স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বাজেট
কমঃ জ্যোতি বসুর দ্বাদশ মৃত্যু বার্ষিকীতে ফিরে দেখা ইতিহাসের পাতা থেকে…
[১৯৪৮ সালের ২০
ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ভাষণ]
জ্যোতি বসু:
মি. ডেপুটি স্পিকার, দূর্ভাগ্যক্রমে
আমি আগামীকাল বলবো ভেবেছিলাম, আর তাই যথেষ্ট প্রস্তুত হইনি,
কিন্তু শুনলাম আগামীকাল ছুটি এবং সোমবার যেহেতু আমি এখানে থাকবো
না তাই বাজেটের ওপর আমার বক্তব্য আজই বলার চেষ্টা করছি।
আমি মনে করি,
বাজেট সংক্রান্ত যে-কোনো হিসাব-নিকাশ দেশের বাস্তব অবস্থা এবং
সাধারণের প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকা উচিত। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও, কংগ্রেস ও লীগ সরকার
ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থার যে ক্রমশ অবনতি ঘটে চলেছে
তা নতুন করে বলা নিষ্প্রয়োজন। জীবনযাত্রার ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং
১৯৩৯ সালের তুলনায় এটি এখন প্রায় ৩৪০-এ ঠেকেছে। আমাদের এই সোনার দেশে কালোবাজারীদের
জমানা আর মুনাফাবাজদের স্বর্গরাজ্য কায়েম হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষকরা আরও গরিব
হয়ে পড়েছে, ভূমিহীন
ক্ষেতমজুরবাহিনী ক্রমশই আয়তনে স্ফীত হচ্ছে। গত একবছরে ধানচাষীদেরও কালোবাজারে চাল
কিনতে হচ্ছে, কিনতে
হচ্ছে অন্যান্য পণ্যসামগ্রী। এরফলে নিজের একখণ্ড ছোট্ট জমি কিংবা সামান্য যে
সম্পত্তি তাও বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। বলদ,
লোহা, ইস্পাত, লাঙল — সবকিছুর দাম সাংঘাতিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা এখন হতদরিদ্র
হয়ে পড়েছে। বহু গ্রামে কুটির শিল্পের অস্তিত্ব নেই। শ্রমিকের মজুরি আর মধ্যবিত্ত
কর্মচারীর মাসমাইনের অর্থমূল্য তাঁদের আগের আয়ের তুলনায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হ্রাস
পেয়েছে — এমনকি
উচ্চতর হারে মহার্ঘভাতার পূর্ণ সুবিধা এবং অনেকক্ষেত্রে মজুরির নিয়মমাফিক বৃদ্ধি
সত্ত্বেও। যে পরিমাণ রেশন দেওয়া হয় সেটা গোটা পরিবারের জন্য অপ্রতুল তো বটেই, এমনকি তার নিজেরও তাতে কুলোয়
না। গত দু’বছরে
কাপড় দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদ এদেশে কোনো বুনিয়াদী শিল্প গড়ে
তুলতে রাজি না-হয়ে প্রকৃত শিল্পোন্নয়নের বিষয়টি বাতিল করে দেওয়ায় ৯৮ শতাংশ
শ্রমিক আর মধ্যবিত্ত-কর্মচারী পরিবারে অভাব আর দুঃখকষ্ট অত্যন্ত স্বাভাবিক
প্রাত্যহিক ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ শেষ হতে না হতে লাখ লাখ মানুষ তীব্র
বেকারত্বের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, অথবা সেনাবাহিনী বা সরকারি অস্ত্র বিভাগ, সরকারি অফিস, অসামরিক সরবরাহ, মিলিটারি হিসাব-নিকাশ আরো আরো
সব কাজের জায়গা থেকে ছাঁটাই হয়ে গেছে। এই সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির কবলে সাধারণ মানুষ
যখন যন্ত্রণায় কাতর তখন কিন্তু ধনী পুঁজিপতিরা যুদ্ধের সময়কার কন্ট্রাক্ট, অর্ডারের দৌলতে ফুলে ফেঁপে
উঠেছে। তাঁদের ঘরে জমেছে সম্পদের স্তুপ। — এই কথাটাই আমি মন্ত্রীদের স্পষ্টভাবে
মনে করিয়ে দিতে চাই। গ্রামে জমিদার আর জোতদারের দল কৃষকের সম্পত্তি দখল করে শোষণের
শক্তি বৃদ্ধি করছে। এরসঙ্গে মড়ার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো বঙ্গবিভাগ আমাদের
অর্থনীতিতে নিদারুণ প্রভাব ফেলেছে, যেকথা মাননীয় অর্থমন্ত্রীও উল্লেখ করেছেন। পশ্চিমবাংলাকে যদি
এই পঙ্কিল আবর্ত থেকে উদ্ধার করতে হয়, যদি এ বাংলার সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে হয়, সুখী আর সমৃদ্ধ
দেশের ভবিষ্যত ভিত্তি স্থাপন করতে হয় তবে এইমুহূর্তে দ্রুত, আশু, এমনকি প্রয়োজনে
কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের যে ক্লেদ, আবর্জনা, পৈশাচিক অপরাধ বছরের পর বছর
