হকারদের উচ্ছেদ করো/ অবৈধ বালি খাদান শুরু করোঃ দেশের বিচারালয়ের নতুন দিশা

ডেস্ক রিপোর্টঃ সুরজিত মণ্ডল


১৪ই অক্টোবর, ২০২০ সালে ‘ন‍্যাশনাল গ্ৰিন ট্রাইব্যুনাল’ অবৈধ বালি খাদানের বিরুদ্ধে শুনানিতে বিহার সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেয়। কোর্টের তরফে বলা হয়েছিল যে, যে সমস্ত অযোগ্য সংস্থাকে বালি খাদানের নিলামি করা হয়েছে এবং যে পদ্ধতিতে করা হচ্ছে, তা পরিবেশ বান্ধব নয়। বর্তমানে আমাদের দেশের যে পরিবেশ সংক্রান্ত আইনগুলো আছে, সেগুলোকে উল্লঙ্ঘন করে নিলামি করা হচ্ছে। বিহারের বাঙ্কা জেলায় যে বালি খাদান হবে তার জন্য ১৩০ কোটি টাকার নিলামি করা হয়েছে এবং সরকার পক্ষের যুক্তি হল, এখান থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হবে। কিন্তু বিহার সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা বালি খাদান শুরু করার আগে কোন সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করা হয়নি (যার ভিত্তিতে নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাগ বাটোয়ারা হবে), বরং নিলামি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে নামকেওয়াস্তে সেই সার্ভে রির্পোট প্রকাশ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, এই সার্ভে রিপোর্টে বালি ও বিভিন্ন খনিজ পদার্থের উপস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এবং তার সাথে নদীর বাস্তব‍্যবৈদিক বা ইকোলজিকাল প্রক্রিয়া যাতে ব‍্যহত না হয়, তার মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু সরকার প্রদত্ত সার্ভে রিপোর্টে সেরকম কোনো তথ্য একদিকে যেমন নেই, তেমনই এই বালি খাদানের কোনো নিদিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া নেই। অর্থাৎ,  যথেচ্ছ বালি অঞ্চল থেকে নিষ্কাশন করা যাবে। ‘হাফিংটন পোস্ট’ নামক সংবাদ সংস্থা থেকে জানা যাচ্ছে, যে তিনটি সংস্থাকে নিলামে বাঙ্কা জেলায় বালি খাদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের আগের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগরের একটি সংস্থাকে এগারোটার মধ্যে সাতটা অঞ্চলের খাদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, দুটো উত্তর প্রদেশের একটা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে এবং একটা অঞ্চল দেওয়া হয়েছে ঝাড়খণ্ডের একটি সংস্থাকে। ফলে ন‍্যাশনাল গ্ৰিন ট্রাইব্যুনাল বিহার সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেয় এবং খাদান প্রক্রিয়া বন্ধ‍ করতে বলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিহার সরকার সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ হয়। কিছুদিন আগে, ১০ই নভেম্বর, ২০২১ সুপ্রিম কোর্ট এই খাদান প্রক্রিয়ার উপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল এক বছর আগে, সেই রায়কে খারিজ করে দিয়েছে! তাদের মতে, বৈধ(?!) খাদান বন্ধ করা যাবে না। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, এই খাদান প্রক্রিয়াকে তারা বৈধ কি করে বলছে কারণ সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল নিলামি প্রক্রিয়ার পরে। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্ট আরও যে যুক্তি দাঁড় করিয়েছে তা হল, এই খাদানের ফলে রাজস্ব আদায় হবে, যেটা বিহার সরকারেরও এঁদো যুক্তি ছিল এই পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রক্রিয়া চালানোর ক্ষেত্রে। আবার একই সাথে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, যদি বৈধ খাদান বন্ধ করে দেওয়া হয় তবে অবৈধ উপায়ে জমি মাফিয়াদের দৌরাত্ম বাড়বে। অর্থাৎ প্রশাসনিক দুর্বলতাকে মেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী কাজ করার কথা সুপ্রিম কোর্টের মুখ থেকে বেরোচ্ছে, যেখানে আদতে তাদের কাজ হচ্ছে প্রশাসনিক দুর্বলতাগুলোকে দূর করার নির্দেশ দেওয়া! সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দেওয়ার পর বারংবার ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’-এর কথা বলে নিজেদের যে নঞর্থক অবস্থানকে ঢাকার চেষ্টা করেছে। কিভাবে ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’ হবে তা জানা মুশকিল কারণ সঠিক সার্ভে রিপোর্ট কার্যকর হওয়ার অভাবে এবং এই খাদান প্রক্রিয়ার ওপর সীমারেখা না টানার ফলে ব‍্যাপক পরিবেশ ধ্বংসের শুরু হবে ‘বিহার স্টেট মাইনিং করপোরেশন’-এর দ্বারা। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে আগামী ছয় মাসের মধ্যে সার্ভে রিপোর্ট জমা দিতে হবে রাজ‍্য সরকারকে, কিন্তু আপাতত এই খাদান পক্রিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হোক। অর্থাৎ রাজ‍্য সরকার যে কাজটা ইতিমধ্যে করেছে যে নিলামি প্রক্রিয়া হয়ে যাওয়ার পর সার্ভে রিপোর্ট প্রকাশ করা, সেটাকেই আদতে সিলমোহর দিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নাগেশ্বর রাও-এর নেতৃত্বাধীন তিনজন বিচারকের যৌথ বেঞ্চ। এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের যে জনবিরোধী নীতিসমূহ, তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশের সংবিধান ও আইনগুলোকে নতুনভাবে ব‍্যাখ‍্যা করার চেষ্টা করছে, যা একটা দেশব‍্যাপী ফ‍্যাসিস্ট উত্থান পর্বের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। স্বৈরাচারীদের কাছে বার বার সুপ্রিম কোর্ট মাথা নোয়াচ্ছে।

