মধুসূদন আমার চোখে
বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত
"বড়ই নিঠুর আমি ভাবি তারে মনে,
লো ভাষা,পীড়িতে তমা গড়িল যে আগে
মিত্রাক্ষর-রূপ বেড়ি! কত ব্যথা লাগে
পর যবে এ নিগড় কোমল চরণে॥
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে!
ছিল না কি ভাব-ধন,
কহ,
লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার,
যে মিথ্যা সোহাগে
ভুলাতে তোমারে দিল এ তুচ্ছ ভূষণে?"
মধু কবির জন্ম ১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারীর মাঘের শীতের দিনে। সুবে বাংলার যশোহর জেলার সাগরদাড়ি গ্রামে। দুই কম দুশ' বছর
আগের কথা। ধন জন মান আর বিদ্যার প্রাচুর্যের পরিবেশে লালিত। কিন্তু আবদ্ধ থাকেননি
কোনোওটাতেই। ব্যক্তিজীবনে ব্যতিক্রমী ছিল তাঁর উচ্চাভিলাষ। যে অভিলাষ কবি হবার
অভিলাষ। সে অভিলাষ প্রিয় কবি মিল্টন বায়রণের দেশে যাবার অভিলাষ। আকাঙ্ক্ষা তাঁর
কবিতা আর কাব্য রচনা করে বিখ্যাত হবেন।
এর জন্য পৈত্রিক গৃহ ত্যাগ করেছেন। জন্মসূত্রে পাওয়া নিজের ধর্ম ত্যাগ করেছেন। বিদেশিনী নারীর
পাণি গ্রহণ করেছেন। অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যারিস্টার হয়েছেন। মহাকবিদের স্বপ্নের
দেশে গিয়েছেন। অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেছেন। অর্থকষ্টে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। অনাহারে
দিন কাটিয়েছেন। আবার দরাজ হাতে দান করতে পারতেন এ-ও দুর্লভ। ছা-পোষা গৃহস্থ
বাঙালির জন্য আদর্শ জীবন মোটেই নয়। ফলে ঘৃণা অবহেলা জুটেছে আমৃত্যু।
অবাক করবার মতো ছিল তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি। এখানেও সাধারণ বাঙালির চেয়ে
ব্যাতিক্রমী। নিজের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থা তাঁকে বিদ্রোহী করে গড়েছে।
তাই পুরাতনকে যোগ্য স্থানে রেখে নতুনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন সকল প্রতিকূলতার
ঊর্ধ্বে। বাজি ধরে রচনা করেছেন অপূর্ব সব কাব্য নাটক আর প্রহসন। তাঁর সকল রচনায়
সর্ব কালের উপেক্ষিতরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন বীরাসনে। নিজের চরিত্র উপযোগী ছন্দ
প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলার কাব্য ছন্দের প্রচলিত পয়ার দ্বিপদী ত্রিপদী
অন্তমিলের ছন্দের বদল ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। বাংলা গীতি কবিতার
একমুখী ভাটিয়ালি ছন্দের বদলে এক ঝোড়ো বাতাসের মতোই জোয়ারের তাকত নিয়ে যার
আবির্ভাব।
কাব্যের ছন্দকে বন্ধন মুক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন ভবিষ্যৎ কালের
জন্য। নূতন এই ছন্দ শুধু কাব্য নয় জীবনেও বাঙালিকে আধুনিক করে তুলবে এই প্রত্যাশা
নিয়ে। যা বাঙালিকে করেছে বিদ্রোহী দৈনন্দিন জীবনের আচরণে। সমাজে রাষ্ট্রে এবং তার
কাব্য সাহিত্যের জগতে। পুরাতন ছন্দ টিকে আছে আজ শুধুমাত্র বারের পাঁচালি আর পুরাতন
বৃত্তান্তের আসরে।
বাংলার কবিরা এখন গদ্যে কবিতা রচনা করেন। অথচ মধুসূদন যথেষ্ট আলোচিত নন। যদিও তাঁর রচনা করা পথেই আজকের আমাদের চলা। বাঙালি কি অকৃতজ্ঞ। না কি আত্মবিস্মৃত জাতি।
Comments
Post a Comment