সমাজজীবনের গভীরে প্রোথিত হয়েছে, তা একদিনে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। সে কথা আমি
জানি। আমাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা যে পথ আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছে সেই পদচিহ্ন
ধরে কিংবা মন্থর সংস্কারেও এ-কাজ করা যাবে না। একশ বছরের লোকসানের ওপর আমাদের
প্রলেপ দিতে হবে। যতো কম সময়ে সম্ভব অগ্রগামী পুঁজিবাদী দেশগুলোর নাগাল পেতে হবে
আমাদের। তাই আমাদের তাড়া আছে, আমরা একটু অস্থির। জানি,
খুব অল্প সময়ে কিংবা একদিনের মধ্যে কোনো জাদু-কাঠি বুলিয়ে, আগে যেমনটি ছিলো আমার দেশ, সুখ আর সমৃদ্ধিতে উপচে পড়া,
ঠিক তেমনটি গড়ে তোলা যাবে না। কিন্তু আমাদের সামনে যে বাজেট পেশ করা হয়েছে, তার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের
একটা স্পষ্ট পরিপ্রেক্ষিত অবশ্যই দেখতে পাওয়ার কথা। এটি অবশ্যই চমকে দেওয়া নতুন
কোনো ব্যতিক্রমকে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করবে,
যাতে জনতার দরবারে অগৌরবের অতীত থেকে নতুন নেওয়া এক বাঁকের
বিশ্বাসযোগ্য সম্ভাবনা ঘোষিত হবে। এদিক থেকে বিচার করে আমি দেখিয়ে দেবো যে, বিভিন্ন ব্রিটিশ সরকারের
আমলে একের পর এক যেসব বাজেট তৈরি করা হয়েছিল,
সেগুলিরই মতোই আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীর তৈরি করা এ-বাজেট
একেবারেই গতানুগতিক।
স্বাধীন বাংলার
তথাকথিত প্রথম বাজেটে রাজস্ব প্রস্তাবনায় ২৪১/২ কোটি টাকা যে
সাধারণ রাজস্ব দেখানো হয়েছে সেটির মধ্যে একচতুর্থাংশ আয় অর্থাৎ ৬ কোটি ধরা
হয়েহে বিক্রিকর বাবদ আয় — এরমধ্যে ৫ কোটি টাকা আসছে আয়কর থেকে,
আর ৪০ লাখ কৃষি-আয়কর। এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে বাস্তবকে
দেখিয়ে দিচ্ছে। যে রাজ্য অর্থের ও আফিম, মদ এইসব বিক্রি করে বিক্রিকর বাবদ সাধারণ মানুষের উপর বোঝা
চাপায়, সেই
রাজ্যের ভবিষ্যত বড়ো অন্ধকার। আমার মনে পড়ে যে,
এই বিশেষ বিক্রয়করের প্রস্তাব যখন প্রথমবার পেশ করা হয়েছিলো
তখন কংগ্রেস সদস্যরা একেবারে হৈ চৈ তুলেছিলেন। আজ নির্লজ্জের
মতো কংগ্রেসের মন্ত্রীরা ওকালতি করছেন যে এরাজ্যের রাজস্ব সংগৃহীত হবে বিক্রয়কর
থেকে। ঠিকই, এ-সরকার
তার শ্রেণীচরিত্র অনুযায়ী আপনজনদের কথা খুব বেশি করেই মনে রেখেছে। তাই কৃষি-আয়কর
হিসেবে জমিদারদের কাছ থেকে হচ্ছে মাত্র ৪০ লাখ টাকা। ধনীর ওপর কর বসানোর লক্ষ্যে
কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়নি। যেমন, মৃত্যু-কর চালু করা, অন্যান্য ধনতান্ত্রিক ইউরোপীয় দেশে যেমন আছে। লোহা-ইস্পাত, কয়লা, বস্ত্র, চা আর অন্যান্য শিল্প জাতীয়করণের ভিত্তি তৈরি করার এবং
জমিদারী ব্যবস্থা বিলোপের জন্য কিছু করা হয়নি। মন্ত্রীমহোদয়েরা নিশ্চয়ই বুঝতে
পারছেন যে এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজ্যের রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা হবে। কেন্দ্রও
বাড়তি মুনাফা-কর তুলে দিয়ে নির্লজ্জের মতো আয়করের বেশ মোটা অঙ্ক দাবি করছে। যা
বিভক্ত বাংলার কাছে
প্রাপ্যের চেয়ে বেশি। রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে কংগ্রেস সরকারগুলি জনসাধারণের সুবিধেজনক
কোনো পদ্ধতি না নিয়ে আমাদের সাম্রাজ্যবাদী ধনতান্ত্রিক প্রভুদের — পথেই চলেছে।
কাজেই, আমাদের মাননীয়
অর্থমন্ত্রী মহোদয় তাঁর বাজেট ভাষণে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আমাদের অর্থনীতির
এমন এক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে চলেছেন, যাতে যতটা সম্ভব কম সময়ে এই
মানুষে-মানুষে বিভেদের চিহ্ন যে আর এরাজ্যে থাকবে না সেটা একেবারে নিশ্চিত করা
যাবে — এতে আমি অত্যন্ত অবাক।
এবার ব্যয়ের দিকে এক নজর
তাকালে আমরা দেখতে পাবো একইরকম হতাশাব্যঞ্জক ছবি। মানুষে মানুষে পার্থক্য বেড়ে
যাওয়ার সুস্পষ্ট চিহ্ন। ধনী যাতে আরো ধনী হতে পারে, আর গরিব আরো গরিব সেইজন্যে সব
