অক্টোবর বিপ্লব, রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং বিশ্বের শ্রমজীবী জনগণঃ মুজফফর আহ্মদের কলমে
[১৭ই অক্টোবর, ২০২১: রুশ বিপ্লবের ১০৪তম বর্ষপূর্তিতে মুজফফর আহ্মদের কলমে দুটি প্রবন্ধের পুনঃপাঠ:
১. অক্টোবর বিপ্লব - গণশক্তি (পঞ্চাশতম নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী সংখ্যা), ১২ই অক্টোবর ১৯৬৭
২. সোবিয়েৎ দেশের গৃহযুদ্ধে বিশ্বের শ্রমজীবী জনগণ - স্বাধীনতা (শারদ সংখ্যা), ১৯৬২
বানান মূল রচনা অনুযায়ী অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
আর্কাইভ করেছেন সাথী শুভাশিস দাস।]
১. অক্টোবর বিপ্লব
১৯০৫ সালে
রাশিয়ায় প্রথম বিপ্লব হয়েছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিপ্লব হয়েছিল ১৯১৭ সালে। রুশ
দেশের পুরানো পঞ্জিকা অনুসারে দ্বিতীয় দ্বিতীয় বিপ্লব হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসে।
এই বিপ্লবে বিপ্লবে জারের পতন ঘটেছিল। নূতন পঞ্জিকার হিসাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিপ্লব
হয়েছিল মার্চ ও নভেম্বর মাসে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিপ্লব বুর্জোয়া গণতান্তিক বিপ্লব
আর তৃতীয় বিপ্লব সোশ্যালিস্ট বিপ্লব। মজুরশ্রেণীর পার্টির অর্থাৎ বলশেভিক পার্টির
নেতৃত্বে পুরনো পাঁজির হিসাবে এই বিপ্লব আরম্ভ হয়েছিল ২৫শে অক্টোবর তারিখে। তাই
তাকে বলা হয় অক্টোবর বিপ্লব। নূতন পাঁজির
হিসাবে বিপ্লব আরম্ভ হয়েছিল ৭ই নভেম্বর তারিখে কিন্ত অক্টোবর বিপ্লব নামটিই রয়ে
গেছে। আমাদের দেশে আমরা নভেম্বর বিপ্লবও বলে থাকি। সোভিয়েত দেশের ও অন্যান্য
দেশের লোকেরা তা বলেন না। তারা বলেন অক্টোবর বিপ্লব।
রুশ দেশের মহান
অক্টোবর বিপ্লব সমগ্র জগতের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এই বিপ্লবের দ্বারা পৃথিবীর
একটি দেশে অন্তত শ্রমজীবী জনগণ ক্ষমতার আসনে বসেছিলেন। এই একটি দেশেই মানুষের
দ্বারা মানুষের শোষণ শেষ করে দেওয়ার কাজ প্রথম আরম্ভ হয়েছিল।
জগতে একের পর
এক যে সাম্রাজ্যবাদের দৃঢ় বিন্যাস হয়েছিল তাতে প্রথম ভাঙন ধরিয়েছিল অক্টোবর
বিপ্লব। বিরাট-বিশাল জারের সাম্রাজ্য নিপীড়িত জাতিসমূহকে মুক্তির আস্বাদ
শিখিয়েছে অক্টোবর বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লব হতেই ঔপনিবেশিক অধীনতার শৃঙ্খলবদ্ধ দেশগুলি
মুক্তির প্রেরণা পেয়েছে। আমাদের ভারতবর্ষও এই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ দেশগুলির বাইরে
ছিল না।
সবচেয়ে বড়
কথা এই যে অক্টোবর বিপ্লবের কাজ কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক পার্টির) অবিভক্ত
নেতৃত্বে সাধিত হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি মজুর শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি। এই
বিপ্লবের সময়ে পার্টি সমগ্র শোষিত ও শ্রমজীবী জনগণের মজুরশ্রেণীর সে জড়ো করতে সমর্থ
হয়েছিল। এইভাবেই স্থাপিত হয়েছিল ভূতপূর্ব জারের বিশাল সাম্রাজ্যে দুনিয়ার সর্বহারা
শ্রেণীর প্রথম একনায়কত্ব।
ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা শোষিত ও শাসিত আমাদের ভারতবর্ষ হিন্দুকুশ, হিমালয় ও সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেও, রুশ বিপ্লবের সঠিক খবর যেন
ভারতে না পৌঁছায়,
তার
জন্যে ভারতের ব্রিটিশ শাসনকর্তারা নানাভাবে আটঘাট বেঁধে দিলেও এ দেশে পৌছয়নি এমন
কথা বলা যায় না। ১৯১৮ সালে প্রথম মহাযুদ্ধের বিরতি ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের
দেশের নানাস্থানে মজুরদের ধর্মঘট শুরু হয়ে গিয়েছিল। আরও পরে কৃষকদের সংগ্রামও
আরম্ভ হয়েছিল, এখানকার উত্তর প্রদেশেই বেশি।
সুদূর
অতীতে হিন্দুকুশের গিরিসংকট পার হয়ে কত কত জাতি ভারতে এসেছেন। রুশ বিপ্লবের
প্রকৃত খবর যে সেভাবে আসতে পারত না, কিংবা আসেনি এমন
কথা বলা যায় না। কিন্তু যুগের পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। রুশ বিপ্লবের পরের সময়ে
মানায় আর বার্তা বহন করে আনতেন না, তখন বার্তা
নিয়ে আসছিল বৈজ্ঞানিক উপায় বৈদ্যুতিন শক্তি। এই সমস্ত কল-কব্জা ছিল শোষক ও
ধনিকশ্রেণীর হাতে। কাজেই রুশ বিপ্লবের খবরগুলি ও তার পরবর্তী ঘটনা সমূহের বিবরণ
সঠিক হতো না। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা তাদের প্রয়োজন সাধনের উদ্দেশ্যে বিবরণগুলিকে
মিথ্যার পোশাক পরিয়ে দিনের পর দিন নানা দেশে পাঠাতো।
