটি আন্তর্জাতিক
গ্রুপও আছেঃ
ক. Alliance
for World Liberty (Third
camp-এ আছে)
খ. Freedom Socialist
Party
গ. Movemento
আর আছে ‘মিলিট্যান্ট’ নামে একটি
পত্রিকা এবং তাদের অনুগামী যারা কোনোভাবেই নিজেদের প্রকাশ্য দল তৈরি করে না। গোপনে
বুর্জোয়া, পেতি-বুর্জোয়া, বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপ ও দলে থেকে ট্রটস্কির মত প্রচার
করে। পাকিস্তানে Pakistan People’s Party দলের মধ্যে, ভারতে CPI (M), CPI (ML)
Liberation, RSP [Revolutionary Socialist Party] এবং ছোটো ট্রটস্কিপন্থী দল ‘কমিউনিস্ট
লীগ’-এর ভেতরে ঢুকে এরা কাজ করে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু
নয়া-ট্রটস্কিপন্থী বা আধা-ট্রটস্কিপন্থী দল আছে।
ট্রটস্কিপন্থী দলগুলির পর আসা যাক মাওবাদী দলগুলির দিকে। তারাও আলাদা
আন্তর্জাতিক মঞ্চ গঠন করেছে। মনে রাখতে হবে, প্রায় সমস্ত ট্রটস্কিপন্থী দলগুলি
নিজেদের দেশের শ্রেণী-চরিত্রকে পুঁজিবাদী ধরে নিয়ে 'সমাজতান্ত্রিক' বিপ্লবের ডাক দিয়েছে; সেখানে
প্রায় সমস্ত মাওপন্থী দলগুলি রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্র 'আধা-সামন্ততান্ত্রিক', 'আধা-ঔপনিবেশিক' ধরে নিয়ে 'নয়াগণতান্ত্রিক' বিপ্লবের ডাক দিয়েছে। কিছু
ইউরোপিয়ান দেশেও 'মাওবাদী' দল আছে (এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও)। তারা অবশ্য তাদের
দেশকে 'পুঁজিবাদী' বলেই মনে করে, যদিও তারাও
মুক্তাঞ্চল তৈরি করতে চায়।
যাই হোক, মূলত তিনটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ আছে মাওবাদী পার্টিগুলির। সেগুলি
একে একে আলোচনা করা যাক।
১. Revolutionary International Movement [RIM]:
মোট ১৮টি দেশে ছড়ানো সদস্যদের মধ্যে Maoist Communist Party
(Turkey) ও Communist
Party of Peru (Shining Path) নিজেদের দেশে সশস্ত্র
সংগ্রামে ব্যস্ত। এছাড়া ভারতের প্রতিনিধি Communist Party of India
(Maoist)
এবং Communist Party of Philippines নিজেদের দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম চালাচ্ছে, যাকে RIM পূর্ণ সমর্থন করে।
২. International Confederation of Maoist-Leninist Parties and Organization
(International News Letter):
একই নামে আরো একটি সংগঠন আছে, তবে তারা ‘Hoxa’পন্থী (অ্যালবেনিয়ার এনভার
হোজা বা আনোয়ার খাজা)। যাই হোক, ১৯টি দল ও ২টি দেশীয় গ্রুপ নিয়ে এই মঞ্চ তৈরি হয়।
ভারত থেকে CPI (জনশক্তি), CPI (নিউ ডেমোক্রেসি) ছিল। বর্তমানে যদিও জনশক্তি ও নিউ
ডেমোক্রেসি নেই (কেন নেই তা পরে দেখা যাবে)। তার বদলে COC
[Central Organizational Committee], CPI (ML) দল রয়েছে আর তার সাথে আছে RCPI
[Revolutionary Communist Party of India]।
৩. Co-ordination Committee of Maoist Parties of South Asia [COMPOSA]:
বাংলাদেশের ৫টি, ভুটানের ১টি, নেপালের ১টি, শ্রীলঙ্কার ১টি দল নিয়ে এই
সংগঠনটি তৈরি হয়। ভারতের ৫টি দলের মধ্যে দুটি দল মিশে CPI (মাওবাদী) তৈরি করে
(৬ক)। মায়ানমার থেকেও পার্টি ছিল। এদের বৈশিষ্ট্য হল, নিজেদের দেশে প্রত্যেকটি সংগঠনই
নিষিদ্ধ।
৪. International Committee of Revolutionary Party and Organization
(ICOR):
এই মূহুর্তে এটাই পৃথিবীর সবথেকে বড় 'মাওপন্থী' সংগঠন, যদিও প্রভাব সর্বত্র সমান
নয়। তবুও ৪০টি দেশে তাদের প্রতিনিধি আছে। ভারত থেকে CPI (ML) Red Star ও PCC CPI (ML) নামে দুটি দল এদের সদস্য।
যারা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের
সদস্য ছিল এবং এখনো দেশে দেশে সংসদীয় ও অসংসদীয় কোনো পথকেই ছাড়েনি, তাদের অন্যতম
বড় মঞ্চ হল International Meeting of Communist and Workers’ Party [IMCWP]। ১৯৯৮-৯৯ থেকে লাগাতার
১৮বছর ধরে ৪৬টি দেশের ৫৯টি পার্টি নিয়ে তৈরি এই মঞ্চ সারা পৃথিবীতে লড়াইতে ব্যস্ত।
মূলত আইনি পার্টিগুলি নিয়ে এই মঞ্চ। ভারত থেকে CPI (M), CPI আছে। যে সকল দেশে সরকারে
(সংসদীয় গণতন্ত্রে) কমিউনিস্ট পার্টিগুলি আছে, তারাও এই সংগঠনে আছে। বহু
ট্রটস্কিপন্থী দল এদের ‘স্তালিনবাদী’ আর মাওবাদীরা এদের ‘শোধনবাদী’ বলে সমালোচনা
করে।
অন্যান্য ধারাগুলিকে নিয়ে এবার আলোচনার সময় এসেছে। ১৯৩৮ সালে চতুর্থ
আন্তর্জাতিক তৈরি হওয়ার পরই (২ মাসের
মধ্যে) বিভাজন ঘটে। ৭ জন সদস্য নিয়ে তৈরি Workers' Party of Marxist Unity গ্রুপ যার নেতৃত্বদান করেছিলেন
ট্রটস্কিপন্থী দুটি পার্টি Communist Left of Spain এবং Workers and
Peasant Bloc, তারা
হঠাৎই ট্রটস্কির বিরোধিতা শুরু করে। Workers and Peasant Bloc-কে সমর্থন করত আবার
বুখারিন, রিয়ভ
এবং ট্রটস্কিপন্থীদের Right Opposition (৭)। যাই হোক, ১৯৪১ সালে আর্জেন্টিনীয়
নেতা লিবোরি গুজাস্তো পঞ্চম আন্তর্জাতিকের ডাক দেন। ১৯৪৬ সালে লিও লাব্রুসে
‘স্পারটাসিস্ট লীগ’ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘পঞ্চম আন্তর্জাতিক’-এর ডাক দেন। মাঝে
৬০-৭০-এর দশকে ‘Communist Party of Cuba’-ও প্রবল আগ্রহী ছিল কিন্তু বাকিদের
(মূলতঃ Communist Party of Soviet Union-এর) প্রবল বিরোধিতায় তারা এগোয়নি। ১৯৯৪ সালে এবং ২০০৩ সালে 'পঞ্চম আন্তর্জাতিক'-এর ডাক ওঠে এবং সংগঠন
তৈরি করার চেষ্টা করা হয়। অবশেষে ১১টি আধা-ট্রটস্কিপন্থী দল নিয়ে 'পঞ্চম-আন্তর্জাতিক' তৈরি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য
বেশকিছু কল্পবিজ্ঞান কাহিনীতে L-5I বা পঞ্চম আন্তর্জাতিকের কল্পনা
করা হয়েছে! আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হল ‘Confederation of Marxist-Leninist
Party and Organisation (Unity and Struggle)’। ১৭টি দেশে আছে তাদের সংগঠন। ২টি
দেশের সদস্যদের এর আগে বহিষ্কার করা হয়েছে। ২টি দল নিজেরা বেরিয়ে গেছে, ৩টি দলের অস্তিত্ব নেই।
ভারতে এদের প্রতিনিধি হল ‘কমিউনিস্ট গদর পার্টি অফ ইন্ডিয়া’। এরা মূলত আলবেনীয়
কমিউনিস্ট নেতা এনভার হোজার লাইনে বিশ্বাসী, যিনি মাও-এর মৃত্যুর পর তাঁর তিন
বিশ্বের ধারনাকে সমালোচনা করেন, যার ফলে 'চীন-আলবেনীয় বিচ্ছেদ' (Sino-Albanian Split) ঘটে। কমরেড স্তালিনের
নীতিতে চললেও একটা বড় অংশের দলগুলিকে শোধনবাদী আখ্যা দেন তিনি। তবে মার্কসীয়-লেনিনীয়
শাখার সবথেকে বড় শোধনবাদ বিরোধী প্রচারক ছিলেন হোজা। আরো একটি গ্রুপ আছে Initiative of Communist and Workers’ Parties নামে। ইউরোপের
দলগুলিকে নিয়ে গঠিত এই মঞ্চ। এছাড়াও একটি ক্ষুদ্র গ্রুপ মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়েছিল যারা কেবল মার্কসের নীতিতে বিশ্বাসী ছিল এবং তারা
লেনিনবাদ বর্জন করেছিল। ১৯৯৫তে তৈরি হয়।
ভারতে লাল পতাকা গ্রুপ,
Workers and Socialist Party তাদের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়া ৯৫টি দেশের ১২৪টি দল ও
১০০টি গ্রুপ নিয়ে রয়েছে ‘প্রোগ্রেসিভ
এলায়েন্স’। এখানে ভারত থেকে ‘এসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট’ ও ‘জাতীয় কংগ্রেস’
দল আছে এবং ‘সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’
মঞ্চে ৯১টি দেশের ১০১টি দল আছে। এখানেও ভারত থেকে আছে ‘জাতীয় কংগ্রেস’।
ভারতে Socialist Unity Centre of India (Communist) [SUCI(C)] পার্টিও একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ গঠনে প্রয়াসী হয় এবং ২০০৮ সালে বেইরুটে International Forum For Resistance, Anti-imperialism, Solidarity between People and Alternative নামে একটি সম্মেলন হয়। এটা লন্ডনের Stop-War Campaign, লেবাননের National Gathering to Support the Choice of Resistance, কায়রো কনফারেন্স অর্থাৎ International Campaign against American and Zionist Occupation, বেইরুটের Consultative Centre for Studies and Document এবং কলকাতার India Conference-এর মিলিত প্রয়াস ছিল। ভারতের SUCI(C)-এর সাথে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে চলা পার্টিটা হল All Union Communist Party of Bolsheviks যা ১৯৯১ তৈরি হয়। নেত্রী কিনা আন্দ্রেয়িভা। CPRF [Communist Party of Russian Federation]-এর সাথে তাদের মত বিরোধের মূল কারন হল CPRF-এর তথাকথিত “শোধনবাদী” চরিত্র।
বেলজিয়ামের ওয়ার্কার্স পার্টি প্রতি বছর মে মাসের ২-৪ তারিখ ব্রাসেলসে
আয়োজন করে International Communist Seminar (ICS)। ১৯৯২ সালে তারা কাজ শুরু
করে। ১৯৯৫-এর
সম্মেলনে তারা আলোচনা করে সোভিয়েত ইউনিয়নে কেন পুঁজিবাদ ফিরে এলো। ৪৫টি দেশের ৫৪টি
পার্টি এতে আছে। ভারত থেকে এখানে প্রতিনিধি কেউ নেই কিন্তু
আফগানিস্তান, চীন, লাওস, লাতভিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনাম থেকে আছে। এছাড়াও World Socialist Movement, Sao Paolo Forum, International of Anarchist Federation, International Workers’ Association (Anarchist Communist) প্রভৃতি গ্রুপগুলিতে বিভিন্ন বামপন্থী দল আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার
পর কিছু পূর্বতন সোভিয়েত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া দেশগুলি ১৯৯৩ সালে গঠন করে Union of Communist Parties-CPSU
[UCP-CPSU] মঞ্চ। পূর্বতন CPSU (Bolshevik)-এর আদলে তারা সম্মেলন
করে। মোট ১৮টি দেশ আছে এতে। এদের প্রধান নেতা গেন্নাদি
যুগানভ। এর মধ্যে থাকা তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেন, লাতভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার পার্টিগুলি নিজ দেশে
নিষিদ্ধ। এস্তোনিয়াতেও পার্টি নিষিদ্ধ। এছাড়া সমান্তরালভাবে CPSU-এর নামে কাজ করে সারগেই সভোরোৎসবের দল। তারা মূলত স্তালিনের অনুরাগী। ২০০১
সালে UCP-CPSU থেকে ভেঙে তৈরি হয় আর একটা CPSU মঞ্চ। এটা ওলগে শেনিনের দল। মূলত বেলারুশ ও রাশিয়াতে
তারা কাজ করে। International Seminar ও IMCWP-তে তারা আছে।
বর্তমানে তাদের নেতা হলেন সারগেই আলেকজান্দ্রভ। শেনিন হলেন সেই
ব্যক্তি যিনি সোভিয়েতের পতনের পর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবার সোভিয়েত পুনর্প্রবর্তন
করার চেষ্টা করেন। শেনিন শোধনবাদ বিরোধী এক হার্ডলাইনার নেতা। এছাড়া ‘Essence of Time’ নামেও একটি আন্দোলন
চলছে। সেখানে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, শোধনবাদ বিরোধী, রুশ জাতীয়তাবাদ, সোভিয়েত
দেশাত্মবোধ, নব্য স্তালিনবাদ প্রভৃতি মতের মিশ্রন দেখা যায়। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে নতুন রূপ দিতে চায় ও তাকে Neo-Communist বলে। তারা রাশিয়াকে বিশ্বের
ত্রাতা (Messianist) হিসেবে দেখতে চায়। তাদের নেতা হলেন সের্গেই কুর্গিনিয়াম। মার্কস,
গ্রামশি, বগদানভ, ব্লাঙ্কি, ওয়েবার সবার মত মেনে চলে তারা। মনে রাখতে হবে, স্তালিন
কিন্তু গ্রামশির মত খুব একটা আমল দেননি; যদিও এরা নিজেদের নব্য-স্তালিনবাদী বলে। মোটামুটিভাবে,
এই হল গোটা বিশ্বের বামপন্থী আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মঞ্চগুলি। এবার আমরা আলোচনা করব
ভারত নিয়ে।
ভারতে বিপ্লব প্রচেষ্টা
ভারতের
কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূলত তিনটি ধারা এবং সেই ধারাগুলি থেকেই বহুস্রোতধারা বের হয়ে
এসেছে। এর প্রথম ধারাটি হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বা CPI এর ধারা। ১৯২০ সালের ১৭ই
নভেম্বর মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগে তৈরি হয় CPI, তাশখন্দে। যদিও CPI নামের বর্তমান অংশটি (যারা
পরপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে NOTA-র থেকেও কম ভোট পেয়েছে) সালটি ১৯২৫ বলে। যাই হোক, ১৯৫১ সালে CPI ঘোষনা করে
যে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি, জাতীয় বুর্জোয়া ও একচেটিয়া পুঁজিপতি, এই
দুই অংশে বিভক্ত। যেহেতু বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সামন্ততন্ত্রবিরোধী
ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কাজগুলি সম্পূর্ণ করার জন্য জনগন্তান্ত্রিক ফ্রন্টে জাতীয় বুর্জোয়া
শ্রেণি হল হল সর্বহারার মিত্রশক্তি, তাই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে একটা জাতীয় গণতান্ত্রিক
পর্যায় আছে। এই নিয়ে দলে যথারীতি বিতর্ক ওঠে। অবশেষে ১৯৬৪-এ দলের জাতীয় পরিষদের ৩২
জন সদস্য দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন পার্টি গড়ে তোলে (৭ক)। CPI
(M) [Communist Party of India (Marxist)] নামে পরবর্তীকালে পরিচিত দলটি হল সেই নতুন
