হন্ডুরাস: কাস্ত্রো কি বামপন্থী থাকতে পারবে?
সুরজিত মন্ডল
সাম্প্রতিক ২০২১-এর হন্ডুরাসের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লিব্রে পার্টির তরফ থেকে জিয়ামারা কাস্ত্রো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। কংগ্রেসে তাঁদের পার্টির সংখ্যাধিক্য থাকলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁর পার্টি পেতে পারেনি, ফলে জোট করেই কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করতে হবে। কংগ্রেসে বরং ডানপন্থী ন্যাশনাল পার্টির বিশেষ প্রভাব থাকতে চলেছে। 'লিব্রে' একটা স্প্যানিশ শব্দ থেকে আসছে, যার অর্থ মুক্তি। লিব্রে পার্টি তৈরি হয়েছে ২০১১ সালে এবং পার্টির পুরো নাম হচ্ছে লিবার্টি অ্যান্ড রিফাউন্ডেশান।
২০০৬ সালে কাস্ত্রোর স্বামী হোসে ম্যানুয়েল জেলায়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তৎকালীন লিবারেল পার্টির তরফে। লিবারেল পার্টি একটি ডানপন্থী পার্টি। জেলায়া এর আগেও হন্ডুরাসে অন্যান্য যে ডানপন্থী সরকারগুলোর এসেছে, তাদের অর্থ মন্ত্রকের বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন; উল্লেখ্য যে সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট বা সামাজিক বিনিয়োগ দপ্তরে তিনি কাজ করেছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে অনেক সময় আর্থিক কারচুপির যেমন অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। তিনি মোটামুটি ডানপন্থী অর্থনীতির কাছাকাছিই অবস্থান করেছেন সেই সময়ে। কিন্তু যখন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন, দেখা গেল যে তাঁর আস্তে আস্তে ডান থেকে বামপন্থার দিকে একটা ঝোঁক তৈরি হচ্ছে। তিনি ক্ষমতায় এসেই ALBA বা বলিভেরিয়ান অ্যালায়েন্স ফর দ্য পিপল'স অফ আওয়ার আমেরিকা নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী জোট এবং একইসাথে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করলেন যাতে কম দামে তেল পাওয়া যায়। অন্যদিকে, কিউবার সাথে তিনি সুসম্পর্ক স্থাপন করলেন যার ফলে নিজের দেশের শাসকশ্রেণীর একটা বড় অংশ জেলায়ার বিরুদ্ধে চলে গেল এবং স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হল। জেলায়া মোটের উপর যে অর্থনীতি চালিয়েছেন সেটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বাইরে কিছুনা, শুধু তারই মধ্যে একটা 'মানবিক' দৃষ্টিকোণ তিনি রেখেছিলেন। তাই আমরা দেখতে পাই যে তাঁর রাষ্ট্রপতিত্বের সময় দেশে গরীবী ১০% কমে যায়। স্কুলগুলোতে মিড ডে মিল-এর ব্যবস্থা চালু করা হয়, শিক্ষাকে অবৈতনিক করে দেওয়া হয়, ছোট কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া হয়, ব্যাংকের ঋণের সুদ কমিয়ে দেওয়া হয়। এর সাথে লক্ষণীয় যে গৃহপরিচারক বা পরিচারিকাদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হয়, শিক্ষক এবং অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়। এই ধরণের সামাজিক সুরক্ষার পদক্ষেপগুলো তিনি নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, তিনি সংবিধান পরিবর্তনের পথে এগোন। তিনি একটা কন্সটিটুয়েন্ট আ্যসসেম্বলি তৈরি করে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন ১৯৮২ সালের সংবিধান। এখানে বিতর্কটা হচ্ছে, ডানপন্থীরা মূলত প্রচার করে জালেয়া নিজের রাষ্ট্রপতিত্বের সময়সীমা বাড়াতে এই সংবিধান পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, আবার বামপন্থীরা প্রচার করে যে আসলে এই সংবিধান পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই রাফায়েল কোরেয়া, ইভো মোরালেজ এবং হুগো শাভেজের মত লাতিন আমেরিকার নেতারা তাঁদের দেশে একটা বাম ঘেঁষা অর্থনীতি প্রণয়ন করার চেষ্টা করে গেছেন, ফলে সেটাকে আটকানোর জন্য এই অপপ্রচার। হন্ডুরাসে এই সাংবিধানিক পরিবর্তন আনতে গেলে কংগ্রেসে সংখ্যাধিক্য দরকার; যদি সেটা না থাকে তাহলে গণভোট করতে হবে। কিন্তু সেই গণভোটের প্রক্রিয়ার দিকে জালেয়া এগোলেও তাঁকে আটকাতে সেই সময় কংগ্রেস, সুপ্রিম কোর্ট এবং সেনা তাঁর বিরুদ্ধে যায়, যার ফলে ২০০৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁর সরকারকে ফেলে দেওয়া হয় এবং তিনি দেশান্তরী হন। সামরিক সরকারের পরবর্তী পর্যায়ে তিনখানা পরপর উগ্ৰ ডানপন্থী সরকার নির্বাচিত হয়েছে সেই দেশে। জালেয়ার স্ত্রী জিয়ামারা ২০১৩ সালে ভোটে হেরেছেন এবং ২০২১ সালে এসে জিতলেন। ২০১১ সালে লিব্রে পার্টির প্রতিষ্ঠা করেন জালেয়া, যে পার্টি বর্তমানে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতেছে। লক্ষণীয়, যে লিবারেল পার্টিতে আগে জালেয়া ছিলেন, সেটা ছিল ডানপন্থী পার্টি। লিব্রে পার্টি মূলত বাম ঘেঁষা। এই পার্টির চরিত্র দেখলে বোঝা যায় তারা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, বামপন্থী পপুলিস্ট এবং একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের প্রচারকদের শিবিরভুক্ত।
জালেয়া যে রাজনীতি নিয়ে চলেছিলেন সেটা ছিল পুঁজিবাদের মধ্যেই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণ মানুষকে কিছু স্বস্তি দেওয়া। তাঁকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফেলে দেওয়ার ১২ বছর পর আজকের জিয়ামারা কাস্ত্রো আবার ক্ষমতা দখল করেছেন। বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন যে জালেয়ার থেকে জিয়ামারা অনেক বেশি মধ্যপন্থী। জিয়ামারা মূলত মহিলা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন লিবেরাল পার্টিতে থাকাকালীন এবং লিব্রে পার্টি তৈরি হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন বাম ঘেঁষা কর্মসূচীর কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। মহিলাদের গর্ভপাতের ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে কিছু অধিকার দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি কিন্তু এবারের নির্বাচনের সময় তিনিই আবার অন্য শুরে বলেছেন যে সাধারণ মানুষই ঠিক করবে যে এই গর্ভপাত আইন আদৌ থাকবে কি থাকবে না। অর্থাৎ তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন না। দেশের চেম্বার অফ কমার্স তাঁর সাথে বিশেষ সুসম্পর্ক রাখছে। ফলে মধ্য লাইনে মোটামুটি থেকে নয়াউদারবাদী পথে কাস্ত্রোর এগানোর প্রভূত সম্ভাবনা আছে কারণ তিনি বা তাঁর স্বামী মূলগতভাবে বামপন্থার কোন কিছুর ধার দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেননি; বরং ডানপন্থী পার্টি দিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। পরে বামপন্থার শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেটাও ছিল পুঁজিবাদের মধ্যে সীমিত পরিসরে সাধারণ মানুষের কিছু উপকার করা মাত্র। মূলগতভাবে যে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ তাঁর স্বামী চালিয়ে গেছেন, তিনিও যে তাই চালাবেন তার ইঙ্গিত কিন্তু রয়েছে। কিন্তু তবুও যেটা লক্ষণীয় যে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মাঝখানে যে ক্ষুদ্র ভূমিখন্ড সেখানে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য চলে; কিন্তু সেখানেই অবস্থিত একটি অতি ক্ষুদ্র দেশ হন্ডুরাসে যদি বামপন্থার উত্থান হয় সেটা আনন্দেরই কিন্তু একই সাথে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে যে আমরা যেন আবারো পেরুর পেদ্রো ক্যাস্টিলোর উত্থানের সময় যে উল্লাস করেছিলাম, সেই একই উল্লাস করে নিরাশ না হই। তার কারণ আমরা ক্যাস্টিলোর রাষ্ট্রপতিত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় সদর্থক ভাবনা রেখেছিলাম কিন্তু একই সাথে আমরা এই প্রশ্নটাও রেখেছিলাম যে সে কতটা বামপন্থী হিসেবে টিকে থাকতে পারবে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। দুর্ভাগ্যবশতঃ ক্যাস্টিলো বামপন্থী থাকতে পারেনি কারণ ক্ষমতায় আসার পর যেটা দেখা গেছে যে তার অর্থমন্ত্রীর (ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রাক্তন কর্মী) প্রভাব বেড়েছে সরকারের পদক্ষেপগুলির উপর এবং বামপন্থী পার্টির মন্ত্রীদেরকে আস্তে আস্তে পদচ্যুত করা হয়েছে। সে ভেনেজুয়েলা এবং কিউবা উভয়ের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছে এবং যত দিন যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তার নির্ভরশীলতা বাড়ছে। অর্থাৎ ক্যাস্ট্রো যে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে তা আইডেন্টিটি পলিটিক্সের বাইরে আর কিছুই নয়। এইরকম পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা চিন্তিত যে হন্ডুরাসে আদৌ বামপন্থা টিকবে কিনা এবং থাকবে কিনা কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে যে ১২ বছর ধরে যে তিনখানা উগ্ৰ ডানপন্থী সরকার থেকেছে তাদের নেতারা ছিল ড্রাগ মাফিয়া এবং ব্যাপক পরিমাণে দুর্নীতির প্রতিভূ। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় ন্যূনতম সরকারী অর্থ ব্যয় করেনি। এইরকম একটা পরিস্থিতি থেকে যদি সাময়িকভাবে সাধারণ জনগণকে জিয়ামারা কাস্ত্রো স্বস্তি দিতে পারেন, তবে সেটা সদর্থকই কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, শ্রেণী সংগ্রাম ব্যতীত আর্থিক বৈষম্যের দীর্ঘমেয়াদী সমাধান সম্ভব নয়।
Picture Courtesy: Voz de la Diaspora
Comments
Post a Comment