রাস্তা একেবারে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী বিভক্ত
বঙ্গপ্রদেশের বেশ পরিষ্কার একটা ছবি উপস্থিত করেছেন। কিন্তু প্রথমেই একটা ব্যাপারে
ধাক্কা লাগে যে,
পশ্চিমবাংলা
যদিও মূল বাংলা প্রদেশের প্রায় একের তিন ভাগ, তবুও প্রশাসনিক খরচ একই রয়ে গেছে, বিশেষত, ওপরমহলের খরচ। জানি না
কেন অফিসাররা একই বেতন পেয়ে যাচ্ছে আগের মতোই। তাঁদের যাতায়াতের ও অন্যান্য ভাতা
একইরকম রয়ে গেছে। অনাড়ম্বর জীবনযাপন আর মহৎ চিন্তাভাবনার ভক্ত সব, খাদির জামা-কাপড়েই
অভ্যস্ত যাঁরা,
আমি অবশ্য
মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কথা বলছি না, অন্য যাঁরা, যেসব ভদ্রমহোদয়গণ উল্টোদিকে বসে আছেন, তারা তো গতকালও তৃতীয়
শ্রেণীতে যাতায়াত করেছেন, আজ ক্ষমতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে রাজামহারাজার মতো ভাব
করছেন। একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি কেননা তারা এমন ভান করছেন যেন এটা একটা জনমুখী
বাজেট। এতে মানুষে মানুষে বিভেদ একেবারে বিলোপ হয়ে যাবে।
আগের মতোই শতকরা হারে মোট
খরচের সিংহভাগ পুলিসের জন্য খরচ করা হয়েছে, এটাও লক্ষ্য করলাম, এক্ষেত্রেও টাকার অঙ্ক
অবিভক্ত বাংলায় যা খরচ করা হতো প্রায় তাই রয়েছে।
অতীতে সরকার যে পথে চলেছে
তারই যুক্তিমতো হিসেবে এরকম করা যেতেই পারে; আর এই বিশেষ বাজেট তো সেই পদাঙ্ক
অনুসরণ করেই চলেছে। মন্ত্রীমহোদয় যদি এমন কোনো ভিত নির্মাণ করতে না পারেন যার
কারণে মানুষের কিছু ভালো হবে, শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে কিংবা বেকারত্বকে রুখে দেওয়া যাবে, তবে তো পুলিসের জন্যে
অর্থ বরাদ্দ বাড়াতেই হবে। কেননা শ্রমিকরা, কৃষকরা যখন বেশি মজুরির জন্য, আরো চাল, আরো খাবার, আরো কাপড় চাইবে তখন তাঁদের
হাত থেকে ঐ ওনারা যাকে বলেন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা সেগুলি ফিরিয়ে আনতে
কিংবা রক্ষা করতে ঐ পুলিস বাহিনীকেই তো পাঠাতে হবে শহরে, গ্রামে। পুলিসি খাতে আরো বেশি খরচ
বাড়িয়ে শ্রমিকদের বাধ্য করানো হবে এই পুঁজিপতি শ্রেণীর সেবাদল হয়ে থাকতে। যাতে
যথেষ্ট খাবার পাচ্ছে না বলে তারা যেন প্রতিবাদ করতে না পারে। কাজেই আমার বক্তব্য হলো, পুলিস বাজেটের এই ব্যয়
অত্যন্ত যৌক্তিক।
আগে মিঃ সুরাবর্দি, যা করেছেন সেরকমভাবে
আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীর আরেকটি ব্যয়বরাদ্দ আমার কাছে বেশ চিত্তাকর্ষক মনে
হয়েছে। সেটা হলো সঠিক পথে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকলাপ এবং আরো অন্যান্য বিষয়ের জন্য
কিছু অর্থ বরাদ্দ। এই খাতে প্রায় তিন লাখ তেত্রিশ হাজার টাকা ব্যয় করা হবে। আমি
জানি মিঃ সুরাবর্দি শ্রমিকদের অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়নগুলো ভাঙতে এবং সরকার
নিয়ন্ত্রিত ও সরকারের দ্বারা প্রভাবিত ট্রেড ইউনিয়ন তৈরির জন্য এসব করতেন। আজ ডঃ
সুরেশচন্দ্র ব্যানার্জির আই এন টি ইউ সি-র বর্তমান সরকার তার নিজস্ব একটা সংগঠন
পেয়ে গেছে,
যাঁরা ঐ একই
সম্ভবত সেকারণেই এই অর্থবরাদ্দ — যে টাকা আই এন টি ইউ সি-কে শ্রমিকরা কোনোদিন দেবে
না, বর্তমান মন্ত্রিসভা সেই
টাকাটাই তাঁদের জন্য বরাদ্দ করে রেখে দিয়েছে। অতীতে জার্মানিতে, ইতালিতে যে ফ্যাসিস্ট
ট্রেড ইউনিয়ন দেখা গিয়েছিলো সেই ঐতিহ্য মতোই এটা করা হয়েছে। জার্মানিতে ছিলেন ডঃ গোয়েবলস
আর ডঃ লে আর। আমাদের দেশেও ডাক্তাররা আছেন যাঁরা ঠিক একই কাজ করতে চলেছেন পুঁজিপতি
শ্রেণীর জন্য। সেকারণেই এই খাতে অর্থবরাদ্দ হয়েছে।
এবার যদি আমরা
সেচ আর কৃষির দিকে মুখ ফেরাই তাহলে দেখবো যে গত বাজেটের তুলনায় এ-বছর কৃষিতে আর
একটু বেশি খরচ করা হয়েছে এটা দেখাতে গিয়ে আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে কি
পরিমাণ কষ্ট পেতে হয়েছে। অত্যন্ত সত্যি একথা। মাত্র কয়েক লক্ষ টাকা বাড়তি খরচ
ধরা হয়েছে কৃষিতে, কিন্তু