পার্টি। CPI (M) মনে করে যে ভারত একটি আধা-বুর্জোয়া, আধা-সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র অর্থাৎ
বুর্জেয়া-জমিদার রাষ্ট্র, ফলে এখানে একাধারে পুঁজি ও সামন্ত-জমিদারদের বিরুদ্ধে জনগণতান্ত্রিক
বিপ্লব করতে হবে।
ইতিমধ্যে
পার্টি গঠনের তেনালি অধিবেশন থেকে শুরু হয় একটি অন্যধারা, যারা মূলত পার্টির মতাদর্শগত
দলিল নিয়ে বিরোধিতা করে ১৯৬৮-এর বর্ধমান প্লেনাম থেকে বেরিয়ে যায় এবং তৈরি করে All India
Co-ordination Committee of Communist Revolutionaries of CPI (M)। এরা দাবি করে যে তারা পার্টির ভিতরে থাকা শোধনবাদীদের বিরুদ্ধে লড়ছে।
এই সময় নকশালবাড়ি নামে উত্তরবঙ্গের একটি অঞ্চল থেকে যে সশস্ত্র লড়াই
শুরু হয়েছিল তার জন্যই এই ধারাকে নকশালবাড়ি আন্দোলন নামে অভিহিত করা হয়। CPI (M) সহ
ভারতের এক বিরাট অংশের কম্যুনিস্ট দলগুলি এই ঘটনাকে অতি-বাম বিচ্যুতি নামে অভিহিত
করে আর এই ধারা নিজেদের র্যাডিক্যাল, বিপ্লবী ইত্যাদি নামে অভিহিত করে। এই আন্দোলনের
৫০ বছরে দাঁড়িয়ে তাই এই ধারা নিয়ে একটু বেশি কথাই হবে। কারণ ধারাটি
বৈচিত্র্যপূর্ণ। যাই হোক, যে দলিল তারা দাখিল করে তা ছিল তেলেঙ্গানা আন্দোলনের
মহান নেতা কমরেড ভেঙ্কটেশ্বর রাও-এর লেখা কিন্তু তিনি AICCCR of CPI (M)-এ যোগ দেননি
এবং ১৯৬৯ সালে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড চারু মজুমদারের
নেতৃত্বে যখন AICCCR of CPI (M) নাম বদল করে প্রকাশ্য সমাবেশ থেকে CPI
(ML) নামে পরিচিত হয়, তখন আবার তারা ঐ ভেঙ্কটেশ্বর
রাও-এর দলিলটির প্রতি সমর্থন জানাননি (৮)। ফলে ভেঙ্কটেশ্বর রাও APCCCR বা Andhra
Pradesh Co-ordination Committee of Communist Revolutionaries নাম নিয়ে আলাদা সংঠন
গড়ে তোলেন (৯)। যাই হোক, 'কেন এই অতিবাম বিচ্যুতি' শীর্ষক দলিলে CPI (M) সরাসরি দাবি
করে যে, CPI দলের অধিকাংশ সদস্য শ্রেণিচরিত্রের দিক থেকে 'পেটি-বুর্জোয়া' ছিল এবং
CPI থেকে CPI (M) হওয়ার সময় এই ‘পেটি-বুর্জোয়া’
মানসিকতা কাজ করেছিল, তাই সকলে প্রকৃত রাজনীতি বুঝে দল ছাড়েননি। স্বভাবতই CPI (ML)
দল তৈরি হওয়াতে আসলে এই মানসিকতাই কাজ করেছিল। সেই সময় সারা বিশ্ব 'মস্কো ঘোষনা' ও
‘মস্কো বিবৃতি’ (মানে ১২ পার্টি ও ৮১ পার্টি দলিল) নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। মূল দ্বন্দ্ব
কোনটা? সাম্রাজ্যবাদ বনাম তৃতীয় বিশ্ব? নাকি পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র? এই প্রসঙ্গে
CPI দ্বিতীয়টি অর্থাৎ সোভিয়েতের লাইন নেয় এবং CPI (ML) চীনের লাইন নেয়। কিন্তু CPI
(M) কোনো লাইনই নেয়নি, এমনকি পার্টি কংগ্রেসে তারা এমন কোনো প্রস্তাবই দেয়নি। CPI (ML) থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে কমিউনিস্ট ধারার একটি
গুরুত্বপূর্ণ স্রোত তৈরি হয়। এই সময় চারু মজুমদারের নেতৃত্বে CPI (ML) ‘শ্রেণিশত্রু
খতম’ করার লাইন নেয়, যাকে চ্যালেঞ্জ করে সুশীতল রায়চৌধুরী ‘পূর্ণ’ ছদ্মনামে
একটি দলিল দেয়। ‘পূর্ণর দলিল’ নামে খ্যাত এই দলিলে খতম লাইন, স্কুল
কলেজে বোমা মারা, মূর্তিভাঙা, মনীষীদের গালাগালি করা, এইসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অসীম
চ্যাটার্জী এর বিরোধিতা করে বলেন চারু
মজুমদারের বিরুদ্ধে কোনো কথা নয়, CPI (ML)-এ থাকতে গেলে চারু মজুমদারের কর্তৃত্ব মানতে
হবে। ‘কর্তৃত্বের ধারণা’ আমদানীকারী এই ব্যাক্তিই পরে চারু মজুমদারের ঘোর বিরোধী
হয়ে ওঠেন। ১৯৭০ সালে প্রথম ভাঙন ঘটে, AICCCR থেকে ভেঙে বেরিয়ে যায় কে পি
গোপালনের CRP-KPG [Communist Revolutionary Party – K P Gopalan] দল। ঐ বছরই
সত্যনারায়ণ সিং তাঁর ‘মুশাহারীর শিক্ষা’ নামে এক দলিলে খতমলাইনের বিরোধিতা করেন
এবং প্রশ্ন তোলেন যে ধনী কৃষক শত্রু কিনা। কেন্দ্রিয় কমিটি কোনো মিটিং ডাকেনি কিন্তু ‘দেশব্রতী’
তাকে ‘রেনগেড’ বলে ঘোষণা করে। ফলে সত্যনারায়ণ সিং সমান্তরাল কেন্দ্রিয় কমিটি গঠন করে
চারু মজুমদারকে দল থেকে তাড়িয়ে দেন ও “ট্রটস্কিপন্থী এডভেঞ্চারিস্ট”
বলে সমালোচনা করেন। ইতিমধ্যে ১৯৭১
সালে APCCCR থেকে বেরিয়ে আসা APCCCR (চন্দ্রপুল্লা রেড্ডি) গোষ্ঠী তাদের সাথে
১৯৭৫ সালে যোগ দেয়। এই দল নাম নেয় Provincial Central Committee CPI (ML) [PCC CPI
(ML)]। এরা চীনের ‘গ্যাঙ অব ফোর’-এর বিরোধিতা করে এবং হুয়া-গুয়া-ফেং-কে সমর্থন করে, ভোটে
দাঁড়ায়
এবং ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ অবধি গোপীবল্লভপুর থেকে জয়লাভ করে (তারাই প্রথম নকশাল গোষ্ঠী
যারা ভোটে দাঁড়ায়), কিন্তু
১৯৮৪-তে তাদের দলে ভাঙন ধরে। তাদের নেতা সন্তোষ রাণা নিজের জীবনের শেষের দিকে এই দল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭২ থেকেই চারু মজুমদারের উত্তরসূরিরা
কোনও ভাবেই আর মূল নকশাল ধারার নেতৃত্বে ছিল না। খোকন মজুমদারের গ্রুপ, জম্মু
কাশ্মিরের সরফ গ্রুপ, পাঞ্জাবের কিছুটা, কেরালা আর তামিলনাড়ুর কিছুটা আলাদাভাবে
কাজ করতে শুরু করে। ১৯৭৩ সালে CPI (ML)-এ
আবার ভাঙন ধরে। একটি গোষ্ঠী ছিল শর্মার গোষ্ঠী, অপরটি হলো মহাদেব মুখার্জীর
দল। ওই বছরই সেপ্টেম্বরে ‘বর্ধমান রিজিওনাল কমিটি’ ও বিনোদ মিশ্র (বিহারের ভোজপুর কেন্দ্রিক দল) মহাদেব গোষ্ঠী ত্যাগ করে।
এরা প্রাথমিকভাবে শর্মার দলের সাথে
যোগাযোগ রাখলেও পরে সরে যায়। এরপর ১৯৭৪ সালে বিনোদ মিশ্র সুব্রত দত্ত
(জহর) -এর সাথে যুক্ত হন এবং ২৮শে জুলাই
চারু মজুমদারের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁরা নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি তৈরি করে সুব্রত দত্তকে সাধারন সম্পাদক এবং স্বদেশ
ভট্টাচার্য (রঘু)-কে সদস্য করেন। এরা লিন বিয়াও বিরোধী ছিল,
এদের পত্রিকার নাম ছিল ‘লিবারেশন’,
তাই এদের নাম হয় CPI (ML) লিবারেশন। পরে ১৯৮২ সালে এরা IPF [Indian People’s
Front] নামে প্রকাশ্যে কাজ করতে থাকে। ১৯৮৯-এ IPF নামে ভোটও লড়ে, ১৯৯০-এ বিহারে ৭টি
আসনও পায়। ১৯৯২সালে প্রকাশ্যে আসে দল। মনে রাখতে হবে,
এরা চারুপন্থী (যদিও চারু
লাইনের
বিরুদ্ধে
লড়ে
এদের
সূত্রপাত)
কিন্তু লিন বিয়াও বিরোধী। ১৯৭৩-এ দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস হয় (বা
১০ম পার্টি কংগ্রেস; যদিও একে
অনেকে মানতে চায়না পার্টি কংগ্রেস বলে)। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির দেগঙ্গা সভায় মহাদেব মুখার্জীর
সাথে বিতর্ক হয় কারণ ১৯৭৮-এ কাটিহার অঞ্চলের
মনিহারীতে জমি-মালিক
খুন হওয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্ক হয়। তখন চারুপন্থী ও লিন বিয়াওপন্থীরা দল থেকে মহাদেব
মুখার্জীকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি বানায় যারা CPI
(ML)
Second Central Committee নামে পরিচিত
ছিল। এরা ছিল খতম লাইনের সমর্থক ও লিন বিয়াওপন্থী।
মহাদেব মুখার্জীকে হৃদয়ের নেতা হিসেবে
দাবীদাররা এদের থেকে পৃথক ছিল। বর্তমানে এদের নাম CPI (ML)। CPI (ML) Second Central Committee-তে প্রথম থেকেই অজিত মাস্টার (দিনাজপুরের) আলাদা গোষ্ঠী
ছিল। তাদের একটা অংশ CPI (Maoist) দলে
মিশে যায়। পরে এদের আবার আলাদা তিনটি গোষ্ঠী হয় যারা একই নাম ব্যবহার করত।
সুবীর তালুকদারদের গোষ্ঠীর বেশীরভাগেরই
অস্তিত্ব নেই। কিছুজন অন্যদলে চলে গেছে, অর্জুন ব্যানার্জীদের কিছুটা MCCI [Maoist Communist
Centre of India]-তে ঢোকে, বাকিটার অস্তিত্ব
নেই।
আজিজুল হক ও নিশীথ ভট্টাচার্যরা অনেকদিন টিকে থেকে বর্তমানে গ্রুপ হিসেবে সম্পূর্ণভাবে
বিলুপ্ত।
এদের মধ্যে অর্জুন ব্যানার্জীরা লিন বিয়াওপন্থীদের
পথ ছেড়ে দিয়েছে। APCCCR ছাড়াও অমূল্য সেন, কানাই ব্যানার্জীদের দক্ষিণ
দেশ পত্রিকা গ্রুপ CPI (ML)-এ যোগ দেয়নি। এদের বক্তব্য ছিল ‘উত্তরদেশে’ (চীন) বিপ্লব হয়েছে। এবার
‘দক্ষিণদেশে’ (ভারতে)-ও বিপ্লব করতে হবে। এরাই পরবর্তীকালে তৈরি করে Maoist Community
Center (MCC)। পরে RCC (M) [Revolutionary Communist Centre (Maoist)]-এর সাথে ও CPI (ML) Second
Central Committee-এর অর্জুন ব্যানার্জী গ্রুপের সাথে মিশে গিয়ে MCCI তৈরি করে। এতে কল্যান রায়ের
তৈরি MMG (Man Money Gun) গ্রুপ বা Revolutionary Communist Council of India
দল
যোগ দেয়,
যাদের সাথে ছিলেন চট্টগ্রাম
অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মহান বিপ্লবী নেতা অনন্ত সিং।
এরা একসময় লেনিনের 'রাজনৈতিক ডাকাতি'-র মত তুলে ধরে। অনেকটা
চৌ
এন
লাইয়ের
সাংহাই
ডাকাতির
মতো। মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই
এই আন্দোলন প্রায় টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আদর্শগত দেউলিয়াপনার কারনে এরা কোনও
সমস্যার সমাধান করতে পারতো না যা অনিবার্যভাবে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পথ থেকে এদের
বিচ্যুতি ঘটায়। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক এবং তাত্ত্বিক ইস্যুতে তারা সংঘাতে জড়াতো
এবং অনিবার্যভাবে যা ডেকে আনত সাংগঠনিক ভাঙ্গন। এমনকি CPI (M) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার
সময় আদর্শগত-কর্মসূচীগত-রণনীতিগত যে লাইন তারা নিয়েছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা-ই তারা
খারিজ করে দেয়। যেখানে কিছুটা পুরনো মত রেখে ছিল সেখানে তারা তত্ত্ব ও প্রয়োগের
বিপরীতমুখী দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। এবং এর সাথে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কুন্নিক্কল
নারায়ণের গ্রুপ, বি বি চক্রবর্তীর গ্রুপ (পরে
লিবারেশন ফ্রন্ট) এবং মনি গুহর গ্রুপ প্রথম থেকেই বাইরে ছিল। এদিকে,
APCCCR-এর নেতা দেবুলাপল্লি
ভেঙ্কটেশ্বর রাওয়ের উদ্যোগে North Zone Communist Revolt (ML) ও West Bengal
Committee of Unity Centre মিলে একটা ঐক্য সম্মেলন করে ও নাম নেয় Unity Conference
of Communist Revolutionaries of India (ML) (১০)। ১৯৭৭ সালে UCCR (ML) থেকে হরভজন
গোষ্ঠী তৈরি হয়। এরা হোজাবাদী ছিল। এরা আলবেনীয় লাইনকে সমর্থন করে। পরে
দেং-জিয়াও-পিংকে সমর্থন করে ডি ভেঙ্কটেশ্বর রাও নতুন দল গড়েন, যার নাম হয় UCCRI (ML)
D V Rao Group। ১৯৮২ সালে UCCRI (ML)হরভজন গোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে যায় UCCRI (ML) আজমেঢ় গোষ্ঠী। হরভজন গোষ্ঠী
অবশ্য বাবরী মসজিদ ও শিখ বিরোধী দাঙ্গা থামাতে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা নেয়। ইতিমধ্যে সন্তোষ রাণার প্রথম স্ত্রী জয়শ্রী রাণা ১৯৭৭
সালে PCC CPI (ML) থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করে CPI (ML) Bolshevik।
আর অসিত সেন গণআন্দোলনে না থাকাকে
সমালোচনা করে তৈরি করেন Revolutionary Communist Unity Centre (ML)। ১৯৭৭ সালে চারুপন্থী হিসেবে পৃথক দল গঠিত হয়েছিল CPI (ML)
Central Team। অনেকের মতে পরে হরভজন গোষ্ঠী, আজমেড় গোষ্ঠী, RCPI, Organising Committee
CPI (ML)-দের সাথে মিলে তৈরি হয় CPRCI (ML) বা কমিউনিস্ট পার্টি রেভোলিউশনারী
কমিটি অব ইন্ডিয়া (এম এল)। এটা ১৯৯৪ সালে তৈরি হয়।
যদিও অনেকের মতে এরা অর্থাৎ CPI
(ML) Central Team CPRCI (ML)-এ ছিল না। CPI (ML) CT চারুপন্থী হয়েও বর্ণ সংরক্ষণ বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। এরা বামফ্রন্টের
শিল্পনীতির সমর্থক ছিল। এদের দুটো গোষ্ঠীর দুটো পত্রিকা
ছিল, ‘আন্দোলনের সাথী’ ও ‘আন্দোলনের
দিশা’। এই দলও বহুবার বিভিন্ন জায়গায় ভেঙেছে।
পরে এই পত্রিকা দুটি মিশে যায়। আর COC CPI (ML) [Central Organising Committee CPI (ML)] দলটি তৈরি
হয়েছিল ‘কমিউনিস্ট ইউনিটি সেন্টার অফ ইন্ডিয়া’
(সুনিতি ঘোষের দল), ‘মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট
অর্গানাইজেশন কমিটি’ (অন্ধ্রের একটি গ্রুপ) ও বি এন শর্মার ‘বিহার-বেঙ্গল কমিটি’-র দ্বারা, সম্ভবত ১৯৭৪ সাল নাগাদ; যদিও “রোড টু লিবারেশন” প্রস্তাব (১৯৭৫ অক্টোবর) নেওয়ার
সাথে সাথে এদের দল ভেঙ্গে যায়। এদের মধ্যে শর্মার দল CLI (Communist League of
India) তৈরি করে ও কিছুদিনের মধ্যে অকেজো হয়ে যায়। এদের একটি অংশ ‘COC CPI (ML) শান্তিপাল’
নামে কাজ করে এবং আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল, হয়তো এখনও আছে। ১৯৮০ সালে সি পি রেড্ডিরা CPI (ML) থেকে বেরিয়ে যায়, বাকিরা PCC CPI
(ML)-এ ছিল। সি পি রেড্ডিরা পরে নাম নেয় CPI (ML) Red Flag।
১৯৮৪-এ PCC CPI (ML)-এ বড় ভাঙন ঘটে
যখন CPI (ML) TND [CPI (ML) Towards New Democracy] তৈরি হয় (১১)। পশ্চিমবঙ্গে
