ধর্ম না কি রাজনীতি?
বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত
ধর্ম নিয়ে বিশ্বজুড়ে একটা মাতামাতি শুরু হয়েছে। এই উত্তেজনা নিয়ে মানব গোষ্ঠী একুশ শতকে পা রেখেছে। এই কোলাহলে প্রথম সারিতে যারা আছে সংখ্যায় আধিক্য অনুসারে ধর্মগুলি হল খ্রিস্টান ইসলাম নাস্তিক বা ধর্মনিরেপেক্ষ হিন্দু বৌদ্ধ শিখ এবং আরও ছোট ছোট ধর্মীয় গোষ্ঠী।
সংখ্যার আয়তনে নাস্তিকেরা তৃতীয় স্থানে আছে। কিন্তু সংগঠিত নয়। সে কারণে শক্তি হিসেবে তাদের ধরা হয় না। বাকি চার ধর্মের কথা প্রতিদিনের সংবাদে পাওয়া যাচ্ছে লিপিতে চিত্রে বা সবাকচিত্রে। বিষয় একটাই আগ্রাসন অথবা প্রতিরোধ।
ছোটবেলা থেকে ধর্ম বিষয়ে যে কথা শুনে বড় হয়েছি তা হল, ধর্ম, যা ধারণ করে রাখে। কিন্তু কী বা কাকে ধারণ করে রাখে সে কথা স্পষ্ট নয়। চোখের সামনে দেখি গাছ ফল ধারণ করে। নদী সমুদ্র জল ধারণ করে আছে। পৃথিবী জীব জড় উদ্ভিদ নির্বিশেষে সকলকে ধারণ করে আছে। তাই সে ধরণী। এর মাঝে ধর্ম কোথায়।
ধর্মের আরও এক অর্থ পরে জেনেছি। সে হল স্বভাব। যে কোন বস্তু জীব হোক বা জড় প্রত্যেকের নিজের ধর্ম আছে। সেই ধর্ম বা স্বভাবের নিয়মে প্রত্যেকের জীবনচক্র বাঁধা। আগুন পোড়াবে। জল ভিজিয়ে দেবে তো বাতাস শুকিয়ে দেবে। এটা বস্তুর ধর্ম বা স্বভাব। পশু পাখি কীট পতঙ্গ প্রত্যেকে চলেছে নিজের নিজের ধর্মের নির্দিষ্ট নিয়মে। যত গোল মানুষকে নিয়ে। যুগে যুগে মহান মানুষেরা মানুষের আচার আচরণ প্রত্যক্ষ করে তার ধর্ম বিষয়ে নানা পুঁথি রচনা করে গেছেন। তবু মানুষের ধর্ম বলে কোনো নির্দিষ্ট সূত্র আজও অধরা। নিজের ধর্মের সন্ধান করাটাই বুঝি বা মানুষের ধর্ম।
স্বভাব অর্থে ধর্ম অনেক সত্য। ধর্মের ধারক অর্থ আরোপিত। ধর্ম সংঘগুলো প্রতিষ্ঠার আগেও জীব হিসেবে মানুষের ধর্ম অবশ্যই ছিল। সেই দিক থেকে দেখলে বিষয়টা বরং বিপরীত বলেই চিহ্নিত হবে। কেন না, বাস্তবে দেখা যায় মানুষের ছোট বড় গোষ্ঠী ধর্মকে আশ্রয় করে টিকে আছে।
ইতিহাস বলে, সংগঠিত প্রতিটি ধর্ম পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কিছু জনগোষ্ঠীর মাঝে বিকশিত হয়েছে। প্রতিটি ধর্ম এক একজন মহান ব্যক্তির চিন্তার ফসল। তিনি কনফুসিয়াস হোন বা হজরত মহম্মদই হোন বিষয়টা একই। দেখবার বিষয়, প্রতিটি ধর্ম একটা সময়ে এক নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর এলোমেলো জীবনধারায় শৃংখলা আনবার উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়ে ছিল। এটা ছিল সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক ফসল। এই গোষ্ঠীগুলি প্রতিবেশের দুর্বল জনগোষ্ঠীগুলির উপর প্রভাব বা চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের কলেবর বৃদ্ধি করেছে বা করছে। এটা ধর্মের আগ্রাসী ধর্ম বা চরিত্র।
প্রতি ধর্মের আছে দুটি ভাগ। প্রথম ভাগে আছে সৃষ্টিতত্ত্ব। অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির কাল্পনিক বাখ্যা।দ্বিতীয় ভাগে আছে কিছু আচরণবিধি। এই আচরণবিধি নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যম হল অনুগামীদের শৃংখলাবব্ধ রাখবার প্রক্রিয়া। সৃষ্টিতত্ত্বের প্রতি প্রশ্নাতীত বিশ্বাস আর আচারের প্রতি নিষ্ঠা সাধারণ মানুষকে সমাজের মধ্যে থাকা বৈষম্যকে উপেক্ষা করতে শেখায়।