তখনকার
দিনে দেবনাগরী হরফের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। তাই, হিন্দী
কাগজ আমি পড়তে পারতাম না। কেউ কেউ বলেছেন অক্টোবর বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে হিন্দী
কাগজে লেখা বা’র হতো। এই সম্বন্ধে “হ্যা” কিংবা “না” কিছুই
আমি বলতে পারব না। কিন্তু, আমাদের বাঙলা
দেশের কাগজগুলি শুরুর দিকে অক্টোবর বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়েছেন, এমন
ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে না। বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের পুস্তিকা বিপ্লবের বিরুদ্ধে
লিখিত হয়েছিল। রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার যে কত রকমের হতো তা ভাষায় বর্ণনা
করা কঠিন, প্রচার হতো যে, বলশেভিকরা
মায়ের বুক হতে শিশুদের কেড়ে নিচ্ছে। এখানেই শেষ ছিল না। বলা হতো যে, সোভিয়েত
ভূমিতে নারী জাতিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছে। ব্যতিক্রম হিসাবে ১৯২২
সালে আমরা দেখেছি যে, চন্দননগরের “প্রবর্তক” গ্রুপের
সাপ্তাহিক পত্রিকা “নবসঙঘ”-তে “লেনিনের
সঙ্গে দশ মাস” নাম দিয়ে একটি ইংরেজি লেখার বাঙলা
অনুবাদ ক্রমশ প্রকাশিত হয়েছিল। ভালো লেখা। এটা কোন্ ইংরেজী লেখার বাঙলা অনুবাদ
ছিল তা এখন আমি ভুলে গেছি। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে বিপিনচন্দ্র পাল ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন।
ফিরে এসে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে ইংরেজি ভাষায় যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা আমি শুনেছিলাম।
তিনি বলেছিলেন বলশেভিকরা কি এমন খারাপ লোক? “আমিও তো
বলশেভিক।” তার পরে আর এ বিষয়ে তাঁকে কিছু বলতে শোনা
যায়নি।
বিপ্লবের পূর্বে আমাদের বাঙাল দেশের সাহিত্যপ্রিয় লোকেরা রুশ সাহিত্য ভালোবাসতেন। তারা তলস্তয়, তুর্গেনিফ ও দস্তয়ভস্কি প্রভৃতি লেখকের লেখা পড়তেন। উনিশ শ’ বিশের দশকে গোর্কির ‘মা’ এদেশে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আশ্চর্য এই যে, অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বে আমাদের বাঙলা দেশের লোকেরা রুশ দেশের রাজনিতিক সংগ্রামের কথা বিশেষ কিছু জানতেন না। তাঁরা নিহিলিস্ট ও এনার্কিস্টের কথা জানতেন। কিন্তু রাশিয়ান সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির এবং তার বলশেভিক ও মেনশেভিক বিভাগের কথা কেউ তেমন জানতেন বলে আমার মনে হয় না। আমার নিজের কথা যদি বলি, ফিলিপস প্রাইসের বিখ্যাত পুস্তক “রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে আমার স্মৃতিকথা” (My Reminiscences of the Russian Revolution) প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে বলশেভিক, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন সম্বন্ধে আমার কোন জ্ঞান ছিল না। পার্টি সম্বন্ধে প্রথম উপলব্ধি আমার এই পুস্তক পড়েই হয়েছিল।
ভারতের
ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট এদেশে শুধু বিকৃত খবর পরিবেশন করতেন বটে, কিন্তু ব্রিটেনে
ও আমেরিকায় ছাপানো মাসিক, পাক্ষিক ও
সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার এদেশে আসা তারা বন্ধ করতে পারেননি। এই সব কাগজেও রুশ
বিপ্লবের বিরুদ্ধ-প্রচারই বেশি থাকত, কিন্তু মাঝে
মাঝে সত্য ঘটনা দিয়েও কোনো কোনো লেখক প্রবন্ধ লিখে বসতেন। বাঙলা দেশের লেখকদের
চোখে এসব লেখাও পড়ত।
দেশের
ভিতরে মজুরদের ধর্মঘট যে হচ্ছিল সে কথা আমি আগে বলেছি। এত বেশি সংখ্যায় ধর্মঘট
হতে আগে কেউ কোনো দিন দেখেননি। তার উপরে যুক্ত খিলাফৎ অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে দেশের
সাধারণ মানুষেরাও সাড়া দিয়েছিলেন। ১৯২২ সালের মে মাস হতে শুরু করে ভারতের
প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রগুলি “ভ্যানগার্ড অফ
ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডস”, “এডভান্স গার্ড” ও “ভ্যানগার্ড” প্রভৃতি
জার্মানিতে ছাপা হয়ে এদেশে প্রচারিত হচ্ছিল। এই সবই বাঙলা সাহিত্যের উপরেও ধীরে
ধীরে প্রভাব বিস্তার করছিল। বাঙলা গল্প ও উপন্যাসে ক্রমশ জমিদার ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের
জায়গায় সাধারণ মানুষদেরও স্থান হতে লাগল। আমার মনে হয় বাঙলা সাহিত্যের এই দিকটা
গবেষণার বিষয় হতে পারে।
অক্টোবর