এদের পত্রিকা ছিল 'আগামী যুগ'। তারা এই নামেই
পরিচিত ছিল, অর্থাৎ ‘CPI (ML) আগামী যুগ’। ১৯৮০-তে
কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়া, যিনি CPI-তে , কিন্তু CPI
(M)-এ যোগ দেননি, পরে নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন, তিনি ও
কোল্লুর চিরঞ্জীবী মিলে তৈরি করেন CPI (ML) People’s War। এরা
আসলে ১৯৭৬ সালে COC CPI (ML)-এর অন্ধ্র গ্রুপ থেকে ভেঙ্গে ছিল। এরা পরে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে যায়।
কোডান্থারমনও এদের সাথে ছিল। এরা সশস্ত্র লড়াইয়ের সাথে সাথে গণসংগঠনও তৈরি করত। ২০০৪ অবধি এরা CCOMPOSA-তে ছিল, পরে এরা CPI (Maoist)-এ যোগ দেয়।
এরা প্রথম থেকেই গেরিলা যুদ্ধ করেছে। ১৯৮২ সালে এন প্রসাদ ও ভবানী রায়চৌধুরীদের দল CPI (ML) Unity
Organisation এবং এম আপ্পাদুরাইয়ের দল (১২)
মিলে তৈরি করে Central Organising
Committee CPI (ML) Party Unity বা COC CPI (ML) PU। এরাও পরে মাওবাদীদের সাথে মিশে যায়। এরকম আরেকটি দল ছিল CRC CPI (ML)
[Central Reorganizing Committee CPI (ML)]। নেতার নাম ছিল ভেনু।
এরা চারুপন্থী হলেও গণআন্দোলনে যেত। ১৯৭৮
সালে CLI (ML) তৈরি হয়। CRC CPI (ML) রামনাথ গোষ্ঠীর
একটা অংশ ১৯৭৮ সালে CLI (ML) তৈরি করে। এরাই CPI শাখার উত্তরসূরীদের প্রথম দল যারা ভারতকে একটি
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমর্থন করে। ১৯৯৭ সালে
তৈরি হয়েছিল আরও এক বড় দল CPI (ML) New Democracy। এরা একসময় লোকসভা, বিধানসভা
বয়কট করলেও এখন আর করে না। কারো মতে এরা গেরিলা যুদ্ধের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি
নিচ্ছে (আসলে এদের মধ্যে এখন বিতর্ক চলছে দল
সংসদে যাবে কি যাবে না, গেলে কিভাবে? এদের একটা অংশ যারা যাওয়ার পক্ষে, তারা CPI
(ML) ND নামটা ব্যবহার করছে কিন্তু যে অন্য অংশটা সংসদে যেতে চায় না তারা প্রায়
পৃথক হওয়ার পথে। এদের দলে পরে
সি পি রেড্ডি গোষ্ঠির লোকও যোগ দেয়। ১৯৯২ সাল
নাগাদ তৈরি হয় CPI (ML) জনশক্তি। এই দল তৈরির মূলে ছিল CPI (ML) Resistant, UCCRI (ML)
মুক্তিগামী [Unity Centre for Communist Revolutionaries of India] (ML) মুক্তিগামী,
CPI (ML) আগামী যুগ, CPI (ML) RV Rao [এরা CPI (ML) ND থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল], CPI (ML)
খোকন মজুমদার, CRGU (Communist Revolutionary Group for Unity), অসিত সেনের RCUC
(ML) [Revolutionary Communist Unity Centre (ML)] এবং পরিমল দাশগুপ্তের দল। এদের
নেতা ছিলেন সি পি রেড্ডি ও টি নাগী রেড্ডি। আবার ১৯৯৭ সালে আলোক মুখার্জী ও MLRO
গ্রুপ বেরিয়ে আসে জনশক্তি থেকে। এদের একটি অংশ আবার বেরিয়ে গিয়ে যোগ দেয়
CPI (ML) ND-এর সাথে। এরপর ২০০০ সাল নাগাদ কানু সান্যালের COI (ML) [Communist
Organization of India (ML)], রামচন্দ্রনের CPI (ML) Red Flag ও অলোক মুখার্জী
মিলে তৈরি করেন CPI (ML)। এর থেকে ভেঙেই পরে তৈরি হয় CPI (ML) Red Star। এরা ভারতকে
বুর্জোয়া-বড় ভূস্বামী শ্রেণীর দ্বারা সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যকারী রাষ্ট্র বলে চিহ্নিত
করে জনগণতন্ত্রের ডাক দিয়েছে। এরা মনে করে
ভারতের কর্পোরেট-রাও মুৎসুদ্দি। কানু
সান্যালের COI (ML) তৈরি হয়েছিল CPI (ML) কাইমুর রেঞ্জ (রবিশংকর গোষ্ঠী), কানু সান্যালের OCCR
(Organizing Committee of Communist Revolutionaries),
COC CPI (ML) উমাধর সিং, UCCRI (ML) সুবোধ
মিশ্র গ্রুপ, ICP (Indian Communist Party)-এর ইউ কৃষ্ণনাপ্পা গ্রুপ ও সবুজ সেনের ‘লিবারেশন
ফ্রন্ট’ মিলে। আবার পরে ২০০৩ সালে কানু সান্যলের COI
(ML) এবং CPI (ML) মিলে তৈরি হয় CPI (ML) Class Struggle, যারা ঐ বছরই CPI (ML)
দলে মিশে যায় নভেম্বর মাসে। আবার
CPI (ML) Red Flag শুরুতে তৈরি হয়েছিল CPI (ML) সোমনাথ (কানুর
দল থেকে ভেঙ্গে বেরোয়), CPI (ML) Red Star (Unnichekkan-শোধনবাদ
বিরোধী) ও CPI (ML) Red Flag (KN Ramachandran) গোষ্ঠী নিয়ে।
আর CPI
(ML)
Unity Initiative-ও ছিল ছয় পার্টির
একটি জোট। এদের মধ্যে ছিল CPI (ML) New Initiative, যাদের নেতা ছিল অরবিন্দ সিনহা। ১৯৯৭-এ CPI (জনশক্তি) ভেঙে তৈরি হয় Communist Party of
United States of India, এদের নেতা হলেন এম বিরানা। তাছাড়া
CPI (ML) ভাইজি , CPI (ML) প্রজাশক্তি, CPI (ML) প্রজাপতিঘটনা দল তৈরি হয়।
জনশক্তির আরেক অংশ CPR CPI (ML) [Chandra Pulla Reddy CPI (ML)] দলে মিশে CPI (ML)
জনশক্তি (CPR) বানায়, যারা বর্তমানে প্রজাপতিঘটনার সাথে মিশে যেতে ইচ্ছুক। চন্দ্র
পুল্লা রেড্ডীর দল থেকেই তৈরি হয় PRC CPI (ML) [Proletarian Reorganizing
Committee CPI (ML)]। ১৯৯৮ সাল
নাগাদ COI (ML) থেকে ভেঙে বেরিয়েছিল CPIU (ML) [CPI Unity (ML)]। ২০০৩-এ এই দলটি উঠে
গেছে। ১৯৮২ সাল থেকে CPI (ML) Liberation গণআন্দোলনে আসে এবং
IPF (Indian People’s Front) তৈরি করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ইতিমধ্যে দেবরা-গোপীবল্লভপুরে সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যর্থ
হবার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধীতা করে অসীম চ্যাটার্জী (কাকা) তৈরি
করেন Bengal -Bihar-Orissa Border Regional Committee, CPI
(ML)
যা পরে নাম নেয় CLRI। যদিও এই মত
অনেকে মানেন না। ১৯৯৫-২০০০ সালে এই দলটি বামফ্রন্ট-এ ছিল। পরে কাকা (অসীম
চ্যাটার্জী) তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়ান, এমনকি তাঁর হয়ে প্রচার করতে আসেন নকশাল আন্দোলন দমনের প্রধান
কংগ্রেসী মুখ সিদ্ধার্থ শংকর রায়! ওড়িশার নাগভূষণ
পট্টনায়ক জেল থেকে বেরিয়ে কাকার দল ত্যাগ করে নতুন দল তৈরি করে। ইতিমধ্যে মনি গুহ
আলবেনীয় লাইন নেয় আর সরফ-এর দল নাম নেয় ‘প্রলেতারিয়েত পার্টি’। ১৯৮০-এর দশকে AOC
(Andhra Organizing Committee) এবং COC নামে আরও দুটো দল ছিল, ছিল শান্তি পালের
দল, চেলাপতি রাও (অন্ধ্র) এবং RCP (পাঞ্জাব)। এদের বর্তমানের হাল জানা নেই। CPI (ML) (কানু সান্যালের একটি
গোষ্ঠী) থেকেই ভেঙে তৈরি হয়েছে CPB (Communist Party of Bharat)। এদের নেতা
রঞ্জন চক্রবর্তী ও বর্ণালী মুখার্জী। CPI (ML) Red
Flag থেকে ১৯৮৭ সালে ভেঙে তৈরি হয় CPC CPI (ML) [Central Recognition Ccommittee
CPI(ML)]। ১৯৯১ সালে যখন এরা উঠে যায় তখন এদের কেরালা CP এবং মহারাষ্ট্র CP নামে
দুটো গোষ্ঠী থেকে যায় যারা CPI (ML) রউফ গোষ্ঠী তৈরি করে একসাথে। পরে Maoist Unity
Centre-এর সাথে মিলে একযোগে তৈরি করে CPI (ML) নকশালবাড়ী। এরা RIM-এ ছিল। এদের নেতা
অজিতের একটি লেখা “মাওবাদী পার্টি” নামে অনিয়মিত বাংলা
পত্রিকা 'দাবানল'-এ
প্রকাশিত হওয়ার পরই (পত্রিকাটি
এদেরই তৈরি) এরা CPI
(Maoist)-এ মিশে যায়।
১৯৮০ সালে কানাডায় Hindustani Gadar
Party Organization of India (MLM) চীন-আলোবেনীয় বিচ্ছেদে এনভের হোজাকে সমর্থন করে আলবেনিয়ার
পাশে দাঁড়ায় এবং ওইবছর ২৫শে ডিসেম্বর নাম নেয় CGPI
(Communist Gadar Party of India)। ২০০৪ সালে
প্রকাশ্য সমাবেশে MCCI (Maoist Communist Centre of India), CPI (ML) PU [CPI (ML)
Party Unity], CPI (ML) PWG [CPI (ML) People’s War Group]
ও অবশিষ্ট CPI (ML) Second CC যুক্ত
হয়ে তৈরি করে CPI (Maoist)। পরে ২০১৪ সালে এদের সাথে যুক্ত হয়েছে CPI (ML) নকশালবাড়ী। RIM ও COMPOSA-তে
থাকা এই মাওবাদীরা গেরিলা পদ্ধতিতে জনযুদ্ধ চালিয়ে এরা নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব
চায়। এছাড়াও CPRC (ML) (পত্রিকা-সংগ্রামী দিশা) (১৩), UCML (পত্রিকা- পালনিক্স) (১৪), CPI (ML) International
Revolutionary বলে আরো কিছু ছোট নকশালপন্থী দল ছিল/আছে। MLRG (Marxist Leninist
Revolutionary Group) বলে একটি নকশাল দলের সঙ্গে ML Fraction-এর ছোট একটি অংশ মিশে
বর্তমানে MLRO (Marxist Leninist Revolutionary Organisation) বলে একটি দল চালায়। বর্তমানে
এই দলটির প্রকাশ্য সংগঠনের নাম মজদুর ক্রান্তি পরিষদ বা MKP
এবং যুব সংগঠন ‘ক্রান্তিকারি নওজওয়ান সভা’। ১৯৬৯ সালে নকশালবাড়ির প্রভাবে বাম শরিক RSP ভেঙে তৈরি হয় RSPI (ML)। এরা
পরে (সম্ভবত ১৯৭৮ সালে) নাম নেয় ‘মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট গ্রুপ’ বা MLG। এরা ছাত্র
সংগঠন তৈরি করেছিল DSC (Democratic Student’s Committee) নামে যাদের কলকাতার
প্রেসিডেন্সি কলেজে শাখা ছিল। PCSA (Presidency College Student’s Association)-এর
কিছু বেরিয়ে আসা ব্যক্তি এবং কিছু SFI-ঘেঁষা ব্যক্তি কোনো রাজনৈতিক দলের সংস্পর্শ
না থাকার ধুঁয়ো তুলে ৯০-এর দশকের শুরুতে IC বা ইন্ডিপেনডেন্টস কনসলিডেশন শুরু করে। ইতিমধ্যে DSC
তুলে দেবার সিদ্ধান্ত MLG গ্রহণ করে ফেলে। তখন এদের একটি অংশ ‘ছাত্র আন্দোলনের
প্রস্তুতি কমিটি’ (CAP) নামে একটি সংগঠন তৈরি করে যারা IC-কে দীর্ঘদিন যাবত নিয়ন্ত্রন করেছে। এরা (MLG) বহু
জায়গায় ‘সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন’ নামে ট্রেড ইউনিয়ন চালায়।
এই চূড়ান্ত
বৈচিত্র্যময় ভাঙা-গড়ার মধ্যে দু'তিনটে জিনিস খুব পরিষ্কার:
১) প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই ML Faction-এ প্রচুর ভাঙাগড়া
চলেছে। গোটা '৭০ ও '৮০-এর দশক জুড়ে চলে এই পর্ব।
যদিও ১৯৭০-এর শেষে এবং ১৯৮০-এর শুরুতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী কিছু জোট এরা করেছে। PCC,
COC এবং UCCRI মিলে এই জোটের পরেই শেষোক্ত দুই দল ঐ জোট ভাঙ্গে এবং সাথে সাথে COC
৪ টুকরো হয়। এরপর যখন ১৯৮২-এ বেশকিছু দল মিলে IPF গঠন করে, তখন বাকি দল যেমন সরফ,
COC-রা এদের সমালচনা করে। সত্যনারায়ণ সিং-এর দলের আক্রমণ ছিল এই প্রকারঃ “NO sane
political creature believes that any single political party can emerge as the
National Alternative to Indira fascism
right
now… Recently one group and its supporters held a national conference in Delhi
and formed the Indian People’s Front…
Utpoian
dreams based on exaggerated self-esteem is a disease that drives a victim to
commit suicide. So the Indian People’s Front led by one revolutionary group has
become the National Alternative!” (For a new democracy, May Day, 1982) ।
২) সোভিয়েতের
পতনের পর '৯০দশকের প্রথম দিক জুড়ে চলে ঐক্যস্থাপনের পর্ব।
৩) '৯০ দশকের
শেষ দিকে যখন বোঝা গেল যে এসবে কিছু হবে না তখন আবার ভাঙন শুরু হলো।
৪) ভাঙন এখনো
চলছে, আবার পার্টি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলছে ঐক্যের প্রস্তুতি।
কেন এই ভাঙন?
'অতিশয়োক্তি' ও 'অতিসরলীকরন': ১৯৭৫ সালের মধ্যে বিপ্লব হয়ে যাবে; ৭-৮ টা গাদা বন্দুক দখল করেই 'গণফৌজ যাত্রা শুরু করেছে’-এ জাতীয় অতিশয়োক্তি শোনা যেত। তাছাড়া, অমুক জায়গা মুক্তাঞ্চল; ওখানে রাষ্ট্রকে ঢুকতে হলে নৌবাহিনী লাগবে - এ ধরণের কথা শোনা যাওয়ার পর দেখা যেত গাদা বন্দুকধারী ১৫ জন কনস্টেবল সেই জায়গা দখল করল। তাছাড়া গণ-আন্দোলন থেকে দূরে থাকা, গোপন পার্টি, গুপ্তহত্যা, পরস্পরকে সন্দেহ, প্রশ্নহীন লাইন মেনে নেওয়া অনিবার্য ভাঙন ডেকেছিল।
CPI থেকে CPI
(M), ছাড়াও আরো কিছু দল ভেঙেছিল। ১৯৪৭-এর আগেই তৈরি হয় RCPI (সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দল),
১৯৭০ সালে তৈরি হয়েছিল তামিলনাড়ু কমিউনিস্ট পার্টি,
১৯৮০ সালে ডাঙ্গের মেয়ে রোজা দেশপান্ডে ও বাণী দেশপান্ডে তৈরি করেন
AICP [All India Communist Party]। ১৯৮৭ সালে তারা ICP-এর সাথে মিশে তৈরি করে UCPI
[United Communist Party of India]। ICP তৈরি হয় ১৯৭৮ সালে যখন মোহিত সেন CPI থেকে বেরিয়ে
যান। ১৯৯১ সালে CPI থেকে Realist CPI তৈরি করেন যা ২০০১ সালে RCPI-তে মিশে যায়।
২০০০ সালে CPI থেকে ভেঙে তৈরি হয় ‘রাষ্ট্রবাদী কমিউনিস্ট পার্টি’। আর একটি ভাঙন
হল ‘ক্রান্তিবাদী কমিউনিস্ট পার্টি’। CPI (M) থেকেও CPI (ML) ছাড়াও আরো বেশ কিছু ভাঙন হয়েছে। মহারাষ্ট্রে প্রথমে
CPI (M) ভেঙে বেরিয়ে যায় একটি দল, তাদের নাম ‘লাল নিশান পার্টি’। কিন্তু
পরবর্তীতে কংগ্রেস-(ই)র সাথে হাত মেলানোয় তাদের একটি অংশ ভেঙে বেরিয়ে যায় ও নাম
নেয় ‘লাল নিশান পার্টি (লেনিনবাদী)’। ১৯৭৮ সালে
মহারাষ্ট্র থেকে ভেঙ্গে বেরিয়েছিল মার্ক্স-ফুলে-আম্বেদকারপন্থী দল ‘সত্যশোধক কমিউনিস্ট
পার্টি’। ১৯৮৩ সালে CITU (Centre of India’s Trade