তাত্ত্বিক অংশ নির্দিষ্ট করা আছে শিক্ষিত আলোকিত সম্প্রদায়ের জন্য। আচরণের অংশে আছে কিছু আধ্যাত্মিক আধিদৈবিক আর আধিভৌতিক সংকটের উল্লেখ। এবং তার উপশমের জন্য আছে কিছু শক্তি, দেবতা বা অপদেবতা। এই ধর্ম এবং বিশ্বাসকে আশ্রয় করে গোষ্ঠীসমাজ টিকে আছে আজকের অতি আধুনিক কালেও। অপরের উপর কর্তৃত্ব করবার স্বাভাবিক ধর্ম গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে পরস্পরে বিভেদ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে চলেছে সেই আদিম কাল থেকে। এভাবে দেখলে ধর্মকে প্রাচীন রাজনীতি ছাড়া অন্য কিছ্ ভাববার অবকাশ থাকে না।
সতের শতক নাগাদ সময়ে মানুষের যুক্তিবাদী মন, বিশ্ব সৃষ্টির অনেক রহস্য উন্মোচন করেছে প্রত্যক্ষ গোচরের মাধ্যমে। শুরু হল চোখে দেখা সত্যের সঙ্গে কাল্পনিক সত্যের প্রকাশ্য সংঘাত। সূচনা হল প্রত্যক্ষদর্শী বিজ্ঞানীদের উপর ধর্ম বিশ্বাসীদের সামাজিক নির্যাতন। বোঝা গেল, বাস্তবিক সত্যের উপর প্রভুত্ব করতে চায় কাল্পনিক সত্য। এবং বিষয়টা আজকের ভাবনায় অবশ্যই রাজনৈতিক।
এর মাঝে অনেক বদল ঘটে গেছে সমাজের কাঠামোতে। উন্নত প্রযুক্তি কৌশল সঙ্গে সামাজিক উৎপাদন বৃদ্ধি। ফলে সমাজে মজুর শ্রমিকগোষ্ঠীর আবির্ভাব। সামাজিক সংগঠন আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গেল শ্রমজীবী আর শ্রমের ফলভোগী দুই শ্রেণিতে। বাস্তবে যা প্রত্যক্ষ হল, এক দিকে প্রাচুর্য বিপরীতে দারিদ্র্য। তার থেকে জন্ম নিল ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রতিবাদ প্রতিরোধ আর বিদ্রোহ। এই হল মানুষের সমাজের ধর্ম গুণ বা বৈশিষ্ট্য। এ-ও এক রকমের সত্য। এ-ও এক রাজনীতি। অর্থাৎ টিকে থাকবার, অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখবার প্রক্রিয়া বই কিছু নয়।
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই নিয়মকে সূত্রায়িত করে নির্দিষ্ট রূপ দেওয়া গেল। রূপ দিলেন কার্ল মার্কস। তাই এর নাম মার্কসবাদ। যার মূল ধরা আছে তাঁর রচিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার নামের বইখানাতে। সময় উনবিংশ শতকের মধ্যভাগ। এই তত্ত্বেরও দুটি ভাগ। সৃষ্টিতত্ত্ব আর সামাজিক আচরণ। আধুনিক কালে একে আর ধর্ম বলা হল না। মার্কসকেও ধর্মগুরু বা ঋষি বা মুনি সন্বোধন করা গেল না। একে বলা হল, রাজনীতি। কিন্তু এর বিষয়বস্তু প্রকৃতি এবং মানুষের সমাজের বিবর্তনের প্রকৃতি এবং ধর্মের বাস্তব তথ্যের সংগ্রহ সংকলন।
রাজনীতি কী। রাজ্য শাসন এবং পরিচালনার নীতি। অভিধানে তাই লেখে। রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সে কারণে বর্তমানে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির যে সংঘাত তা হল ধর্ম নামে রাজনীতির সঙ্গে সমাজের স্বাভাবিক ধর্মের রাজনীতির সংঘাত। প্রথমেরটা সীমিত ছোট ছোট মানব গোষ্ঠীর মাঝে। দ্বিতীয়ের সীমানা নির্ধারিত সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে একত্রিত করে।
I agree !
ReplyDelete