বিপ্লব সমস্ত জগৎকে নূতন পথ দেখিয়েছিল। জগতের শোষিত ও নির্যাতিত মানুষেরা অক্টোবর
বিপ্লবকে শুধু রাশিয়ার বিপ্লব মনে করেননি, তাঁরা
মনে করেছেন অক্টোবর বিপ্লব তাঁদেরও বিপ্লব। এই বিপ্লব হতে পাওয়া সুফলকে বাঁচিয়ে
রাখতে পারলে একদিন তাঁরাও তার অনুসরণে আপন আপন দেশে ক্ষমতা দখল করতে পারবেন, এই ছিল
তাঁদের আশা।
বিপ্লবের
পরের বছরই রুশ দেশে প্রতিবিপ্লব আরম্ভ হয়ে যায়। এই প্রতিবিপ্লবে যোগ দিয়েছিল সে
দেশের জমিদার, ধনিক, ধনী কৃষক জারের আমলের বড় বড় সৈন্যাধ্যক্ষগণ (সবই জমিদার শ্রেণীর
লোক) এবং রাজনীতিক দলগুলির মধ্যে ন্যাশনালিস্ট পাটিগুলি, কনস্টিটিউশনাল
ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, মেনশেভিক পার্টি, সোশ্যালিস্ট রেভোলিউশনারি পার্টি ও
এনার্কিস্টগণ। ব্রিটিশ, ফরাসী, জাপানী
ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে প্রতিবিপ্লবের সাহায্য করছিল। ইউরোপের
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই কাইজার বিল্হেলমের জার্মানিও সোভিয়েত দেশের দক্ষিণাংশ
আক্রমণ করেছিল। তারা ট্রান্স-ককেশিয়াকে সোভিয়েত রাশিয়া হতে বিচ্ছিন করে
দিয়েছিল। জর্জিয়া ও আজারবাইজানের ন্যাশনালিস্টদের অনুরোধে তারা জার্মান ও তুর্কি
সৈন্য ওসব দেশে পাঠিয়েছিল এবং বাকু ও তিবলিসির উপরে প্রভু হয়ে বসেছিল।
সোভিয়েত
দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও-দেশের শ্রমজীবী জনগণের সাহায্য অসীম দৃঢ়তার সহিত লড়াই
ক’রে প্রতিবিপ্লবীদের ও জগতের তাবৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরাজিত করেছিল। মনে
রাখতে হবে যে, ওই সময়ে সোভিয়েত দেশকে সাম্রাজাবাটি
শক্তিরা সব দিক হতে ঘেরাও করে রেখেছিল।
অক্টোবর
বিপ্লব যে দুনিয়ার সকল দেশের শ্রমজীবী জনগণের বিপ্লব ছিল তার প্রমাণ পাওয়া
গিয়াছে রাশিয়ার গৃহযুদ্ধে। দীর্ঘস্থায়ী প্রথম মহাযুদ্ধে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী
দেশের যে সকল সৈন্য রাশিয়ায় বন্দী হয়েছিল তাদের বড় অংশ প্রতিবিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ
দিয়েছিল। প্রত্যেক দেশের বন্দীদের মধ্য হতে একটি অংশ আপন আপন দল হতে বা’র হয়ে
এসে প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এককথায় সকল সাম্রাজ্যবাদী দেশের
বহুসংখ্যক লোক বিপ্লবের পক্ষেও লড়েছিলেন। বিপ্লবের পূর্বে উত্তর-পূর্ব চীনের
প্রায় দুই লক্ষ মজুর রুশ দেশে নানান ধরনের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। গৃহযুদ্ধের সময়ে
এই চীন দেশীয় মজুরেরাও বিপ্লবের ভিতর দিয়ে পাওয়া সোভিয়েত দেশকে রক্ষার করার
জন্যে লড়াই করেছিলেন। প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে অন্য কোনো দেশের এত বৃহৎ সংখ্যক লোক
লড়াই করেছে বলে আমি জানিনে।
সোভিয়েত
দেশের ইতিহাসের ছাত্ররা পুরানো কাগজপত্র ঘেঁটে এখন এই সকল তথ্য আবিষ্কার করেছেন।
আমার ধারণা ছিল যে সোভিয়েত রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সময়ে আমরা ভারতীয়েরা বুঝি কিছুই
করতে পারেনি। অথচ, সোভিয়েত দেশ আমাদের তো প্রতিবেশী দেশ।
এখন দেখতে পাচ্ছি আমাদেরও তাতে অবদান আছে।
গৃহযুদ্ধের
সময়ে রেড আর্মিতে আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠিত হয়েছিল। তাতে ভারতীয় সৈন্যরাও ছিলেন।
১৯১৮ সালে ইরান হতে ব্রিটিশ দখলকার সৈন্য এসে ট্রান্স-ককেশাস দখল করেছিল। এই
সৈন্যদের ভিতরে ভারতীয় সৈন্যরাও ছিলেন। তাঁদের গায়ে রুশ বিপ্লবের কোনো ছোঁয়াচ
যাতে না লাগতে পারে সে জন্যে ব্রিটিশ অফিসাররা তাঁদের উপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন।
স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে তাঁদের মেলামেশা করা বারণ ছিল। তা সত্ত্বেও ভারতীয় সৈন্যদের
ভিতর চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিল। কিছু সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশ অফিসারদের নাকের বেওনেট
তুলে ধরে লাল ফৌজে এসে যোগ দিলেন। তাঁরাই দাগিস্তান ও কাবার্দার পার্বত্য এলাকায়
যুদ্ধ করেছিলেন। নিজেদের বাঁচিয়ে তাঁরা যুদ্ধ করেননি। তাঁদের অফিসার মুর্তজা আলীর
সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের কথা ও দেশে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
মাশ্হাদকে
কেন্দ্র করে ইরানের খুরাসান প্রদেশে একটি বিশাল ব্রিটিশবাহিনী আড্ডা গেড়ে বসেছিল।