Union) নেতা জগজিৎ সিং লায়লপুরী CPI (M) ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং গঠন করেন Marxist Communist
Party of India (MCPI)। এরা ১৯৬৪ সালের মতাদর্শগত দলিলের সমর্থনে লাইন তৈরি করে। একইভাবে CPI (M) থেকে
ভেঙে M-L-C (Marxist-Leninist-Committee) তৈরি হয়।
২০০৩ সালে CITU নেতা ভি বি চেরিয়ান
CPI (M) থেকে ভেঙে BTR-EMS-AKG-জনকিয়াবেদী বা BTR-EMS-AKG (People's Forum)
[Bhalchandra Trambak Ranadive-Ernakulam Manakkal Sankaran-Ayillath Kuttiari Gopalan
(People’s Forum)] তৈরি করে যা MCPI-র সাথে যুক্ত হয়ে MCPI (United) তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গের হারাধন রায় এদের সাথে ছিলেন। পাঞ্জাবে এভাবেই CPI
(M) ভেঙে তৈরি হয় CPM (Punjab) যা
কিনা পাঞ্জাবে CPI (M) থেকে বেশী শক্তিশালী। এদের নেতার নাম মঙ্গতরাম পাসলা। এদের সাথে ২০০৯ সালে চন্দ্রশেখরনের দল RMPI (Revolutionary
Marxist Party of India) যোগ দিয়ে MCPI (United)-এ
মিশে গেছে। এরকমই একটি গোষ্ঠী হিসেবে বেরিয়ে যায় New Socialist
Movement। ১৯৮৬ সালে কেরালার CPI (M) থেকে
ভেঙ্গে বেরোয় অরবিন্দাক্ষন। যার নামে দলের নাম CPM (অরবিন্দাক্ষন)। এদের সাথে PDS
(Party for Democratic Socialism)-এর যোগ আছে, এরা কংগ্রেসের সাথে জোটের পক্ষে। ১৯৯৪
সালে গৌরীআম্মা CPI (M) থেকে বেরিয়ে তৈরি করেন ‘জনপতিয়া সংরক্ষণ সমিতা’। ২০০১ সালে মধ্যপ্রদেশে CPI
(M)
ভেঙে তৈরি হয়েছে 'মধ্যপ্রদেশ
কিষাণ-মজদুর আদিবাসী ক্রান্তি দল'। এছাড়া ঐ বছরই CPI
(M)
থেকে ভেঙে কলকাতার তৈরি হয় ‘মার্ক্সিস্ট
মঞ্চ’ এবং প্রায় একই সাথে গঠিত হয় - Confedaration of Indian Communist and
Socialist। ১৯৯৯ সালে বা তার আগেই সুমন্ত হীরা তৈরি করেন পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মঞ্চ যার পরে
নাম হয় People's Revolutionary Party of India। সুমন্ত হীরার সাথে এই দলে কিছুদিন
বাবলু চক্রবর্তী ও বাদশা আলমও ছিলেন। এইভাবে ত্রিপুরাতে অজয় বিশ্বাস তৈরি করেন ত্রিপুরা
গণতান্ত্রিক মোর্চা। ১৯৮৩ সালে CPI (M) ভেঙ্গে
তৈরি হয়েছিল CMP (জন)। আসামের CPI (M) থেকে তৈরি হয় ‘মার্কসিস্ট মঞ্চ’। এছাড়া
CPI (M) থেকেই তৈরি হয়েছে CPM (New) রবীন্দ্রনাথ কেনেডি। ২০১৬ সালে CPI (M) থেকে বেরিয়ে কিছু সদস্য তৈরি
করে ‘ইয়ং বেঙ্গল’। ওই বছরই কিছু প্রাক্তন
CPI (M) সদস্য ও কর্মীরা মিলে তৈরি করে
‘পিপল’স ব্রিগেড’। ২০১৭ সালে তৈরি হয় 'ভারতের সাম্যবাদী সংঘ'।
১৯৩৮-এ
রামগড়ে বামপন্থীরা মিলে যে সংগঠন তৈরি করেন, তাই হয়ে উঠেছিল RSP (I), পরে I বাদ
দিয়ে এরা পরিচিত হয় RSP [Revolutionary Socialist Party] নামে। এরা বর্তমানে
বামফ্রন্টে আছে। এদের দাবি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এরা স্তালিন বিরোধী (যদিও পুরোটা ট্রটস্কিপন্থী নয়, এরা দাবি করে
স্তালিনের বিরোধিতা মানেই ট্রটস্কিপন্থী নয়, যদিও চিন্তাধারার অনেক মিল আছে) এবং তা মূলত CPI-এর
বাইরে থাকার কারনেই শুধু নয়, আসলে এরা মূলত পুরোনো অনুশীলন সমিতির একটি ধারা। এরা
নিজেদের
মতবাদকে
‘নন-কনফরমিস্ট’
বা ‘অননুসারী’
মার্কসবাদ
বলে। ‘২০/’৩০/’৪০-এর
দশকে
যখন
স্তালিনের মত অনুযায়ী সোভিয়েতে, তার বিপ্লব
কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সর্বত্র বিপ্লব হওয়া দরকার কিন্তু আবশ্যিক নয়, বরং তার বদলে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ক্ষেত্র থেকে পুঁজিবাদকে
মুছে ফেললে বিপ্লব বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, এই মতে গড়ে উঠছে মূল ধারার পার্টিগুলোতে, তখন ট্রটস্কি ও তাঁর অনুগামীদের মত ছিল সোভিয়েতকে ধরে রাখতে গেলে অন্য দেশে
বিপ্লব করতেই হবে। তখন RSP-র বক্তব্য ছিল, শুধু সোভিয়েতের জন্যই নয় (সেটা দরকারী, কারণ সেখানে বিপ্লব হয়েছে, ফলে অস্বীকার বা খারিজ না করেই) বরং সারা দুনিয়ার শ্রমিকের মুক্তির জন্যই দেশে দেশে বিপ্লব করতে হবে। ফলে স্তালিন ও ট্রটস্কির কারও মতের পক্ষেই পুরোপুরি যায়নি
বলে RSP নিজেদের অননুসারী বলত।
১৯৪৮ সালে RSP-র
স্তালিন বিরোধী চরিত্রের জন্য শিবদাস ঘোষ, নীহার মুখার্জীরা RSP থেকে বেরিয়ে তৈরি করে SUCI;
বর্তমানে যার নাম SUCI (C) [Socialist
Unity Centre of India (Communist)]। এদের দাবি, ভারতে প্রকৃত অর্থে কোনো কমিউনিস্ট পার্টি
নেই এবং SUCI সেই শূণ্যস্থান পূরণ করবে। আসলে স্তালিনের নীতি ছিল কমিউনিস্ট পার্টিহীন দেশে
Socialist Unity Centre তৈরি করা (যেমন- Socialist Unity Centre of Polland), যাদের
মাধ্যমে জনগণতান্ত্রিক সরকার তৈরি করার চেষ্টা চালাতে হবে। SUCI ১৯৪৭ সালে ভারতের
স্বাধীনতাকে পুঁজিবাদীদের ক্ষমতায় আসা বলে মনে করে (বিস্তারিত জানতে পড়া উচিত
"কেন SUCI ভারতের একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি" এবং "CPI (M) – SUCI - মতবাদিক সংগ্রাম")।
RSP বহুবার
খন্ডিত হয়েছে। ১৯৬৯ সালে তৈরি হয় RSPI (ML), মূলত নকশালপন্থী এরা
(নকশালপন্থী অংশে দ্রষ্টব্য)। ১৯৬০
সালে RSP-এর কিছু অংশ, CPI ও CPI (M)-এর কিছু অংশ মিলে তৈরি হয় MLK (Marxist
League of Kerala)। এদের কোন চিহ্ন বর্তমানে নেই। ১৯৬৯-এ এদের একটি অংশ Socialist
Workers’ Party-তে যোগ দেয়। কোভুর কুন্নুমন
কেরালার RSP থেকে ভেঙ্গে RSP (Leninist) তৈরি করে। ১৯৭৭ সালে RSP থেকে National RSP তৈরি হয় আবার ১৯৮২ সালে উঠে যায়।
১৯৮৯-তে RSP থেকে RSP (Bolshevik)
তৈরি হয়। এখান থেকে বাবু দিবাকরণ (কিছুদিন Socialist Party-তে ছিল) RSP (B) থেকে
বেরিয়ে গিয়ে RSPI তৈরি করে (২০০৫-২০০৮)। বর্তমানে আবার RSP(B)-তে আছে।
১৯৮০-তে এন সমাজপতি তৈরি করে ‘সাম্যবাদী
সংস্থা’। ১৯৫১-৫২ সালে ‘উত্তরপ্রদেশ RSP’ তৈরি হয়, যারা কিছু পরে CPI-তে যোগ দেয়।
ভারতীয়
বামপন্থী আন্দোলনের তৃতীয় ধারা হলো ট্রটস্কিপন্থী ধারা। ১৯৩১ সালে এই ধারায় ‘কমিউনিস্ট
লিগ’ (CL) তৈরি হয়। ১৯৪২ সালে ‘বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অফ ইউনাইটেড প্রভিন্স অ্যান্ড
বিহার’ ও ‘বলশেভিক মজদুর পার্টি অফ ইন্ডিয়া এবং লঙ্কা সমসমাজ পার্টি অফ সিলোন নিয়ে
তৈরি হয় ‘বলশেভিক -লেনিনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া-সিলোন অ্যান্ড বার্মা’ তৈরি হয়। ১৯৪৮-এদের কেউ কেউ ‘সোশ্যালিস্ট পার্টি’ ও কেউ কেউ CPI-তে মিশে যায়। এরা সবাই ট্রটস্কিপন্থী
দল ছিল। ছিল
CPFI [Communist Party of Fourth International] (যা ভি সুব্বাইয়ার দল)।
‘ইনকিলাবি কমিউনিস্ট
সংগঠন’ নামে একটি দল ছিল। সেখান থেকে পরে CL, ‘র্যাডিকাল সোস্যালিস্ট’ পত্রিকা, প্রভৃতি গোষ্ঠী তৈরি হয়। এই ধারাটি মূলত অনুশীলন সমিতির ধারা
এবং সবাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দাবিই করে। এদের মতো আরো কিছু দল আছে যাদের উল্লেখ
আন্তর্জাতিক মঞ্চের আলোচনায় আছে।
অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারার উল্লেখ করার আগে আরো দুটি CPI (M) থেকে বিভাজনের কথা উল্লেখ করতে হবে। বিশ শতকের গোড়ায় উত্তরবঙ্গে জাতিগত ইস্যু-কে কেন্দ্র করে CPI (M) ভেঙে CPRM (Communist Party of Revolutionary Marxists) তৈরি হয়। এরা বর্তমান গোর্খাল্যান্ডের দাবীতে বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছে! যদিও সবথেকে উল্লেখযোগ্য ভাঙন হল PDS-এর ভাঙন যা আসলে চূড়ান্ত শোধনবাদী লাইনের বহিঃপ্রকাশ। যদিও PDS কোনো সমস্যাই প্রত্যক্ষভাবে সৃষ্টি করতে পারেনি। মূলত কংগ্রেসের সাথে জোট করার কথা বলে সমীর পুততুণ্ড, সৈফুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতারা PDS তৈরি করে। ফলে দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও কলকাতার কিছু অংশে সাংগঠনিক কিছু ক্ষতি হয় যা দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে সাহায্য করে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ CPI (M) এই লাইনই নিয়েছে।
ভারতের
বামপন্থী আন্দোলনের আর একটি ধারা হল ‘Radical Democratic Party’। এদের অন্যতম নেতা
জ্যোতি ভট্টাচার্য ১৯৭৬ সালে CWP (I) [Communist Worker’s Party of India
(Internationalist)] তৈরি করেন। ১৯৯৩ সালে তাঁরা ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’ নাম নেন এবং ২০১১
সালে আবার বামফ্রণ্টে ফিরে আসে।
১৯৩৮
সালে ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ তৈরি করেন সুভাষচন্দ্র বসু। পরবর্তীকালে এখান থেকে তৈরি হয় ‘ফরোয়ার্ড
ব্লক (মার্কসবাদী)’, যা আবার ১৯৪৮ সালে ভেঙে যায় ও তৈরি হয় ‘ফরোয়ার্ড কমিউনিস্ট পার্টি’।
১৯৫২-তে এদের থেকে ভেঙে তৈরি হয় ‘ফরোয়ার্ড কমিউনিস্ট পার্টি (আনন্দী মুখার্জী)’ এবং
এরা পরে বলশেভিক পার্টিতে মিশে যায়। আর FCP (কে এম জোগলেকর) CPI-তে মিশে যায়। এরপর
ফরোয়ার্ড ব্লক থেকে তৈরি হয় ‘মার্কসবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক’। এরা বামফ্রন্টে তো আছেই, এমনকি
এদের দুজন একদা মন্ত্রীসভাতেও ছিল (রাম চ্যাটার্জী ও প্রতিম চ্যাটার্জী)। ফরোয়ার্ড
ব্লকের শুরুটা হয়েছিল স্বরাজ্য দলের মুখপত্র হিসেবে। পার্টি শুরু হয় ১৯৩৮ সালে। মূলতঃ
জাতিয়তাবাদী থাকলেও এরা পরবর্তীতে বামপন্থী হয়ে যায়। তাদের রাজ্য সর্বোচ্চ নেতা অশোক
ঘোষ (প্রয়াত), বাংলায় জোট আন্দোলনের রূপকার ছিলেন। তিনি ফরোয়ার্ড ব্লকের পতাকায় কাস্তে
হাতুড়ি থাকারও বিরোধী ছিলেন যদিও সবার মত তিনি মেনে নেন। ফরোয়ার্ড ব্লক বহুবার ভেঙে
বহুবার জুড়েছে। কখনো ‘সারা ভারত ফরোয়ার্ড ব্লক’, কখনও ‘নিখিল ভারত ফরোয়ার্ড ব্লক’,
‘পশ্চিমবঙ্গ ফরোয়ার্ড ব্লক’, ‘সুভাষবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক’ প্রভৃতি নাম নিয়ে ভেঙে আবারও
জুড়েছে।
যুক্তফ্রন্টে
থাকা এবং শুধুমাত্র শ্রমিকদের নিয়ে দল করতে চাওয়া ‘বলশেভিক পার্টি’ (ভারতের) প্রায়
উঠেই যায়। বরদা মুকুটমনির এই দল বর্তমানে পুনরায় গড়ে উঠে বামফ্রন্টে ফিরে এসেছে।
এবার
দুটো উঠে যাওয়া দলের কথা বলি। ‘লাল কমিউনিস্ট পার্টি অফ হিন্দ ইউনিয়ন’ ১৯৪৮ সালে তৈরি
হয় তেজ সিং স্বতন্ত্র-এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবে। এরা ১৯৫২ সালে CPI-তে যায় এবং ১৯৬৪ সালে
পুরো অংশটাই CPI (M)-এ মিশে যায়। ১৯৩৫ সালে আন্দামান সেলুলার জেল থেকে তৈরি হয় ‘কমিউনিস্ট
কনসলিডেশন’। এরা রাজনৈতিক ডাকাতি করত। এই দলে ছিলেন শিব ভার্মা এবং পরে হরেকৃষ্ণ কোঙার।
এরা ১৯৩৬ সালে CPI-তে মিশে যায়। আসলে এরা সবাই HRSA (Hindusthan Republican
Socialist Association) দলের উত্তরসূরি ছিল। পরে এরা সবাই CPI (M)-এ চলে যায়।
১৯৮০
সালে তৈরি হয় কাংলেইপাক কমিউনিস্ট পার্টি [KCP], মণিপুরে। চূড়ান্ত সশস্ত্র আন্দোলন
চালানো তাঁদের লক্ষ্য। মোট ১২টি পার্টিতে ভেঙেছেঃ KCP (পৃথ্বী), KCP (মেয়ং), KCP (Military
Council), KCP (Maoist), KCP (নয়ন), KCP (লামকেল), KCP (সুনীল মেইতো), KCP (মোবাইল
ফোর্স), KCP (লামান্ডা খুষান), KCP (লায়লাপ্পা), KCP (চিলি মুসি), KCP (Marxist-Maoist)
[এদের আরেক নাম – KCP (ইবনো গ্যাম্পো)]। ২০১১ সালে ৪নং দলটি থেকে তৈরি হয় ‘মাওইস্ট
কমিউনিস্ট পার্টি (মণিপুর)’, যাদের লাইন হল
নিউ ডেমোক্রেসি।
ভারতে
কিছুদিন আগে পর্যন্তও দেখা গেছিল দুই ধরনের কমিউনিস্ট দল: Pro-Left দল অর্থাৎ CPI (M),
CPI, AIFB, RSP, PWP ইত্যাদি আর হলো Pro-Congress দল, যেমন – MCC (Marxist
Co-Ordination Committee), MCPI, OCP (Odisha Communist Party) ইত্যাদি। তবে এই বিভাজন
এখন সম্ভব নয়।
এখন
প্রশ্ন হল, এই যাবতীয় আলোচনা থেকে আমাদের শেখার কি আছে? শিখলাম এটাই যে এতদল, এত আন্দোলন,
এত মত, এত লাইন থাকা স্বত্ত্বেও একের পর এক শ্রমিক আন্দোলন ব্যর্থ, জনগণ হতাশ, আন্দোলন
কোনো দিশা দিতে পারছে না, নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না আর হলেও তারা বিশ্বাসঘাতকতা করছে।
এমতাবস্থায় কয়েকটি মূল বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিতঃ
১)
বর্তমানে বিশ্বে প্রধান দ্বন্দ্বগুলি কি?
২)
দেশ স্থান বিভেদে ধর্মের ভূমিকা কি?
৩)
ঐক্য রক্ষা করা যায় কিভাবে?
৪)
নয়া-উদারবাদ কি শুধুই একটি নীতি নাকি এটি সাম্রাজ্যবাদী যুগের পর্ব?
৫)
পরিবেশ দূষণের সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উৎপাদন কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন জরুরী কি?
৬)
আদৌ ভারতে সামন্ততন্ত্র উৎপাদনে কোনও প্রভাব ফেলে?
৭) পুঁজির গতিবিধি পুঁজি রপ্তানির সাথে নতুন কোনো পথ নিয়েছে?