এতে কোনো গুণগত পরিবর্তন ঘটবে না। জনগণের প্রয়োজন মেটাতে বাড়তি কয়েক লক্ষ টাকা
খরচ করা হবে এবং আমরা যদি জনগণের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করি, তাহলে দেখবো, এই টাকা সমুদ্রে একবিন্দু
জলের সমান। মন্ত্রীমহোদয় সম্ভবত তা বুঝবেন। আজকের দিনে প্রধান কাজ যেটা দরকার বলে
কংগ্রেস এবং দেশের কার্যত সবাই উপলব্ধি করেছেন তাহলো জমিদারি প্রথার অবসান। এই
প্রথাই মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করছে, এই ব্যবস্থাই মানুষকে দারিদ্রে,
নিরক্ষরতায় এবং সাধারণভাবে অধঃপতনে আটকে রাখছে। কিন্তু
জমিদারি প্রথার অবসান ঘটানোর জন্য কার্যত কোনো চেষ্টা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। উল্টোদিকে
বসে থাকা ভদ্রমহোদয়গণ সম্ভবত সেই জমিদার শ্রেণীরই প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করেছেন।
পুঁজিবাদী শ্রেণীর মুখপাত্ররা, পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরাও স্বীকার করেছেন যে জমিদারি
ব্যবস্থাকে রদ করতে হবে এবং কৃষক ও সরকারের মধ্যে অন্য কোনো ধরনের সম্পর্ক তৈরি
করা উচিত। কিন্তু তবুও মুক্ত বাংলার প্রথম বাজেটে এই লক্ষ্যে কোনো সৎ, সোজাসাপটা ব্যবস্থা নেওয়া হল
না। আপনারা হয়তো বীজ, সার, লোহা, ইস্পাত প্রভৃতি কৃষকদের সরবরাহ খাতে এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ বা দশ লক্ষ বা তার
বেশি টাকা খরচ করতে পারেন। কিছু অবাঞ্চিত লোকজনের হাতে পড়ে জলে যাবে, হাতে কিছু থাকবে না এবং
দু-এক বছরের মধ্যে কোনো ফল মিলবে না।
অনুরূপভাবে, শিল্পক্ষেত্রে দেশকে এবং বিশেষত
পুঁজিপতি শ্রেণীকে সযত্নে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে শিল্পের একটা বড় অংশই বেসরকারি
হাতে থাকবে। বর্তমান কাজের যে ঐতিহ্য এবং ভূমিকা তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তাঁরা
একথা বলেছেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী নিজে একজন পুঁজিপতি হলেও তাকে আমি দোষ দিচ্ছি না।
অর্থমন্ত্রীকে দোষ দিচ্ছি না কারণ আমি জানি এই নীতি অন্যান্য কংগ্রেসি মন্ত্রীরাও অনুসরণ
করেছেন। যাঁরা কংগ্রেসে দীর্ঘদিন ধরে আছেন,
যাঁরা লড়াই সংগ্রাম করেছেন — আমি জানি না তাঁরা উচ্চ আদর্শের
জন্য লড়াই করেছিলেন কিনা, কিন্তু যাঁরা উচ্চ আদর্শের কথা বলেছিলেন — তারা কেন এই নীতি
অনুসরণ করছেন এবং সম্ভবত সেই কারণেই তাঁদের স্যর সম্মুখম চেট্টি, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এবং
মিঃ নলিনীরঞ্জন সরকারকে সরকারের মধ্যে আনা হয়েছে। তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় যেমন সর্দার প্যাটেল, পুঁজিপতি শ্রেণীকে বলেছেন,
“আপনারা ভয় পাচ্ছেন কেন?” —
(এসময় মুসলিম লীগের একজন মাননীয় বিধায়ক অধ্যক্ষের আসনের
সামনে দিয়ে চলে যান।)
উপাধ্যক্ষ: অর্ডার, অর্ডার।...
জ্যোতি বসু: স্যর, যেসব ভদ্রমহোদয়গণ এই
বাজেট তৈরি করেছেন আমি তাঁদের দোষ দিচ্ছি না। সর্দার প্যাটেল এবং তাঁর বন্ধুদের
কথা মতোই তারা এ কাজ করেছেন পুঁজিপতি শ্রেনীকে তারা একেবারে সোজাসাপটা বলেছেন, “আপনারা ভয় পাচ্ছেন কেন? কংগ্রেস সরকারের মধ্যেই তো
আপনাদের প্রতিনিধিরা রয়েছে।” কাজেই শিল্প প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার দরকার নেই। সারা
পৃথিবী জুড়ে পুঁজিবাদ যখন গভীর সঙ্কটে তখন আমাদের দেশে কী ধরনের অর্থনীতি আমরা পাবো
সে তো আমরা জানি। এমনকি আমাদের সামনে বসে আছেন কয়েকজন ভদ্রলোক তাঁদের নতুন প্রভুর
দেশ, মানে আমেরিকা, সেখানেও এ ধরনের সঙ্কট
ঘনীভূত হচ্ছে। কাজেই সমস্ত শিল্পকারখানা ব্যক্তিমালিকের জিম্মায় ফেলে রাখলে
আমাদের দেশের কোনো লাভ হবে না। বরং অতি শীঘ্রই আমরা দেখবো, একটা সাংঘাতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট
আমাদের প্রিয় দেশকে তছনছ করে দিচ্ছে। তখন অবশ্যই শ্রমিকদের দোষ দেওয়া হবে যে