এখান থেকেও পাঠান সৈন্যরা পালিয়ে গিয়ে লাল ফৌজের আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দেন। রাইফেলের
যুদ্ধ তো তাঁদের জানা ছিল না, যান্ত্রিক যুদ্ধও তারা খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করে নিলেন।
তখনকার দিনে ভারতীয় সৈন্যদের যান্ত্রিক যুদ্ধ শেখানো হতো না। রুশ বিশেষজ্ঞরা এসে
তাদের গেরিলা যুদ্ধও শিখিয়ে দিলেন। দুর্ধর্ষ হয়ে উঠলেন তারা। প্রথমে তারা রুশ
অফিসারদের অধীনে যুদ্ধ করতেন। তারপরে তাঁদের ভিতর হতেই সৈন্যরা অফিসারের পদে
উন্নীত হলেন। প্রথমে তাঁরা ক্রাসনোভদ্স্ক-মাৰ্ভ রেলওয়ে রোডকে নিরাপদ করে নিলেন।
তাতে ককেশাস হতে মধ্য এশিয়ায় পেট্রোল পাঠানোর সুবিধা হয়ে গেল। ইরানের বিপ্লবী ও
আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের সৈন্যদের সঙ্গে একত্রে ভারতীয় সৈন্যরা আশ্কাবাদ-মাশ্হাদ রোড
বিপন্ন করে তুলল। আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের ইরানী সৈন্যরা কোয়েটা-মাশ্হাদ রোডের
ওপরে প্রায়ই এমন ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলেন যে, ভারতবর্ষ
হতে ইরানে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য রসদ আসাই বন্ধ হয়ে গেল। ইরানের সাধারণ
বাসিন্দারাও এই কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ফলে, ব্রিটিশের
ভারতীয় ও ব্রিটিশ সৈন্যদলকে মাশ্হাদ হতে গুটিয়ে নিতে হলো। ইরানের সমগ্র খুরাসান
প্রদেশ ব্রিটিশ প্রভাব হতে মুক্ত হলো।
খুরসান
হতে বিতাড়িত হয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদল চিত্রাল ও গিলগিতে তাদের আড্ডা গেড়েছিল। এখান
হতেই তারা ফরগনার পার্বত্য এলাকার ভিতর দিয়ে বুখরায় অস্ত্রশস্ত্র পাঠাত।
ক্রুশ্চভ ও তাঁর পরবর্তী নেতারা আজ সোভিয়েত
রাশিয়াকে যেখানেই এনে দাঁড় করান না কেন, আমি বলব
যে অক্টোবর বিপ্লব আমাদেরও বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লব দুনিয়াকে নূতন পথের সন্ধান
দিয়েছে। আমি নিজেকে অক্টোবর বিপ্লবের দ্বারা সৃষ্ট একজন অতি সামান্য লোক বলে মনে
করি।
২. সোবিয়েৎ দেশের গৃহযুদ্ধে বিশ্বের শ্রমজীবী জনগণ
১৯১৭ সালে রাশিয়ার নভেম্বর বিপ্লব সমস্ত পৃথিবীর চোখের সামনে একটি অভিনব
সমাজব্যবস্থা তুলে ধরল। এই ব্যবস্থায় মজুরশ্রেণীর শ্রেণীর রাজনীতিক দল —
কমিউনিস্ট পার্টির অধিনায়কত্বে শোষিত, নির্যাতিত ও
পর-পদদলিত মেহনতী মানুষেরা পেলেন রাষ্ট্রক্ষমতা। কিন্তু রুশ দেশের এই সামাজিক
পরিবর্তন সাম্রাজ্যবাদী জগৎকে অত্যন্ত বিচলিত করে তুলল। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে
পারল, এই যে নতুন
আদর্শ জগতের জনগণের সামনে স্থাপিত হলো তা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের পক্ষে কখনও
মঙ্গলকর হতে পারে না।
অন্যদিকে হতে জার্মানির সহিত সোবিয়েৎ দেশের সন্ধি স্বাক্ষরিত হওয়ায়
মিত্রপক্ষ প্রমাদ গণল। কারণ, জার্মানির
অর্ধেক সৈন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। মিত্রপক্ষ ভাবল এবার পূর্ণ শক্তিতে
তাঁদের বিরুদ্ধেই জার্মানি যুদ্ধে লেগে যেতে পারবে। এই সম্ভাবনা সত্ত্বেও
সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান চিন্তা হলো কি করে গোড়াতেই জনগণের সোবিয়েৎ শক্তিকে
পায়ের তলায় গুড়িয়ে দেওয়া যায়। চক্রান্ত শুরু হলো। এই চক্রান্তে যোগ দিল
আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জাপান প্রভৃতি
চৌদ্দটি শক্তি। আবার সোবিয়েৎ দেশের ভিতরকার শ্বেত প্রতিবিপ্লবীরা মাথা তুলল।
নভেম্বর বিপ্লবের ফলে ক্ষমতা ও মুনাফা দু’-ই যাঁরা হারিয়েছিল সেই
জমিদার ও ধনিকরা তো শ্বেত প্রতিবিপ্লবী দলে ছিলই, আরও তাতে যোগ দিল ক্যাডেট ও সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারি
প্রভৃতি রাজনীতিক দল। তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের নিকট হতে অস্ত্র ও অর্থের
সাহায্য পেতে লাগল।
যুদ্ধের সময়ে যে সকল বিদেশী সৈন্য রাশিয়ায় বন্দী হয়েছিল, সোবিয়েৎ সরকার তাঁদের
মুক্তি দিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তাঁদের ভিতর হতে কিছু সৈন্য বিপ্লবী
লালফৌজে যোগ দিলেন। আর খুব বেশির ভাগ যোগ দিল শ্বেত প্রতিবিপ্লবী দলে। অস্ট্রিয়া
কয়েক হাজার চেক্ ও স্লোভাক সৈন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছিল।
তাঁদের প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্য রুশের হাতে বন্দী হয়। এই সৈন্যরা অস্ট্রিয়ার
ওপরে খুশি ছিল না। তাঁরা স্থির করেছিল জারের পক্ষে যোগ দেবে। নভেম্বর বিপ্লবের পরে
সোবিয়েৎ সরকার চেক্ ও স্লোভাক সৈন্যদের দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তাঁরা
সাইবেরিয়ার ভিতর দিয়ে দেশে ফিরবে বলে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী
সক্তিদের উস্কানিতে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করল। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিল
প্রায় বিশ হাজার শ্বেত প্রতি-বিপ্লবী। এই প্রবল গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে সোবিয়েৎ
দেশের শ্রমজীবী জনগণ অসম সাহসের সহিত লড়তে লাগলেন। এই সময়েই লালফৌজ গড়ে উঠল।
লেনিনের নেতৃত্বে সোবিয়েৎ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি শুধু গৃহযুদ্ধের পরিচালনাই
করছিলেন তা নয়, পার্টি ও সোভিয়েতের সংগঠনিক কাজও এই সময়ে পূর্ণ
মাত্রায় চালু ছিল। গৃহযুদ্ধের ভিতরেই কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস ও সোবিয়েৎ
সমূহের কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। তৃতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের আনুষ্ঠানিক ও
প্রথম কংগ্রেসের অধিবেশনও এই সময়েই ১৯১৯ সালে হয়েছিল। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল
ছিল বিশ্ব কমিউনিস্ট পার্টি অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি সমূহের সমবায়। লেনিন ঘোষণা
করেছিলেন, কমিউনিস্ট
পার্টি আন্তর্জাতিক মজুরশ্রেণীর পার্টি। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গঠনের দ্বারা
তারই তাৎপর্য প্রমাণিত হলো। লেনিন বললেন, অনেকে বলে থাকেন
যে, কমিউনিস্টরা স্বপ্নচারী।
কিন্তু “এই দু’ বছরের জগতের ইতিহাস প্রমাণ
করে দিয়েছে যে আমরা যা, বলছি তা হাজার
বার সত্য” (ডিসেম্বর, ১৯১৯)।
গৃহযুদ্ধের সময়ে যদিও চৌদ্দটি দেশ সোবিয়েত দেশকে আক্রমণ ও অবরোধ করেছিল, তবুও এই চৌদ্দটি দেশের তো
বটেই, পৃথিবীর আরও বহু
দেশের নির্যাতিত মানুষ গৃহযুদ্ধের সময়ে সোবিয়েৎ দেশকে সক্রিয় সাহায্য করেছেন।
এই সকল দেশের হাজার হাজার সৈন্য সোভিয়েতের মাটিতে দাঁড়িয়ে লাল ফৌজের সঙ্গে পা
মিলিয়ে নভেম্বর বিপ্লবের অবদানকে বাঁচাবার জন্যে যুদ্ধ করেছেন এবং যুদ্ধ করতে
গিয়ে জীবনোৎসর্গ করতেও পিছপা হননি। ওপরে আমি চেক্ ও স্লোভাক সৈন্যদের বিপ্লবের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা বলেছি। কিন্তু এই চেক্ ও স্লোভাকদেরই ভিতর হতেও কম পক্ষে
দশ হাজার সৈন্য লালফৌজে যোগ দিয়েছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে নভেম্বর
বিপ্লব হতে যা পাওয়া গিয়েছিল সেই পাওয়াকে সমস্ত পৃথিবীর মেহনতী মানুষরা নিজেদের
একান্ত পাওয়া হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। লেনিনের শিক্ষায় যা, প্রকাশ পেয়েছিল তা
থেকে বিশ্বের মেহনতী মানুষরা অনুভব করেছিলেন যে সোবিয়েৎ দেশ তাঁদেরও দেশ, সোবিয়েৎ ভূমির সীমানার
ভিতরে যাঁরা জন্মেছেন কিংবা বাস করছেন কেবল তাঁদেরই দেশ নয়। এই চেতনা দুনিয়ার
মেহনতী মানুষের মনে না জন্মালে তাঁদের ভিতর হতে কেউ বিদেশ-বিভুঁইয়ের জন্যে এমনভাবে
অকাতরে প্রাণ দিতে পারতেন না।
পৃথিবীর কত দেশের কত হাজার হাজার লোক গৃহযুদ্ধের সময় সোবিয়েৎ দেশের পক্ষ
নিয়ে লড়াই করেছেন। তাঁদের সকলের কথা এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। অনেক অচেনা
সৈন্যদের কথা এখনও অজ্ঞাত। খুব সংক্ষেপে আমি শুধু কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে
দিব।
চীনের লি চেং-তুং বলেছেন: “আমার কমরেডরা ও আমি ক্ষুধার তাড়নায় ১৯১৬ সালে পুরনো চীন ছেড়েছিলাম।
রাশিয়ায় কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম একসঙ্গে আমরা বারো হাজার চীনা মজুর।
পেট্রোগ্রাদের কাছাকাছি এক জায়গায় বড় বড় গাছের গুঁড়ি উঠানো-নামানোর কাজ আমরা
করতাম। সুখের খোঁজে আমরা দেশ ছেড়েছিলাম কিন্তু রাশিয়ায় যে-ধরনের শ্রমের কাজ
আমাদের করতে হতো তা ছিল প্রায় গোলামির মতো। চীনের ধনিক ডাকুদের মতোই ছিল জার ধনিক
ডাকুরা। রাশিয়ায় ধনতন্ত্রের পতন যখন হলো এই কারণেই তখন আমরা চীনা মজুররাও রুশ
মজুরশ্রেণীর নেতৃত্বে মহান নভেম্বর সমাজবাদী বিপ্লবকে বাঁচানোর কাজে যোগ দিলাম।
“নভেম্বর বিপ্লবের প্রথম দিনগুলিতেই আমরা পেট্রোগ্রাদে বিপ্লবী চীনা মজুর
লীগ গঠন করলাম। অনেক চীনা মজুর সঙ্গে সঙ্গেই লালরক্ষী বাহিনীতে (রেড গার্ড) যোগ