এই
সমস্ত আলোচনা পূর্বের সমস্ত আলোচনাকে ব্যাকগ্রাউন্ড-এ রেখে করতে হবে। অন্তহীন আলোচনা
নয়; কাজের মাধ্যমে চর্চা।
সম্পূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশ (যার অধিকাংশ একসময় ব্রিটিশ শাসিত ‘অবিভক্ত
ভারত’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল) জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু করবার মূল কাজটি করেছিল
ভারতীয়রা। আরও ভালো ভাবে বললে সিপিআই। ভূটান বাদে সবকটা দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন
সিপিআই-এর সদস্যরা অথবা সরাসরি সিপিআই-এর সম্মেলন থেকে বা সিপিআই-এর সাথে সম্পর্ক
রেখে তৈরি হয়েছে। শুধু শ্রীলঙ্কাতে ট্রটস্কিপন্থীরা আন্দোলন শুরু করেছিল এবং তাতে
সম্পূর্ণভাবে ভারতের ট্রটস্কি সমর্থক ও দলগুলোর সক্রিয় সাহায্য ছিল।
এবার উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা শুরু করা যাকঃ
শ্রীলঙ্কা
১৯৩৫ সালে
ট্রটস্কিপন্থী ‘লঙ্কা সমসমাজম পার্টি’ [LSSP] তৈরি হয়। তারাই শ্রীলঙ্কায় বা সিংহলে
কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। ১৯৪২ সালে তাদের সাথে কিছু ভারতীয় দল মিলে
(ভারতের ট্রটস্কিপন্থী দলের অংশ দেখুন) তৈরি করে ‘বলশেভিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া, সিলন
অ্যান্ড বার্মা’। খুব বেশিদিন টেকেনি। তারপরই ‘লঙ্কা সমসমাজম পার্টি’-এ ভাঙ্গন
দেখা দেয়। তৈরি হয় LSSP (Alternative Group)। এরপর ১৯৬৪ সালে আবার ভাঙ্গন। তৈরি হয়
LSSP (Revolutionary) নামে আর একটি দল যারা চতুর্থ আন্তর্জাতিক-এর কোনও একটি মঞ্চে
ছিল।
১৯৬৮ সালে LSSP থেকে তৈরি হয় ‘রেভেলিউশনারি ওয়ার্কার্স পার্টি
(শ্রীলঙ্কা)’। ১৯৭০-৭৯ সাল পর্যন্ত তারা ‘স্পারটাসিস্ট টেন্ডেন্সি’ নামক একটি
আন্তর্জাতিক ট্রটস্কিপন্থী
সংগঠনে ছিল। ১৯৮১ সালে তাদের মধ্যে থেকে তৈরি হয় ‘রেভেলিউশনারি ওয়ার্কার্স গ্রুপ’
যারা IWCC [International Worker’s Co-ordination Committee] নামে একটি আন্তর্জাতিক
ট্রটস্কিপন্থী
গোষ্ঠী তৈরি হওয়ার মূল উদ্যোক্তা, বিশেষত যখন ‘স্পারটাসিস্ট টেন্ডেন্সি’ ভাঙছে
তখন। এখন খুবই দুর্বল।
১৯৭৬ সাল থেকে LSSP থেকে নবসমসমাজম পার্টি তৈরি করেন সিরিতুঙ্গে
জয়সূর্য এবং বাসুদেব নানাকাকারা। তাঁরা CWI-তে কিছু দিন ছিলেন। তারপর স্তালিনের
বিষয়ে মতপার্থক্য হওয়ায় ভেঙ্গে বেরিয়ে যান। তাঁদের একটা অংশ USP [United
Socialist Party (Sri Lanka)]-এর সাথে ১৯৯১ সাল থেকে কাজ করে। বাকিরা কোনও এক
চতুর্থ আন্তর্জাতিকের গোষ্ঠীর সদস্য। USP থেকে SPSL [Socialist Party of Sri
Lanka] তৈরি হয় ২০০৬ সালে। তারা পঞ্চম আন্তর্জাতিকের সদস্য। তৈরি হয়েছিল ১৯৭০
সালে। তারা CWI-এর সদস্য ছিল। এছাড়া LSSP (R) থেকে SEP [Socialist Equality Party]
তৈরি হয় যারা IFCI [International Committee of Fourth International]-এ আছে এবং
তারা গেরি হেলির সমর্থক।
১৯৪৫ সালে LSSP থেকে ‘বিপ্লবী সমসমাজ পার্টি’ [BSP] তৈরি হয়, ১৯৫০ সালে
যারা আবার LSSP-তে মিশে যায়। তাই নিয়ে সমস্যা হয় ও একটি অংশ ভেঙ্গে বেরিয়ে
‘বিপ্লবী লঙ্কা সমসমাজ পার্টি’ (BLSSP) তৈরি করে। পরে আবার ১৯৮২ সালে SLSSP [Sri
Lanka Sama Samaj Party] তৈরি হয় যারা ১৯৮৩ সালে বন্দরনায়েকের SLFP [Sri Lanka
Freedom Party]-তে মিশে যায়।
১৯৪৩ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারার ‘কমিউনিস্ট পার্টি সিলোন’ তৈরি হয়।
তারা ১৯৪৮ সালে নাম নেয় CPSL [Communist Party of Sri Lanka]। ১৯৬৪ সালে
মস্কো-পিকিং বিতর্ক (১২ পার্টি-৬৪ পার্টি দলিল) দলে ভাঙ্গন আনে ও তৈরি হয় Ceylon
CP (Marxist)। পরের বছরই মাও-ৎসে-তুং-এর ধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয় ‘জনতা
বিমুখি পেরামুন’ [JVP]। ’৭০ ও ’৮০-র দশকে দুবার তারা বিপ্লবের প্রচেষ্টা চালায় এবং
দুবারই ব্যর্থ হয়। তাদের ব্যর্থতাই শ্রীলঙ্কায় LTTE [Liberation Tamil Tigers Elam]-এর
উত্থান প্রশস্ত করে। তারা বর্তমানে পুরোপুরি পার্লামেন্টী দল। ২০১২ সালে এই দল
ভেঙ্গে তৈরি হয়েছে FSP (ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টি)।
ভূটান
বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র রাজতান্ত্রিক দেশ ভূটান কমিউনিস্ট
আন্দোলনের সবথেকে নবীনতম সদস্যদের মধ্যে অন্যতম। ২০০৩ সালে এখানে প্রথম কমিউনিস্ট
পার্টি তৈরি হয়, যার নাম CPB (MLM) [Communist Party of Bhutan
(Marxist-Leninist-Maoist)]। এদের অনুপ্রেরনা হল (এবং বন্ধুপার্টিও বটে) নেপালের
মাওবাদীরা। এই নিষিদ্ধ দলের সশস্ত্র বাহিনীও, আছে যার নাম ‘ভূটান টাইগার্স ফোর্স’।
উল্লেখ্য, ভূটানে অতিসম্প্রতি সীমিত গণতন্ত্র চালু হয়েছে।
মায়ানমার
বার্মায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান হরিনারায়ণ ঘোষাল। সাথে ছিলেন ডঃ অমর নাথ। CPB [Communist Party of
Burma] তৈরি হয় ১৯৩৯ সালে। দলটি গুপ্ত দল ছিল। মার্কিন কমিউনিস্টদের বিচ্যুতি দ্বারা
প্রভাবিত হয়ে এই দল শোধনবাদের দিকে আকৃষ্ট হলে ১৯৪৬ সালে দল ভাঙ্গে ও তৈরি হয় ‘রেড ফ্ল্যাগ কমিউনিস্ট
পার্টি’। তখন
হরিনারায়ণ ঘোষাল দলের বিচ্যুতি ঠেকাতে “ঘোষাল থিসিস”-এর অবতারণা
করেন। কিন্তু
এরপর দলে অতিবাম ঝোঁক দেখা যায়। ১৯৬৫ সালেই ঘোষালের পল্যিটব্যুরোতে
ভোটাধিকার চলে যায়। ১৯৬৮
সালে পার্টি তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। অন্যদিকে অমর নাথ মিলিটারি হাসপাতাল
আক্রমণে মারা যান। ঘোষাল
CPI-এর
সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। CPB, BSP (Burma Socialist Party)
এবং বার্মা ন্যাশনাল আর্মি মিলে ১৯৪৫ সালে তৈরি করে Anti-Fascist People’s Freedom
League (AFPFL) যা দেশের স্বাধীনতা লাভে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৫৮ সালে
AFPFL-এ ভাঙন ধরে। ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। সাম্রাজ্যবাদের দালালী করতে
থাকে সামরিক সরকার এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন দমন করতে শুরু করে। CPB ১৯৭৮ সালে বোধহয় উঠে
যায়। অনেকে
দাবী করেন যে তাঁরা ১৯৯১ সালেও আরাকান অঞ্চলে ছিলেন। যাই হোক, এখন সে দেশে কমিউনিস্ট
পার্টি নিষিদ্ধ।
পাকিস্তান
১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর তাসখন্দে তৈরি হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৪৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ই
মার্চ কলকাতার মহম্মদ আলি পার্কে হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। এতে উপস্থিত ৭৯২ জন প্রতিনিধির
১৩০ জন ৬ই মার্চ বিশেষ অধিবেশনে বসে তৈরি করেন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (CPP)। সাধারণ সম্পাদক হন সাজ্জাদ জাহির। কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন সাজ্জাদ
জাহির, খোকা রায়, কৃষ্ণবিনোদ রায়, নেপাল
নাগ, মনি সিংহ, আতা মহম্মদ ইব্রাহিম,
জামালউদ্দিন বুখারি ও মনসুর হাবিবুল্লাহ। আর পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক কমিটির
সম্পাদক হন খোকা রায়। CPP-এর পলিটব্যুরোতে ছিলেন সাজ্জাদ জাহির, খোকা রায় ও কৃষ্ণবিনোদ
রায়।
প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টি করা পাকিস্তান-এ প্রায় অসম্ভব
ছিল। একসময়
আজাদ পাকিস্তান পার্টি নামে, কখনও মৌলানা ভাসানির ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নামে,
তারপর আওয়ামী লীগের ভেতরে কাজ করতে হয়েছে তাঁদের। একবার MKP (মজদুর কিষান পার্টি)-এর সাথে যুক্ত হয়ে CMKP [Communist Mazdoor Kisan Party] নামে কাজ করে
(MKP একবার অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়েছিল), অবশেষে
২০০২ সালে আবার CPP নামে কাজ শুরু করে। যদিও মৌলাবক্স আর খাদিম তাহিমের গোষ্ঠী
আলাদা হয়ে চলছে। CMKP
ছিল পুরোপুরি শোধনবাদ বিরোধী হার্ডলাইনার পার্টি।
১৯৭০ সালে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী আদর্শে তৈরি হয়েছিল
আওয়ামী তেহরীক। একই সালে ন্যাপ [National Awami Party] থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে
MKP তৈরি হয়েছিল। পরে
১৯৭৪ সালে আফজল খান দানেশ এখান থেকে বেরিয়ে তৈরি করেন PMKP [Pakistan Mazdoor
Kisan Party]। ১৯৯৯
সালে MKP দলে আওয়ামী জামুরি পার্টি, PSP [Pakistan Sarzameen Party], PNP [People’s National Party] মিশে যায়।
পাকিস্তানের ট্রটস্কিপন্থী দল হল লেবার পার্টি। এরা ১৯৮৬ থেকে ২০০২ অবধি ছিল। একটি অংশ ১৯৯১ সালে বেরিয়ে ‘জেদ্দোজুই ইনকিলাবী তেহরিক’ বলে একটি দল বানায়। বাকি অংশটি CWI [Committee for a Worker’s International]-তে ছিল। কিন্তু এনজিও ফান্ড নেওয়ার জন্য CWI এদের বহিষ্কার করে; একটি বড় অংশ তাই ‘International Marxist Tendency’ নামে আন্তর্জাতিক ট্রটস্কিপন্থী দলে আছে। আর বাকিরা ২০০৫ সাল থেকে ‘Re-unified Fourth International’-এ আছেন। ২০১২ সালে WPP [Workers Party Pakistan], লেবার পার্টি ও আওয়ামী পার্টি মিলে বানিয়েছে AWP [Awami Workers Party]। এদের মধ্যে প্রভূত পরিমাণে ‘মিলিট্যান্ট’ লোক আছেন; Pakistan People’s Party-তেও অনেক ট্রটস্কিপন্থীরা আছেন। CWI-এর সাথে যুক্ত আছে SMP [Socialist Movement Pakistan], যারা USP [United Socialist Party] এবং MWT [Marxist Worker’s Tendency] জুড়ে তৈরি হয়েছে।
আফগানিস্তান
আফগানিস্তানে মার্কসবাদকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া একটি গোপন কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসিজম-লেনিনিজম–মাওইজম (এমএলএম) মতবাদে চালিত। দলটি ২০০৪ সালে পাঁচটি এমএলএম পার্টির একীভূতকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলনের (RIM) সদস্য।
দলটির
ঘোষিত
লক্ষ্য
হল,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত করার জন্য একটি গণযুদ্ধ শুরু করা, দেশে একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আফগানিস্তানে প্রথম কমিউনিস্ট সংগঠন, প্রোগ্রেসিভ ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (PYO) গঠিত হয় ১ লা মে ১৯৬৫ সালে। সেখানে ছিল ছাত্র, শ্রমিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার কর্মী যারা রাজা জহির শাহের পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিদিন বিক্ষোভ এবং রাস্তায় লড়াই করত। আফগানিস্তানে বিপ্লবের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য প্রথম কমিউনিস্ট সংগঠন গঠনের জন্য বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীদের কয়েকটি বৃত্ত একত্রিত হয়েছিল। মাওবাদী নেতা আকরাম ইয়ারি PYO গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। PYO একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সংস্থা ছিল। PYO-র নেতারা শোলে জাভিদ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করত। শোলে জাভিদ নিজেকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক জার্নাল বলে দাবি করত, যা ব্যাপকভাবে এবং প্রকাশ্যে প্রচারিত হত। ১১টি ইস্যু প্রকাশের পর, শোলে জাভিদ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়। তৎকালীন সরকার আইন প্রয়োগকারী এবং ইসলামী মৌলবাদীদের শোলে জাওয়িদ সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। এই সরকারী কৌশলের ফলে যারা মাওবাদীদের সমর্থন করেছিল এবং যারা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ছিল তাদের মধ্যে সংঘর্ষ
হয়েছিল,
যার
ফলে
কাবুল
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হাতে বিশিষ্ট মাওবাদী ছাত্রনেতা সায়দাল সোখন্দ খুন হয়েছিল। গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার পরবর্তীতে আফগানিস্তানের ইসলামিক পার্টির নেতা হন, যিনি অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। সাউর বিপ্লবের
মাধ্যমে People’s Democratic Party of Afghanistan (PDPA) ১৯৭৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় এলে, তারা PYO-র নেতৃত্বাধীন মাওবাদী আন্দোলনকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। হাজার হাজার মাওবাদী এবং তাদের সহযোগীরা নিহত হয়। মাওবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বহীন অবশিষ্টাংশ PDPA শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য বেশ কয়েকটি সংগঠন তৈরি করে। এই সময়কালে, কিছু কমিউনিস্ট গোষ্ঠী ইসলামী মুজাহিদিন গোষ্ঠীগুলির সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছিল যাদের তারা পূর্বে বিরোধিতা করেছিল। কট্টর মাওবাদী সংগঠনগুলি মুজাহিদিনদের সাথে সহযোগিতা করে এবং ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে এই দলগুলি আফগানিস্তানের বিপ্লবী কমিউনিস্ট সেল (RCCA) গঠন করেছিল। RCCA অন্যদের সাথে মিলে আফগানিস্তানের বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন (RCOA) গঠন করে, যা ১৯৯১ সালে আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (CPA) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। CPA শোলে জাভিদকে নতুন করে প্রকাশ করে, যাতে তারা PYO-র প্রতিষ্ঠাতা আকরাম ইয়ারির পদাঙ্ক অনুসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ২০০১ সালে CPA মাওবাদী সংগঠনগুলিকে একক, ঐক্যবদ্ধ মাওবাদী দলে একত্র হওয়ার আহ্বান জানায়। সেই উদ্দেশ্যে CPA আরও চারটি মাওবাদী সংগঠনের সাথে আফগানিস্তানের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী আন্দোলনের ঐক্য কমিটি গঠন করে। কমিউনিস্ট (এমএলএম) আন্দোলনের ঐক্য কংগ্রেসের জন্য তিন বছরের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের পর ঐক্য কমিটি গঠিত হয়। ঐক্য কংগ্রেস ২০০১ সালের ১লা মে শেষ হয় এবং আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট (মাওবাদী) দল গঠিত হয়।
এরা বর্তমানে তালিবান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে।
PDPA একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক দল ছিল আফগানিস্তানে। ১লা জানুয়ারী ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। পার্টির চারজন সদস্য সে বছরের সংসদ নির্বাচনে আসন জিতেছিল। দলটি কট্টর খলক এবং মধ্যপন্থী পরচম গোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত ছিল, যারা উভয়েই নিজেকে ‘সত্যিকারের’ PDPA বলে দাবী
করত। দলটি একে বামপন্থী, তায় লেনিনবাদী - এতদসত্ত্বেও, দলটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজেকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে অভিহিত করেনি, বরং ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক’ বা ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলে উল্লেখ করেছিল। দলটি আফগানিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ দাউদ খানকে ১৯৭৩ সালে বাদশাহ মোহাম্মদ জহির শাহকে উৎখাত করতে এবং আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিল। প্রাথমিকভাবে PDPA সরকারের মন্ত্রিসভা অত্যন্ত প্রতিনিধিত্বশীল ছিল, কিন্তু পরে রাষ্ট্রপতির সাথে সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় অনেককে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে PDPA, আফগান ন্যাশনাল আর্মির সদস্যদের সাহায্যে দাউদ খানের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে, যা সৌর বিপ্লব নামে পরিচিত। নুর মুহাম্মদ তারিকির নেতৃত্বে PDPA আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে যা ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চলেছিল। ১৯৯০ সালে মহম্মদ নজিবুল্লার নেতৃত্বে পার্টির নাম পরিবর্তন করে হোমল্যান্ড পার্টি করা হয় এবং পার্টির কমিউনিস্ট প্রতীক ও নীতিমালার অনেক কিছু পরিবর্তন বা অপসারণ করা হয়। দেশ মুজাহিদিন বিদ্রোহীদের দখলের পর ১৯৯২ পর্যন্ত স্থায়ী হয়; PDPA দ্রবীভূত হয়েছে, কিছু কর্মকর্তা নতুন সরকারে যোগদান করে, কিছু মিলিটারীতে যোগ দেয় এবং অন্যরা দেশ