তারা উৎপাদন করছে না। একইভাবে কৃষকদেরও দায়ী করা হবে যে তারাও ফসল ফলাচ্ছে না, অতএব দোষ যদি কারোর থাকে
সে তো ওদেরই।
তারপর, এখানে দেখছি, বস্তি উন্নয়নে কুড়ি লাখ
টাকা রাখা আছে। এর মানে, তখনকার সুরাবর্দি সরকার বরাদ্দ করেছিলো মাথাপিছু ১ টাকা ৮০
পয়সা, আর তার জায়গায় এটা মোটামুটি
মাথাপিছু ২ টাকার মতো। এ কথা বলার কারণ শহর কলকাতায় বস্তিবাসীর সংখ্যা দশ লাখেরও
বেশি। প্রতিদিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। পূর্ববাংলা, আরো অন্যান্য জায়গা থেকে ক্রমাগত
মানুষ এসেছে।
তারপর স্যর, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর
জন্যে ৫০ লাখ টাকা অনুমোদন করা হয়েছে। খুবই সামান্য টাকা। জানি না কিভাবে খরচ
হবে। কিন্তু এ টাকায় মাত্র ৩০০ কি ৪০০-র বেশি পরিবারের উপকার হবে না।
এছাড়া সিমেন্ট, লোহা, ইস্পাত, ইট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়
জিনিসপত্র যেগুলো বাড়ি তৈরি করতে দরকার সেগুলি অধিক সরবরাহের বিষয়ে বাজেটে একটা
শব্দও নেই। আমরা জানি যে, এইসব জিনিসপত্র যদি নিয়ন্ত্রিত দরে সরবরাহ করা হয় তবে
এমনকি সাধারণ লোকজনও বাড়ি তৈরি করার কথা ভাবতে পারবে। আমরা জানি, যুদ্ধের সময় এ অধিকার
কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো। শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষের জন্যে নয়, সরকারকেও বাড়ি তৈরি করতে
দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখন সেরকম কোনো কথা উঠবে না। তথাপি আমাদের বর্তমান সরকার, মন্ত্রিপরিষদ তাঁদের
পুঁজিপতি বন্ধুদের, এইসব
লোকজন যাদের সিমেন্টের কারখানা আছে, লৌহ-ইস্পাত কারখানা আছে, আরো নানান সব আছে, তাদের কীভাবে চটিয়ে দিতে
পারে? অতএব তাদের নিয়ে একটা
শব্দও নেই। আমাদের বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের বাসস্থান সংক্রান্ত বিশাল সমস্যা
সমাধানের জন্যে কয়েক লাখ টাকা খরচ করা হবে। বেতন বৃদ্ধি নিয়ে বাজেট বক্তৃতায়
দেড় পাতা খরচ করা হয়েছে। আমার যতদূর মনে আছে এবং জানা আছে, আমাদের প্রদেশের
পূর্বর্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ ঘোষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, সরকারি কর্মচারীদের
পে-কমিশনের বেতনহার দেওয়া হবে। হিসেব করে আমরা দেখেছিলাম যে এতে প্রায় তিন কোটি
টাকা কিংবা তার একটু বেশি খরচ হবে। কিন্তু বর্তমান মন্ত্রক এজন্যে বরাদ্দ করেছেন
মাত্র এক কোটি টাকা। আমি অবশ্য শুনেছি, বাজেটের প্রথম খসড়া যখন তৈরি করা হয়েছিলো
তখন এই খাতে আরো বেশি খরচের বন্দোবস্ত হয়েছিলো। কিন্তু আমাদের বর্তমান
অর্থমন্ত্রীমহোদয় সেসব বাতিল করে এই বরাদ্দ অনুমোদন করেছেন। জানি না কেন তিনি
এরকম করলেন,
কেননা আজকের
দিনে যেসব মধ্যবিত্ত কর্মচারী অফিসে চাকরি করেন তাঁদের সত্যিকারের অবস্থা কি সে তো
প্রত্যেকেই জানেন। সারা বাংলায় কোথাও একটা বাড়ি নেই। একটাও নেই — যেখানে
দুঃখকষ্ট নেই, একটা সংসারও নেই যেখানে মা-বোনেদের চোখের জল ঝরছে না। এসব কোনো কিছুই
কংগ্রেস মন্ত্রীদের অজানা নয়, তবুও এই সামান্য বেতন বৃদ্ধির সুবিধাও তাদের দেওয়া হচ্ছে
না। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা অনেক কঠিন সংগ্রামে যে সুবিধা জিতে নিয়েছে, বাংলার সরকারি
কর্মচারীদের সেই সুবিধা দিতে অস্বীকার করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে আঘাতের ওপর আর এক দফা
অপমান, বলা হচ্ছে, সরকার মুনাফা সৃষ্টিকারী
কোনো সংস্থা নয়। তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়া হচ্ছে, স্বাধীন অবস্থায় সরকারি
কর্মচারীদের শিখতে হবে কীভাবে তারা জনগণের সেবা করতে পারে। আমার তো মনে হয়, মাস গেলে যাৱা ৩০, ৪০ কি ৬০ টাকা পায় তাদের
সামনে কষ্ট করে দেশসেবার বাণী প্রচার না করে সেটা যদি মহাকরণ থেকে শুরু করা যেতো, একেবারে ওপরতলা থেকে, তাহলেই ভালো হতো। যেসব মন্ত্রীরা তাঁদের
ভাতা ছাড়াও ব্যবসা কিংবা ঠিকাদারি এইসব নানান কিছু করে বেশ মোটা টাকা মাস গেলে
পকেটস্থ করেন,
তাঁদের
প্রথম যে কাজটা করা উচিত, তা হলো সরকারের কাছ থেকে মাসিক ভাতা না নেওয়া। এইভাবে
নীচের মহলে যাবার আগে ওপরতলা থেকেই আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত শুরু করা ভালো।
নলিনী রঞ্জন সরকার: সরকারে যোগ দেবার আগে তাঁরা
এসব ছেড়ে দিয়েছেন।
জ্যোতি বসু: অবশ্যই, মাননীয় অর্থমন্ত্রী
বলছেন, তিনি এসব ছেড়ে দিয়েছেন।
নলিনী রঞ্জন সরকার: প্রত্যেকেই ছেড়ে
দিয়েছেন।
জ্যোতি বসু: প্রত্যেককে আমি চিনি না।
কিন্তু যদি অর্থমন্ত্রী ভাতা না নিয়ে থাকেন কিংবা ডাঃ বি. সি. রায় তাঁদের বিশাল
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম ছেড়ে দেশমাতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে
মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে থাকেন, তবে সেটা তো অত্যন্ত ভালো একটা দৃষ্টান্ত, অবশ্য কথাটা যদি সত্যি
হয় তবেই। আমি জানি, এমনকি
এখনো পর্যন্ত এইসব সম্মানীয় ভদ্রমহোদয়রা ওটা নেবেন না এমন কথা বলেননি — বাংলার
বিরাট বিরাট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁরা যুক্ত — পরিচালক না কিসব ভগবান জানেন কি, কেননা কি তাঁরা তাদের
মুনাফা পেয়ে যান সে রহস্য আমার মগজে ঢোকে না। কখনো কখনো আমি তো কোনো কার্য-বিবরণী
কি বইপত্র এমন অনেক কিছুতে তাঁদের নাম খুঁজে পাই না, যদিও ঐসব সংস্থা থেকে টাকা রোজগারের
নিজস্ব পদ্ধতি সব ব্যবসাদারেরই জানা থাকে। উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয়, আমরা বিলক্ষণ জানি
মন্ত্রীপরিষদের কোন্ কোন্ ভদ্রলোকেরা কোন্ কোন্ প্রদর্শনীর সঙ্গে যুক্ত — এলাহী
সব ব্যাপার-স্যাপার। এইসব সংস্থা থেকে তাঁরা কত মুনাফা পান তাও আমাদের জানা আছে।
কিন্তু আমি সরাসরি ঠিক তাঁদের কথা বলতে চাইছি না। অত্যন্ত লজ্জায় এবং বিস্ময়ে
আমি লক্ষ্য করেছি যে, কংগ্রেস
ক্ষমতায় আসামাত্র অনেক মানুষজন — একেবারে আমজনতা – তারা সব মন্ত্রীদের ধরে জটলা করছে
— যাচ্ছে আসছে — কয়েকটা দালালি কিংবা ঐরকম কিছু পাবার আশায়। নিজের চোখে দেখেছি
এসব। এসব ঘটছে,
আমি জানি। কাজেই
যেসব গরিব কেরানীদের পে-কমিশনের বেতনহার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, তাঁদের সামনে ভাষণ দেবার
আগে আমরা যদি নিজেদের জন্যেই ঐ ভাষণগুলো বরাদ্দ রেখে দিই তাহলেই ভালো হয়।
স্যার, বেকার-সমস্যা
নিয়ে একটা শব্দও এই বাজেটে আমি খুঁজে পাইনি। কদিন আগে অসামরিক সরবরাহ বিভাগে
গিয়েছিলাম। তখন ওখানকার কিছু কেরানি আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বিধানসভায় আমি তাঁদের
প্রশ্নটি উত্থাপন করবো কি না। এখন আর ওঁদের আমাদের জিজ্ঞাসা করার দরকার নেই, কেননা অল্প কয়েকদিনের
মধ্যেই সামরিক হিসাব দপ্তরের শতসহস্র লোক ছাঁটাই হতে চলেছেন। ইংল্যান্ড বা
অন্যান্য দেশের মতো বেকার-ভাতা দেবার কোনো পরিকল্পনা আমাদের সরকারের নেই। তাঁদের
যে অন্য কোনো কাজে নেওয়া হবে কিংবা দেশে এখন যেসব নতুন শিল্প স্থাপন করা হবে
সেখানে তাঁরা কাজ পাবেন, এমন কোনো পরিকল্পনা নেই। আমি জানি তাঁদের এই কথাই বলা হবে, ‘মাতৃভূমির স্বার্থে, দেশসেবার কারণে তোমরা
মুখে কুলুপ এঁটে থাকো, এমনকি
ছাঁটাই হয়ে গেলেও’। তাঁদের বলা হবে, অন্তত তিন বছর যেন তাঁরা কোনো ধর্মঘট না করেন। তাঁরা যদি
ধর্মঘট করেন তবে তাঁরা স্বাধীন ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত করছেন বলে মনে করা
হবে। “কিন্তু তোমরা যদি বেকার
হও, তবে স্ত্রী-বাচ্চা-পরিজন
নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াও কিংবা যা মন চায় তাই করো কিন্তু সরকার তোমাদের কোনো
দেখভাল করবে না।” এই
ধরনের সভ্য সরকার রয়েছে এ-দেশে। স্যর, সুরাবর্দি সরকারের আমলের মতো খাদ্যসামগ্রী, চাল, আরো অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয়
সামগ্রী সাধারণ মানুষকে অল্প দামে বা বিনামূল্যে সরবরাহ করার জন্য সেগুলো গুদামজাত