দিল্লীর ‘কনট প্লেস’ অঞ্চলের হকারদের হকারি করাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে তাদের উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিল সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন। সেই নির্দেশ অনুযায়ী দিল্লী পুলিশ কনট প্লেসের সমস্ত হকারদের উচ্ছেদ করে। এর বেশকিছু দিন পর কিছু হকাররা ঐ স্থানে পুনরায় হকারি করতে শুরু করে। এই পরিস্থিতির ভিত্তিতে কনট প্লেসের বড় দোকানের মালিকদের সংগঠন দিল্লী পৌর সংস্থার দ্বারা হকারদের উচ্ছেদ করানোর জন্য দিল্লী হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়। গত ৪ঠা নভেম্বর, ২০২১ বিচারপতি বিপীন সাঙ্ঘী ও অমিত বানসাল হকারদের বিরুদ্ধে রায় দেন। তাঁরা বলেন যে, কোনও নির্দিষ্ট আইন মেনে হকারি না করলে সারা শহরে যে কেউ ঢুকে পড়ে ‘জঙ্গলরাজ(!)’ তৈরি করবে। তাঁরা ‘স্ট্রিট ভেন্ডরস অ্যাক্ট, ২০১৪’ লাগু করার কথা বলেন, যার প্রধান নির্দেশিকা হল একটি TVC বা টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠন করতে হবে যা প্রত্যেক ৫ বছর অন্তর বৈঠকের মাধ্যমে অঞ্চল বিশেষে কোথায় হকারি করা যাবে তার একটি নির্দেশিকা তৈরি করবে। এই TVC-এর মধ্যে হকারদের আঞ্চলিক প্রতিনিধিদেরও রাখতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কোনো অঞ্চলে হকারি করা বৈধ কি অবৈধ সেটা আগে থেকে প্রশাসন কিভাবে ঠিক করছে যখম সেখানে টাউন ভেন্ডিং কমিটিই গঠন করা হয়নি! বরং বলা হচ্ছে, আগে উচ্ছেদ করা হোক, তারপর টাউন ভেন্ডিং কমিটি গঠন করা হোক, যারা ঠিক করবে কোথায় হকারি করা যাবে আর কোথায় হকারি করা যাবে না। সুপ্রিম কোর্ট আরেকটা নঞর্থক বক্তব্য রেখেছে, ‘মৌলিক অধিকার সম্পূর্ণ শয়ম্ভু নয়, তার কিছু শর্তও রয়েছে’। এক স্থানীয় মহিলা হকার দিল্লী হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁর আইনজীবী কমলেশ কুমার মিশ্রর মারফৎ এবং তিনি জানান যে ঐ কনট প্লেসে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষেরা গত ৮০ বছর ধরে হকারি করছেন, হঠাৎ করে সেখান থেকে তুলে দিলে তাঁরা না খেতে পেয়ে মারা যাবেন। কোর্ট তাদের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার পর তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানান যে হাই কোর্ট হকারদের কোনও কথাই শুনতে চাইছে না বরং তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। এখান থেকে আরেকটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যখন বালি খাদানের প্রশ্ন আসে তখন কোর্ট আগে খাদান প্রক্রিয়া শুরু করে তারপর সার্ভে রিপোর্ট তৈরি করতে বলে, কিন্তু যখন হকারি করার প্রশ্ন আসে তখন তাদের বক্তব্য হল আগে হকারদের উচ্ছেদ করতে হবে তারপর টাউন ভেন্ডিং কমিটি তৈরি করতে হবে। কোর্টের এই অবস্থান মূলগতভাবে শ্রমিক বিরোধী এবং এটা গোটা দেশজুড়ে বাড়তে থাকা ফ্যাসিস্ট উত্থান পর্বের অংশ হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে।

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views