ছেড়ে চলে যায়। নুর মহম্মদ তারিকি একজন আফগান সাংবাদিক হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিল। ১৯৬৫ সালের ১লা জানুয়ারি তারিকি বাব্রক করমলের সাথে ‘ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টি অফ আফগানিস্তান’ প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে দলটি ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক টেন্ডেন্সি’ নামে চলছিল। সে সময় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং রাজতন্ত্রবিরোধী দলগুলি অবৈধ ছিল। ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান’ (PDPA) আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬৫ সালের ১লা জানুয়ারি আফগানিস্তানের সমাজতান্ত্রিক দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ঐক্য কংগ্রেসে গঠিত হয়। ২৭ জন কাবুলে তারিকির বাড়িতে জড়ো হয়ে তারিকিকে প্রথম দলের মহাসচীব এবং করমলকে ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নির্বাচিত করে এবং পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি (যাকে পলিটব্যুরো বলা হয়) নির্বাচন করে। তারিকিকে সেই বছরের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মস্কোতে আমন্ত্রণ জানায়। PDPA সেই সময় আফগান সমাজে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে পরিচিত ছিল। PDPA তার তিনজন সদস্যকে পার্লামেন্টে আনতে সক্ষম হয় আফগান ইতিহাসের প্রথম অবাধ নির্বাচনে; এই তিনজন সংসদ সদস্য ছিলেন করমল, অনাহিতা রাতেবজাদ ও নুর আহমেদ নূর। ১৯৬৭ সালে দলটি বিভিন্ন রাজনৈতিক উপদলে বিভক্ত হয়েছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হল খলক ও পরচম। এছাড়াও ছিল সেতামি মিলি এবং গ্রোহী কার।
এই
নতুন
বিভাগগুলি তাত্ত্বিক এবং অর্থনৈতিক কারণে শুরু হয়েছিল। খলক সমর্থকদের অধিকাংশ গ্রামীণ অঞ্চলের পশতুন জাতি থেকে এসেছিল আর
পরচম সমর্থকরা বেশিরভাগই শহুরে নাগরিকদের থেকে এসেছিল, যারা দেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারকে সমর্থন করেছিলেন। খলকরা পরচমদের বাদশাহ মোহাম্মদ জহির শাহের প্রতি আনুগত্যের অভিযোগ এনেছিল কারণ তাদের পত্রিকাকে রাজা
নিষিদ্ধ করেনি। পার্টির
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলস্বরূপ, আফগান পার্লামেন্টে পার্টির প্রতিনিধিত্ব চারটি থেকে মাত্র দুটি আসনে হ্রাস পায়। ১৯৭৩ সালে PDPA মহম্মদ দাউদ খানকে প্রায় রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে জহির শাহের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করতে সহায়তা করে। দাউদ ক্ষমতা দখলের পর প্রজাতান্ত্রিক আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা করে। অভ্যুত্থানের পর, লয়া জিরগা দাউদের নতুন সংবিধান অনুমোদন করে, ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। নতুন সংবিধান দাউদকে তার অনেক রাজনৈতিক মিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তারিকির নেতৃত্বাধীন খলক গোষ্ঠী এবং করমলের নেতৃত্বে পরচম গোষ্ঠীর পুনর্মিলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে, ঐক্যের উপর একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি অর্জিত হয় এবং জুলাই মাসে দুই গোষ্ঠী এক দশকে তাদের প্রথম যৌথ সম্মেলন করে। ১৯৬৭ সালে পার্টি বিভাজনের পর থেকে উভয় পক্ষই সোভিয়েত সরকারের সাথে যোগাযোগ করেছিল। উভয় দলই ধারাবাহিকভাবে সোভিয়েতপন্থী ছিল। তারিকি এবং করমল কাবুলে সোভিয়েত দূতাবাস এবং সেখানকার কর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখেছিল এবং সোভিয়েত মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (Glavnoye Razvedyvatel'noye
Upravleniye - GRU) খলকের সামরিক অফিসার নিয়োগে সহায়তা করেছিল।
খলক নেতৃত্বের সাথে মনোমালিন্যের জেরে পরচম নেতৃত্বকে
পার্টি পরিচালনার দায়িত্ব দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। মৌলবাদী শক্তিদের অভ্যুত্থান এবং
পরচমদের সাথেও মতবিরোধ শুরু হলে ‘সোভিয়েত-আফগান’ সমস্যা দেখা দেয়। সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তানে
প্রবেশ করে। ১৯৮৯-এর শেষের দিকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার সেই রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দেয় যা PDPA-কে এতদিন ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম করেছিল। ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান শাহনওয়াজ তনাই সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয় এবং তানাই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।
মধ্যপন্থী নজিবুল্লাহ তখন রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিল, তাই ১৯৯০ সালের জুন মাসে সে দলের নাম পরিবর্তন করে ‘হোমল্যান্ড পার্টি’। দলটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শকে বাদ দেয় যা পূর্বে PDPA দ্বারা গৃহীত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্রের জন্য সব ধরনের সমর্থন বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯২ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লার পদত্যাগের পর আফগান জেনারেল আবদুল রশিদ দস্তুমের আকস্মিক আনুগত্য পরিবর্তনের পর আফগানিস্তানে PDPA শাসনের পতন ঘটে।
১৯১৯ সাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগান রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। হাজার হাজার আফগান USSR-এর একাডেমিক ছাত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণার্থীদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন অধ্যয়ন করানো হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে প্রথম PDPA সাধারণ সম্পাদক নুর মুহাম্মদ তারিকি একসময়ে ভারতে কাজ করেছিল এবং পড়াশোনা করেছিল। সেখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের সাথে দেখা করেছিল এবং কমিউনিজম গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় PDPA সাধারণ সম্পাদক হাফিজুল্লাহ আমিন ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নের সময় তার বামপন্থী বিশ্বাসকে শক্তিশালী হতে দেখেছিল। তারিকি এবং বাব্রক করমল (তৃতীয়
PDPA সাধারণ সম্পাদক) ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত দূতাবাসের সাথে ঘন ঘন যোগাযোগ করত। ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কমপক্ষে ১৯৮৪ পর্যন্ত, PDPA নিজেদেরকে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক’ ('কমিউনিস্ট' নয়) লেবেল করেছে; যাই হোক, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গিতে, PDPA স্পষ্টভাবে সোভিয়েতপন্থী ছিল। ১৯৬৫ সালের গোপন দলীয় সংবিধানে "আফগান-সোভিয়েত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালী করার" কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের পার্টির ইতিহাস বলেছে: দলটি সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ এবং তার মিত্র মাওবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে এবং তাদের ভাই দলগুলোর সাথে লড়াই করছে, যাদের মধ্যে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনবাদী দল। ১৯৭৮ সালের একটি দলীয় লিফলেটে, PDPA নিজেকে "শ্রমিক শ্রেণীর ভ্যানগার্ড" এবং সাধারণ সম্পাদক তারিকিকে "অভিজ্ঞ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী" হিসেবে বর্ণনা করেছে। যদিও ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে PDPA-র অভ্যুত্থানের পর, PDPA সাধারণ সম্পাদক তারিকি বলেছিল যে PDPA জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবী কিন্তু "কমিউনিস্ট" নয় এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যে ইসলামের প্রতি অঙ্গীকার ঘোষণা করছে! একবার ক্ষমতায় আসার পর, এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে PDPA শহুরে বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং আফগানিস্তানের অত্যধিক গ্রামীণ ও ইসলামী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকৃত সামাজিক ভিত্তির অভাব ছিল। দলটি ভূমি পুনর্বণ্টন থেকে শুরু করে মহিলাদের মুক্তি ও শিক্ষা পর্যন্ত একটি কর্মসূচী চালু করে, যা প্রচলিত রীতিনীতি, ধর্মীয় আইন এবং কাবুল ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য লঙ্ঘন করে। মৌলবাদী সংস্কার কর্মসূচী, শ্রেণী-সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বক্তব্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্ব চুক্তিতে স্বাক্ষর, দেশে সোভিয়েত উপদেষ্টাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং কিউবা ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের সমর্থন আন্তর্জাতিক মিডিয়া PDPA-কে 'কমিউনিস্ট' লেবেল লাগিয়ে দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ‘আফগানিস্তানের ওয়াতান পার্টি’ গঠিত হয় যা PDPA-এর নাম গ্রহণ
করার চেষ্টা করে ও ব্যর্থ হয়। ২০০৩ সালে ‘আফগানিস্তানের ন্যাশনাল ইউনাইটেড পার্টি’ তৈরি হয়েছে যারা পুরোনো ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান’ (PDPA) সদস্যদের একত্রিত করতে চায়।
‘আফগানিস্তান ন্যাশনাল পার্টি’ জার্মানির মিউনিখে তালেবান শাসনের সময় নির্বাসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং দেশের অভ্যন্তরে
এদের সদস্য রয়েছে, যদিও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে রেজিস্টার্ড
নয়। এটি নিজেকে নজিবুল্লার কমিউনিস্ট, ইসলামী সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক এবং আফগানিস্তানের নব্য ‘মার্ক্সিস্ট ডেমোক্রেটিক ওয়াতান পার্টি’-র ধারাবাহিকতা বলে মনে করে, যা ১৯৯০ সালে ক্ষমতাসীন ‘পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান’ (PDPA)-এর উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মিউনিখ সম্মেলন মহম্মদ জাসুরকে দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়। ২০০০ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ দলটির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।
২৮শে জুলাই, ২০১০-এ কাবুলের একটি হোটেলে চতুর্থ "ওয়াতান পার্টির আইনি পুনঃপ্রবর্তনের জন্য পরামর্শমূলক সমাবেশ"-এর একটি অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অতীতে, দলটি PDPA নামে রেজিস্ট্রেশন করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু রেজিস্ট্রেশন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
বাংলাদেশ
১৯৫৬ সালেই Communist Party of Pakistan (CPP)-এর থেকে আলাদা দল হয়
Communist Party of East Pakistan (CPEP)। তার আগে আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্রী দলের
হয়ে ২৭ জন কমিউনিস্ট প্রার্থী জয়ী হয়। যদিও CEP কিন্তু আলাদা হয়েও স্বাধীনতার কথা
বলেনি। National Awami Party (NAP) এই সময় সবথেকে কাছের দল ছিল কমিউনিস্টদের।
চূড়ান্ত অ-মার্কসীয় দল কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, প্রগতিশীল ও কমিউনিস্টদের বন্ধু।
১৯৬২-এর মতাদর্শগত বিতর্ক NAP ও CPEP-তে ভাঙ্গন ধরায়। ১৯৬৬-এ দল ভেঙ্গে যায়,
একদিকে মনি সিংহের মস্কোপন্থী দল CPEP। অপরদিকে সুখেন্দু দস্তিদার, ত্বহা ও আব্দুল
হকের দল CPEP (M) [Communist Party of East Pakistan (Marxist)]। এরা স্বাধীন
জনগণতান্ত্রিক পূর্বপাকিস্তান চায়। এরাই প্রথম স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবী
তোলে। কিছুদিন বাদে ভারতে যখন নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়, তখন CPEP (M) নাম বদলে
হয়ে যায় CPEP (ML)। এর লক্ষ্য হল ‘নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব’, যার মাধ্যমে
‘আধা-সামন্ততান্ত্রিক, আধা-ঔপনিবেশিক’ ব্যবস্থার উচ্ছেদ। ১৯৭০-এর মধ্যে বেশকিছু
ভাগ হয়। একদিকে সুখেন্দু-ত্বহা (যারা ১৯৬৬ সালে খালেদ-বশির নামে দলিল দিয়েছিল)-হকের
EPCP (ML) আর অন্যদিকে কাজি জাফর, রাশেদ খান মেনন, হায়দর আকবর রনোর দল ‘কমিউনিস্ট
বিপ্লবীদের পূর্ব-বাংলা সমন্বয় কমিটি’, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার ও আব্দুল মতিনের
CPEB (Communist Party of East Bengal) এবং সিরাজ শিকদারের ‘সর্বহারা পার্টি’। ইনি
মেননের সাথে ছিলেন। প্রথমে ‘মাও গবেষণা কেন্দ্র’, তারপর ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক
আন্দোলন’ (১৯৭০) থেকে পিবিএসপি (পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি) (১৯৭১) তৈরি হয়।
সিরাজ শিকদারকে সরকারি বাহিনী হত্যা করে (১৯৭৫)। স্বাধীনতার পর CPB (ML)
[Communist Party of Bangladesh (Marxist-Leninist)] নাম গ্রহণ। যদিও একটা অংশ ঐ
পুরনো নাম রেখে দেয় ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি ১৯৭৮ অবধি। এরা
সোভিয়েত বিরোধী ছিল। যদিও এদের সঙ্গ ছেড়ে দেয় শরদিন্দু দস্তিদার ও তৈরি করে
‘বাংলাদেশের মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টি’। বাকি অংশ পুরনো নামই রেখে দেয়। যথারীতি
PBSP ভাঙতে থাকে। প্রথমে একটি অংশ BCP (Bangladesh Communist Party) নাম নেয়। অন্য
অংশটি PBSP (CC) [PBSP (Central Committee)] নামে কাজ করে। পরে তার থেকে PBSP
(Maoist Bolshevik Recognition Movement) তৈরি হয়। এরা বর্তমানে COMPOSA-র সদস্য
এবং দ্বিতীয় দলটি RIM তুলে দেওয়ার পক্ষে অর্থাৎ ‘অবলোপবাদী’।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হতে ত্বহার দল CPB (ML) নাম নেয়। CPEB (যারা “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” তৈরি করে) নতুন নাম নেয় CPB (Communist Party of Bangladesh)। কিন্তু হকের দল PBCP (ML) নাম নিয়ে চলে। আর ওহিদুর রহমান আলাদা দল করে। কিন্তু মতিনও নতুন দল তৈরি করে আলাউদ্দিনের সাথে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার যুদ্ধকে ‘দুই বুর্জোয়া কুত্তার লড়াই’ বলে। ঐ ১৯৭১ সালেই কলকাতায় একটি কনফারেন্স হয়। কাজি জাফর আহমেদ-এর ছাত্র আন্দোলনের দল ‘কমিউনিস্ট সমন্বয় কেন্দ্র’, অমূল্য সেনের দল ‘কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র’ এবং নাসিম আলির ‘হাতিয়ার গ্রুপ’ (শেষ দুটি দল খতম লাইনের বিরোধিতা করে CPEB (ML) থেকে বেরিয়ে আসে) মিলে তৈরি করে BCP (L) [BCP (Leninist)]। CPI (M)-এর সাথে এদের ভালো সম্পর্ক ছিল। ১৯৮০ সালে এরা WPB (Worker’s Party of Bangladesh)-এ মিশে যায়। এই দলটি তৈরি হয় BCP (L), RCL (Revolutionary Communist League) এবং মজদুর পার্টি মিলে। ১৯৮৪ সালে এদের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দিলেও ১৯৯২ সালে জুড়ে যায়। ২০০৪ সালে এদের থেকে RWPB (Revolutionary Worker’s Party of Bangladesh) আলাদা হয়, যাদের মুখপাত্র ছিল ‘পিপলস ডেমক্রাসি’। ২০১০ সালে Worker’s Party (Reconstituted) of Bangladesh নামের ছোট গোষ্ঠী CPB-র সাথে জুড়ে যায়। উল্লেখ্য, CPB ১৯৭৩ সালে মতাদর্শগত মহাবিতর্কের পরিস্থিতিতে সোভিয়েত পথ অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের সাথে ‘গণঐক্য জোট’-এ অংশগ্রহণ করে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা BAKSAL গঠন করে মুজিবর রহমানের ‘রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র’-এর নামে অগণতান্ত্রিক বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্রে সামিল হয়। ১৯৭৫ সালে মুজিবরকে খুন করে সামরিক অভ্যুত্থান শুরু হলে, CPB ব্যাপক নিপীড়ন এবং ধরপাকড়ের সম্মুখীন হয়। ১৯৮৯-এ সোভিয়েত প্রভাবিত দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির পতন শুরু হলে, CPB দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়। একদল পার্টি তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করে এবং বাকিরা দল টিকিয়ে রাখার পক্ষে সওয়াল করে ১৯৯৩ সালে আলাদা কনফারেন্সের ডাক দেয়।