করার কোনো ব্যবস্থা আমি দেখছি না। অথচ এসব না হলে গ্রামে শহরে শতসহস্র পরিবারের
জীবনে অনাহার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠবে। সাধারণভাবে বলতে গেলে আমি ঠিক বুঝতে
পারি না — আমি বাজেট ভাষণ আর রেডবুক পড়বার চেষ্টা করেছি। আমাদের সামনে যে বাজেট
রাখা আছে তার অর্থবরাদ্দের মধ্য থেকে কোনো চিত্র, কোনো সুসমন্বিত পরিকল্পনার চিত্র
আমি পাচ্ছি না। আমি দেখছি, বাজেটের খুঁটিনাটি নিয়ে হিসেবনিকেশ করা হয়নি। মাননীয়
অর্থমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ওপর এই দায়িত্ব দেওয়া আছে।
সুতরাং আমরা অপেক্ষা করবো এবং নজর রাখবো। বাজেটে যে সমস্ত পরিকল্পনা করা
হয়েছে, এমনকি যেসমস্ত অনুদান
দেবার কথা বলা হয়েছে নানান খাতে — কৃষি, শিক্ষা, সেচ, আবাসন এইরকম আরো কতকিছু দেখা যাক কি হয়, বরাদ্দ টাকাটাও খরচ হয়
কিনা। কীভাবে তাঁরা খরচ করবেন সেটা আমরা খেয়াল রাখবো, টাকাটা গরীব মানুষের উপকারে লাগে
নাকি দালালদের স্বার্থে খরচ হয়।
মি. ডেপুটি
স্পিকার, আর
বেশি সময় আমি নেবো না। কিন্তু একথা বলবো যে, মানুষের মনে একটা মোহ সঞ্চার করা হচ্ছে যে, আমরা সত্যিই স্বাধীন, ব্রিটিশের শেষ প্রতিনিধি
পর্যন্ত এদেশের তটভূমি ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। স্বভাবতই বিশাল প্রত্যাশা মানুষের
১৫ই আগস্টের পর থেকে শান্তি আর সমৃদ্ধিতে ভরা এক দেশের স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা, এ দেশে এক নতুন সভ্যতার
ভিত প্রতিষ্ঠিত হবার আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁরা কিন্তু সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস তাঁরা কেবলি
হতাশ হচ্ছেন। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী কাগজের উপর সরকারের প্রভাব আছে আমরা জানি। কাজেই
তাদের মধ্যে অনেকেই জয়ঢাক বাজিয়ে চলেছে, এটা একটা জনমুখী বাজেট। কিন্তু
কেমন করে সেটা হলো তা আমাদের কেউ বলছে না। রেডিওতে এসব বলা হচ্ছে, কাগজে, বিধানসভা জনমুখী বাজেট — এই বাজেটে জনজীবনের
ভিত্তি এমনভাবে স্থাপিত হবে যাতে মানুষে মানুষে বিভেদের আর কোনো চিহ্ন আমাদের চোখে
পড়বে না! কিন্তু কেমন করে সেটা হবে তার কোনো খুঁটিনাটি আমরা জানিই না। পক্ষান্তরে, আমি বাজেটে যতটুকু চোখ
বুলিয়েছি তাতে দেখছি, আমাদের
ব্রিটিশ প্রভুদের ঐতিহ্য জুলজুল করছে। সেই ব্রিটিশ প্রভুদের আমাদের মাননীয়
অর্থমন্ত্রী যেসব বাজেট তৈরি করেছিলেন, আজ কংগ্রেসের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি ঐ একই বাজেট তৈরি
করেছেন। আমি বলবো, এগিয়ে
যাবার রাস্তা,
এটা নয়।
এভাবে হবে না,
ব্রিটিশরা
যেভাবে আমাদের শিখিয়েছে সেসব উপায়ে রাজস্ব সংগ্রহও করা যাবে না, আর ব্রিটিশ ধনতান্ত্রিক
প্রভুদের প্রচলিত পথে মানুষের উপকারেও টাকা খরচ করতে পারবেন না।
আমার মনে আছে, প্রথমদিন মাননীয়
মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বি. সি. রায় আমাদের বলেছিলেন, আমাদের দৃষ্টি শুধু দেশের ভেতরেই
আবদ্ধ থাকলে চলবে না, বাইরেও
তাকাতে হবে — সেই সবে তিনি আমেরিকা আর ইউরোপ থেকে ঘুরে এসেছিলেন। আমি লক্ষ্য করেছি, পূর্ব ইউরোপের যে সমস্ত
দেশে নতুন গণতন্ত্র উত্থিত হচ্ছে সেখানে কিন্তু বিষয়গুলো তারা সম্পূর্ণ অন্যভাবে
দেখছে। সেগুলি জনগণের সাধারণতন্ত্র। আর সেজন্য সবসময় তারা অসুবিধার অজুহাত দেখায়
না। বরং তারা জমিদার আর জোতদারদের হাত থেকে জমি কেড়ে নিয়ে কৃষকদের মধ্যে বিলি
করে দিয়েছে। যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, পোলান্ড এই সব দেশে সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে
আলাপ-আলোচনা হয়। এই আলোচনা উদ্দীপনার সঞ্চার করে সর্বত্র। সেকারণেই সেখানকার
তরুণরা বিনা পারিশ্রমিকে রেললাইন পেতে দেয়। রেললাইন যে তাদের, এটা অন্তরে অনুভব করে
বলেই তারা মজুরি নেয় না। দেশের জন্যই তারা কাজ করে। কলকারখানাগুলো — সমস্ত প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ কারখানা
