চিলি: গেব্রিয়েল বরিক কি আলেন্দের উত্তরসূরি?

সুরজিত মন্ডল 

সাম্প্রতিক চিলির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গেব্রিয়েল বরিক জয়ী হয়েছে। বরিক জয়ী হওয়ার ফলে সারা বিশ্বজুড়ে বামপন্থীদের মধ্যে উল্লাস এবং উন্মাদনা দেখা দিয়েছে। বরিকের পরিচয়, কোন রাজনৈতিক ধারা থেকে তার উত্থান এবং শুরু থেকে সে যে অবস্থানগুলো নিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে কোন ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান সে নিতে পারে এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে সংসদের কতটা সমর্থন লাভ সে করবে, তা নিয়ে এই আলোচনা। সম্ভবত, ওই দেশে এই প্রথম তথাকথিত নন-পার্টিজান বা অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কোনো প্রতিনিধি সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করল।

বরিক কোন রাজনৈতিক ধারা থেকে এসেছে, সেটা বুঝতে গেলে জানা দরকার চিলির রাজনৈতিক ইতিহাস। লক্ষণীয় যে সালভাডর আলেন্দে চিলির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার তিন বছরের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এয়ার স্ট্রাইক-এর মাধ্যমে তাঁর সরকারের পতন ঘটিয়েছিল; প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অগাস্টো পিনোশের সামরিক একনায়কতন্ত্র। সেই একনায়কতন্ত্রের শেষ লগ্নে ডানপন্থীদের মধ্যে থেকেই পিনোশের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া শুরু হয় এবং বিভিন্ন বিরোধী জোট তৈরি হতে শুরু করে। এদের মধ্যে আমাদের দেশের কংগ্রেসী ঘরানার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ মতাদর্শের জোট 'কনসারটেশিয়োঁ'। এটি পিনোশে বিরোধী জোট হিসাবেই খ্যাত ছিল। এই জোটের অধীনে থাকা বিভিন্ন পার্টির সদস্যরা পিনোশের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরবর্তী সময় একটানা ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হয়েছে। এই কনসারটেশিয়োঁ-র শেষ সরকার হল মিশেল ব্যাচেলেট নেতৃত্বাধীন সরকার; সময়কাল ২০০৬ থেকে ২০১০ অব্দি। ব্যাচেলেট সোস্যালিস্ট পার্টির সদস্য এবং নিজের রাষ্ট্রপতিত্বের প্রথম অংশে যে অবস্থানগুলি সে নিয়েছিল তা হল, দেশের পেনশন ব্যবস্থার সংস্কার করা যাতে পেনশনের আওতায় আরো বৃহৎ অংশের মানুষ আসতে পারে, কন্ট্র‍্যাকচুয়াল শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন এবং প্রাইভেট সেক্টরে পুরুষ এবং মহিলাদের বেতন যাতে সমান হয় তার পক্ষে সওয়াল করা। তার সোস্যালিস্ট পার্টি মূলগতভাবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট মতধারার অংশ, যার ফলে সে বহু সামাজিক সুরক্ষার পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও মূলগতভাবে তার সরকার কিন্তু ডানপন্থা অর্থাৎ ইকোনোমিক লিবারালিজম বা অর্থনৈতিক উদারবাদ, ফ্রি ট্রেড বা মুক্ত বাণিজ্য এবং মার্কেট ইকোনোমি বা বাজার অর্থনীতি-র পক্ষে ছিল। এই কারণে, এই পার্টি নয়াউদারবাদের খুব একটা বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেনি। উল্লেখ্য, সোস্যালিস্ট পার্টির পূর্ববর্তী যে পার্টি কনসারটেশিয়োঁ জোটের অধীনে ক্ষমতাধীন ছিল তার নাম 'পার্টি ফর ডেমোক্রেসি'। এই পার্টির অবস্থানও একইরকম ছিল। এই ধরনের প্রাথমিক অবস্থান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে কংগ্রেসী কিংবা জনতা ঘরানার আঞ্চলিক পার্টিগুলি শুরুর দিকে রেখেছিল; যদিও সামাজিক সুরক্ষা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কংগ্রেসী ঘরানার আঞ্চলিক পার্টি (যেমন আমাদের রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস) অনেক বেশি দুর্নীতিগ্রস্থ এবং সেই পলিসিগুলি আদতে বাস্তবায়িত কতটা হয় তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। আদতে এরা সবই ডানপন্থী এবং যত সময় এগিয়েছে এরা নয়াউদারবাদের পক্ষে জোড়ালো সওয়াল করতে শুরু করেছে। সেই সন্দেহের নির্যাস চিলির ক্ষেত্রেও রয়েছে কারণ পার্টি ফর ডেমোক্রেসি বা সোস্যালিস্ট পার্টি অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়াউদারবাদকে সর্মথন করে এসছে এবং তাদের সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিসর তৈরিতে ব্যর্থতার পরিস্থিতিতেই উগ্র ডানপন্থী রাজনীতি ত্বরান্বিত হয়েছিল।