এছাড়া RIM-এর সাথে আছে অজয় দত্তের ‘বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (অজয় দত্ত)’
ও ‘বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (বদরুদ্দিন উমর)’, যাদের প্রকাশ্য মুখ ‘গণতান্ত্রিক
বিপ্লবী জোট’। এই দলগুলো গোপন ও বে-আইনি। আছে ত্বহার দল CPB (ML), যার নেতা দিলিপ
বরুয়া। এদের আরেক নাম ‘বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম এল)’। এছাড়া আছে ভারতের
SUCI(C) দলের বাংলাদেশী বন্ধু ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ বা জাসদ (১৯৭২ সালে তৈরি)।
আছে ১৯৮৯ সালে তৈরি ‘শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল’ যারা ভারতের RSP দলের বাংলাদেশী
বন্ধু। এছাড়া CPB (ML) Fourth International নামে ট্রটস্কিপন্থী দলও আছে, যাদের
কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চ নেই।
১৯৮০ সালে জাসদ থেকে
বেরিয়ে বাসদ বা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল গড়ে
ওঠে। ১৯৮৬ সালে কাজী
আরেফ আহমেদ ও হাসানুল
হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদ (ইনু) তৈরি হয়। ১৯৯৭ সালে জাসদ (রব), জাসদ (ইনু)
এবং বাসদ (মাহাবুব)-এর একাংশ মহিনুদ্দিন খান বাদলের নেতৃত্বে সংযুক্ত হয়। কিন্তু
পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যেকার গোষ্ঠী কোন্দল চলতে থেকেছে, যা বর্তমানেও অব্যাহত।
নেপাল
প্রায় সম্পূর্ণ পার্বত্য দেশ নেপালের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে:
(১) এখানে কিছুকাল আগে অবধি রাজতন্ত্র ছিল। বর্তমানে গণতন্ত্র।
(২) এখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে স্বীকৃত ছিল হিন্দুধর্ম, বর্তমানে ৮১.৩%
হিন্দু (২০১১ জনগণনা), যদিও দেশ ধর্মনিরপেক্ষ।
(৩) এখানকার সবদল বামপন্থী, একমাত্র দক্ষিণপন্থী দল হল নেপালি কংগ্রেস
যারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তুলনায় সেন্ট্রিস্ট।
(৪) এখানে জনগণের মূল লড়াই ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
যাই হোক, ভারতের মত নেপালেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেক ধারা এবং অনেক
পার্টি। তাত্ত্বিক বিরোধ যত না হয়েছে, তার থেকে বেশি নেতৃত্বের মধ্যে ঝামেলা, মতান্তর-মনান্তর
এবং পরিতৃপ্ত না হওয়ার জন্য পার্টি ভাগ হয়েছে। সংগ্রামী জনগণ তবুও লড়েছেন লাল
ঝাণ্ডার তলে, এখনও লড়ছেন, ভবিষ্যতেও লড়বেন।
১৯৪৯ সালের ২২শে এপ্রিল শ্যামবাজারে (কলকাতা) পুষ্পলাল শ্রেষ্ঠ,
নরবাহাদুর কর্মচারী, নিরঞ্জন গোবিন্দ বৈদ্য, নারায়ন বিলাস যোশী এবং মোতি দেবীরা
তৈরি করেন CPN (Communist Party of Nepal)। সাধারন সম্পাদক হন পুষ্পলাল শ্রেষ্ঠ। এই
পার্টির ঘোষণা প্রকাশ্যে করা হয় ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৯।
এর কিছুকাল আগে মনমোহন অধিকারী CPI-এর সদস্য হন। যাই হোক, ১৯৫১ সালেই
পতন ঘটে রানা শাহির। নেপালে শুরু হয় রাজার শাসন। এরপরই CPN নেপালি কংগ্রেসকে
ভারতের দালাল বলে ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালেই পার্টি নিষিদ্ধ হয়।
১৯৫৪ সালে প্রথম পার্টি কংগ্রেস। এখানেই শুরু হয় ‘শোধনবাদী’ ও
‘বিপ্লবী’-দের লড়াই। CPN-এর ঘোষিত লাইন-এর থেকে ‘দুর্বল’ লাইন আনেন কেশর জঙ্গ
রায়মাঝি। উনি রতনলাল ব্রাহ্মণের সহযোগী কিন্তু CIA-এর লোক বলে অভিযুক্ত।
এরপর ঘটে যায় একের পর ঘটনা। প্রথম নির্বাচন (১৯৫৮)। ১৯৬০-এ রায়মাঝি এর
পক্ষে ইতিবাচক বিবৃতি দেন মস্কো থেকে। এরপরই দ্বারভাঙ্গা প্লেনাম। একমাস ধরে চলে।
একদিকে রায়মাঝি, যারা সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অধীনে সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে,
অন্যদিকে পুষ্পলাল ছিলেন সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নেপালি কংগ্রেসের সাথে ঐক্যবদ্ধ
আন্দোলনের পক্ষে। আর ছিলেন মোহন বিক্রম সিং; তিনি দুটো লাইনেরই বিরোধিতা করেন।
তাঁর দাবী ছিল গণপরিষদ। আনন্দ বাহাদুর ছেত্রী ছদ্মনামে তাঁর নিবন্ধ বের হয়; নাম
‘গদ্দার পুষ্পলাল’। প্লেনামে মোহন ২৫টি ভোট পাণ, রায়মাঝি ১৯টি, পুষ্পলাল ৪টি। যদিও
মোহন বিক্রম সশস্ত্র অভ্যুত্থান চেয়েছিলেন যা দ্বিতীয় কংগ্রেসের গৃহীত লাইনের
বিরোধী, তবুও তৃতীয় কংগ্রেসে তাঁকে দলিল পেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়। যাই হোক, যখন
নেতৃত্বই প্লেনামের উল্টো পথে হাঁটছেন, তখন ১৯৬১ সালে ৫টি অঞ্চলের প্রতিনিধি
‘আন্তঃ অঞ্চল সমন্বয় কমিটি’ তৈরি করেন। যথারীতি রায়মাঝির নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয়
কমিটি এই কমিটিকে মানেনি।
এবার শুরু হয় ভাঙ্গন। ১৯৬২-তে পার্টি দু’ভাগে বিভক্ত হয়। একদিকে CPN
(রায়মাঝি)। তাঁরা ১৯৭৯ অবধি অটুট ছিলেন। কিন্তু বিষ্ণু বাহাদুর মানন্ধর রায়মাঝিকে
‘রাজতন্ত্রী’ বলে অভিযুক্ত করেন কারণ তিনি রাজসভার সদস্য ছিলেন। মানন্ধররা ১৯৭৯
সালে CPN (Democratic) তৈরি করেন যা পরে CPN (United)-এর সাথে মিশে যায়।
রায়মাঝির দলের নাম CPN (রায়মাঝি)। কিন্তু ১৯৮৩ সালে এখান থেকেও রায়মাঝিকে
বহিষ্কার করা হয় এবং তাঁরা নতুন নাম নেন CPN (ভারমা)। তাঁরা পরে CPN (United) দলে
মিশে যান। যদিও ভারমা নিজে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ২০০১ সালে CPN (UML) দলে মিশে
যান। আর রায়মাঝি নতুন দল তৈরি করেন CPN (মাতৃ সমূহ)। এখান থেকেও পরে রায়মাঝিকে
বহিষ্কার করা হয় ও দলের নতুন নাম নেয় ‘মাতৃসমূহ’। রায়মাঝি অন্য একটা দল তৈরি করেন
এবং ২০১২ সালে মারা যান।
অন্যদিকে CPN-এর যে অংশটি ১৯৬২ সালে রায়মাঝির দল থেকে আলাদা দল হয়ে
গিয়েছিল, তাদের নাম ছিল CPN (অমাত্য)। ১৯৬৮ সালে এখান থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে পুষ্পলাল
তৈরি করে CPN (পুষ্পলাল)। ১৯৭১ সালে মনমোহন তৈরি করেন তাঁর দল CPN (মনমোহন)।
অমাত্যর দল থেকেই তৈরি হয় CPN (চতুর্থ কনফারেন্স)। আজকের নেপালের মাওবাদীদের
বেশীরভাগই এখান থেকে বেরিয়েছে। CPN (পুষ্পলাল)-এর লাইন ছিল জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব।
তাঁদের হেডকোয়ার্টার ছিল বেনারস (ভারত)। এখান থেকেই ভেঙ্গে ১৯৭৬ সালে নারায়ণ মন
বিজু কাছে (রোহিত) তৈরি করেন ‘নেপাল ওয়ার্কার্স পিজ্যান্ট অর্গানাইজেশন’ বা NPWO।
মদনকুমার ভাণ্ডারী এখান থেকেই ভেঙ্গে তৈরি করেন মুক্তিমোর্চা সমূহ (১৯৭৭)।
মনমোহনের দল ১৯৮২ সালে তৈরি করে CPN (ইউনিটি কনফারেন্স) আর ১৯৮৬ সালে পুষ্পলালের
সাথে মিশে তৈরি করে CPN (মার্কসবাদী)। এই দুই নেতা অর্থাৎ পুষ্পলাল ও মনমোহন উভয়ের
সাথেই CPI (M)-এর ভালো সম্পর্ক ছিল। পরে যখন CPN (ML) ও CPN (M) মিলে CPN (UML)
[CPN (Unified Marxist Leninist)] বানায়, তখন একটা অংশ এতে রাজি না হয়ে CPN (M) বা
‘CPN (১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৯)’ নাম নিয়ে চলে। ২০০৫ সালে তাঁরা CPN (ইউনাইটেড) দলের
সাথে মিশে তৈরি করে CPN (ইউনাইটেড মার্কসিস্ট)। এই দল অর্থাৎ CPN (UM) ২০১৩ সালে CPN
(ইউনিফায়েড), CPN (সমাজবাদী), ‘মার্কসিস্ট কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল’, বিরোধী
গ্রুপ এবং ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স থট’রা মিলে নতুন করে একটা CPN তৈরি করেছে। তাঁদের মধ্যে
CPN (ইউনিফায়েড) ২০০৭ সালে তৈরি হয় যখন CPN (ML) নতুন করে CPN (UML)-তে যোগ দিলে
২০০২ সালে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয় ঋষি কাওলের গোষ্ঠী। তাঁদের সাথে যোগ দিয়েছিল CPN
(UC মশাল)-এর চিত্রবাহাদুর আলের ‘জনমোর্চা নেপাল’ গ্রুপ ও CPN (ML MC) [Communist
Party of Nepal (Marxist-Leninist-Maoist Centre)]-এর সীতারাম তামাং গ্রুপ।
২০০২ সালে এখন CPN (ML) নতুন করে UMLতে ঢুকল, তখন নৈমালী
(জয়/সুভাষ/দেবী/কাঞ্চন যার ছদ্মনাম ছিল) এই সংযুক্তির বিরোধিতা করে CPN (ML) নাম
চালু রাখেন। তারই এক অংশ ২০১০ সালে বেরিয়ে গিয়ে জগৎ বাহাদুর বোগাতির নেতৃত্বে তৈরি
করে CPN (ML সমাজবাদী)। এরাই CPN (UM) এ মিশে যায়। আর CPN (UC মশাল) ২০০২ সালে
তৈরি হয় CPN (UC) এবং CPN (মশাল)-এর একটা অংশ নিয়ে। বাকিরা CPN (M)-এ গিয়ে UCPN (M)
[Unified Communist Party of Nepal (Marxist)] তৈরি করে ২০০৯ সালে।
CPN (UC) [CPN (Unity Centre)] তৈরি হয়েছিল ১৯৯০ সালে CPN (মশাল)
অর্থাৎ কিরন (মোহন বৈদ্য)-এর দল, CPN (চতুর্থ কনফারেন্স), ‘প্রলেতারিয়ান
ওয়ার্কার্স অর্গানাইজেশন’ এবং CPN (জনমুখী) নিয়ে। এই দলে কিছুদিন বাবুরাম ভট্টরাই
(লালদুজ) ছিলেন।
১৯৮৩ সালে চতুর্থ কনফারেন্স থেকে ভেঙ্গে তৈরি হয়েছিল CPN (মসাল)। মনে
রাখতে হবে, মশাল আর মসাল আলাদা দল। এরাই রিম [Revolutionary Internationalist
Movement]-এর প্রতিষ্ঠা করা দলগুলির একটা। CPN (মসাল) ভেঙ্গে তৈরি হয় CPN (মসাল-মোহন
বিক্রম সিং) দল। ১৯৮৪ সালে তৈরি হয় CPN (মশাল) মানে মোহন বৈদ্য (কিরন)-এর দল। বাকিরা
CPN (মসাল COC) [CPN (মসাল Central Organisational Committee)] নামে কাজ করত। এখান
থেকেই বেরিয়ে বাবুরাম ভট্টরাই CPN (UC)-তে যোগ দেন। মোহন বৈদ্যের দল তৈরি হয়েছিল
তথাকথিত ‘পঞ্চম কংগ্রেস’ থেকে। তাঁরাই ১৯৯০ সালে আবার CPN (UC)-তে যোগ দেন।
১৯৭৪ সালে চতুর্থ কনফারেন্স তৈরি হয় মোহন বিক্রম অধিকারীর নেতৃত্বে।
এখান থেকেই ঝাপা জেলা (নকশাল বাড়ির লাগোয়া) কমিটি শুরু করে ‘খতম অভিযান’। তাঁরা
তৈরি করেন ‘অল নেপাল কমিউনিস্ট রেভলিউশনারি কো-অরডিনেশন কমিটি (এম এল)’ [ANCRCC
(ML)]। এই দলে যোগ দেয় ডাঙ্গা জেলা, ঝাপা জেলা, ‘নেপাল রেভলিউশনারি অর্গানাইজেশন
(এম এল)’। নেপাল রেভলিউশনারি অর্গানাইজেশন (এম এল) ১৯৭৩ সালে তৈরি হয়েছিল;
মাধবকুমার নেপাল প্রধান নেতা। ১৯৭৭ সালে এখানে যোগ দেয় ‘মুক্তি মোর্চা সমূহ’, যারা
মদন ভাণ্ডারী ও পুষ্পলালের দল থেকে বেরিয়ে তৈরি হয়েছিল। ১৯৭৮-এ যোগ দেয় ধানুকা
জেলা ও ‘রেভলিউশনারী কমিউনিস্ট অর্গানাইজেশন কমিটি’ (ভারত মোহন অধিকারীর এই দল ‘CPN
(ইস্টার্ন কোশী প্রভিন্সিয়াল কমিটি)’ নামে সমান্তরাল ভাবে কাজ করত)। তারা গণ্ডকী
জোনের ‘মার্কসিস্ট রেভলিউশনারি কমিউনিস্ট পার্টি’-র সাথে মিশে তৈরি হয়। তাঁরা RCOC
[Revolutionary Communist Organizing Committee] নাম নেওয়ার আগে তাঁদের নাম ছিল
রতো ঝাণ্ডা জেলা কমিটি)। এছাড়া ছিল ডাং জেলা কমিটি এবং CPN (UC) থেকে ভেঙ্গে বেরনো
সন্দেশ সমূহ। ANCRCC (ML)-এর থেকে বেরিয়ে তৈরি হয় CPN (ML)। নেতা মৈনালি। তাঁরা
বিনোদ মিশ্রের CPI (ML লিবারেশন)-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁদের পত্রিকার নাম
ছিল ‘বর্গ-সংঘর্ষ’ (ক্লাস স্ট্রাগল)। ১৯৮২ সালে দল ভাঙ্গে এবং ১৯৮৬ সালে আবার জোড়া
লাগে। অবশেষে ১৯৯১ সালে এরা CPN (M)-এর সাথে মিশে তৈরি করে CPN (UML)। CPN (UC)-তে
মিশে যাওয়া CPN (জনমুখী) ছিল রুপচন্দ্র বিস্তারের দল। একটা অংশ রামনারায়ণ-এর
নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে CPN (UC)-তে যোগ দিয়েছিল।
এবার আসি অন্য কিছু দল (ভাঙ্গন বলাই ভাল)-এর কথায়। ১৯৬৯ সালে CPN-এর
বাগমোতি জেলা (যারা সমান্তরাল ভাবে কাজ করতো) তাদের থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণদাস শ্রেষ্ঠ
১৯৮১ সালে তৈরি করেন CPN (MLM) [CPN (Marxist-Leninist-Maoist)]। এদের থেকে ভেঙ্গে
বেরিয়ে তৈরি হয় NCP (MLM) বা নেপালের সাম্যবাদী দল (MLM), যাদের নেতা ছিলেন
নন্দকুমার প্রসাদ। ২০০৫ সালে দুই দল আবার এক হয়ে তৈরি করে CPN (ML MC)। তারা ২০০৭
সালে CPN (মাওবাদী) দলে মিশে গেছে।
আগেই বলেছি নারায়ন মন বিজু কাছে (রোহিত) ১৯৭৫ সালে CPN (পুষ্পলাল) থেকে
বেরিয়ে তৈরি করেন NPWO। কখনও আত্ম-সমালোচনা না করা এই দল ১৯৮১ সালে দু’ভাগে ভাগ
হয়। এক ভাগের নাম NPWO (রোহিত)। আর এক দলের নাম NPWO (হরেরাম) যারা ১৯৮১তে পার্টি
কংগ্রেস করে। এরাও ভাগ হয় দু’ভাগে: NPWO (ডি পি সিং), যারা ১৯৮৬ সালে CPN (ML)-এ মিশে যায়। ডি পি সিং
অবশ্য আলাদা করে ‘নেপাল অ্যান্টি- ইম্পিরিয়ালিস্ট ফোরাম তৈরি’ করেন। অন্যদিকে
হরেরাম শর্মার গোষ্ঠী ‘নেপাল ফ্রন্ট’ নাম নেয়।
এদিকে ১৯৮৩ সালের মসাল দল ভেঙ্গে যায়। ১৯৯৯ সালে দীননাথ শর্মা আলাদা CPN
(মসাল) তৈরি করেন, যাদের ’৯৯ এর মসাল বলা উচিৎ। তাঁরা এখন মাওবাদীদের সাথে মিশে
গেছেন। অন্যদিকে CPN (UC মশাল) থেকে ভেঙ্গে ২০০৬ সালে তৈরি হয় CPN (মশাল) যারা
২০০৭-এ ৭ম কংগ্রেস করে (মানে CPN, CPN (চতুর্থ কনফারেন্স), CPN (মশাল) এবং CPN (UC
মশাল)-এর কংগ্রেস গুলো ধরে)। ইতিমধ্যে মশালের প্রকাশ্য ফ্রন্টগুলোও
ভাঙতে থাকে। ২০০২
সালে CPN (UC মশাল) জনমোর্চা তৈরি করে। এখান থেকে ২০০৬ সালে তৈরি হয় ‘রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা’
যেটা মোহনবিক্রমের মশালের অর্থাৎ ২০০৬-এর মশালের প্রকাশ্যে মুখ। ১৯৮০ সালে CPN (চতুর্থ কনফারেন্স)
থেকে ভেঙ্গে ঋষি দেবশর্মা (আজাদ) তৈরি করেন ‘রেবেল ইউনিটি সেন্টার’ (RUC), যারা ১৯৮১ সালে
CPN (ML)-এ মিশে যায়। ১৯৭৪ সালে CPN (পুষ্পলাল) দল থেকে থেকে বেরিয়ে তৈরি হয় ‘প্রলেতারিয়ান রেভলুসিওনারি
অর্গানাইজেশন নেপাল’ (PRON)। মুখপত্র ছিল ‘রত ঝাণ্ডা’। আদর্শ ছিল মাও ৎসে তুং-এর চিন্তাধারা। এরা মনমোহন–পুষ্পলাল-মোহনবিক্রমদের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীতন্ত্রের অভিযোগ করে। এরপরে এরা মাও এবং গৌতম বুদ্ধের হীনযান
মত মিশিয়ে বোধিসত্ব-মাওবাদ তত্ত্ব তৈরি করে। এবং এই তত্ত্ব দলীয় কর্মীদের বোঝাতে
না পেরে এক বছরে গুটিয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে বাকিরা NPWO-তে মিশে যায়। ১৯৯১ সালে CPN (ডেমোক্রেটিক),
CPN (বর্মা), CPN (অমাত্য)-রা মিলে প্রথম CPN (ইউনাইটেড)
তৈরি করে। তারা ২০০৫ সালে CPN (M)-এ যোগ দেয়
(UML থেকে আলাদা দলটি) এবং নতুন দল করে CPN (ইউনাইটেড মার্কসিস্ট) [CPN (UM)]। ইতিমধ্যে CPN (UML) থেকে ভেঙ্গে পুষ্পলালের স্ত্রী সাহানা প্রধান CPN (ML)
তৈরি করেন এবং পরে আবার UML-এ মিশে যান; যদিও মৈনালি নিজের দল রেখে দিয়েছিলেন। UML থেকে বাইরে থাকা CPN (M)-এ ২০০৬ সালে মিশে গিয়েছিল CPN (২০০৬), যারা CPN (UC মশাল) থেকে ভেঙ্গে বেরোছিল। তাদের সাধারন সম্পাদক ছিলেন বিজয়কুমার। পুষ্পলালের দল থেকে ১৯৮০-এর দশকে বররে অঞ্চল
থেকে ভেঙ্গে বেরিয়ে তৈরি হয় ‘বররে সংঘর্ষ সমূহ’। কখনো কখনো CPN (ML)-এ মিশেছে, আবার আলাদা হয়েছে। এছাড়া ছিল কমিউনিস্ট লীগ, যা অনেক আগে ১৯৪৬-এ তৈরি হয়েছিল। তাদের থেকে ভেঙ্গে বেরোয় ‘নেপাল রেড কমিউনিস্ট
পার্টি’ যারা CPI-এর পি সি যোশীর ঘনিষ্ঠ ছিল। নেতা ছিলেন গঙ্গলাল শ্রেষ্ঠ। ১৯৫৭ সালে তাঁরা CPN-এর দ্বিতীয় কংগ্রেসে
দু’জন
প্রতিনিধি পাঠান মিশে যাওয়ার জন্য কিন্তু অন্তরদ্বন্দ্ব দেখে সেই প্রসঙ্গই তোলেননি
এবং শেষদিন প্রতিনিধি পাঠাননি। পরে দলটা উঠে যায়। CPN (মূল পার্টি)-এর কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য শ্রেষ্ঠ মনমোহনের দল থেকে ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি বেরিয়ে গিয়ে ‘নেপাল কমিউনিস্ট লীগ’
তৈরি হয় এবং ১৯৯১ সালে CPI (UML)-এ মিশে যায়। তাছাড়া ছিল নেপালের সাম্যবাদী দল
(২০০৮-এ ভোটে দাঁড়ায়)। ছিল প্রলেতারিয়ান লীগ। ১৯৮৩ সালের রুপাল বিশ্বকর্মা, যিনি
NPWO থেকে ভেঙ্গে বেরোন, তাঁর সাথে তাঁরা যুক্ত হয়ে PWO [Peasant’s and Worker’s
Organisation] তৈরি করেন। ১৯৮০ সালে CPN (ML)-এর সাথে মিশে যায় একটি ছোট দল ‘রেভেলিউশনারি