পুঁজিপতিদের হাত থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেসব দেশে কোনো টাটা নেই, বিড়লা নেই, ইস্পাহানী নেই। চিরতরে
তারা শেষ হয়ে গেছে, আর
তাই সমস্ত কলকারখানা জনগণের সম্পত্তি। শ্রমিকের, কৃষকের সমাজের অন্যান্য সমস্ত
অংশের মানুষের। মানুষ যখন চোখের সামনে এই সমস্ত কিছু ঘটতে দেখছে তখন তার মনের ভেতরে
সে প্রকৃতই অনুভব করছে যে, তার দেশে একটা নতুন সমাজ জেগে উঠছে। সেজন্যই তারা কোনো মজুরি
ছাড়াই দেশের জন্য কাজ করে। প্রয়োজনে দেশের জন্যে তারা প্রাণ বিসর্জন দেয়। কেননা
তারা মনে করে এ তাদের মাতৃভূমি। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের সরকার দেশের থেকে শিক্ষা
নেবার বদলে তাকিয়ে আছে আমেরিকার দিকে, ব্রিটিশের দিকে। সেজন্যই আজ আমাদের এমন করুণ অবস্থা। আমি
মনে করি,
এ এক রাজনৈতিক
বিষয়; এ নিছক বাংলার সরকারের ত্রুটি নয়, এ হলো সামগ্রিকভাবে কংগ্রেস পরিচালিত সরকারগুলির ত্রুটি।
কারণ তারা প্রতিক্রিয়ার পথ নিয়েছে, পুঁজিপতি আর জমিদার শ্রেণীর দাসানুদাস হবার পথ। যেন ওদেরই
প্রতিনিধি তারা। এমন তাদের আচার-আচরণ। এ কারণেই বাড়তি মুনাফা করের ব্যাপারটা
বাতিল করেছে,
সেকারণেই তারা
এক নতুন উদ্যোগ নিয়েছে, এক ধরনের ফিনান্স কর্পোরেশনের পথ। ইতালিতে যেমন হয়েছিলো
তেমন কোনো ফ্যাসিস্ট কর্পোরেশনের পথ ধরছেন কিনা ভাবছি। আমি তো ভয় পেয়ে যাচ্ছি, ঐরকম
কিছু একটা হতে চলেছে এখানে।
যাই হোক, মি. ডেপুটি স্পিকার, শেষ করার আগে সমগ্র
মন্ত্রীমণ্ডলীর কাছে আমার সনির্বন্ধ আবেদন — মন্ত্রীমণ্ডলীর মধ্যে আমি পুঁজিপতিদের
প্রতিনিধিদের থেকে ‘খাদি’ ব্যবহারে অভ্যস্ত যাঁরা, অন্তত নিজেরা তাই বলেন, তাঁদের আলাদা করছি না —
এদের মধ্যে পার্থক্য না করার কারণ, আসলে এঁদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, এরা সবাই একই পথের পথিক —
এঁদের সকলের কাছেই আবেদন, সত্যিই যদি মানুষের ভালো করতে চান তাহলে আমাদের সামনে যে
বাজেট পেশ করা হয়েছে সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিন। একে জনমুখী বাজেট আখ্যা দেবার অর্থ
আমাদের সকলকে চূড়ান্ত অপমান করা। এই বাজেটে জনগণের কোনো স্থান নেই কেবল একটা
ছাড়া — টাকাটা তাদেরই দিতে হবে — বাজেটের সঙ্গে তাঁদের এটুকুই সংযোগ। অতএব মুক্ত
বাংলায় এই বাজেট উপস্থাপনার পর প্রথম যারা মন্ত্রী পরিষদকে স্বাগত জানালেন, তারা পুঁজিপতি, বড় বড় শিল্পের মুখপত্র —
তাঁরাই বলছেন,
আমাদের
সামনে যে বাজেট উপস্থাপিত হলো তা এক মহান বাজেট। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র
যাই বলুক — আমার বিশ্বাস তাদের কারো কারো সম্পাদকীয় অন্য কোনো স্থান থেকে
অনুপ্রাণিত —
সে যাই হোক।
মানুষকে ভবিষ্যতে ঠকানো যাবে না, এবং আজকেও তাদের ঠকানো সম্ভব নয়। নিত্যদিনের কষ্ট আর
যন্ত্রণার ভেতর দিয়েই মানুষ বুঝবে, এ বাজেট তাদের নয়। তারা বুঝবে যে, আজকের সরকার পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী
প্রভুদেরই অনুসরণ করছে এবং এভাবেই, মানুষ অবিলম্বে এগিয়ে আসবে, আজকের ভদ্রমহোদয়দের বলবে গদি
ছেড়ে দিতে। যদি ঐ ভদ্রলোকরা জনতার স্বার্থরক্ষা করে কাজ করতে না পারে তবে তাদের
সরে যেতে হবে — অন্যদের সুযোগ দিতে হবে জনতার প্রতিনিধি হিসাবে জনতার বাজেট পেশ
করতে।
[ডা. বিধান চন্দ্র রায় সরকারের প্রথম বাজেটের উপর আলোচনায়
অংশ নিয়ে সি পি আই বিধায়ক জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এই বক্তব্য
রেখেছিলেন ১৯৪৮-র ২০ ফেব্রুয়ারি। তখন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ছিলেন নলিনীরঞ্জন
সরকার। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তখন সি পি আই'র সদস্য ছিলেন দু’জন। অপর জন রতনলাল
ব্রাহ্মণ।]
তথ্যসূত্র: জ্যোতি বসুর
নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ – খন্ড ১, এনবিএ
Comments
Post a Comment