এই নয়াউদারবাদ কিছু ডানপন্থী সরকারের নেওয়া কোনও পলিসি নয় বরং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি বিবর্তিত পর্যায়; অর্থাৎ পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদী পর্যায় থেকে সে নয়াউদারবাদী দশায় উন্নীত হয়েছে। এর কারণ হল, পূর্বতন ওয়েলফেয়ার বা কেনশিয়ান ইকোনোমি যা সারা বিশ্বজুড়ে চলছিল, তার প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য ছিলঃ প্রথমত, তৎকালীন বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাধীন কমিউনিস্ট সরকারগুলির হাত থেকে নিজেদের অর্থনীতিকে রক্ষা করার একটা মরিয়া প্রয়াস, এবং দ্বিতীয়ত, ইনপুট-আউটপুটের ভারসাম্যের অভাবের মধ্যে দিয়ে তৈরি হওয়া পুঁজিবাদের মধ্যেকার আভ্যন্তরীন সংকটকে মেটানোর একটা প্রয়াস।যেহেতু সামগ্রিকভাবে ইনপুট এবং আউটপুট পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে কখনোই সমান হয়না, ফলে এই ওয়েলফেয়ার ইকোনোমি দীর্ঘদিন চালানোর পরেও মূলগতভাবে সে সংকট মেটেনি বরং একটা বিবর্তিত রূপ গ্রহণ করেছে। এর পরিণতিতে এই সংকটকে নতুনভাবে মেটানোর জন্য নয়াউদারবাদী পর্যায়ে পুঁজিবাদ উন্নিত হয়েছে যার ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় একটা আমূল পরির্বতন চলে এসেছে। এর পরিণতিতে লক্ষ্য করা য়ায যে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে যে সরকারই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হোক না কেন, তাকে যদি মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হয় বা সফ্ট পলিসি গ্রহণ করতে হয়, তাহলে মূলগতভাবে নয়াউদারবাদের পক্ষেই যেতে হবে, নতুবা তাকে কোনো বৈপ্লবিক অবস্থান গ্রহণ করতেই হবে যা নয়াউদারবাদকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়তে পারে। 

লক্ষনীয় যে মিশেল ব্যাচেলেটদের অবস্থানের ফলে লক্ষ্য করা যায় যে ২০১০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কনসারটেশিয়োঁ জোট হেরে যায় এবং উগ্র ডানপন্থী সেবাস্তিয়ান পিনেরা ক্ষমতাধীন হয়। সে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলে। এই সময় সে শিক্ষার প্রাইভেটাইজেশান শুরু করে, যার বিরুদ্ধে  ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চিলিতে ছাত্র আন্দোলন চলতে থাকে। এই আন্দোলন সারা বিশ্বকে দেখায়, যে চিলি নয়াউদারবাদী এক্সপেরিমেন্টের প্রাথমিক গবেষণাগার ছিল, সেই এক্সপেরিমেন্টের বিরুদ্ধেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে ছাত্র রাজনীতি। ২০১৪ সালে পিনেরা নির্বাচনে হেরে যায় এবং মিশেল ব্যাচেলেট আবার ক্ষমতা লাভ করে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সে ক্ষমতায় থাকাকালীন পূর্বতন জোটের অবসান ঘটিয়ে 'নিউ মেজোরিটি' নামে নতুন জোট তৈরি করে। এই জোট ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলা ছাত্র আন্দোলনের দাবীগুলির নিরিখে নিখরচায় শিক্ষা প্রদানের একটি কর্মসূচী গ্রহণ করে; এই জোটে চিলির কমিউনিস্ট পার্টিও যুক্ত ছিল। মিশেল ব্যাচেলেট কর্পোরেট ট্যাক্স বৃদ্ধি করে প্রাপ্ত অতিরিক্ত রাজস্ব দিয়ে নিখরচায় শিক্ষা প্রদানের বক্তব্য রাখে। এই ধরনের অবস্থান সে আগেও নিয়েছে। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে পূর্বতন একটি সরকারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সে 'AUG প্ল্যান' গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী নিখরচার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা ফ্রি ইউনিভার্সাল হেল্থ (Free Universal Health) প্রণয়নের কথা বলতে থাকে; যদিও এটা কতটা সফল তা একটা বড় প্রশ্ন।