দিলাম।
অন্য সব রুশ শহরে অবস্থিত চীনা মজুরেরাও এই একই পথের অনুসরণ করেছিলেন।
মস্কোর বিভিন্ন কারখানায় বিরাট সংখ্যায় চীনা মজুর কাজ করতেন। তাঁরাও তাঁদের রুশ
মজুর ভাইদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বৈপ্লবিক সংগ্রামে যোগ দিয়েছেন। চীনা মজুরদের প্রথমে
যাঁরা রেডগার্ডে যোগ দিয়েছে পরে তাঁরা লালফৌজেও শামিল হয়েছেন।
লি চেং তুং-কে লাল ফৌজের সৈনিক হিসাবে ককেশাসে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে তিনি
একাধিক বার সুনাম অর্জন করেছে।
পিং কাই-চ্যাং-এর নেতৃত্বে ওডেসাতেও চীনারা বিপ্লবের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন।
১৯১৮ সালের ১৩ই জুন তারিখে “কুলিরাও বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিয়েছেন” এই শিরোনামা দিয়ে “ক্রাস্নায়া আর্মিয়া” নামক কাগজে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে লেখা
হয়েছিল:
আগে হতেই ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ, জার্মানি ও অস্টিয়ান
মজুরদের দ্বারা গঠিত আমাদের ইন্টারন্যাশনাল ব্যাটালিয়ান সমূহ আছে।
“বিপ্লব চীনা কুলিদেরও জাগিয়ে তুলেছে। দুরবস্থার তাড়না এই চীনাদের
রাশিয়ায় টেনে এনেছিল। মর্শানস্স্কিয়ে ইজভেজস্তায়া-র খবর হতে জানা যায় তাঁরা
একটি রেজিমেন্ট গঠন করেছেন। এই রেজিমেন্ট এখন দক্ষিণে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে
লিপ্ত আছেন।
“এই রেজিমেন্টের সংগঠকের নাম
সাং-ফু-ইয়াং। শিশুকাল হতেই দুঃখ ও দারিদ্র্য তাঁর সাথী হয়েছিল। তিনি চীনা
সোস্যালিস্ট পার্টির সভ্য। বিপ্লবে তিনি সক্রিয় সহায়তা করেছেন।
“সোভিয়েতের বিরুদ্ধে রুমানিয়ান আক্রমণের সময়ে তিরাস্পুলে আহূত সোবিয়েৎ
বিপ্লবী সৈন্যদের দ্বিতীয় কংগ্রেসে সাং-ফুং-ইয়াং প্রস্তাব করেন যে তিনি চীনাদের
রেড ব্যাটালিয়ন সমূহ গড়ে তুলবেন।
“এই ব্যাটালিয়নগুলিতে সৈন্যদের কেবল গরিব কৃষক ও মজুর খনি-মজুরদের ভেতর
হতেই নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন তথাকথিত কুলি...।
“কঠোর শৃঙ্খলা ও সহনশক্তি
তাঁদর উৎসাহী সৈন্যে পরিণত করেছে।
“ইতিমধ্যেই এই হাজার আট শতের
বেশি চীনা সৈনিক লাল ফৌজে আছেন। এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
“বিশেষ করে সামারা ও
সাইবেরিয়ায় সাফল্যের সহিত চীনা সৈন্য দল গঠনের কাজ চলেছে। আশা করা যায় যে তাঁরা
কম পক্ষে দশ হাজার লোক আমাদের পাঠাতে পারবেন।
“চীনাৱা রুশ বিপ্লবের অগ্রগতির ওপরে বিশেষ নজর রাখছেন। তাঁরা প্রায়
প্রতিদিনই মিটিং করছেন। চীনা সৈন্য দলকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে অদূর ভবিষ্যতে
চীনা বলশেভিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হওয়ার আশা করা যায়।”
লি সি-হুয়াই বাইরেকার আক্রমকারী ও শ্বেত প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে
অস্ত্রধারণকারীদের একজন। তিনি বলছেন:
“আমি শুনেছি বিপ্লবের পূর্ব
মুহূর্তে রাশিয়ায় দুই লক্ষ চীনা ছিলেন। আমি তাঁদেরই একজন।
“যুদ্ধচলাকালীন রাশিয়ার
কল-কারখানার মজুর, খনিতে কাজ করার
মজুর, রাস্তা বাঁধানোর
মজুর ও গাছের গুঁড়ি ওঠানো-নামানোর মজুরের অভাব হয়ে পড়েছিল। এই অভাব পূর্ণ করার
উদ্দেশ্যে আমাদের খুব বড় অংশকেই চীনের ভিতরে সংগ্রহ করা হয়েছিল। আমাদের সামান্য
মজুরি দেওয়া হতো, খাওয়াও দেওয়া
হতো খারাপ। তবুও যে আমরা রাশিয়ায় গেলাম তার কারণ ছিল এই যে আমাদের দেশে আমাদের
খাওয়া আরও খারাপ। এক পেয়ালা ভাত জোগাড়ের মতোও আমরা রোজগার করতে পারতাম না।
“রাশিয়ায় যেসব চীনা মজুর
কাজ করতেন তাঁদের খুব বেশিরভাগ ছিলেন চীনের উত্তর-পূর্ব প্রদেশগুলির লোক। আমরা
সকলে একই বুলিতে কথা বলতাম। এই একই বুলি হওয়ার কারণে আমাদের কাজের অনেক সুবিধা
হয়েছিল। রাশিয়ার বিভিন্ন এলাকা হতে যে-সকল আন্দোলনকারী আমাদের ভিতরে আসতেন
তাঁদের ভাষা আমরা সহজেই বুঝতে পারতেম। পেট্রোগ্রাদ হতে যে-কাগজখানা বা'র হয়েছিল তার
সম্বন্ধেও ওই একই কথা ছিল। একজন চেঁচিয়ে পড়লেই আর সকলে তা বুঝতে পারতেন। আমরা
বলশেভিক পার্টিকে লালপার্টি বলতাম, আর লেনিনের
প্রত্যেকটি কথা একান্তভাবে বোঝার চেষ্টা করতাম.....” ইত্যাদি।
গ্রিগরি ত্রেতিয়াকভ পেং তি-সাঙের অধিনায়কত্বে পরিচালিত চীনা সৈন্যদলের
কথা বলেছেন। পেং-তি-সাং কমিউনিস্ট ছিলেন। তিনি কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন এস. এম.
কিরভের হাত হতে। এই কার্যভার তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার সময়, কিরভ বলেন:
“রুশ বিপ্লবের বিজয়ের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে আপনারা চীনের মুক্তির
জন্যেই সংগ্রাম করবেন। এমন এক সময় আসবে যখন রাশিয়ার মজুরেরা চীনের বীর জনগণের
প্রতি তাঁদের ভ্রাত্রীয় হস্ত প্রসারিত করবেন, আর সে-সময়ে চীনের জনগণ তাঁদের নির্যাতকদের হাত হতে
মুক্তিলাভ করবেন।”
চীনা যোদ্ধাদের তরফ হতে বলতে গিয়ে কমান্ডার পেং তি-সাং বললেন:
“বিপ্লবী রাশিয়া আমাদের
দ্বিতীয় মাতৃভূমিতে পরিণত হয়েছে। আমরা প্রতিজ্ঞা করছি যে আমরা রাশিয়ার জন্যে ও
বিপ্লবের স্বার্থে যুদ্ধ করব।”
গ্রিগরি ত্রেতিয়াকভ বলছেন যে, চীনারা তাঁদের
কথা রেখেছিলেন।
৮১-নম্বর রেজিমেন্টের রেজিমেন্টাল স্কুলের সেকশন কমান্ডার চুং কিং-লিং।
আসিজানকে “অর্ডার অফ্ দি
রেড ব্যানার”-এর উচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল। ইস্টার্ন ফ্রন্টের ভলচিয়ে নামক গ্রামে
১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শত্রুর লাইনের পেছনে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তিনি অসম
সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। নিজে আহত হয়েও তিনি দু’জন মেশিনগান চালককে ধরে
ফেলেছিলেন এবং একটি মেশিনগানও কব্জা করে নিয়েছিলেন।
সোবিয়েৎ দেশের আরও কত জায়গায় চীনারা যে কত বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তার
তথ্য আজও উদঘাটিত হয়নি।
ইউরোপের সব দেশের লোকেরা যে রুশ বিপ্লবকে সাহায্য করেছেন তার উল্লেখ আমি
আগেই করেছি। আমেরিকাও এই সাহায্য করা থেকে বাদ যায়নি।
অনেক আন্তর্জাতিক সৈন্যদল যে গঠিত হয়েছিল সে কথাও বারে বারে উল্লেখ করা
হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সৈন্য দলের কথা কিছুই বলা হয়নি। লালফৌজের অন্তর্ভুত
আন্তর্জাতিক সৈন্যদলে ভারতীয় সৈন্যরাও ছিলেন। তাঁরা ১৯১৮ সালে ইরান হতে ব্রিটিশ
দখলকার সৈন্যদলের সঙ্গে ট্রান্স-ককেশাসে এসেছিলেন। ব্রিটিশ অফিসারদের মনে সর্বদা
এই ভয় ছিল—পাছে ভারতীয় সৈন্যদের মনে লালদের মতবাদের ছোঁয়াচ লেগে যায়। এই কারণে
তাঁদের ওপরে কড়া নজর রাখা সঙ্গে তাঁদের মেলামেশা সম্পূর্ণ বারণ ছিল।
কিন্তু ব্রিটিশ অফিসারদের এত সতর্কতাও বিফল হয়ে গেল। বিপ্লবের ধারণাগুলি
ব্যারাকের পুরু দেওয়াল ভেদ করেও তার ভিতরে পৌঁছে গেলো। তার ফলে ভারতীয় সৈন্যদের
ভিতরে একটা উত্তেজনা দেখা দিল। কিছু সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বৃটিশ অফিসারদের
বিরুদ্ধে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে লালফৌজে এসে যোগ দিলেন।
নিকোলাই গিকালোর সৈন্যদলে যে-সকল ভারতীয় সৈন্য যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের কথা
এখন কিছু কিছু জানা গেছে। এই সকল সৈন্যরা দাগেস্তান ও কাবাদরি পার্বত্য অঞ্চলে
লড়াই করতেন। এই দলে একজন ভারতীয় অফিসারের নাম ছিল মুর্তজা আলী। তিনি যে
দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার জন্যে তাঁর কথা আজও লোকের মনে জাগরুক হয়ে
আছে। শ্বেত কসাক প্রতি-বিপ্লবীদের মনে তিনি ভীতির প্রতিমূর্তি হয়ে
দাঁড়িয়েছিলেন। তার সাহস, নির্ভীকতা ও
উপস্থিত বুদ্ধির কথা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল।
পিয়াটিক্স হতে প্রকাশিত “কমিউনিস্ট পথ” নামক কাগজখানা ১৯২২ সালে লিখেছিল:—
“নিকোলাই গিকালোর সৈন্যদলে শেষ পর্যন্ত যাঁরা ছিলেন তাঁদের ভিতরে মুর্তজা
আলী একজন। তিনি ছিলেন শত্রুর মনে ধোঁকা সৃষ্টিকারী পার্বত্য যোদ্ধা, শ্বেত প্রতিবিপ্লবীদের মনে
তিনি ছিলেন মূর্তিমান ভীতি, আর শত্রুর ওপরে
তিনি ছোঁ মারতেন ঠিক বাজপাখীর মতো।”
গৃহযুদ্ধের বীর সেনানী গিকালোর ভগ্নী ভেরা ফিয়োদোরোভনা তার ভ্রাতার
সৈন্যদলের আন্তর্জাতিক সৈন্যদের সম্বন্ধে অনেক কথা মনে রেখেছেন। তিনি বলছেন :
“আজ যখন আমি দু’টি বিশাল ভূমি—সোভিয়েত দেশ ও
ভারতের মধ্যে প্রীতির বন্ধনের কথা পড়ি তখন আমি অতীত দিনের কথা ভাবি। আমি ভাবি
সাহসী ও বিনয়ী আন্তর্জাতিকতাবাদী যোদ্ধাদের কথা। হতে পারে সংখ্যায় তাঁরা কম
ছিলেন, কিন্তু সাহসী
মুর্তজা আলীর মতো কর্তব্যের নির্দেশে আত্মবলিদানে তাঁরা কখনও পিছ-পা হননি।
“আমাদের বন্ধুত্ব রণক্ষেত্রের
রক্তের মোহরে দৃঢ়ীভূত হয়েছে। জাতিসমূহের ভিতরকার এই বন্ধুত্ব বরাবর অটুট থাকবে।”
ভেরা ফিয়োদোরোভনা গিকালোর লেখা হতে বোঝা যায় যে মুর্তজা আলী আত্মবলিদান
করেছেন, খোলাখুলি তিনি
বলেননি তার কি হয়েছিল। অন্য এক জায়গায় আমি পড়েছি যে একদিন যুদ্ধ করতে গিয়ে
মুর্তজা আলী আর ফিরে আসতে পারেননি। মানবেন্দ্রনাথ রায় তার “স্মৃতিকথা”য় ভারতীয় সৈন্যদের সম্বন্ধে আরও কিছু
তথ্যের উদ্ঘাটন করেছেন। এটা অবশ্য তুর্কমানিস্তান অঞ্চলের কথা। তিনি লিখেছেন
যে-সকল ভারতীয় সৈন্য ব্রিটিশ সেনাদল ত্যাগ করে এসেছিলেন তাঁদের সঙ্গে ইরানী
বিপ্লবীদের ও রুশ কমিউনিস্টদের নিয়ে একটা আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠনের চেষ্টা হয়। এই
চেষ্টা সফল হয়েছিল। ভারতীয় সৈন্যরা ছিলেন সীমান্তের পাঠান। রাইফেল হাতে নিলে তো
তাঁরা চিরদিনই দুর্ধর্ষ ছিলেন। এবার আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দিয়ে মেশিনগান
প্রভৃতি উচ্চতর গ্রামের যন্ত্রগুলির ব্যবহারেও তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি পারদর্শী হয়ে
উঠলেন। বৃটিশ সৈন্যদলে তাঁদের এসব অস্ত্র স্পর্শও করতে দেওয়া হতো না। পাঠানরা খুব
কষ্টসহিষ্ণু। তাই মরুভূমির যুদ্ধ তাঁরা অনায়াসে চালাতে পারলেন। গৃহযুদ্ধের আরম্ভ
হতেই যে-সকল রুশ অফিসার গেরিলা যুদ্ধে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন প্রথমে তাঁরাই
ভারতীয় সৈন্যদলের পরিচালনা করছিলেন, কিন্তু অল্পদিনের ভিতরে ভারতীয়দের ভিতর হতেই
অফিসার সৃষ্টি করা হলো। এর ফলে হলো আশাতীতরূপে ভালো। যে-সকল ভারতীয় সৈন্য তখনও
বৃটিশ সৈন্যদলে ছিলেন তাঁদের ভিতর হতে আরও বহুসংখ্যক সৈন্য এসে আন্তর্জাতিক
ব্রিগেডে যোগ দিতে লাগলেন। ট্রান্স-ককেশিয়ান রেলওয়ের ক্রাসনোভদ্স্ক হতে মার্ভ
পর্যন্ত রেল লাইনে ওপরে কড়া পাহারা রাখতে হয়েছিল। এই লাইনে গোলমাল হলে মধ্য
এশিয়ায় ককেশাসের তেলের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ইরানের খোরাসান প্রদেশের মাশ্হাদ
ছিল ব্রিটিশ সেনার একটি ঘাঁটি। তাই, হামলা শুরু হলো
মাশ্হাদ-আশ্কাবাদ রোডের ওপরে। আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের ইরানী বিপ্লবীরা নানা
ছদ্মবেশে ইরানের ভিতরে ঢুকে গিয়ে মাশ্হাদের পেছন হতেও বৃটিশ সৈন্যের ওপরে নানান
রকম উৎপাত শুরু করেছিল। এদিকে ভারতীয় সৈন্যরা মেশিনগান নিয়ে ওৎ পেতে থাকতেন।
তাঁরা ব্রিটিশ সৈন্যদের পেলেই অলক্ষিতে আক্রমণ করে বসতেন। সব কিছু মিলিয়ে অবস্থা
এই দাঁড়ালো যে এক বৎসরের কম সময়ের ভিতরে সোবিয়েৎ সীমানা হতে ব্রিটিশ সৈন্যরা
অপসারিত তো হলোই, ইরানের সমগ্র
খোরাসান প্রদেশ হতেও বৃটিশরা তাঁদের সৈন্য ঘাঁটিগুলি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলো।
তুর্কমানিস্তানে বৃটিশের প্ররোচনায় তুর্কমেনরা যে বিদ্রোহ করেছিল সে বিদ্রোহেরও
দমন হয়ে গেলো।
আমি মানবেন্দ্র রায়ের ‘স্মৃতিকথা’ হতে শুধু কিছু তথ্য নিয়েছি, তাঁর লেখার অনুবাদ কোথাও করেনি। রায় আমাদের জানাননি যে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ভারতীয় পাঠান সৈন্যরা কোথায় ছিলেন? তুর্কমানিস্তান ও ট্রান্স-ককেশিয়ায় যে-সকল ভারত সোভিয়েতের পক্ষ নিয়ে লড়েছিলেন তাঁদের মধ্য হতে একমাত্র মুর্তজা ছাড়া আর কোনো নামও আমরা জানতে পারিনি। জানিনা সোবিয়েৎ দেশে আরও কাগজপত্র পড়ার পরে আরও কিছু তথ্য উদঘাটিত হবে কিনা।*
*এই লেখার বেশির ভাগ তথ্য “In Common They Fought” নামক পুস্তক থেকে নেওয়া হয়েছে। মস্কোর ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজেস্ পাবলিশিং হাউস বইখানা ১৯৫৭ সালে প্রকাশ করছেন। —লেখক
Khub bhalo laglo ,,,ami Moscow te Chinese descent er ak shopkeeper er songe kotha bolechhilam ,,tar great grandfather Russia te kaj korte esechhilen !
ReplyDelete