G20: ইঙ্গিত কোনদিকে?
আলোচনায়ঃ মৌ বাছার
গত ৩০ এবং ৩১শে অক্টোবর রোমে জি-টোয়েন্টি বৈঠক হয়েছে। এই প্রথমবার ইটালিতে এই বৈঠক হল। অবশ্যই জনবিরোধী অবস্থানেরই পাল্লা ভারী থাকাটাই স্বাভাবিক কারণ জি-টোয়েন্টিভুক্ত দেশগুলোর অনেক দেশেই এখনো অব্দি অতি ডানপন্থী সরকার রয়েছে এবং যেখানে যেখানে নেইও, তারাও এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে নয়াউদারবাদী অর্থনীতির যে আভ্যন্তরীণ সমস্যা, তাতে জর্জরিত হয়ে বেশকিছু স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থান বা জনবিরোধী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। লক্ষণীয় যে এই রোম ঘোষণায় বারংবার আবহাওয়া পরিবর্তন বা 'ক্লাইমেট চেঞ্জ'-এর কথা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে কিন্তু এটা আমরা জানি যে বিগত প্যারিস চুক্তির সময় থেকে আজ অব্দি কোন নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি তো করা যায়নি বরং বারংবার যে বিধিনিষেধগুলোর কথা বলা হয়েছে সারা পৃথিবী জুড়ে, পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নিবারণের উদ্দেশ্যে, সেগুলো মানা হয়নি। উল্লেখ্য, আমাদের দেশের বর্তমান কেন্দ্র সরকার (জি-২০ ভুক্ত), রাজ্য সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দেউচা-পাচামীতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ খোলা মুখ কয়লা খনির প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে; তাদের পরিবেশ সংক্রান্ত এই বার্তা হাঁসির চুটকি বইয়ের বিষয় অনায়াসেই হতে পারে...
আরো একটা সোনার পাথরবাটি শব্দ যেটা ব্যবহার করা হয়েছে সেটা হলো লিঙ্গ সাম্য বা জেন্ডার ইকুয়ালিটি এবং লক্ষণীয় যে লিঙ্গ সাম্যের কথা এরকম একটা আন্তর্জাতিক মঞ্চে যখন বলা হয় তখন আশঙ্কা থেকেই যায় যে এটা হয়তো একটা ফাঁপা বুলি আর নইলে এর কোন নঞর্থক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বর্তমানে কেন্দ্র সরকার (জি-২০ ভুক্ত) মহিলাদের বিবাহযোগ্য বয়স ১৮ থেকে ২১ বছর করার কথা ভাবছে; পুরুষদের বিবাহযোগ্য বয়স ২১ বছর আগে থেকেই ছিল। অর্থাৎ লিঙ্গ সাম্য মানে এখানে বিয়ের বাইরে কিছু ভাবাই হয় না আর তা প্রকট হয় পুরুষদের সমানাধিকারের ভিত্তিতে, বলা ভালো পুরুষতন্ত্রের ভিত্তিতে; আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলাদের অধিকারের ভিত্তিতে নয়।
জি-টোয়েন্টি 'জয়েন্ট ফিনান্স হেলথ টাস্কফোর্স' তৈরি করতে চাইছে যাতে বিভিন্ন দেশের অর্থ এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রক একসাথে একযোগে কাজ করতে পারে। তাদের বক্তব্যের যে আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে তা হল, সরাসরি স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পদক্ষেপগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য ওষুধের ক্ষেত্রে যে সরকারি দামগত নিয়ন্ত্রণ বা বেসরকারিকরনের যে ফাঁকটুকু রয়েছে, সেগুলোকে পূর্ণ করার পথে এগোনোর জন্যই এই নির্দেশিকা।
জ্বালানি তেলের উপর থেকে বা যে কোন ধরনের জ্বালানির উপর থেকে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার অবস্থান নেওয়া হয়েছে। এছাড়া জি-টোয়েন্টি আরোও একটি ঘোষণা করেছে যে তারা আফ্রিকাতে শিল্পায়নের একটা প্রচেষ্টা করবে এবং সেই শিল্পায়নের পদ্ধতিই তারা বিভিন্ন ছোট দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র ও বিভিন্ন অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া মধ্য আয়ের দেশে বলবত করবে। শিল্পায়নের নামে আসলে কি হয় সেটা আমরা সবাই জানি। সম্পদ লুঠের নতুন এই ফন্দির শিকার হতে চলেছে ছোট ছোট দ্বীপ এবং আফ্রিকা মহাদেশ।
এছাড়া 'ডেট সার্ভিস সাসপেনশন ইনিশিয়েটিভ' অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের ধারগুলোকে কমিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। এরকম ৭৩খানা দেশের নাম নথিভুক্ত হলেও তাতে কিন্তু ভারত নেই। এটা লক্ষণীয় যে ২০২১-এর অন্তত ৩১শে মার্চের যা তথ্য রয়েছে তাতে ভারতের সামগ্রিক বিশ্বজুড়ে ধার হচ্ছে ৬৯.৭ বিলিয়ন ইউএস ডলারের কাছাকাছি। যারা তাকে ধার দিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে 'এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক', 'ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' এবং 'ইন্টারন্যাসনাল ডেভলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন' বা আইডিএ। এই আইডিএ কিন্তু সরাসরি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর অন্তর্ভুক্ত একটি সংস্থা। ফলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ভারতের ক্ষেত্রে কেন তাকাচ্ছে না বরং তাকে নাচাচ্ছে অন্যদেশের উপরে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ সমর্থন করাতে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
এর বাইরে, বিভিন্ন যে খাদ্য সরবরাহ পদ্ধতিগুলো রয়েছে, সেগুলোতে ফিনান্স পুঁজির বিভিন্ন সেক্টরের তরফে কিছু বিনিয়োগ করার কথা নির্দেশিকায় তুলে ধরেছে জি- টোয়েন্টি। অর্থাৎ এই খাদ্য সরবরাহের পথগুলোকে সরাসরি বড় বড় কোম্পানিগুলো নিজের অধীনে এনে একদিকে খাবারের দাম আরও বাড়াতে থাকবে এবং অন্যদিকে উপলব্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে সেগুলো দুরূহ হয়ে উঠবে যদি বিশ্ব ব্যাংকের অঙ্গুলি হেলনে ছোট দেশগুলো না চলে।
ডিজিটাল অর্থনীতির প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে যে কারণে বিভিন্ন তথ্য হরপানো বা ডেটা অ্যাকুইজিশন প্রকল্পের উপর বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেটের উপর আরো বেশি করে যাতে নিয়ন্ত্রণ আনা যায়, যাতে যে কেউ ইন্টারনেটে যা ইচ্ছা না খুঁজতে বা আপলোড করতে পারে, সেই প্রক্রিয়া বলবত করে ইন্টারনেটে মুক্তচিন্তার আদান-প্রদানগুলিকে খর্ব করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাছাড়া জি-টোয়েন্টি একটা 'রোড ম্যাপ ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার' নামে নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছে যার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন প্রাইভেট এবং পাবলিক সংস্থাগুলোকে প্রাইভেট ক্ষেত্রগুলোতে বেশি করে বিনিয়োগ করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে বোঝা যাচ্ছে যে আসলে পাবলিক সেক্টরকে মূলগতভাবে ধ্বংস করার একটা প্রক্রিয়ার দিকে তারা এগোতে চাইছে যাতে পাবলিক সেক্টর বলে আর কিছুই না থাকে।
তাছাড়া 'নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল কো-অপারেশন' বা এনবিএফসির আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করার কথা বলা হচ্ছে। আমরা জানি যে নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল কো-অপারেশন বা কর্পোরেশনগুলো ব্যাংকের মতো বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত নয় এবং এখানে টাকাপয়সা আদান প্রদানের ক্ষেত্রে প্রচুর ফ্রড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই প্রবণতাগুলো আরো বাড়তে পারে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে।
এই অর্থনীতিকে ডিজিটাল করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কর আদায়ের যে বিভিন্ন অসুবিধা দেখা দিয়েছে সেগুলোকে সমাধানের ক্ষেত্রে যে টু-পিলার সলিউশন বা দুই স্তম্ভ নীতি প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে। এই নীতি অনুযায়ী প্রথম স্তম্ভ হল, লাভের একটি অতিরিক্ত অংশকে বাজারের নিয়ম-নীতির অধীনে নিয়ে আসা এবং দ্বিতীয় স্তম্ভ হল, করের একটা ন্যূনতম মাত্রা নির্ধারণ করা। এই নীতি অনুযায়ী আসলে সারা পৃথিবীতে কর্পোরেট ট্যাক্স রেটের ন্যূনতম স্তর ১৫% রাখা উচিৎ।
Comments
Post a Comment