ওমিক্রন: ঘটনা আর রটনা
শুভাশিস দাস
কোভিড সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত ব’লে পশ্চিমবাংলা তথা, ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে আবার বিধিনিষেধ আরোপ করা হল। আশ্চর্যজনক ভাবে কর্পোরেট মিডিয়া এবার করোনার ভেরিয়েন্টের (আলফা, বিটা, ডেল্টা ইত্যাদি) নাম মুখে আনছে না। অথচ এই মাত্র কয়েকটা দিন আগে পর্যন্ত—
“ভারতে ঢুকে পড়ল ওমিক্রন,....”/ “ওমিক্রন নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ,...”/ “দ্রুত বিশ্বের দখল নেবে কি ওমিক্রন”/ “ডেল্টা এবং বিটার তুলনায় পুনর্সংক্রমণ প্রায় তিন গুণ বেশি ওমিক্রনে! দাবি সমীক্ষায়”/ “ওমিক্রনে প্রথম মৃত্যু ব্রিটেনে, বুস্টার টিকা চালু করার ঘোষণা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর”/ “ইউরোপে ঢুকে পড়ল ওমিক্রন, আতঙ্কে বিশ্ব”/ “ওমিক্রন বিশ্বব্যাপী ‘মারাত্মক বিপদ’ ডেকে আনতে পারে, সতর্ক করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা”/ “ওমিক্রনে সিঁদুরে মেঘ, ৩য় ঢেউ কি শুরু?"— খবরের কাগজ থেকে খবরের চ্যানেলে এই ধরণের ভয় ধরানো শিরোনামগুলো ক্রমাগত তুলে ধরা হচ্ছিল।
ইতিমধ্যেই কোভিড-কে (সার্স কোভ ২ ভাইরাস) কেন্দ্র করে আদতে ‘ডর-কা-বিজনেস’ চলছিলই, গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হল এর নতুন রূপ (!) ওমিক্রন। করোনাভাইরাসের নতুন ‘বি.১.১.৫২৯’ রূপকে উদ্বেগজনক বা ‘ভেরিয়েন্ট অব কনসার্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করে সেটিকে ‘ওমিক্রন’ নাম দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। প্রসঙ্গত, করোনা ভাইরাস ব্যাপারটি পৃথিবীর বুকে নতুন আমদানি নয়, এক এবং অদ্বিতীয়ম নয়। যুগ যুগ ধরে নয়া নয়া অবতারে তিনি ধরাধামে এসেছেন এবং বসবাস করছেন। তা বলে, তাদের সবাই রাক্ষুসে—এমনটা মোটেই নয়, তাদের কেউ কেউ সাধারণ সর্দি-কাশি ঘটায় (যেমন HCOV 229E), যা হামেশাই হয়।
এতগুলো বাড়তি কথা বলার কারণ? কারণ এই ‘ওমিক্রন’ বাবাজী নিজের স্পাইক প্রোটিনের জিনের মধ্যে নির্বিষ কোভিড ভাইরাসের জিন ঢুকিয়ে নিয়েছে। তেমনটাই দেখিয়েছেন ইনফারেন্স সংস্থার ‘বায়োঅ্যানালিটিক্স’ (জৈব বিশ্লেষক বিভাগ) বিভাগের কেমব্রিজ (ম্যাসাচুসেটস), বেঙ্গালুরু এবং টরেন্টো-তে কর্মরত বিজ্ঞানীরা। একে ‘ভাইরাস’ বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘টেম্পলেট সুইচিং থ্রু ইন্সারশন’। তথ্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে বিশ্বজুড়ে ওমিক্রন আক্রান্তদের বেশিরভাগই অল্প ও মৃদু উপসর্গ নিয়েই সেরে উঠেছেন। পশ্চিমবাংলায় ওমিক্রন আক্রান্তদের চিকিৎসাকারী ডাক্তারও এই বক্তব্যতেই কার্যত সিলমোহর দিয়েছেন। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই যে, কোভিড ভাইরাসের অন্যান্য অবতারগুলোর তুলনায় এই অবতারটি রাক্ষুসে হওয়ার সম্ভবনা প্রায় নেই—এর দৌড় সাধারণ সর্দি-কাশি অবধি। ওমিক্রনের ক্ষেত্রে আর একটি বিষয় হল শরীরে সংক্রমণ ঘটানোর জন্য এর কাছে দুটো দরজা (বিজ্ঞানের ভাষায় রিসেপটার প্রোটিন) আছে — সার্স কোভ ২-এর ACE2 (অ্যাঞ্জিয়োটেন্সিন কনভার্টিং এনজাইম ২) দরজা আর HCOV 229E-এর ANPEP (অ্যালানাইন অ্যামাইনো পেপটাইডেজ) দরজা। (https://osf.io/f7txy/) তাই ডেল্টা ভেরিয়েন্টের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রমণশীল ওমিক্রন। কিন্তু, ভাইরাস জগতের প্রচলিত নিয়মই হল যে ভাইরাস যত বেশি সংক্রামক, তত কম মারাত্মক। ইজরায়েলি চিকিৎসক আফসাইন এমরাইনের মতে ওমিক্রন সংক্রমণ প্রাকৃতিক ভ্যাক্সিনের কাজ করবে।
এখন ঘুরে ফিরে সেই একই কথা, তাহলে এই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার পিছনে কারণ কি? কারণের উৎসের সন্ধান পাওয়া যাবে ফোর্বস পত্রিকার বিশ্বের ১০ জন সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তালিকায়। তাদের সম্পদের লেখচিত্র দেখলেই পরিষ্কার হয় প্রতিটা লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিম্নগামী সম্পদের পরিমাণ হাউই বাজির মতো হুস করে বেড়ে গেছে। লকডাউনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল প্রথম সংক্রমণের সময় (২০১৯-২০) তৎকালীন অজানা এই ভাইরাসের খুঁটিনাটি জানার জন্য এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সাজানোর জন্য কিছুটা সময় চুরি করা। বিগত বছরগুলোতে এ-ব্যাপারে কতটা কাজ হয়েছে তা পাঠকবৃন্দ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। অথচ লকডাউন, শাটডাউন, বিধিনিষেধ নানাভাবে সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এর কারণ ব্যাখ্যা এই লেখার স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। শুধু কয়েকটা প্রশ্ন পাঠকদের উদ্দেশ্যে, ভাবার জন্য রাখা থাকল:
১। বিগত দুটো লকডাউনে চিকিৎসা ব্যবস্থার কি উন্নতি হয়েছে যে এই সামান্য রোগীর চাপ সামলানো যাচ্ছে না?
২। প্রতিবার করোনা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত আর্থিক বর্ষ সম্পূর্ণ হওয়ার সময়কালের আশেপাশেই হয় কেন?
৩। ভারতবর্ষের মত ঘন জনবসতি পূর্ণ দেশে লকডাউন অনুকরণ করে কতটা শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা যায়?
৪। বিনোদনের সমস্ত সাধন খোলা অথচ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, কেন?
অতীতে ভাইরাসের কোপে নানা সময়ে বহু মানুষ মরেছে। মনুষ্য-প্রজাতি সাময়িকভাবে স্তব্ধ হলেও ধ্বংস হয়ে যায়নি কোন কালেই। বরঞ্চ প্রতিক্ষেত্রে মানুষের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে । ভাইরাস প্রকৃতিতে অবদমিত ভাবে রয়ে গিয়েছে । করোনা ভাইরাস রূপ পাল্টে ওমিক্রন বা যে রূপেই আসুক না কেন সতর্কোতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে মানুষকে বাইরে চলা ফেরা করতেই হবে।ভাইরাসের সঙ্গে ঘাত প্রতিঘাতেই মনুষ্য জাতি টিকে থাকবে। লক ডাউনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই ।
ReplyDelete"কিন্তু, ভাইরাস জগতের প্রচলিত নিয়মই হল যে ভাইরাস যত বেশি সংক্রামক, তত কম মারাত্মক।" (শুভাশিস দাস)
ReplyDeleteনা, এরকম কোনো সাধারণ "নিয়ম" নেই। কোনো মিউটেশনের ফলে বেশী মারাত্মক ও বেশী সংক্রামক -ও হয়ে উঠতে পারে। বা বেশী মারাত্মক ও কম সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে। বা কম মারাত্মক ও বেশী সংক্রামক হয়ে উঠতে পারে। সবকটা পসিবিলিটিই থাকে। আগে থেকে বলা যায় না।