২০১৮ সালে মিশেল ব্যাচেলেট হেরে গেল এবং পিনেরা আবার ক্ষমতাধীন হল। পিনেরার উগ্র ডানপন্থী সরকার ২০১৮ থেকে ২০২১ অব্দি ক্ষমতায় ছিল। তার এবারের অবস্থানগুলির মধ্যে ছিল শিক্ষার বেসরকারিকরণ, মাপুচে আদিবাসীদের উগ্রপন্থী চিহ্নিত করে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা, ন্যাচারাল গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা, অ্যান্টার্কটিকার হিমশৈলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজ বন্ধ করার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, যানবাহনের খরচ বৃদ্ধি এবং প্রতিবাদ করলেই চিলির সেনা নামিয়ে প্রতিবাদীদের অধিকার খর্ব করা। 'প্যান্ডোরা পেপারস' সর্বসমক্ষে চলে এলে দেখা যায় মিনেরা-ডমিঙ্গা নামে একটি সংস্থা থেকে ঘুষ নিয়ে পিনেরা দেশের কিছু কয়লাখনি তাদের প্রদানের অবস্থান নিয়েছিল। 

স্বাভাবিকভাবে ২০২১ সালের নির্বাচনে পিনেরার জোট পরাজিত হয়েছে এবং গেব্রিয়েল বরিক জয়ী হয়েছে। চিলি যে ইতিহাসের ধারা বহন করছে তাতে দেখা যাচ্ছে পিনোশে পরবর্তী যুগে মূলগতভাবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট ও ডানপন্থীরাই ক্ষমতায় ছিল এবং তাদের মধ্যপন্থার ত্রুটিগুলিকে কাজে লাগিয়ে উগ্র ডানপন্থী পিনেরা বারংবার ক্ষমতাধীন হয়েছে; অর্থাৎ আমাদের দেশের ডানপন্থী কংগ্রেস এবং উগ্র ডানপন্থী বিজেপি যেমন কেন্দ্রে সরকার গঠন করে এসেছে।  

আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে, কারুর উত্তরসূরি কি বরিক হতে চলেছে, নাকি সে কোনও নতুন ধারার জন্ম দেবে। বরিক কি সালভাডর আলেন্দের উত্তরসূরি হিসেবে বৈপ্লবিক অবস্থান গ্রহণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়ে আবার ক্ষমতাচ্যুত হবে? সে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধকে আটকাতে পারবে? নাকি, বরিক কনসারটেশিয়োঁ বা নিউ মেজোরিটি জোটের অর্থনৈতিক অবস্থানের উত্তরসূরি হয়ে আরও একটা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বা ডানপন্থী সরকার চালাতে থাকবে - অর্থাৎ মুখে থাকবে বাম বুলি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ডানপন্থাকে সে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই প্রশ্নগুলির উত্তর আমরা ভবিষ্যতেই পাবো যখন এই সরকার তার বিভিন্ন অবস্থানগুলি স্পষ্ট করে তুলবে; ঠিক যেমনভাবে বাম বুলি মুখে নিয়ে পেরুতে ক্যাস্টিলো ক্ষমতাধীন হওয়ার পরে এখন সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দালালী ছাড়া আর কিছুই করছে না। 

বর্তমানে চিলির সংসদের নিম্নকক্ষ বা চেম্বার অফ ডেপুটিস-এ ৫৩ আসনে উগ্র ডানপন্থী চিলি-ভামোস জোট জিতে রয়েছে। গেব্রিয়েল বরিকদের বামপন্থী 'এপ্রুয়েবো ডিগনিড্যাড' বা 'অ্যাপ্রুভ ডিগনিটি' জোট তাদের থেকে কম আসেন জয়ী রয়েছে। যদি আমরা উচ্চকক্ষ বা ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর দিকে তাকাই, ৭২ আসনে উগ্র ডানপন্থী চিলি-ভামোস জয়ী রয়েছে এবং বামপন্থী জোটগুলির আসন সংখ্যা কম। অর্থাৎ বরিকের রাষ্ট্রপতিত্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সংসদ কারণ তার উচ্চ এবং নিম্ন উভয় কক্ষই উগ্র ডানপন্থীদের হাতে রয়েছে, যাদের বরিকের পলিসির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। 

অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমরা দেখব যে শিক্ষার পরিসরে নয়াউদারবাদী বেসরকারিকরণ নীতির বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন চলে ২০১০-১৩ সাল অব্দি, তাতে লক্ষ করা যায়, ২০১১ সালে 'ইউনিভার্সিটি অফ চিলি স্টুডেন্ট ফেডারেশন' (FECH)-এর সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির যুবলীগের সদস্যা ক্যামিলা ভ্যালেজোকে হারিয়ে গেব্রিয়েল বরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে। সে মূলগতভাবে অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনের ধারারই অংশ ছিল। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে সে 'ব্রড ফ্রন্ট' নামে একটি জোটে যুক্ত হয় যা নয়াউদারবাদকে ছুঁড়ে ফেলে সোস্যালিস্ট মডেলের সামাজিক উন্নতির পক্ষে সওয়াল করেছিল। কিন্তু ২০১৭-র নির্বাচন এগিয়ে আসতে শুরু করলে দেখা যায় যে ব্রড ফ্রন্ট হারের মুখ দেখবে, ফলে পিনেরা যাতে সরকারে ফিরে না আসে, বরিক নিউ মেজোরিটি জোটকে সমর্থন করে; সেই নিউ মেজোরিটি বা ডানপন্থী জোট যার বিরুদ্ধে সে এতদিন লড়াই করে এসেছে। এই পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হয়নি। পিনেরাই ক্ষমতাধীন হয় ঐ নির্বাচনে।

এরপর লক্ষ করা যায়, বরিকের প্রাথমিক যে রাজনৈতিক দল, 'অটোনমাস লেফ্ট', যেটা ২০১৬  সালে তার নিজের হাতে তৈরি, তাতে ২০১৮ সালে ভাঙন ধরে। এই ভাঙনের কারণ হিসেবে তারই বন্ধু এবং একদা ছাত্রনেতা আন্দ্রে ফিলবম বলে যে অটোনমাস লেফ্টের যে আভ্যন্তরীন কার্যকলাপ তা ছিল অগণতান্ত্রিক এবং বরিক সব সিদ্ধান্ত নিজেই একা নেওয়ার চেষ্টা করত। তার মতে, বরিক আসলে পপুলিস্ট মতধারার। সে কিছু বিখ্যাত মানুষকে ভিরিয়ে দ্রুত একটা বড় সংগঠন তৈরির প্রচেষ্টা করছিল, যে কারণে রাজনৈতিক এবং মতাদর্শগত দিক থেকে সেই সংগঠন ছিল যথেষ্ট ভঙ্গুর। ফিলবম বলে যে পার্টি ফর ডেমোক্রেসি যা কনসারটেশিয়োঁ জোটের অধীনে ছিল, তার থেকে আর একটু বেশি বাম ঘেঁষা অবস্থান গ্রহণের বাইরে বরিক আর বেশিকিছুই করতে চাইছিল না। তারা অটোনমাস লেফ্ট সংগঠন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা করে সংগঠন তৈরি করে, ফলে এই জোট ভেঙে যায়। 

বরিক ২০১৮ সালে নতুন করে 'সোশ্যাল কনভারজেন্স' নামে একটি সংগঠন তৈরি করে যা ব্রড ফ্রন্ট জোটের মধ্যে ছিল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এই ব্রড ফ্রন্ট মতধারার দিক থেকে একটু কম বামপন্থী। অন্যদিকে, এপ্রুয়েবো ডিগনিড্যাড নাকি মতধারার দিক থেকে একটু বেশি বামপন্থী। এই এপ্রুয়েবো ডিগনিড্যাড-এর মধ্যে আছে ব্রড ফ্রন্ট ও 'চিলি ডিগনো'। এই চিলি ডিগনো জোটের মধ্যে আছে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি। ফলে, এবার যে সোশ্যাল কনভারজেন্স সংগঠন বরিক তৈরি করল তা কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনও পেয়ে গেল। লক্ষণীয়, ২০২১-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাথমিক পর্যায় বা প্রাইমারীজ-এ এপ্রুয়েবো ডিগনিড্যাড-এর নেতা কে হবে তা নিয়ে যখন নির্বাচন হয়, তখন কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী ক্যান্ডিডেট ড্যানিয়েল জ্যাডুকে বরিক হারিয়ে দেয় এবং সে নিজে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের একজন ক্যান্ডিডেট নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত হয়ে সে নয়াউদারবাদকে খতম করার কথা বলে। সে সফল হবে কিনা সেটা ভবিষ্যতই বলবে। 

