বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গে কিছু টেক-হোম মেসেজ

অনন্যা দেব


১. প্রথম পাওয়া খবর অনুযায়ী, ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশে দুর্গাপুজো চলাকালীন ১২ই অক্টোবর রাত্রে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার একটি দুর্গা মন্ডপে সম্ভাব্য হনুমান বিগ্রহের পায়ের নীচে কোরান শরীফ রেখে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়। পরের দিন অর্থাৎ ১৩ই অক্টোবর সারা বাংলাদেশ জুড়ে বিভিন্ন দুর্গা বিগ্রহ এবং হিন্দু মন্দিরের উপর আক্রমণ চলতে থাকে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে বলা উচিৎ, “ধর্মীয় মৌলবাদ নিপাত যাক; সংখ্যাগরিষ্ঠের মৌলবাদ নিপাত যাক”

২. ঘটনাটি নিয়ে যে কথাগুলি উঠে আসছে তার সত্যাসত্য এখনো বিচার্য বিষয়। যদি আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখি, এখানকার হিন্দু মৌলবাদীরা বারংবার মন্দিরে গরুর মাংস ফেলে দিয়ে এসে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করেছে এবং বেশ কিছু জায়গায় অনেক সময় ধরাও পড়েছে (২০১৫ সালে আজমগড়ের স্থানীয় একটি মন্দিরে আরএসএস-এর সক্রিয় সদস্য এক যুবক বোর্খা পরিহিত অবস্থায় গরুর মাংসখন্ড ছুঁড়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়)। একইভাবে, ১২ই অক্টোবরের ঘটনায় ইকবাল হোসেনের নাম অভিযুক্ত হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের তরফে উঠে আসতে শুরু করেছে।

৩. পশ্চিমবঙ্গের বিগত বিধানসভা নির্বাচনে আমরা দেখেছি যে বিজেপির সরকার গঠনের স্বপ্ন ধরাশায়ী হয়েছে। তবে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে তারা। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে বিশেষভাবে দাগ কাটতে পারেনি বিজেপি। গোটা দেশের নিরীখে, উত্তরপ্রদেশে বিধান সভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে, দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার ফলে বারংবার কেন্দ্র সরকারের মুখ পুড়ছে, তেলের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে। এমতাস্থায় সাধারণ মানুষের নজর ঘোরাতে আফগানিস্তানে তালিবান অভ্যুত্থানের ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে ভারতে কোন দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেনি আরএসএস-ভিএইচপি। ফলে, দুর্গা পুজোর সময় পড়শি দেশে এই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ফায়দা তুলতে চাইছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি। তাদের পক্ষে এই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছে যে শান্তিপুরের উপনির্বাচনে কুমিল্লার ঘটনার ফলে বিজেপির ভোট আরো বৃদ্ধি পাবে এবং তারা জিতবে। তাদের বক্তব্য হল, কুমিল্লার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে যদি কোনো মসজিদ ভাঙা হয়, তার দায় নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। অর্থাৎ এদেশের হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলি মসজিদ ভাঙার পরিকল্পনা করে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আবারও বলা উচিৎ, “ধর্মীয় মৌলবাদ নিপাত যাক; সংখ্যাগরিষ্ঠের মৌলবাদ নিপাত যাক”।  

৪. সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচারে দুই দেশের তুলনা করলে দেখা যায়, ভারতবর্ষে ফ্যাসিস্ট বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতাধীন রয়েছে, যারা উগ্র হিন্দু মৌলবাদী এবং বাংলাদেশের ক্ষমতাধীন শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ওই দলের মধ্যে এই মুহূর্তে প্রচুর মুসলমান মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা ঢুকে রয়েছে। একই সাথে, শেখ হাসিনা চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক পথে সরকার পরিচালনা করছে। বিগত নির্বাচনে বিরোধীদেরকে প্রায় ভোটে দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন এলাকায় হিন্দুদের উপর মাঝে মাঝেই যে আক্রমণ চলছে, তাতেও আওয়ামী লীগের মৌলবাদী সদস্যদের হাত রয়েছে। কিন্তু এটাও উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা কুমিল্লার ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে এবং তার সরকার দোষীদের সনাক্ত করে শাস্তি দেওয়ার কথাও বলেছে। তবে তাদের বর্তমান চরিত্রের নিরিখে এই আশ্বাস আদৌ কতটা কার্যকরী হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

