সংকটে অসংগঠিত ক্ষেত্রঃ সাফাই কর্মচারীদের পার্মানেন্ট করার আর্জি খারিজ করল সুপ্রিম কোর্ট

ডেস্ক রিপোর্টঃ অঙ্কিতা সরকার 

গত ৭ই অক্টোবর, ২০২১ সুপ্রিম কোর্ট একটা রায় দিয়েছে, যেখানে তারা অসংগঠিত ক্ষেত্রের যে কর্মচারীরা রয়েছে যারা দিন প্রতি কাজের ভিত্তিতে মাইনে পায়, বা যাদের চাকরী পার্মানেন্ট নয়, তারা কোর্টের কাছে তাদের কাজ পার্মানেন্ট বা স্থায়ী করার যে আর্জি জানিয়েছিল, তা খারিজ করে দেয়। এই রায় কেন্দ্র সরকারের নয়াউদারবাদী এবং শ্রমিক বিরোধী সরকারি অবস্থানের কাছে কোর্টের মাথা নোয়ানোর একটি নজির হয়ে দাঁড়ালো। নব্বইয়ের দশক থেকেই 'সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবিউনাল'-এর কাছে বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রের নন-পার্মানেন্ট স্টাফরা তাদের কাজকে পার্মানেন্ট করার দাবি জানিয়ে আসছে। এই মর্মে চন্ডিগড় শহরের একটি পোস্ট অফিসের কিছু পার্ট টাইম সাফাই কর্মচারীরা সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবিউনাল-এর কাছে আর্জি জানায় যে তাদের কাজ পার্মানেন্ট করে দেওয়া হোক এবং পার্মানেন্ট কর্মচারীর মতোই তাদের মাসমাইনে দেওয়া হোক। যে বক্তব্য উঠে আসে সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবিউনালের অবস্থানে এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্টের ২০১৫ সালের রায়ে তা হল, এই সাফাই কর্মচারীদের সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করতে হয় এবং প্রত্যেক দিন তাদের চার থেকে পাঁচ ঘন্টা খাটতে হয়, ফলে এই কাজ করতে এসে অন্য কাজে যুক্ত হওয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে না; যতদিনে তারা কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে, ততক্ষণে তাদের ১৫ থেকে ২০ বছর কাজ করা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে যেটা দেখা যায়, সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুউনাল তাদের সরাসরি চাকরি পার্মানেন্ট করার রায় দিতে না পারলেও, তাদের মাইনে বৃদ্ধি করার এবং পার্মানেন্ট স্টাফ-এর মতই কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নির্দেশ দেয় পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার সরকারকে। আবার ১৯৯৯ সালে কর্নাটকের হাই কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, সেই সমস্ত পার্ট টাইম কর্মচারীদের পার্মানেন্ট করতে হবে, যারা ইতিমধ্যেই ১০ বছর টানা কাজ করে ফেলেছে এবং যারা ওই কাজের জন্য যে সমস্ত স্কিলগত চাহিদাগুলি রয়েছে সেগুলি তারা পূর্ণ করছে। তারা এই কথাটাও বলে, বারংবার সরকার যে অর্থ ব্যয় করছে এই পার্ট টাইম স্টাফেদের পার্মানেন্ট করার বিরুদ্ধে কোর্টের দারস্থ হয়ে, সেই একই পরিমাণ অর্থ তারা পার্ট টাইম স্টাফেদের মাসমাইনে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারে। পরে, ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে লক্ষণীয় যে, যখনই হাই কোর্ট রাজ্য সরকারকে চাকরি পার্মানেন্ট করার নির্দেশ দিয়েছে, তখনই সংবিধানের ২২৬ নং আর্টিক্যাল ব্যবহার করেছে যা বাদি-বিবাদির মধ্যেকার সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হাই কোর্টকে কিছু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকার অর্পণ করে থাকে সরকারকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে। কিন্তু ২০০৬-এ সুপ্রিম কোর্ট-এর একটি রায়ে চাকরি পার্মানেন্ট করার ক্ষেত্রে হাই কোর্টের নির্দেশ দেওয়ার যে অধিকার আর্টিকেল ২২৬-এর অধীনে সংবিধানে দেওয়া আছে, তার উল্টো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। বলা হয় যে এই আর্টিকেল কোনমতেই হাই কোর্টকে এই অধিকার দেয় না যে তারা রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিতে পারবে যে পার্ট টাইম কাজ পার্মানেন্ট করে দেওয়া যেতে পারে কারণ রাজ্য সরকারের পূর্ণ অধিকার আছে পার্ট টাইম কাজে লোক নিযুক্ত করা। গত ৭ই অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট আবার যে রায় দিয়েছে সেখানে, বিচারপতি এম. আর. শাহ এবং এ. এস. বোপান্না এই পার্ট টাইম কাজকে পার্মানেন্ট করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং তাঁরা বলেছেন যে, যদি সরকার কোন নির্দিষ্ট পার্মানেন্ট পদের বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে থাকে, তাহলে যে পার্ট টাইম পোস্টে নিযুক্ত করা হচ্ছে, কর্মচারীদেরকে সেই পার্ট টাইম পদেই কাজ করতে হবে; কারণ এটাই রাজ্য সরকারের যদি পলিসি হয়ে থাকে তাহলে তার এই অধিকার পূর্ণভাবে সংবিধানে স্বীকৃত। এমনকি তারা পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার হাই কোর্টের পূর্বতন যে রায় যেখানে রাজ্য সরকারগুলিকে  নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে পার্মানেন্ট স্টাফেদের মতো কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া বা মাইনে বৃদ্ধি করার, সেগুলিও তারা খারিজ করে দেয় এবং বলে যে হাই কোর্টের এই অধিকারই নেই যে তারা রাজ্য সরকারকে এই পার্মানেন্ট করার পলিসিগত নির্দেশ দিতে পারে। আবারও সংবিধানের আর্টিকেল ২২৬ ব্যবহারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়, ফলে সামগ্রিকভাবে যেটা বোঝা যাচ্ছে, আর্টিকেল ২২৬ সমানাধিকারের কথা বললেও সুপ্রিম কোর্ট সেই সমানাধিকার খর্ব করে রাজ্য সরকারের পার্ট টাইম কর্মচারী নেওয়ার অধিকারকেই বড় করে দেখছে। লক্ষণীয়, পার্ট টাইম কর্মচারীদের সাময়িক ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ দশ বছর একটানা যদি তারা কাজ করে থাকে, তাদের পার্মানেন্ট করে নেওয়াই উচিৎ। এমন কথা বারংবার দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক কোর্টে ধ্বনিত হয়েছে। কর্ণাটক হাইকোর্টের ১৯৯৯ সালের সেই ঐতিহাসিক রায়কে বারবার খর্ব করা হচ্ছে এবং বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট চণ্ডীগড়ের পার্ট টাইম সাফাই কর্মচারীদের অনুরোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। ফলে যেটা বোঝা যাচ্ছে, আইনি পথে পার্ট টাইম থেকে পার্মানেন্ট হওয়ার যে লড়াই তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার কারণ সুপ্রিম কোর্ট এই মুহূর্তে নয়াউদারবাদী অক্ষের কাছেই মাথা নুইয়ে রয়েছে। বরং লড়াই করতে হবে রাস্তায়, আন্দোলনই একমাত্র পথ এবং লড়াইয়ের অভিমুখ হোক কর্মসংস্থানকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দানের উদ্দেশ্য।

Picture Courtesy: hannibal.net 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার