মতাদর্শের দৈন্যঃ বিপ্লবী পরিবর্তনের একজন শুভাকাঙ্ক্ষীর চোখে
ডাঃ
সৌম্যঋত চৌধুরী
প্রবীণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কোবাড ঘান্দীর
বই ‘ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম’ এবং সেই বইটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিতর্কের বিষয় নির্ঘাত
আমাদের মধ্যে অনেকেরই নজরে পড়েছে। পড়বারই কথা। কিন্তু কীভাবে পড়েছে সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ সোশ্যাল মিডিয়া এবং হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির দৌলতে শেষমেশ নজরে এসে যা পৌঁছয়,
সেটা কীভাবে মূল বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত সেটা বোঝাটাই গভীর রহস্যের খোরাক হয়ে দাঁড়ায়।
সে যেভাবেই হোক না কেন বইটি এবং সেটার উপর বিতর্ক নিয়ে আমাদের খানিক ধারণা রয়েছে বলেই
ধরে নিচ্ছি, যদিও আমার ধারণা আমাদের মধ্যে খুব কম জনই মূল বইটি ভালোভাবে পড়েছি। যদি
না পড়া থাকে এবং বিতর্কটি নিয়ে আগ্রহান্বিত হন তাহলে সবার আগে মূল বইটি পড়া দরকার নিশ্চিত।
কিন্তু তালি তো একহাতে বাজে না। বিতর্কটা
কিন্তু এসেছে বিপরীত একটা দিক থেকে। সম্প্রতি ২৭ নভেম্বর ২০২১ তারিখে, সিপিআই (মাওবাদী)
নামে রাজনৈতিক দলটি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, তাঁরা তাঁদের প্রাক্তন পলিট
ব্যুরো সদস্য এবং বর্ষীয়ান মাওবাদী নেতা (তাঁদের দাবী অনুসারে) কোবাড ঘান্দীকে দল থেকে
বহিষ্কারের কথা ঘোষণা করেছে। এমন প্রবল সিদ্ধান্তের পিছনে অন্যতম কারণ হল এই বইটি।
কেন? বইটিতে এমন কী রয়েছে, যার জন্য তাঁরা তাঁদের (দাবী অনুসারে) অন্যতম প্রবীণ রাজনৈতিক
নেতৃত্বকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হলেন? আসুন এই বিতর্কের বিষয়টিকে একটু গভীরভাবে কাছ
থেকে দেখা যাক। হয়তো আমাদের নিজেদের চিন্তাভাবনার এবং অনুসন্ধানের কিছু খোরাকও মিলে
যেতে পারে এই আলোচনা থেকে। কিন্তু আবারও বলবো। এইসব বিতর্কের প্রকৃত রসাস্বাদন করতে
হলে কিন্তু অবশ্যই মূল বইটি আমাদের পড়ে ফেলতে হবে।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো মূল বইটি পড়বার
সৌভাগ্য হলেও সিপিআই (মাওবাদী) দলের রাজনৈতিক বিবৃতি দেখবার সৌভাগ্য কিন্তু আমার হয়ে
ওঠেনি। সেটির সত্যতা সম্পর্কে যাচাই করবারও কোনও রকম অবকাশ আমার কাছে নেই। আমি সিপিআই
(মাওবাদী) দলের বক্তব্যের সারাংশটি সংগ্রহ করেছি ৩ ডিসেম্বর ২০২১-এ thewire.in-এ প্রকাশিত
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্যের একটি লেখার থেকে। লেখাটির শিরোনাম হল, ‘For Maoists,
Kobad Ghandy’s ‘Mafia’ Reference in Book was the Last Straw’। এই লেখাটি থেকে কোবাডের
প্রতি মাওবাদী দলের বিভিন্ন অভিযোগগুলি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে।
অভিযোগেরও কিন্তু প্রকারভেদ রয়েছে।
একমাত্রিক অভিযোগ নয়। প্রথম অভিযোগগুলির ধরন হল দলীয়—মানে কোবাড সিপিআই (মাওবাদী) দলের
কী কী নিয়ম-কানুন আইন-শৃংখলা ইত্যাদি মানেননি সেই সংক্রান্ত। সত্যি বলতে এই বিষয়টা
নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। আগ্রহ নেই কারণ এই অভিযোগগুলির মধ্যে তেমন অভিনবত্বের কিছু
নেই। দল থেকে যাকেই বহিষ্কার করা হয় সাধারণভাবে যেকোনো কমিউনিস্ট রাজনৈতিক সংগঠনই তাঁদের
তাঁদের ক্ষেত্রে এই অভিযোগগুলি এনে থাকেন। সুতরাং আলোচনা করতাম না এই অভিযোগগুলি নিয়ে,
যদি না এখানে অদ্ভুত কিছু স্ববিরোধীতা এবং মজার একটা টুইস্ট থাকতো। অগত্যা আলোচনা করতেই
হচ্ছে। আসুন দেখা যাক এই জাতীয় অভিযোগগুলি কী কী!
এক) কোবাড সিপিআই (মাওবাদী) দলের সংবিধান,
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা, মতাদর্শ ইত্যাদি লংঘন করেছেন।
দুই) তিনি মাওবাদী দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা
অভিযোগ এনেছেন।
তিন) গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই তিনি
ক্রমাগত মিথ্যে কথা বলে গেছেন যে, তিনি মাওবাদী নন।
চার) কোবাড উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে
এসেছেন। পার্টিতে তিনি জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। কর্পোরেটদের
মধ্যে তিনি বড় হয়েছেন ইত্যাদি।
পাঁচ) তিনি শাসক শ্রেণীর মন জুগিয়ে
চলার চেষ্টা করছেন।
ছয়) তিনি কায়দা করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের
বিরোধিতা করছেন। তাঁর ভাষার মধ্যে বেশ একটা বাম দুঃসাহসিক ঝোঁক রয়েছে, ঠিক তার বিপরীতে
অনুশীলনে আছে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ। তাঁর এই কার্যকলাপের জন্য দলের মধ্যে উপদল তৈরি
হওয়ার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে।
কী মুশকিল! আপনারা নিজেরাই তো বলছেন
লোকটা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই নাকি বলে যাচ্ছেন উনি মাওবাদী দলের কেউ নন! বাস্তবিক
বিষয়টা সত্যিও। ২০০৯ সালে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে ৬টি রাজ্যের কোর্টে রাষ্ট্র তাঁকে
সিপিআই (মাওবাদী) দলের সদস্য বলে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা সাজিয়েছে। কোবাড
দৃঢ়ভাবে সেই অভিযোগের বিরোধিতা করেছেন। মজার বিষয় হল ৬টি রাজ্যেই রাষ্ট্র এই অভিযোগ
প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আজ হঠাৎ করে সিপিআই (মাওবাদী) দলের কী এমন তাগিদ পড়লো, যেটা
রাষ্ট্র ১০ বছরের বেশী সময় ধরে প্রমাণ করতে পারেনি, আদালতে যে অভিযোগ বারবার খারিজ
হয়ে গেছে, সেই বিষয়টাকে একেবারে সোজাসুজি সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে তাঁদের প্রমাণ করতে
নামতে হল!
আচ্ছা ধরে নেওয়া যাক কোবাড ঘান্দী
মিথ্যে কথা বলে গেছেন এতদিন এবং বিপরীতে শাসক শ্রেণী ও সিপিআই (মাওবাদী) অক্ষরে অক্ষরে
সত্যি কথা বলছে, সেক্ষেত্রেও কিন্তু দলের সংবিধান-গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা ইত্যাদি
ইত্যাদি শব্দ সিপিআই (মাওবাদী)-র মুখে এক বর্ণও মানায় না। আচ্ছা, কোবাড ঘান্দীকে বহিষ্কার
করবার আগে কমিউনিস্ট সংগঠনগুলির সাধারণ যে নিয়মশৃঙ্খলার ধারণা, সেই অনুযায়ী তাঁকে কারণ
দর্শাতে বলা, সাসপেন্ড করা ইত্যাদি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয়েছে কি? আর সংবাদমাধ্যমে
বিবৃতি দেওয়ার মাধ্যমে তাঁকে রাষ্ট্রের সামনে বলি প্রদত্ত জীবের মতন করে ছুঁড়ে দেওয়া
কোন ধরনের কমিউনিস্ট শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে সেও এক অচিন রহস্য। উচ্চ মধ্যবিত্ত-কর্পোরেট
যে শ্রেণী থেকেই কোবাড ঘান্দী আসুন না কেন, সেই অবস্থানকে পিছনে ফেলেই তিনি ৪ দশকেরও
বেশী সময় ধরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন। যদি ধরা যাক
সিপিআই (মাওবাদী)-র মত অনুসারে তিনি তাঁদের সদস্য হয়ে থাকেন, তাহলে সেই অবস্থান থেকেই
সেই দলটিতে তিনি এসেছেন এবং নিজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাগুলি পালন করেছেন। কিন্তু আজ
হঠাৎ কোবাড ঘান্দীর গা থেকে শ্রেণীর গন্ধ মম করে বেরোতে শুরু করলো আর অমনি মাওবাদীরা
আবিষ্কার করলেন বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! সে বাসা এমনই যে দল মাঝে উপদল মাথা চাড়া দিয়ে
উঠছে আর পার্টি নেতৃত্ব বাধ্য হচ্ছেন শাসক শ্রেণীর সুরে সুরে সুর মেলাতে, থুড়ি, কোবাড
ঘান্দীকে চিহ্নিতকরণের কাজ করতে।
আগে বলেছি এই বিষয়টায় আমার আগ্রহ কম।
আমার মূল আগ্রহের জায়গা হল মতাদর্শগত প্রশ্নগুলি। নিঃসন্দেহে সিপিআই (মাওবাদী), কোবাড
ঘান্দীর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত বিচ্যুতির অভিযোগ এনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে
ধরেছেন। সেই প্রশ্নগুলিকে আপনাদের সামনে রাখবো, একই সঙ্গে কোবাড ঘান্দীর লেখার মধ্যে
থেকে মতাদর্শগত কোন কোন দিকগুলি উঠে এসেছে বলে আমার মনে হয়েছে, সেটাও আপনাদের সামনে
তুলে ধরবো। কিন্তু বিষয়টা এমনভাবে রাখা হবে না যেন সেগুলো সিপিআই (মাওবাদীর) তোলা অভিযোগের
উত্তর। সেই প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে চর্চা তো চলতেই থাকবে কিন্তু সেই কাজে যাতে খানিক সুবিধা
হয়, তাই কোবাডের মূল মতাদর্শগত বক্তব্যগুলি আপনাদের সামনে হাজির করবার চেষ্টা করবো।
তবে সবার আগে মাওবাদীদের তোলা অভিযোগগুলির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেবো।
এক) কোবাড মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং
মাওবাদ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যূত হয়েছেন।
দুই) তিনি দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক
বস্তুবাদ, মার্কসবাদের মূলনীতিগুলি এবং শ্রেণীসংগ্রামের ধারণাকে পরিত্যাগ করেছেন।
তিন) তাঁর মধ্যে নৈরাজ্যবাদী ঝোঁক
দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
চার) বুর্জোয়া ভাববাদের পাঁকে আটকা
পড়েছেন।
পাঁচ) রহস্যবাদের মাধ্যমে খুশীতে পৌঁছনোর
রাস্তা বেছে নিয়েছেন।
ছয়) তিনি বিপ্লবী শিবিরে নিরাশা আমদানি
করবার চেষ্টা করছেন।
সাত) শাসক শ্রেণীর স্বার্থে এবং শাসকশ্রেণীর
সুরে সুর মিলিয়ে তিনি বই প্রকাশ করেছেন।
আট) সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা
দখল করার পথ থেকে তিনি জনতাকে বিচ্যূত করতে চাইছেন, একেবারে বার্নস্টাইনের মতো।
মোটামুটি এগুলোই। এগুলো কতটা গ্রহণীয়-কতটা
বর্জনীয় সেই বিষয়ে আলাদা করে কোনও মন্তব্য এখানে আমি করবো না। বরং পাঠককে অনুরোধ করবো
কোবাডের নূল লেখাটি পড়তে বিশেষ করে ফ্র্যাকচারড্ ফ্রিডম বইটির তৃতীয় অধ্যায়টি পড়তে।
সেখানে কোবাডের মতাদর্শ ভাবনাগুলো জায়গা পেয়েছে। এবার আসুন কোবাডের মূল মতাদর্শগত বক্তব্যগুলি
কী, সেই বিষয়ে খানিক আলোচনা করা যাক।
…
কোবাড তাঁর বইটি জুড়ে এবং বিশেষত তৃতীয়
অধ্যায়ে একটা উপলব্ধিকে সামনে এনে হাজির করেছেন।
সেই উপলব্ধিটা আসলে খুবই জরুরী, কারণ সেই উপলব্ধি থেকেই কিন্তু কোবাডের বর্তমান
রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বক্তব্যগুলো দানা বাঁধতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, এই উপলব্ধি
বোধহয় কোবাডের আজকের নয়। ২০১২-১৩ সালে “Questions of Freedom and Peoples’
Emancipation” সিরিজের লেখাগুলি লেখবার সময়ও তাঁকে পরিচালিত করেছিল এই উপলব্ধি। সেটা
হল আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন এক ভয়ঙ্কর ধাক্কার মধ্যে পড়েছে। কোবাড
যখন রাজনীতিতে যুক্ত হন সেই সময়ের প্রেক্ষিতে থেকে তো কয়েক হাজার গুণ পিছিয়ে যাওয়া
বটেই। সেই উপলব্ধিই তাঁকে খুঁজতে তাড়িত করেছে এই ব্যর্থতার কারণগুলিকে। কারণ বর্তমান
সময়ে পৃথিবীতে যেখানে বৈষম্য সর্বাপেক্ষা বেশী, সেখানে কমিউনিস্ট আন্দোলনগুলির অবস্থা
এতোটা করুণ কেন? কমিউনিস্ট আন্দোলনগুলি কোণঠাসা এবং দিশাহীনতায় ভুগছে এই পর্যবেক্ষণের
উপর ভিত্তি করে তিনি সমস্যাগুলিকে খুঁজতে চেয়েছেন। সমস্যাকে বোঝার উপর দাঁড়িয়ে কীভাবে
প্রতিকার করা যায়, সেই উপায়েরও খোঁজ করেছেন। সমস্যাকে খুঁজতে গিয়ে তিনি যা যা অনুভব
করেছেন, তাই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। তিনি যে সমস্যাগুলিকে অনুভব করছেন সমস্যা
বলে, সেই প্রশ্নে দ্বিমত থাকতেই পারে কারও, কিন্তু প্রশ্ন হল তাঁরা কমিউনিস্ট আন্দোলনের
এই সঙ্কটকেও মেনে নিচ্ছেন কিনা এবং সেই সংকটকে কাটিয়ে ওঠার জন্য বিকল্প সমস্যা ও সেই
সমস্যাগুলি সমাধান করার অনুসন্ধান চালাচ্ছেন কিনা। মনে হয় কোবাডের মতামতগুলিকে বিচার
করবার সময় এই পরিপ্রেক্ষিতটাকে মাথায় রেখে চলা উচিৎ। সেক্ষেত্রে দ্বিমত কিংবা আরও বহু
মত পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত-ঐক্য সবই চালাতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে উদ্দেশ্য
হবে গঠনমূলক।
যাই হোক, ভারতের প্রশ্নেও কোবাড তাঁর
এই উপলব্ধি রেখেছেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুর্দশা এখানেও খুব কম নয়। কোবাড উল্লেখ করছেন
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে একদিকে সংসদীয় এবং অন্যদিকে বিপ্লবী উভয় বামশক্তিরই
সর্বোচ্চ স্তরে থাকার কথা। তারপর নয়া উদারনীতিবাদ যত শক্তি সঞ্চয় করেছে, তত ভঙ্গুর
হতে থেকেছে দুটি ধারার অবস্থাই। বর্তমানে প্রায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতোই অবস্থা
হয়েছে সকলের। কেন এমন হল এবং কীভাবে এর থেকে বেরোনো যায় এই হল তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়।
সেই কাজ তিনি জেলে বসে বন্ধ রেখেছেন
বলে একেবারেই মনে হয় না। বরং তিহার জেলে যে উপলব্ধিতে তিনি পৌঁছেছিলেন, সেখান থেকেই
চালু হয়েছিল তাঁর উত্তর খোঁজা। একজন মনোযোগী দর্শকের মতন তিনি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনগুলির
পতনের বিভিন্ন দিককে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করেছেন জেলের দিনগুলিতেও। বিশাখাপত্তনম,
তেলেঙ্গানা কিংবা ঝাড়খন্ডের জেলে বসে সেখানকার নকশাল বন্দী এবং সাধারণ জেলবন্দীদের
মারফৎ তিনি তথ্যানুসন্ধানের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এবং সেটা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে। সেই
তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁর যা উপলব্ধি হয়েছে, যে তথ্য তিনি জানতে পেরেছেন সেটা তিনি
কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুর্দশার কারণ খুঁজতে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর এই পর্যবেক্ষণ এবং
উপলব্ধিগুলিকে মনোযোগ দিয়ে দেখলে বুঝতে পারা যাবে।
ধরা যাক ঝাড়খন্ডের মাওবাদী আন্দোলন
সম্পর্কে ওনার উপলব্ধির কথা। কোবাড খেয়াল করেছেন ঝাড়খন্ড জেলের মাওবাদী বন্দীরা নিজেদের
গ্রাম বা অঞ্চলের কথা বা ইতিহাস নিয়ে কিছুই বলতে চান না। এইসব বিষয় নিয়ে তাঁদের তীব্র
অনীহা। বিশেষ করে যেই সমস্ত কর্মীরা সামরিক কাঠামোর অংশ ছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই প্রবণতা
আরও বেশী।
তাছাড়া তাঁর চোখে পড়েছে ঝাড়খণ্ডের
জেলগুলি পরিচালনা করেন মাফিয়ারা। সমস্ত কিছুতেই টাকার খেলা চলে। দেশের বাকি রাজ্যগুলির
তুলনায় ঝাড়খন্ডের এই চিত্রটি বেশ আলাদা। আর জেল পরিচালনার এই অনৈতিক ব্যবস্থার বিরোধিতায়
না থেকে জেলবন্দী মাওবাদীরা কিন্তু সেই ব্যবস্থারই অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
আরও একটা বিষয় তিনি জেলের বন্দীদের
থেকে শুনেছেন যে, তিনি গ্রেফতার হওয়া পর তাঁকে নিয়ে যেমন বিরাট প্রচার হয়েছিল, তেমন
স্তরের কোনও মাওবাদী নেতা ঝাড়খন্ডের জেলে এলে, তাঁদের সঙ্গে নাকি থলি থলি টাকা থাকে।
তাঁদের জীবনযাপনের মানই অন্য হয়। কোবাডের সাধারণ জীবনযাপনের মান সেক্ষেত্রে তাঁদের
থেকে শ্রদ্ধা আদায় করে।
প্রকৃতপক্ষে ঝাড়খন্ডের মাওবাদীদের
সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা সম্ভবত বিশেষ ভালো নয়। তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, তাঁর আগে দেখা
এবং পড়া বস্তারের মাওবাদীদের সম্পর্কে তাঁর যে ধারণা, সেই তুলনায় ঝাড়খন্ডের মাওবাদীরা
একেবারে আলাদা। সেই ভালো অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না।
কোবাড কেন এমন দেখেছেন, কেন এমন লিখেছেন,
কেন এমন প্রচার করছেন… ইত্যাদি অহেতুক প্রশ্নকে সামনে ঠেলে না দিয়ে তাঁর এই সমালোচনামূলক
পর্যবেক্ষণ থেকে সমস্যার গুরুত্ব খানিক উপলব্ধি করা যেতে পারতো নাকি? তিনি যা পর্যবেক্ষণ
করেছেন, সেটা যদি ঝাড়খন্ডের মাওবাদী আন্দোলনের সামগ্রিক চিত্র নাও হয়, খন্ড চিত্রও
যদি হয়, সেটা কি যথেষ্ট চিন্তার কারণ নয় মাওবাদী সংগঠনের জন্য? কোবাড কিন্তু বারবারই
একটা মাপকাঠির দিকে ইঙ্গিত করছেন বলে মনে হয়েছে এই সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণের পর্যায়
জুড়ে, আর সেটা হল ক্যাডারদের রাজনীতিকরণের মান। “keep politics in command"— সেই
ঐতিহাসিক বক্তব্যের মাপকাঠিতে সমস্যাকে বিচার করতে চেষ্টা করেছেন মাত্র।
এমনই এক অনবদ্য পর্যবেক্ষণ কোবাড রেখেছেন
অন্ধ্র-উড়িষ্যা সীমানা এলাকার নারায়ণপাটনা- কন্ধমাল-নিয়মগিরি অঞ্চলের আন্দোলন এবং আন্দোলনের
ব্যর্থতা প্রসঙ্গে। এই ঘটনাবলী তিনি জেনেছেন বিশাখাপত্তনম জেলে থাকবার সময় নকশাল নেতা
চড্ডা ভূষণমের থেকে। সেই অভিজ্ঞতায় প্রবল গণ আন্দোলন এবং তারপর রাষ্ট্রীয় দমনের সামনে
আন্দোলনের গুটিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক একটা রূপরেখা ফুটে উঠেছে। সেই প্রবল দমন মাওবাদী
স্কোয়াডকে অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে বলে তাঁর পর্যবেক্ষণ। তাঁরা হয় ভবঘুরে বিপ্লবীর
মতন ঘুরে বেড়িয়ে ঠিকেদারদের থেকে অর্থসংগ্রহ করছেন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, না
হয় সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন। এমন ঘটনা আঞ্চলিক ভেদ সমেত তেলেঙ্গানা এবং ঝাড়খন্ডেও
ঘটেছে বলে তিনি জেনেছেন। এই পর্যবেক্ষণের জন্য তাঁকে শাসকশ্রেণীর সুরে সুর মেলানো ইত্যাদি
অভিযোগে সুসজ্জিত করা হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে জরুরী যেটা মনে হয়েছে তা হল, কোবাড এই
পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে সমালোচনামূলকভাবে একদিকে ক্যাডারদের রাজনীতিকরণের দৈন্যতার দিকে
যেমন ইঙ্গিত করেছেন, পাশাপাশি মাওবাদী আন্দোলনের জঙ্গি অর্থনীতিবাদী প্রবণতার দিকেও
কিন্তু তিনি প্রবলভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ১৯৯৯ সালে শহীদ হওয়ার আগে সিপিআই এমএল(পিডব্লিউ)-এর
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড শ্যাম তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে সংগঠনের মধ্যে কার্যকরী থাকা
জঙ্গি অর্থনীতিবাদী ঝোঁককে চিহ্নিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে খুব জোরালোভাবে না হলেও জঙ্গি
অর্থনীতিবাদী ঝোঁকের প্রশ্ন মাওবাদী আন্দোলনের মধ্যে বারবারই এসেছে। কোবাড কিন্তু সেই
বিপজ্জনক ঝোঁকের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।
সে যাই হোক, ফিরে আসি কোবাড কী কী
মতাদর্শগত প্রশ্নকে সামনে এনেছেন সেই বিষয়ে। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে কোবাডের নিজেরই
আর এক উপলব্ধিকে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো, তাহলে হয়তো আপনাদের বিষয়টার গভীরে ঢুকতে
সুবিধা হবে। এই উপলব্ধি হল শত ফুল বিকশিত হতে না পারার উপলব্ধি। শত শত ফুলকে বিকশিত
হতে দেওয়ার জন্য যে উপলব্ধিটুকু প্রয়োজন আজ। ওনার লেখার এই জায়গাটা পড়ে অন্তত তাই উপলব্ধি
হয়েছে আমার। ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম বইটির ২৩৬ পাতার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে তিনি লিখছেন,
“The very concept of dialectics
encompasses democracy and without it there can be no development and growth of
ideas. Discussion of conflicting views is the basis of creation of new
thoughts, essential for creative growth. After all, we do know that it is the
‘unity and struggle of opposites’ that results in development. In the realm of
organization this would entail: starting with a level of unity, then a struggle
between conflicting views, finally arriving a higher level of unity. In the
realm of thought it would need an atmosphere of allowing conflicting views to
clash and thereby arriving at a higher level of knowledge. Today much of the
ossification in parties and organizations is probably due to the lack of such a
process in the development of new ideas. In fact, new ideas in Marxist circles
are often seen as dangerous, and the person is either labelled, targeted or
isolated. This approach does not help growth, particularly at a time when there
have been enormous changes in society and most movements for change are either
marking time or reiterating.”
বিস্ময়কর হল যে এই উপলব্ধিটিকেও হয়তো
বা বিপ্লবী কমিউনিস্ট শিবিরের দিক থেকে রাষ্ট্রের কিংবা শাসক শ্রেণীর সুরে সুর মেলানো
বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তাঁর ঐতিহাসিক প্রথম দলিলে বিপ্লবী কর্মীদের সংজ্ঞা দেওয়ার
সময় স্তালিনকে উদ্ধৃত করে খোদ চারু মজুমদার যে দেখিয়েছেন, “বিপ্লবী কর্মী হচ্ছে সে-ই
যে নিজের উদ্যোগে ঘটনার বিশ্লেষণ করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারে।”
…
এমন একটা কথা প্রবলভাবে হাওয়ায় ভাসছে
যে কোবাড নাকি বলেছেন, ব্যক্তির মুক্তি আগে এবং সমগ্রের মুক্তির প্রশ্ন পরে আসবে। তিনি
নাকি ভাববাদী-আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণার মাধ্যমে সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছেন। কিন্তু
সমস্যার সমাধানে কোবাড বিকল্প হিসাবে কী রেখেছেন প্রস্তাব হিসাবে?
নিঃসন্দেহে কোবাড ব্যক্তির পরিবর্তনের
উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তাঁর ভাবনায়। তিনি মনে করেছেন সমাজ তথা ব্যবস্থা পরিবর্তনের
জন্য যে প্রয়োজনীয় কর্মসূচীগুলি ইতিমধ্যেই কমিউনিস্টদের তালিকায় রয়েছে, সেগুলির সঙ্গে
যুক্ত করা উচিৎ নতুন সমাজের জন্য নতুন মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার প্রকল্পটিকেও।
কিন্তু আগে সেটি করে তারপরে বিপ্লবে নামতে হবে এই কথাটা তিনি কখনোই বলেননি, বরং যারা
সমাজ বদলের কাজে নিযুক্ত রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এই পরিবর্তনগুলি সচেতনভাবে নিয়ে আসাটা
ভীষণ জরুরী কাজ বলে তিনি মনে করেছেন। কমিউনিস্ট বিপ্লবী হিসাবে যে যে গুণাবলী একজন
বিপ্লবী কর্মীর থাকা প্রয়োজন সেটা অর্জন করার সংগ্রাম বাইরের দুনিয়াকে বদলানোর সঙ্গে
সঙ্গে একই সাথে শুরু করতে হবে বলে তিনি মনে করেছেন, এবং সেই মতামতই তিনি ব্যক্ত করেছেন।
আর এই কথাগুলি কিন্তু তিনি প্রথম বলছেন না।
কমরেড নর্মান বেথুন সম্পর্কে লিখতে
গিয়ে খোদ মাও সে তুং বলছেন, “কমরেড বেথুন নিজের প্রতি লেশ মাত্রও মনোযোগ না দিয়ে অপরের
জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গেছেন, তাঁর এই ভাব-মানস এখানে অভিব্যক্ত করে যে, তিনি
কাজের প্রতি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন এবং কমরেড ও জনগণের সঙ্গে অত্যন্ত সহৃদয় ব্যবহার
করতেন। প্রত্যেক কমিউনিস্টেরই তাঁর কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা উচিৎ। বেশ কিছু সংখ্যক
লোক নিজেদের কাজে দায়িত্বজ্ঞানহীন, তাঁরা ভারীটা ভয় করেন, হালকাটা গ্রহণ করেন, ভারী
ভার গুলো অন্যদের কাঁধে ঠেলে দেন, নিজেরা হালকাটা
বহন করেন। যদি তাঁদের সামনে কোনও কাজ পড়ে,
তা’হলে প্রথমে তাঁরা নিজেদের কথা ভাবেন, তারপরে অন্যদের। সামান্য একটা কাজ করলেই
তাঁরা আত্ম অহমিকায় মেতে ওঠেন, নিজেদের বড়াই করতে তাঁরা ভালবাসেন, তাঁরা এই ভয় করেন
যে, তাঁদের কাজ সম্পর্কে হয়তো অপরে জানতে পারবে না। তাঁরা কমরেড ও জনগণের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ
ব্যবহার করেন না, বরং নিরুত্তাপ, যত্নহীন ও নির্দয় ব্যবহার করেন। আসলে এই ধরনের লোক
কমিউনিস্ট নন, অন্ততপক্ষে তাঁদের প্রকৃত কমিউনিস্ট বলে ধরা যায় না। ফ্রন্ট থেকে আগতদের
মধ্যে এমনও কেউ নেই যিনি বেথুনের কথা বলার সময় তাঁর প্রশংসা করেন না এবং তাঁর ভাবমানসের
দ্বারা মুগ্ধ হননি।”
শুধু তাই নয়, কয়েক কদম এগিয়ে মাও সে
তুং এটাও বলেছেন যে, “একজন মানুষের যোগ্যতা বেশী অথবা কম হতে পারে, কিন্তু এই ভাব-মানস
থাকলেই তিনি হতে পারেন মহাপ্রাণ লোক, প্রকৃত লোক, নৈতিক চরিত্রসম্পন্ন লোক, নীচ রুচি
থেকে মুক্ত লোক ও জনগণের জন্য হিতকর লোক।”
‘অনুরাধা’-মডেলের মধ্য দিয়ে এমনই একটা
চিত্রায়ণ ঘটাতে চেয়েছেন কোবাড, কমিউনিস্টদেরকে কেমন হতে হবে। দুনিয়াকে বদল করা আর নিজেদের
বদলানোর মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে মোকাবিলা না করে বিপ্লবের লক্ষ্যে উত্তরণ হওয়া সম্ভব নয়।
মাও সে তুং-এর আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ
লেখায়, এমনকি সামরিক প্রবন্ধগুলিতেও এই বক্তব্যের স্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যায়।
আর কোবাড ঘান্দী শুধু এই ব্যক্তির
বিকাশের প্রশ্নে এমনকি বস্তারের উদাহরণও টেনেছেন। এই প্রশ্নে বস্তারে যে মহিলাদের মধ্যে
বিকাশ ঘটানোর কাজ হয়েছিল সেটাকে তিনি সামনে তুলে এনেছেন বলে মনে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে
ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম বইয়ের ২২১ পাতায় দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে তিনি লিখছেন, “Of
course, I had the example of Anuradha before me. A source from which one could
learn many things about social activists. Also, her experiences in Bastar, and
the way she recounted how they built the individuality, personality and
self-confidence of even the most backward Adivasi women were no doubt
enlighting.” তাছাড়া সিপিআই মাওবাদী সংগঠনটিও সরাসরি স্বীকার না করলেও ঘুরিয়ে এই সমস্ত
গুণাবলীর গুরুত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে, সেটার উল্লেখ করতে ভোলেননি কোবাড। সেটা মনে
হয়েছে কারণ ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম বইটির ২৩৩ পাতার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে তিনি বলছেন,
“…one positive aspect is that an Anu-prototype could gain recognition and also
a leadership role in her organizational environment, which may not have been
possible in other organizations. It was therefore a tacit acceptance (though
not vocal) of these positive attributes.”
আর সর্বোপরি কোবাড কার্ল মার্কসের
থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টির গুরুত্ব সম্পর্কে সকলকে সচেতন করতে চেয়েছেন। Third
Thesis of Feuerbach-এ কার্ল মার্কস লিখেছেন, “Historical materialism helps in
understanding the world; proletarian revolution is the means of changing it. In
the course of doing so, the proletariat would, in the process of remaking the
world, also remake itself. In other words, in the process of remaking society
for the better, revolutionaries also remake themselves better human beings.” বিশ্ব
বদলের প্রক্রিয়ায় সামিল হয়ে বদল আসবে, না কখনও আগে বিশ্ব বদলাক পরে মানুষ বদলাবে এই
কথা মার্কস বলেননি।
এবার আমরা বরং চোখ রাখি সমস্যা সমাধানে
কোবাডের দেওয়া বিকল্প প্রকল্পের দিকে। ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম বইয়ের ২২০ পাতায় দ্বিতীয়
প্যারাগ্রাফে তিনি বলছেন, “…I began thinking that till today no other economic
system has appeared that is more just and sustainable than the communist
project. Yet, due to its failures worldwide there is need for some rethinking.
I felt that no doubt the seeds have to be maintained, but one has to ensure
that the flowers don’t wilt and fruits don’t turn sour. For that the seeds
probably need to be nurtured with much greater care than they were in the past.
Primarily, the saplings, I concluded, should be nursed;
Firstly, in an environment of
freedom.
Secondly, it should be built
with a new set of values, as, say, epitomized by the Anuradha-model.
Thirdly, it should have as it’s
goal universal happiness”
অর্থাৎ বর্তমান প্রকল্পকে কোবাড বাতিল
করে দিচ্ছেন এমনটা একেবারেই সত্য নয়। তিনি বলছেন, বর্তমান প্রকল্পের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ
দিকগুলিকে পরিচর্যা করবার পাশাপাশি আরও কিছু নতুন দিককে প্রকল্পের সঙ্গে জুড়বার কথা।
স্বাধীনতা/গণতন্ত্রের প্রশ্ন। ভালো মূল্যবোধের প্রকল্প, যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি।
তৃতীয় হল universal happiness অথবা সকলের জন্য খুশীকে লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা
(W.T.O. কিংবা অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা যে Universal Happiness-এর কথা বলে, তার
থেকে এটি একেবারেই আলাদা এবং সম্পর্কহীন)। কিন্তু কেন তিনি এই universal
happiness-কে অন্যতম লক্ষ্য হিসাবে বেছে নেওয়ার জন্য সওয়াল করছেন? কারণ হিসাবে ফ্র্যাকচার্ড
ফ্রিডম বইয়ের ২৩৪ পাতায় দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে তিনি বলছেন, “If the organization
seeking radical change keeps ‘happiness’ as their central goal, it will get
reflected in day-to-day associations, in leaders’ attitude to cadres, in
approach to the masses, women, Dalits, everywhere; bringing with it a fresh
breeze of freedom, democracy and the good values..”
অর্থাৎ বর্তমান কমিউনিস্ট শিবিরের
আভ্যন্তরীণ সমস্যাকে সমাধান করবার জন্য তিনি একে লক্ষ্য হিসাবে সামনে রাখাকে সমাধানের
রাস্তা হিসাবে দেখেছেন। এবং এখানে কোবাড সম্ভবত একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে ফিরিয়ে
আনছেন কমিউনিস্ট শিবিরে। সেই প্রশ্নটা হল মাওবাদটা আসলে ঠিক কী? আমার মনে হয়েছে কোবাড মাওবাদকে দেখছেন বৃহত্তর দার্শনিক প্রেক্ষাপটে,
কারণ সেখানে মানুষকে আভ্যন্তরীণ ভাবে পরিবর্তন করবার পক্ষে জোরালো উপস্থাপনা রয়েছে।
যেমন, মাও সেতুং মনে করেছেন আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক দ্বন্দ্বের মধ্যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই
প্রধান এবং শুধু তাইই নয় মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপ্লব “মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব”
হয়েছেই একেবারে এই প্রশ্নের উপর দাঁড়িয়ে।
২০১২-১৩ সালে প্রকাশিত Questions
of Freedom and People’s Emancipation-এর প্রবন্ধগুলিতে তিনি লিখেছিলেন, “And so
it was with China. As they were unable to successfully imbibe the values of
goodness, the masses began trading the old path to happiness. Probably, after
the revolution they sought to bring about change too rapidly for which the
people were not yet mentally ready. This is the both in the realm of the
economy as also in the sphere of people’s thinking. Obviously, people’s
consciousness, having just emerged from a backward feudal background, was not
yet ripe to accept the commune-type organization (without private property),
nor the selfless values sought to be imposed during the cultural revolution.
Just having acquired the basic
necessities of life together with education for the first time in generations
and having so evolved their senses and desires the natural trend was for
greater and greater enjoymentof the newly acquired pleasures, not the rigid
sense of duity that the communist party sought to imposed. So, seeking to
forcibly imposed selfless values during the cultural revolution through the
impetuous Red Guards, the cult of Mao, and labor camps (May 7th schools) only
created an appearance of conforming to dictates, not real change within the
bulk of the people.
Man cannot change his
subconscious/conscious mind through imposition and force. It is only possible
through a sense of awareness voluntarily acquired through a deep understanding
that positive values alone can take us on the path to genuine happiness, not
the instant pleasures of the day acquired through the new-found wealth of the populace
over a generation of socialist construction.
It is now obvious (in
hindsight), that during the Cultural Revolution in China the bulk of the people
merely suppressed their desires and wants in order to conform to the hysteria
whipped up. And, once the opportunity arose, with Deng’s get-rich theory, the
people’s suppressed desires/urges found a release in the form of acceptance. So
there was little resistance to the new policies introduced by Deng. Not even
the examples of Tachai and Taching (commune models in agricultures and
industry), nor the limited resistance in Shanghai could stem the surge of
support to Deng’s reversals. The rest, of course, is history as we witness in
China today with the billionaire ‘princelings’ dominating the communist party
leadership and its 80 million odd rank-and-file comprising a major share of a
relatively priviledged middleclass.
Yet, it is not that human nature
is basically bad and unchangeable. No doubt man’s negative values emotions etc
are very deeply embedded through conditioning over centuries together with
strong impulses generated from our early childhood days. Yet we have also seen
that man’s thinking is not a fixed entity and the neuroplasticity of the mind
allows change. In addition, we have also seen that the innate goodness in man
has time and again sought to assert itself through history.
The lesson to be learnt fron the
Chinese experience is that in man a seed of goodness has been covered by layer
upon layer of poisonous weeds and is therefore unable to bear fruit so easily.”
হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে
এবং কেন সেই ব্যর্থতা সেটা নিয়ে কোবাড তাঁর স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি মাওবাদের
শিক্ষা থেকেই এটা অনুভব করতে পারেন যে মানুষের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন একটি সচেতন প্রয়াশ।
তাই বিপ্লবের সঙ্গে সেই কাজটিকে না জুড়ে নিলে কোনও এক বিপ্লব পরবর্তী সুন্দর সকালে
সব মানুষ ‘নতুন মানুষ’-এ পরিণত হবেন এমনটা হওয়া অসম্ভব। ইতিহাস তার সাক্ষ্য বহন করছে।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর এই সংগ্রামটিকেই নিরন্তর চালিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই কি মাওবাদের
শিক্ষা নয়?
তবুও যাঁরা মনে করছেন যে কোবাড শুধুই
আধ্যাত্মিকভাবে ভালো মানুষ গড়ে তোলবার প্রকল্প
নিতে বলেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, কোবাড কিন্তু বেস এবং সুপারস্ট্রাকচারের প্রশ্ন
দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও স্বাধীনতা-খুশী ইত্যাদি প্রকল্পের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক এবং দ্বন্দ্বটিকে
ব্যাখ্যা করেছেন। অন্তত পড়তে গিয়ে আমার তেমনটাই মনে হয়েছে। ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম বইটির
২৩২ পাতায় তৃতীয় প্যারাগ্রাফে তিনি লিখছেন,
“…the economic structure must facilitate the evolution of happiness, freedom
and good values in the superstructure; while the later must promote an economic
base built in their image.” এই বিষয়ে পরবর্তীকালে কোবাড বিশদে চর্চা করবেন বলেও জানিয়েছেন।
কিন্তু কোবাডের চিন্তার ঢেউ কেবল এখানেই
আটকে নেই। বিশ্বব্যবস্থার উথাল পাথাল এবং নতুন নতুন যে সমস্ত সমীকরন ও সম্ভাবনা তৈরি
হচ্ছে সেইদিকে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে তাঁর। শুধু ফ্র্যাকচার্ড ফ্রিডম নয়, জেলে থেকে এমনকি
জেল থেকে বেরিয়েও সেই নিয়ে ক্রমাগতভাবে কাজ করে গেছেন কোবাড। খুঁজেছেন কমিউনিস্টদের
পিছিয়ে পড়ার কারণ, চেয়েছেন সৃজনশীলতা, যেকোনো সঙ্কট মোকাবিলার প্রশ্নে। শুধুমাত্র রুশ
বা চীনা পথ ধরে নয়, ভারতের বুকে জগদ্দল পাথরের মতন চেপে বসে থাকা ব্রাক্ষ্মণ্যবাদকে
পরাস্ত করতে কোবাড ভারতীয় ইতিহাসের হাজার বছরের ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের থেকে
চেয়েছেন রসদ সংগ্রহ করতে। কোনও অন্ধ অনুকরণ নয়, ভারতের সমস্যার স্বরূপকে বুঝে তিনি
ভারতীয় পন্থায় কমিউনিস্টদের অগ্রসর হওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছেন। ভারতের মেহনতি জনগণের
কাছে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ চিরকালই ভারতীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক ভারী পাথর বিশেষ। হাজার হাজার
বছর ধরে এই পাথর ভারতের মানুষের বুকে চেপে বসে আছে। আর সেই পাথরকে উপড়ে ফেলতে ভারতে
২৭০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে প্রতিরোধ চলছে। চার্বাক থেকে শুরু করে, বৌদ্ধ-জৈন এবং নানান
প্রতিবাদী ধর্মমত, ভক্তি ও সূফী আন্দোলন, নিরবিচ্ছিন্নভাবে ব্রাক্ষ্মণ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ
জানিয়ে গেছে। সেই ধারাতেই জ্যোতিরাও ফুলে, আম্বেদকর এবং পেরিয়ার ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের
বিরুদ্ধে সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কোবাড কমিউনিস্টদের কাছে ভারতীয় এই সমৃদ্ধ ব্রাক্ষ্মণ্যবাদ
বিরোধী সংগ্রামের ধারাকে আত্মস্থ করবার এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান রেখেছেন। তাছাড়া
তিনি খেয়াল করেছেন সেই ব্রিটিশ আমল থেকে ভারত থেকে ক্রমাগত হয়ে চলা সম্পদ নির্গমনকে।
যেটা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ফোঁপরা করে ফেলছে দিন প্রতিদিন এবং দেশের জল-জমি-জঙ্গল-মানুষ
সমস্ত কিছু তলিয়ে যাচ্ছে প্রকান্ড এই কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসী গ্রাসে। সেখানে দেশপ্রেমের
বীজমন্ত্র বপন করতে বলেছেন কোবাড বৈদেশিক লুঠের বিরুদ্ধে। মানুষের মনের দ্বার-চিন্তা
দ্বার উন্মুক্ত হোক এবং তাঁরা এই প্রতিরোধ স্বেচ্ছায়-সচেতন ভাবে-সক্রিয় হয়ে সামিল হোন,
এই চাওয়াটুকু ব্যক্ত হয়েছে তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে।
“বিপ্লবী” শিবির তাঁকে রেনিগেড বললেও,
বিপ্লবের তাঁকে আজ বড়ই প্রয়োজন।
[লেখকের মত তাঁর একান্ত নিজস্ব।]
Comments
Post a Comment