কমিউনিস্ট অর্গানাইজেশন অফ নেপাল’। এছাড়াও ছিল ‘রেবেল মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট’,
MLRCP [Marxist Leninist Revolutionary Communist Party], MCPN [Marxist Communist
Party of Nepal], ইনডেপেন্ডন্ট থট (২০১৩
সালে যারা CPN-এ মিশেছে) প্রভৃতি দল যারা উঠে গেছে। মনমোহন অধিকারী ১৯৭১-এর
ডিসেম্বরে জেল থেকে বেরিয়ে তৈরি করেন ‘সেন্ট্রাল নিউক্লিয়াস’ যার লক্ষ্য ছিল ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থাকা কমিউনিস্টদের এক জায়গায় আনা। যদিও কাজটা পুরোপুরি সফল হয়নি।
যখন সোভিয়েতের পতন হচ্ছে, হাঙ্গেরি-পোল্যান্ড সহ পূর্ব-ইউরোপে পিছু
হঠছে কমিউনিস্ট আন্দোলন, তখন ভারত শুরু করছে নেপাল অবরোধ। যা খেপিয়ে তুলল নেপালের
জনগণকে, রাজার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তীব্র হল, বিরাট ‘গণআন্দোলন’-এর সূত্রপাত ঘটল।
আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা CPN (ML)-এর চতুর্থ কংগ্রেস হয় এভারেস্ট-এর সিরাহায়। ‘যৌথ গণআন্দোলন’-এর
লাইন উঠে আসে। সাধারণ সম্পাদক হন মদন ভান্ডারি। এরপরই ULF [United Left Front]
তৈরি হয়। এই জোটে ছিল CPN (ML), CPN (অমাত্য), CPN (চতুর্থ কনফারেন্স), CPN (M), CPN
(ভারমা), CPN (মানন্ধর), NPWO দলগুলি। চেয়ারম্যান হন সাহানা প্রধান। ‘মশাল’রা যুক্ত
না হয়ে তৈরি করে UNLM [United Nepal Left Morcha], সাথে অনেক ছোট দল। এরপরই CPN
(UC) তৈরি হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪, ‘গণতন্ত্র দিবসে’ নেপালে
ললিতপুর-ভক্তপুর-রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনই মস্কো ও পিকিংপন্থী দুই দলকে এক
করে দেয়। CPN (M) ও CPN (ML) একসাথে তৈরি করে CPN (UML)। রাজা নতি স্বীকার করে
নভেম্বর মাসে। অন্তর্বর্তী বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন সুনিশ্চিত হয়। ভোট হয়। CPN
(UC)-এর UPF [United People’s Front] ছিল প্রকাশ্য মুখ। তারা নির্বাচনে অবতীর্ণ
হয়।
ফল হয়ঃ
নেপালি কংগ্রেস - ১১০
CPN (UML) - ৬৯
UPF - ৯
এরপরই CPN (UC) প্রথম পার্টি কংগ্রেস করে ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা’-এর
লাইন নেয়।
১৯৯৪ সালে CPN (UC) দলে ভাঙ্গন দেখা দেয়। CPN (UC) দলে দুইটি গোষ্ঠীর
অস্ত্বিত্ব ছিল। একটি পুষ্পকমল দহল ওরফে প্রচণ্ড এবং অপরটি নির্মল লামা গ্রুপ।
নির্বাচন কমিশন লামার দলকে স্বীকৃতি দিলে প্রচণ্ড ভোট বয়কটের ডাক দেন এবং ১৯৯৫
সালে প্লেনাম করে দলের নাম রাখেন CPN (মাওবাদী)। যদিও UPF প্রধানমন্ত্রীর কাছে
দাবী সনদ পাঠায় (বাবুরামের ৪০ দফা দাবী) এবং নির্দিষ্ট সময়সীমা বেধে দেয়।
প্রধানমন্ত্রী তখন ভারত সফরে। নির্দিষ্ট সময় পেরনোর আগেই তাঁরা আঘাত হানেন। পার্টি
চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। CPN (UML) ততদিনে বহুদলীয় ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে।
মাওবাদীরা ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ‘দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের লাইন” নিয়ে চলত।
২০০১ থেকে মাওবাদীরা অন্য ভাবনা নেয়। ২০০৩, ২০০৫-এর প্লেনামগুলো থেকে
মাওবাদীরা আসতে আসতে পার্লামেন্টের পথ ধরে। ভুললে চলবে না, জনযুদ্ধ যুগের আগেও তাঁরা
কিছুদিন পার্লামেন্টে ছিলেন। আসলে ১৯৫১ ও ১৯৯১, দুইবারই নেপালের জনগণ রাজতন্ত্র
দ্বারা প্রতারিত হয়। খুব স্বাভবিকভাবেই রাজা জনযুদ্ধ চলাকালীন এবং তার আগেও চেষ্টা
করত যে রাজনৈতিক দলগুলিকে জায়গা করতে না দেওয়ার। এরপর জনযুদ্ধের যুগে তার একমাত্র
লক্ষ্য হয় মাওবাদী ও প্রথাগত দলগুলোকে দূরে রাখা। কিন্তু দুর্গম এলাকায় সমান্তরাল
প্রসাশন চালালেও প্রতিক্রিয়াশীল ও রাষ্ট্রের শক্তঘাঁটি প্রধান শহরগুলিতে গণভিত্তি
না থাকলে ক্ষমতাদখল করা যাবে না, এটা বুঝতে পেরেই মাওবাদীরা নির্বাচনের পথ নেয়।
ভারতের মাওবাদীরা একে ভালো চোখে দেখেনি। ২০০৮-০৯ সালে এদের একটা অংশ ভেঙ্গে তৈরি
হয় ‘জনতান্ত্রিক তরাই মুক্তি মোর্চা’।
বিশ্বজোড়া কোনও সেইরকম বিপ্লবী আন্দোলন বা নেতৃত্ব বা তাত্ত্বিক লাইন
না থাকার কারনে দুইটি ক্রমবর্ধমান শক্তি (একটি প্রসারনবাদী এবং অপরটি অর্থনৈতিক
দিক থেকে বৃহৎ হওয়ার দোরগোড়ায়) নেপালকে চিরে চ্যাপ্টা করবার অবস্থায় ছিল। ফলে
বুর্জোয়া গণতন্ত্রে যেতে বাধ্য হন বিপ্লবীরা। গণতন্ত্রের মোহ তাঁদের কিছুটা হলেও
অন্যপথে নিয়ে গেছে। প্রচণ্ড-এর তত্ত্ব “প্রচণ্ড পথ”-এর মধ্যে সেই বিচ্যুতির ছাপ
আছে। এই পথে একুশ শতকের গণতন্ত্রের নামে লেনিনের বা মাও ৎসে তুং-এর শিক্ষার উলট
কথার নজির আছে। আসলে পেরুর গঞ্জালোর ‘শাইনিং পাথ’-এর অনুকরণে (যদিও বিপুল পার্থক্য
আছে) এই মত প্রয়োজনের ভিত্তিতে তৈরি। তার তাত্ত্বিক ধাঁচ তৈরি করতে গেলে সমস্যা তো
হবেই। যদিও ‘মাওবাদী’দের মধ্যে নেপালেই একমাত্র তাঁরা ক্ষমতায় গেছেন। আর কোথাও এটা
হয়নি। মনে রাখতে হবে, চীনা পার্টি “মাওবাদ” শব্দ ব্যবহার করে না, ভারতে ‘নকশাল’রাও
করতো না, এমনকি চীনা পার্টির ৯ম কংগ্রেস (লিন বিয়াও কংগ্রেস)ও একে “মাওবাদ” বলেনি।
বলেছে মাও ৎসে তুং-এর চিন্তাধারা, যার ব্যাখ্যায় চীনা পার্টি বলেছে, চীনের বিশেষ পরিস্থিতিতে
মার্কস লেনিনের তত্ত্বের বা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ, অথচ এই ৯ম কংগ্রেসই
দুনিয়া জোড়া ‘মাওবাদ’-এর ভিত্তি। যাই হোক, ২০০৯ সালে CPN (মাওবাদী)-দের নাম হয় UCPN
(মাওবাদী) [Unified Communist Party of Nepal (Maoist)] এবং ২০১৬ সালে নাম নিয়েছে CPN (MC) [Communist Party of Nepal
(Maoist Centre)]। প্রচণ্ড-লালধোজ (বাবুরাম)-এর সংসদীয় “মোহ” দেখে (তাঁরা দুজনেই
কিছু সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন), মোহন বৈদ্য (কিরন) আলাদা দল করে সশস্ত্র
সংগ্রামের লাইনে আবার ফিরে গেছেন। নতুন দল CPN (Revolutionary Maoist)। আবার ২০১৪
সালে একই নামে পৃথক দল তৈরি করেছেন নেত্র বিক্রমচাঁদ। ওদিকে ২০০৮ সালে CPN (Maoist)
থাকার সময়ে Revolutionary Left Unity আলাদা হয়ে যায়। উল্লেখ্য, একটা আলাদা দল ২০০৯-২০১৩
অবধি CPN (Maoist) নামে কাজ চালাত। ওদিকে দুর্গাপ্রসাদ গাওয়ালির দলকে ২০০৮-এর ভোটে
লড়তে দেখা যায়। আর একটা ছোট দল আছে বিষ্ণুরাজ রায়িয়ালের। নাম CPN (ML Socialist)।
প্রতিক্রিয়াশিলের বিরুদ্ধে অন্য লড়াইয়ের রাস্তায় যাবে
পাকিস্তান, ভূটানে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটবে, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ভারতে মেহনতিরাজ
আসবে, মিয়ান্মারে জুন্টা-মিলিটারি-বুর্জোয়া আধিপত্য শেষ হবে, নেপালের সংগ্রামী
জনগণ আগামীদিনে দুনিয়াকে অন্যপথ দেখাবে - দুনিয়া জোড়া প্রতিক্রিয়াশীল-ফ্যাসিবাদী-বুর্জোয়া শক্তির পতন হবে, এই আশা নিয়ে এই
রচনা শেষ করলাম।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক,
সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ দীর্ঘজীবী হোক,
দুনিয়ার মজদুর এক হও।
টীকা
(১) মতাদর্শগত পার্থক্য আসলে আজকের দিনে বিচ্যুতিতে রূপান্তরিত হয়ে
গেছে, এগুলি
হল:
ক) নয়া-উদারবাদের পক্ষ
অবলম্বন
খ) পুঁজির উপর সামাজিক
নিয়ন্ত্রণের লক্ষ
গ) জাতিয়তাবাদী প্রবণতা
ঘ) সাংগঠনিক সংকীর্ণতা
ঙ) ব্যক্তি-সন্ত্রাসবাদ
চ) সংসদীয় পদ্ধতি নাকচ
জ) সংসদীয় পদের মোহ
ঝ) নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব
সর্বস্বতা
ঞ) বাস্তবতার নামে
তত্ত্ব নাকচ
ট) পপ্যুলারিজম
ঠ) ইন্টেলেকচুয়ালিজম
ড) সম্ভাব্যতার সীমায়
আটকে থাকা
(তথ্যসূত্রঃ
কনভেনশন খসড়া, পিপল’স ব্রিগেড, ২০১৬)
(২) জ্যোতি ভট্টাচার্য্য-এর 'রুশ বিপ্লবের প্রস্তুতি' প্রথম খন্ড দ্রষ্টব্য: ক্রুপস্কায়া
লিখেছেন-"One morning there was a
violent knocking at the front door, I knew full well that if the knock was
unusual it must be for us and hurried downstairs to open the door. It was
Trotsky and I led him into our room."
নাদেঝধা ক্রুপস্কয়া, 'মেমোয়ার্স অফ
লেনিন'
(লন্ডন, ১৯৭০) (পৃষ্ঠা-৫৯-৬০)
(৩) এ ব্যাপারে পড়ে দেখা উচিৎ: "Once again on the Trade Unions! The Current
Situation and the Mistakes of Trotsky and Bukharin"-Lenin (https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1921/jan/25.htm)
(৪) এম এন রায়ের সেই বিখ্যাত সমর্থন (কমিন্টার্নে) ট্রটস্কিকে তাড়ানোর
পক্ষে। (https://en.wikipedia.org/wiki/M._N._Roy)
(৫) যারা ট্রটস্কির মূল লাইনে পড়ে আছেন, তাঁদের ‘অর্থোডক্স’ বলা হয়।
(৬) যারা ট্রটস্কির মূল লাইনের বাইরে,
তাঁদের আনর্থোডক্স বা নব্য-ট্রটস্কিপন্থী বলা
হয়।
(৬ক) ভারত থেকে ছিল-Maoist Unity Centre, CPI (ML) Naxalbari, MCC [Maoist Communist Centre],
RCCI (MLM) [Revolutionary
Communist Centre (Marxist Leninist Maoist)], CPI (ML) PWG [People’s War Group], RCCI (ML)
ভুটান থেকে ছিল-BCP (MLM) [Communist Party of Bhutan (Marxist
Leninist Maoist)]
নেপাল থেকে ছিল-CPN (Maoist) (বর্তমানে মশাল
গ্রুপ)
শ্রীলঙ্কা থেকে ছিল–CCP (Maoist) [Ceylon Communist Party (Maoist)]
মায়ানমার থেকে ছিল- BCP [Communist Party of Bhutan]
বাংলাদেশ থেকে ছিল-পূর্ববাংলা
সর্বহারা পার্টি (কেন্দ্রিয় কমিটি) [PBSP (CC)], PBSP (ML) (Maoist Reorganisation Centre), PB সাম্যবাদী পার্টি
(ML),
PBCP
(ML)
লাল পতাকা, PBSP (Maoist Bolshevik Reorganisation Movement)।
(৭) রাইট অপোজিশন অর্থাৎ বুখারিন, রিয়ভ, ট্রটস্কিদের ফ্যাকশনকে এম এন রায় সমর্থন করেন। এম এন রায়ের উদ্যোগেই সুভাষচন্দ্র বসুকে
কংগ্রেসের সভাপতি করা হয়। তিনিই সভাপতি নির্বাচনে সুভাষকে জিতিয়েছিলেন। পরে তাদের
মধ্যে মতবিরোধ হয়। একে অনেকে B. Wolfe ও J. Hovestone-এর মধ্যেকার বিভাজনের সাথে তুলনা করেন। ১৯৩৯ সালের মধ্যে
এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
(৭ক) সেই ৩২ জন জাতীয় পরিষদ
সদস্য ছিলেনঃ
পি সুন্দরাইয়া, এম বাসবপুন্নাইয়া, টি নাগি রেড্ডী, এম হনুমন্ত রাও, ডি ভি রাও, এন প্রসাদ রাও, জি
বঙ্গাপ্পায়িয়া, ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদ, এ কে গোপালন, এ ভি কুনহাম্বু, সি এইচ কনরন, ই কে নায়নার, ভি এস অচ্যুতানন্দন,
ই কে ইম্বিচিবাভা, প্রমোদ দাসগুপ্ত, মুজফফর আহমেদ, জ্যোতি বসু, আব্দুল হালিম, হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার, সরোজ মুখার্জী, পি রামমূর্তি, এম আর ভেঙ্কটরমন, এন শঙ্করাইয়া, ই কে রামানি, হরকিষান সিং সুরজিত, জগজিত সিং লায়লাপুরি, ডি এস তাপাইলা, ভাগ সিং, শিউ কুমার মিশ্র, আর এন
উপাধ্যায়, মোহন পুন্মিয়া এবং আর পি শ্রফ (জম্মুর নেতা, পরে
নকশাল ও হোজাপন্থী)।
(৮) আসলে তেনালি কনভেনশনের পরেই কিছু সমস্যা হয় পার্টি কংগ্রেসের
আগের সম্মেলনগুলি থেকে। শৈবাল মিত্র ও আজিজুল হক বাসবপুন্নাইয়ার দলিলের
বিরোধিতা করে কলকাতা জেলা ছাত্র সম্মেলনে, যার পরিণতি হল সুশীতল রায়চৌধুরীর
‘অসংসদীয় পথে ক্ষমতা দখল’-এর প্রস্তাব গ্রহণ,'সংসদ ও অসংসদীয় পথে ক্ষমতা দখলের
প্রস্তাব' নামে।
এরপরেই ১৯৬৮ সালে বর্ধমান প্লেনামের আগে ১৬ জন মিলে তৈরি করেছিলেন AICCCR [All India Co-ordination Committee of Communist
Revolutionaries] of CPI (M)। তাঁরা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের শিবকুমার মিশ্র (উত্তরপ্রদেশ CPI (M) রাজ্য সম্পাদক
ও কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য; পরে CGPI
[Communist Ghadar Party of India]-তে যোগ দেন অর্থাৎ
হোজাপন্থী হয়ে যান; HRSA
[Hindusthan Socialist Republican Association]-এর
এই সদস্যের বিখ্যাত রচনা হল-
"কাকোরি সে নকশালবাড়ি") ও এস এন তিওয়ারী, বিহারের
সত্যনারায়ণ সিং ও লক্ষণ সিং, মাদ্রাজের আপ্পু ও শম্ভুনাথন, মহীশূরের বাবু, কেরালার কুন্নীকাল নারায়ণ ও ফিলিপ প্রসাদ, উড়িষ্যার রাধামোহন দাস এবং পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, সরোজ দত্ত, অসিত সেন, প্রমোদ সেনগুপ্ত ও পরিমল দাশগুপ্ত। বর্ধমান প্লেনামের পর এই সংগঠনের নাম হয় AICCCR। পরিমল দাশগুপ্ত ১৯৬৮ সালের অগাস্ট মাসে দল ছেড়ে বেরিয়ে যান (উনি
CPI ও CPI (M) দলে থাকার সময়েও আলাদা গ্রুপ বজায় রেখে চলতেন, প্রমোদ দাসগুপ্ত এক
সময় ‘দেশহিতৈষী’-তে তাই লিখেছিলেন)। ২২শে এপ্রিল ১৯৬৯-এ তৈরি হয় CPI (ML)।
(৯) বর্ধমান প্লেনামের পর যে দলিলকে ভিত্তি করে এই ভাঙন সম্ভব হয়
তা নিয়ে পুরোপুরিভাবে একমত হননি সবাই। ফলে অন্ধ্রের CPI (M) বিধায়ক টি নাগী রেড্ডী, দেবুলাপল্লী ভেঙ্কটেশ্বর রাও, চন্দ্রপুল্লা
রেড্ডী, কোলা
বেঙ্কাইয়া AICCCR-এ যোগ না দিয়ে APCCCR [Andhra Pradesh Co-ordination Committee of Communist
Revolutionaries] তৈরি করেন। তাঁদের মূল থিসিস তৈরি
করেন ভেঙ্কটেশ্বর রাও এবং তার নাম হয় 'অন্ধ্র থিসিস'।
(১০) APCCCR থেকে
বেরিয়ে এসে যখন UCCRI (ML) [Unity Conference of Communist
Revolutionaries of India (ML)] তৈরি হয়, তখন
তাদের সাথে যোগ দেয় AICCCR থেকে বেরিয়ে আসা PCRC, যারা ছিল AICCCR-এর ভাতিন্দা
জেলা কমিটি। এর মূল ভিত্তি ছিল ওয়াহিকার ইউনিয়ন। এ ছাড়া ছিল অসিত সেনের AICCCR থেকে বিচ্ছিন্ন
হওয়া RCUC
(ML) [Revolutionary Communist Unity
Centre (ML)]-এর নর্দান জোন, যার নেতা মণি গুহ, West Bengal Communist Unity Centre এবং West Bengal Co-ordination Committee of Revolutionaries।
(১১) সত্যনারায়ণ সিং ১৯৭০ সালে 'মুশাহারীর শিক্ষা' নামে এক দলিলে খতম লাইনের বিরোধিতা করেন এবং সমান্তরাল কেন্দ্রিয় কমিটি বানিয়ে চারু মজুমদারকে পার্টি থেকে তাড়িয়ে দেন। চারু মজুমদারকে মূলত তিনি ট্রটস্কিপন্থী অ্যাডভেঞ্চারিস্ট বলে সমালোচনা করেন। ১৯৭১ সালে APCCCR থেকে বেরিয়ে আসা APCCCR (চন্দ্রপুল্লা গোষ্ঠী) ১৯৭৫-এ তাঁর সাথে যোগ দেয়। সত্যনারায়ণ সিং দলের নাম দেন PCC CPI (ML) [Provisional Central Committee CPI (ML)], তাঁরা চীনের 'Gang of Four'-এর বিরোধিতা করেন এবং হুয়া-গুয়া-ফেং-কে সমর্থন করেন। তাঁরা পরে জয়প্রকাশ নারায়ণকেও সমর্থন করেন ও ভোটে দাঁড়ান।
(১২) CPI (ML) TND: Communist
Party of India (Marxist -Leninist) Towards New Democracy
(১৩) সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে সংগঠন আছে।
(১৪) বর্তমানে বিলুপ্ত
Porar somoy ebong porar por Bangla ebong English er alphabet bhule gelam !! Ato bibhokto dol somosti die ar jai kora jak , biplob kora jaye na bole amar dharona !!
ReplyDeleteবহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট দল যত ভাগেই বিভক্ত হোক না কেন, ভারতের ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটি দলেরই লক্ষ্য ছিল, ভারতে আধাসামন্ততান্ত্রিক, আধা পুঁজিবাদী সমাজকে দূরে সরিয়ে প্রকৃত শ্রমিককৃষক আন্দোলন গড়ে সামাজিক সংস্কার করা। ব্যাপকতম দরিদ্র মানুষের রুটিরুজির লড়াইকে মান্যতা দিয়ে তাদের পাশে থেকে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে চলা। বলাই বাহুল্য, এখন এদেশে মার্ক্সবাদী দলগুলির প্রায় অনেকেই এ কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েছে।নানা প্রলোভন, বিভ্রান্তি তাদের মধ্যে এসে পড়ায় প্রকৃত শত্রুকে চিহ্ণিত করা তাদের অধিকাংশেরই সম্ভব হচ্ছে না।অনেক দলই এখন বুর্জোয়াজমিদারশ্রেণির দলগুলোর সংগে সমঝোতা করে চলছে এবং জনগণকে বিভ্রান্তকরছে। তাই সামাজিক সংস্কারএর কাজে যে কমিউনিস্ট দল যত বেশি মানুষের লড়াইকে মান্যতা দেবে, তারাই নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। CPI(M) দলের মধ্যে অবশ্যই এই লড়াইয়ে অগ্রণী ভূমিকা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এবং একাজে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ভূমিকাও লক্ষণীয়।
ReplyDelete