৫. এরপর আসব আব্বাস সিদ্দিকীর প্রসঙ্গে। আব্বাস সিদ্দিকী শুরুতে কিছু উস্কানিমূলক কথা বলেছে, তারপর ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য একটি বিবৃতি দিয়েছে এই মর্মে যে, হিন্দুদের উপর এই আক্রমণের প্রতিবাদ তারা করছে। অর্থাৎ, আব্বাসের চরিত্র মূলত আইমিমের আসাদুদ্দিন ওয়েইসির মতন। আইমিম কোনো একটা জায়গায় গিয়ে উস্কানিমূলক কথা বলে "সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা"-কে তুলে ধরে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতার মাঠ বানিয়ে দেয়। আব্বাস সিদ্দিকীর বর্তমান কাজও এই ধাঁচেরই। অনেকের মতে, আব্বাস ‘আহালে সুন্নাতুল জামাত’-এর নেতা, এবং আইএসএফ সম্পূর্ণ আলাদা দল। যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে আইএসএফ আব্বাসের উস্কানিমূলক বক্তব্যের নিন্দা করে দেখাক, বের করে দিক ধর্মগুরুদের। কিন্তু এটা তারা পারবে না। কারণটা সকলেরই জানা। আব্বাস সিদ্দিকী তার রাজনৈতিক কেরিয়ারের প্রথমদিকে নুসরাত জাহানকে মুসলমান হয়ে হিন্দু মন্দিরে যাওয়ার জন্য "বেহায়া, নির্লজ্জা" বলেছিল। তার বর্তমান বক্তব্য অনুযায়ী, হিন্দুদের দুর্গাপুজার প্যান্ডেল কাবার মত দেখতে হবে কেন বা কোরান ধরার শখ থাকলে হিন্দুরা কোরান মেনে নিলেই হয়। অর্থাৎ, বারংবার আব্বাসের মুখে ধর্মীয় বিভাজনের কথা উঠে আসছে যে, হিন্দুরা মুসলমানদের এবং মুসলমানরা হিন্দুদের কোনো পরব বা অনুষ্ঠানে যোগদান  করবে না। এটা ধর্মীয় বিভাজনমূলক বদমাইশি ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। “সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ নিপাত যাক” বলার সাথে সাথে তাই “সংখ্যালঘুর মৌলবাদ নিপাত যাক”-ও বলতে হবে, তবে এও মাথায় রাখা প্রয়োজন, সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ যেমন নিজ দেশে সরাসরি ফ্যাসিস্ট বৈশিষ্ট্যের কাজ করতে পারে, সংখ্যালঘুর মৌলবাদ কিন্তু কখনোই ফ্যাসিস্ট চরিত্র গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখেনা, বরং তা নিতান্তই সংখ্যাগুরুর মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার চেষ্টা মাত্র।

৬. আমাদের দেশের এবং এই রাজ্যের সাধারণ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়। তারা যে নিজ ধর্মের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ঘৃণা করে, তা তাদের নির্বাচন বা নির্বাচন বহির্ভূত বিভিন্ন আন্দোলনে অবস্থান থেকে বারবার প্রকাশ পেয়েছে। অপরদিকে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যথেষ্ট প্রগতিশীল কারণ তারা এ ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখরিত করছে রাজপথ। সেখানকার মুসলমান যুবকরা দিনরাত বিভিন্ন হিন্দু মন্দির পাহারা দিতে শুরু করেছে।

৭. বাংলাদেশের জামাত-এর সাথে ভারতের আরএসএস-এর যোগাযোগের কথা উঠে আসছে। উঠে আসছে আরএসএস নেতা গোবিন্দ প্রামাণিকের নাম। অন্যদিকে, এই ঘটনায় মুখে কুলুপ এঁটেছে তৃণমূল। সারদা চিটফান্ড কারবারীদের সাথে বাংলাদেশের জামাত-এর সম্পর্কের কথা উঠে আসছে। তবে, এর সত্যাসত্য এখনো বিচার্য বিষয়।

৮. বামপন্থীরা বারংবার নিজ দেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদীদের দ্বারা গালাগাল খায় "সংখ্যালঘু তোষণের" জন্য। কিন্তু নিপীড়িত-অবহেলিত সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে লড়াই করা বামপন্থীদের গর্ব। ভারতবর্ষের বামপন্থীরা  সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের অধিকারের জন্য যেমন লড়াই করে, তেমনি বাংলাদেশের বামপন্থীরাও হিন্দু সংখ্যালঘুদের অধিকারের জন্য লড়াই করছে। কুমিল্লার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বামপন্থী দল সমানে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং লড়াই করে যাচ্ছে।

৯. কুমিল্লার ঘটনার পর বিভিন্ন মুসলমান ধর্মগুরুরাও হিন্দু পুজো মণ্ডপের সামনে মানববন্ধন করে সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছে। ভারতবর্ষেও এরকম ঘটনা আগে ঘটেছে। গুজরাট দাঙ্গা চলাকালীন স্বামী অগ্নিবেশ “ধর্মের বিনাশ ঘটে গেছে” ধরনের বক্তব্য রেখেছিলেন, গণহত্যার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এই ধরণের সম্প্রীতির বাতাবরণ উভয় দেশেই আছে কিন্তু নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে শাসক/মৌলবাদী গোষ্ঠী এই সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য হাত ধুয়ে পড়ে আছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের স্লোগান তুলতে হবে, “ফ্যাসিস্টদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও !!”, “স্বৈরাচারীদের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”, “সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ নিপাত যাক !!” 

Comments

  1. সময়োপযোগী ও ভালো লেখা।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার