বিশ্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি

বিমল কান্তি দাশগুপ্ত 



দুই বাঙালি দেখা হলে পরস্পরকে প্রশ্ন করেনকেমন আছেন উত্তর দাতা তিনটি বিষয়ের একটিকে আশ্রয় করেন যেমন দিনের আবহাওয়া বা বাজারদর অথবা স্বাস্থ্য আমরা শেষেরটিকে আশ্রয় করে কিছু কথা বলবার চেষ্টা করব

স্বাস্থ্যশরীর সংক্রান্ত বিষয় শরীর প্রকৃতির সৃষ্টি প্রকৃতিতে যত প্রাণী আছে সকলেরই স্বাস্থ্যভাবনা আছে শরীরকে সুস্থ রাখা এবং রক্ষা করবার জন্য কিছু প্রকরণ নির্দিষ্ট করা আছে নির্দিষ্ট করা এই প্রক্রিয়াকে বলে স্বাস্থ্যের নিয়ম বা স্বাস্থ্যবিধি।স্বাস্থ্যবিধির আওতায় আছে আহার কর্ম এবং বিশ্রাম কর্ম বলতে বুঝি খাদ্য আর বাসস্থানকে ঘিরে যাবতীয় কাজ এর পর থাকে বিশ্রাম

স্বাস্থ্যবিধির দুই দিক এক ভিতরের দিক আর আছে বাইরের দিক ভিতর অর্থে দেহের অভ্যন্তর ভাগবাহির বলতে বোঝায় দেহের বহিরঙ্গ অন্তর অঙ্গের স্বাস্থ্যের দায় বহন করে খাদ্য আর বহিরঙ্গের দায় থাকে পরিচর্যার

দেহ পরিচর্যা প্রাণীর স্বাভাবিক বৃত্তি আমরা দেখিপশু পাখিরাও নিজেদের অঙ্গ মার্জনা করছে যার যেমন ব্যবস্থা ঠোঁট নখ পা জিভ ইত্যাদির সাহায্যে আবার কখনও বা পরস্পপরে নিজেদের মাঝে গাত্র মার্জনা করছে প্রকৃতিতে প্রাণীদের বহিরঙ্গে নোংরা দেখা যায় একমাত্র অসুস্থ হলে না হলে সর্বদা তারা টিপ টপ

ব্যতিক্রম মানুষ মানুষের ক্ষেত্রে নিজের উভয় অঙ্গের পরিচর্যা নিজে করতে অনেক বছর অপেক্ষা করতে হয় শৈশবকাল কাটে তার পরনির্ভরতায় বাউল কবির কথায় মানব দেহে নয় দরজা এই নয় দরজাকে সুরক্ষিত রাখা দেহের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য একান্ত জরুরি। আর বয়স্বরা এবিষয়ে ছোটদের তালিম দিয়ে দেন শৈশবে

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ দেহের পরিচর্যা পরিষ্কার জলে চোখ মুখ ধোয়া দাঁত মাজা মলত্যাগ এবং সৌচ করা এসকল কাজে যে যে উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেগূলি সমাজ আর প্রকৃতিতে স্বাভাবিক ভাবে যা পাওয়া যায় যেমন মাটি পোড়া কাঠের কয়লা উনানের ছাই বিভিন্ন গাছের ডাল পাতা লবন তেল খড়িমাটি এমনই সব প্রাকৃতিক দ্রব্য এর পর আছে নিয়মিত নখ কাটা চুলের যত্ন নেওয়া বড়দের তালিম পেয়ে শিশু এক সময় এবিষয়ে স্বাবলম্বি হয়ে ওঠে স্বাস্থ্যের এই নিয়ম বড়োছোট নির্বিশেষে দুনিয়ার তাবত মানুষের অঙ্গচর্চার প্রচলিত বিধি

এবার একটু অন্য কথা মানুষের সভ্যতা এগিয়ে চলেছে আদিম মধ্য আধুনিক যুগ পার হয়ে সভ্যতা এখন অতিআধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির উন্নতি মানুষকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে। চলা কিন্তু থেমে নেই। সভ্যতার বদল মানে সমাজের বদল। শিক্ষা সংস্কৃতি অর্থনীতি রাজনীতি তাবত বিষয়ের বদল। ফলে যা ছিল তা হারিয়ে যাচ্ছে। যা আছে তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না। পুরাতন বর্ণভেদি সমাজের বদলে বর্তমানে  শ্রমবিভক্ত সমাজের আবির্ভাব ঘটেছে সমাজ সরাসরি দুটি শ্রেণিতে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে আছে ধনী আর দরিদ্রের ভেদ স্পষ্ট

প্রকৃতিতে বদল ঘটেছে দূষণমুক্ত পৃথিবী আজ অতীতের বিষয় এই দ্বিমুখী বদলের চিহ্ন স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে মানুষের দেহে নতুন নতুন রোগের আক্রমণ ঘটছে ভিতর বাহির উভয় দিকে তার প্রকাশ রোগের হাত থেকে পরিত্রাণের জন্য নয়া নয়া প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে সেগুলো বাজারজাত হচ্ছে মানুষ কিনছে এবং নিজেকে সুরক্ষিত রাখছে কিন্তু পরিতাপের বিষয়ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকা সে সব প্রতিষেধক বেশির ভাগ মানুষের নাগালের বাইরে অন্যদিকে প্রকৃতিতে পাওয়া স্বাভাবিক উপকরণ সে-ও এখন অতীত চর্চার বিষয় ফলে দরিদ্রের দেহ বর্তমানে ব্যাধির নিরাপদ বাসস্থান

একই ভাবে দেহের অভ্যন্তরের স্বাস্থ্য বিষয়ে একই  অভিজ্ঞতা সেখানে প্রধান উপকরণ খাদ্য। অথচ খাদ্যের বন্টনে চালু আছে অসম ব্যবস্থা। খাদ্যের দুষ্প্রাপ্যতা। সমাজ যত উন্নত হচ্ছে প্রকৃতি থেকে খাদ্যসামগ্রীর প্রত্যক্ষ যোগান ততই নিরুদ্দেশ হচ্ছে। প্রকৃতির ভাণ্ডারের খাদ্যসামগ্রীতে সকলের সমান অধিকার। কিন্তু সভ্যজগতের অন্য নিয়ম। আর্থিক সামর্থ্য খাদ্যপ্রাপ্তির মাপকাঠি। সেকারণে বিশ্বে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে দারিদ্র্য খালিচোখে দেখা যায়। বিশ্বের এক বিশাল জনগোষ্ঠী  অপুষ্টির কারণে নানা ব্যাধির শিকার। আর বেশি বেশি মৃত্যু সরবরাহ করে বিশ্বজনসংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখবার দায় বহন করে চলেছে।

আরও কথা আছে। এ পর্যন্ত আমরা দেহের স্বাস্থ্যবিষয়ে আলোচনা করেছি। দেহের ভিতর এবং বাহির দু’দিকের বিষয়ে আলোচনা করা  গেল। কিন্তু এতেই কি সব। যার বিষয়ে এত আলোচনা সেই দেহ নিজে আছে কোন আধারে। তার আশ্রয় তো পৃথিবী নামের এই গ্রহ। আর দেহের স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে পৃথিবীর স্বাস্থ্য। অথচ তার স্বাস্থ্য তো খুব একটা ভালো যাচ্ছে না ইদানীং। মানুষের করা দূষণে পৃথিবীগ্রহের আজ মহা অসুখ। তার নিজের অস্তিত্বই আজ প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের মুখ চেয়ে।

জীবকুলের যাবতীয় স্বাভাবিক বর্জ্য আত্মস্থ করবার ক্ষমতা রাখে পৃথিবী। এবং করেও। সমস্যা যত মানুষকে নিয়ে। প্রকৃতির সৃষ্ট মানুষ। প্রকৃতির প্রতিদ্বন্দ্বী। তার প্রযুক্তিগত আবিষ্কার থেকে যে বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার অনেকটাই আত্মস্থ করা প্রকৃতির পক্ষেও খুব সহজ নয়। যে কারণে পৃথিবী নিজেই অস্তিত্বের সঙ্কটে আছে।

সচেতন মানুষ, সমাধানের পথের সন্ধানে সচেষ্ট। প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পরিবেশকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক রাখবার একমাত্র উপায়। মেনে নিলেও একমাত্র বাধা প্রযুক্তিগত উৎপাদনের অধিকার ব্যক্তি অথবা ছোট ব্যক্তিগোষ্ঠীর অধিকারের সীমানায় আবদ্ধ। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে সমাজের স্বাভাবিক সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হয় না।

পৃথিবী এবং জীবকুলের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখবার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গঠন করেছে, বিশ্বের সকল রাষ্ট্র মিলিত হয়ে। কিন্তু এবিষয়ে তার ক্ষমতা রাষ্ট্রসমূহের কাছে আবেদন করা, দারিদ্র্যতার কারণে যেন কোনো মানুষের মৃত্যু না ঘটে। এ যেন ডাকাতকে অনুরোধ করে বলা সব নিচ্ছ, নাও, কিন্তু প্রাণে মেরো না। অনেকটা সে রকমের নয় কি। 


Picture Courtesy: The Wire 

       

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!