যে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি বরিকের জোটকে সমর্থন করছে, তার অন্যতম নেত্রী ক্যামিলা ভ্যালেজো নিজেও একজন ছাত্র নেত্রী ছিল কিন্তু সে ছাত্র নেত্রী থাকাকালিন একটি বেসরকারি সংস্থা, যে প্রি-ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন কোর্স নিয়ে ব্যবসা করে, তার সাথে একটি অবৈধ কনট্রাক্ট করে বেশকিছু টাকার বিনিময়ে এবং ভ্যালেজোকে হারিয়ে যখন বরিক নিজে FECH-এর নেতৃত্বে আসে, তখন সে ভ্যালেজোর এই কান্ডটা ধামাচাপা দিয়ে দেয়। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা বোঝায় যে ভ্যালেজো নির্ভর চিলির কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক মতধারা বর্তমানে তরলীভূত বা ডাইলিউটেড। এর বাইরে প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন বলে একটি বামপন্থী জোট রয়েছে যার মধ্যে 'চিলিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি (প্রলেটারিয়ান অ্যাকশন)' এবং 'রেভেলিউশনারি লেফ্ট মুভমেন্ট' রয়েছে। এরা মূলধারার রাজনীতিতে অনেক বেশি দুর্বল এবং আমাদের দেশের নকশাল রাজনীতির অনেকটা কাছাকাছি অবস্থান করে। চিলির মূল যে কমিউনিস্ট পার্টি তাদের শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে সংগঠন যত দিন যাচ্ছে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়নের সংগঠনের পরিসরও যথেষ্ট ছোট থাকায় তারাও বিরাট অংশের শ্রমিক ও কৃষকদের একত্রিত করতে সফল হয়নি। 

ছাত্র আন্দোলনের ভিত্তিতে তৈরি বরিকের সংগঠন শ্রমিক এবং কৃষকদেরকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। তাছাড়া 'একুশ শতকের সমাজতন্ত্র'-এর নামে যে বক্তব্যটা বারবার বরিক বা তার পূর্বসুরীদের কথায় উঠে এসেছে তা মূলত প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ অর্থাৎ সেই ঘুরপথে ফ্রি ট্রেড বা মার্কেট ইকোনমির পুনরাবৃত্তি। 

অন্যদিকে, বরিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন তুলেছে ভেনেজুয়েলার মাদুরো সরকার, নিকারাগুয়ার অর্তেগা সরকার এবং কিউবার বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে। নিকারাগুয়ার সরকার বর্তমানে বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে ডানপন্থী অবস্থানে চলছে! ভেনেজুয়েলার বর্তমান সরকারের কিছু ডানপন্থী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কিন্তু তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান বজায় রেখেছে। কিন্তু কিউবার বিপ্লবী সরকার সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে মানবাধিকারের লঙ্ঘনের অভিযোগের প্রত্যুত্তরে কিউবা নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসেনর বিরুদ্ধেও সফলভাবে লড়াই করেছে। অর্থাৎ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভুয়ো অজুহাতে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের খর্ব করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কিভাবে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে খর্ব করছে তা খুব স্পষ্ট করে বলে চলেছে এবং মানবাধিকারকে যে তারা সামাজিক পরিসরে আরও বৃহৎ অর্থে খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত করার একটা মডেল খাড়া করেছে তাও তুলে ধরছে। কিউবান সমাজে পূর্বতন সব বিপ্লব পরবর্তী ব্যবস্থার থেকে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টি তুলে ধরেছে। এর ফলে তারা ১৯৯১-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের পতনের পরেও সসম্মানে টিকে রয়েছে। কিন্তু গেব্রিয়েল বরিক তারপরেও কিউবার বিরুদ্ধে তার বিরোধিতা শাণিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে আবারও সেই প্রশ্নটাি ফিরে আসবে যে সে নিজে সালভাডর আলেন্দের মত কিছুটা বৈপ্লবিক অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে তো? আলেন্দে শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যে সময় পাননি, সেটাই ঢিলেমির রূপে এবার আরও বৃহৎ পর্যায়ে এসে পৌঁছাবে নাকি বামপন্থার দিকে রাশ টেনে ধরার নতুন বিকল্প রচিত হবে, তা এখন দেখার। ডানপন্থার হাত ধরে নয়াউদারবাদের খপ্পরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল কিন্তু সেটা ভবিষ্যতই বলবে... 

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার