হোলিকাদহন আর দোল

বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত


ফাল্গুন চৈত্র ভারতে বসন্তকাল। যার আগে গেল শীত আর পরে আসবে গ্রীষ্ম। বসন্ত সুখের কাল, প্রকৃতিতে। আর সেই সুখের প্রকাশ ঘটে উৎসবে, মানুষের সমাজে। সারা ভারতের মানুষ এই সময় মাতে উৎসবে। 

নয় কি দশ বছর বয়সে যারা ইস্কুলে পড়েছেন তাঁরা জানেন, প্রকৃতি পাঠের ভূগোলের অংশে একটা ছবি থাকত। আজও আছে সেই ছবি। বিষয় তার সূর্যকে ঘিরে একটা বাঁকা পথ। দেখতে অনেকটা উপরে নিচে চাপা বালার মতো। যার ডান আর বামপাশ অনেকটা দূরে সরে গেছে। জ্যামিতির পরিভাষায় বলে উপবৃত্ত। এই পথে আঁকা আছে পৃথিবীর চারটি ছবি। পথের মাঝ বরাবর উপরে নিচে দুটি আর ডান আর বাম দিকের দূরতম অঞ্চলে দুটি। এই ছবি আঁকা হয়েছে আজ থেকে না হোক ছয়শ বছর আগে। ছবির সূর্য আর পৃথিবী বাস্তবে দেখা যায়। পথটা ভাবনা দিয়ে দেখতে হয়। কারণ মহাশূণ্যে পিচ বা কংক্রিটের রাস্তা বানাবার সুযোগ নেই। দু’জনে দূরে দাঁড়িয়ে বল লোফালুফির সময় হাতের বাইরে গিয়ে বল যে শূন্যপথে অন্য হাতে পৌঁছয় এ পথও ঠিক তেমনই। 

ছবিতে আরও দেখা যায়, পৃথিবীকে কেমন যেন কাত করে আঁকা হয়েছে। অর্থাৎ এক দিকে হেলে আছে। আর এভাবেই সে ঘুরে চলেছে। অনেকটা যেন কাঁধ উঁচু করে মোবাইল ফোন কানে চেপে ধরে আমরা যেমন হেঁটে চলি। 

এই কথা আজ সকলে মেনে নিয়েছেন, প্রাণের উৎস সূর্য। আরও নির্দিষ্ট করে বললে সূর্য থেকে যে তাপের নিঃসরণ ঘটে প্রাণের আদিতে রয়েছে সেই তাপ। তারই কমবেশির হেরফেরে ঘটে ঋতুর বদল। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত। 

তাপের এই কমবেশি কিন্তু সূর্য থেকে কোনো রিমোট প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণ হয় না। সেটা ঘটে পৃথিবীর নিজের চলবার পথে সূর্যের থেকে নিকটে দূরে অবস্থানের কারণে। যা নিয়ন্ত্রিত হয় তার গমনপথের বৈশিষ্ট্য থেকে। চলা অব্যাহত রাখতে হলে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যের কাছে দূরে ফিরে ফিরে আসতেই হয়। তার চলবার পথটাই এমন। যেমনটি আমরা শৈশব থেকে ছবিতে দেখে আসছি। শীতে গরমে প্রাণীরা যেমন আগুন আর ছায়া বেছে নেয়। তফাৎ শুধু পৃথিবীর বেলাতে সেটা তার ইচ্ছাধীন নয়। 

প্রকৃতির এই ঋতু ব্যবস্থা উদ্ভিদ আর প্রাণীসমাজকে প্রভাবিত করে। এবং তা চোখে দেখা যায়। প্রাণীদের জীবনচর্যা প্রকৃতিকে মানিয়ে নিয়ে গড়ে ওঠে। শীতে প্রকৃতি পুরাতন জীর্ণ বিষয়গুলি ঝেড়ে মুছে নতুনের জন্য পরিবেশ তয়ের করে। শীতে অনেক প্রাণী গুহা গহ্বরে আশ্রয় নেয়। মানুষ শাল আলোয়ান কাঁথা কম্বলের স্তুপে নিজেকে গোপন করে রাখে। লক্ষ্য করে কবে শীতের মেয়াদ ফুরাবে।    

গাছেরা প্রথম জানান দেয় শীত বিদায়ের। যেমন পাখিরা দেয় প্রভাত হবার সংবাদ। গাছে গাছে নতুন পাতা দেখা দেয়। চারিদিকে নানা রঙের ফুলের বাহার প্রাণীকুলের মন ভুলিয়ে দেয়। স্বাভাবিক এই আনন্দকে উপভোগ করবার উদ্দেশ্যে মানুষের সমাজের কিছু নিয়ম রীতি আর অনুষ্ঠানের আয়োজন। বসন্তের এই আয়োজন বাসন্তী উৎসব। 

মধ্যযুগের ভারতে ভক্তি আন্দোলন, বৈদিক ধর্মাচরণ আর সামাজিক প্রথার বিপরীতে এক যুগান্তকারি ঘটনা। বৈদিক আর্যধর্ম যেমন উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রসারিত হয়েছে ঠিক তার উল্টো ঘটেছে ভক্তি আন্দোলনের বিষয়ে। এই আন্দোলনের উৎপত্তি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু আর কেরল অঞ্চল। সেখান থেকে এই আন্দোলন উত্তরমুখী প্রসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব দিকে উড়িষ্যা বাংলা আসামে মণিপুরে। আবার পশ্চিমে তার প্রসার ঘটে রাজপুতানা আর পশ্চিম সমুদ্র উপকুলের রাজ্যগুলিতে।    

ভক্তিধর্মে হিংসার স্থান নাই। যাগ যজ্ঞ হোম পশুবলি ইত্যাদি বৈদিক ক্রিয়াকর্মের ব্যবস্থা নাই। সবচেয়ে উল্লেখ করবার মতো হল এই ধর্মে জাতপাতের বিচার নাই। ঈশ্বরে ভক্তিই একমাত্র বিবেচ্য। একই সময়ে ধর্মভাবনার  আরও একটি ধারা সমান্তরালে বিকশিত হয়ে বিস্তার লাভ করেছে। সে ধারা ইসলামের সুফিবাদ। 

এঁরা মনে করেন, মানুষের দেহের বাইরে ঈশ্বরের অনুসন্ধান করে কোনো লাভ নেই। তার জন্য ঘর সংসার ত্যাগ করে সন্যাসী হবারও কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ঈশ্বর মানুষের দেহ আশ্রয় করেই অবস্থান করছেন। সেখানেই তার সন্ধান মিলবে। পদ্ধতি, নিত্যদিনের কাজের মাঝে তাকে স্মরণ করলেই হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। আজকের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে সে হতে পারে মধ্যযুগের সাম্যবাদ। ব্যাপ্তি আর শক্তিতে যা ছিল বৈদিক আচারের প্রতিস্পর্ধী প্রতিদ্বন্দ্বী। 

উচ্চবর্ণের ক্ষীণতণু ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিপর্যয়ে টিকে থাকবার কৌশল বদল করল। নিজের ধর্মাচরণের কঠোরতা অনেক শিথিল হল। শংকরের মায়াবাদের তত্ত্বে ভর করে অচ্ছ্যুৎ ইতরজনের সমাজের সঙ্গে নিজের দূরত্ব কমিয়ে নিল। বেদান্তের নতুন ব্যাখ্যা তার হাতিয়ার। শূদ্রের বেদ পাঠের অধিকার গ্রাহ্য হল। আর এরই মাঝে নিজের ঐতিহ্য অহংকারের স্মৃতি হয়ে থাকা  কিছু ঘটনা উৎসবের ডামাডোলে গুঁজে দেওয়া হল। সে সব ঘটনা নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে উৎসবকে সমৃদ্ধ অথবা কলঙ্কিত করল।এমনই এক ঘটনা আজকের হোলিকাদহন উৎসব।  

প্রকৃতির বসন্তের সাথে মিল রেখে আনন্দে মাতাল হল ভক্তিবাদীরা ফাগুয়া আবির আর পিচকারিতে রং নিয়ে। উৎসবে যুক্ত হল রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি। প্রেমের এই যুগল মূর্তি ঘিরে ভক্তরা মাতাল হল রঙে রসে নাচে গানে দোল আর দোলা নিয়ে। ব্রাহ্মণের বেদে এই অনুষ্ঠানের নির্দেশ নাই। কিন্তু বৈদিকদের প্রবেশ ঘটল। আর যুক্ত হল হোলিকা দহন অনুষ্ঠান।

কী এই হোলিকাদহন। সে এক পুরাতন কাহিনি।  হিরণ্য কশিপু, প্রাচীন কালের এক রাজা। এখন যে অঞ্চলে পাকিস্তানের মুলতান সেখানে ছিল তার রাজ্য। চিহ্ন তার ধরা আছে এক সূর্যমন্দিরের অবস্থানকে ঘিরে। হোলিকা রাজা হিরণ্যকশিপুর বোন। তার একখানা মন্ত্রপুত চাদর ছিল। সে চাদর অগ্নিরোধক। যার গায়ে জড়ানো থাকবে আগুন তাকে পোড়াতে পারবে না। এরা ছিলেন অসুর। দেবতা বিরোধী। দেবরাজ বিষ্ণুর সঙ্গে হিরণ্যকশিপুর দ্বন্দ্ব। 

হিরণ্য কশিপুর ছেলে প্রহ্লাদ। শিশু বয়স থেকেই সে বিষ্ণুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ভক্ত। সেই অপরাধে রাজা হিরণ্যকশিপু নিজের ছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। অনেক রকমের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষে ছেলেকে পুড়িয়ে মারবার প্ল্যান করেন। এ বিষয়ে তাকে সাহায্য করবে বোন হোলিকা। এমনই ছক করা হয়। সহজে দাহ্য বস্তু দিয়ে এক কুটির তয়ের করা হবে। প্রহ্লাদকে নিয়ে হোলিকা যখন সেই ঘরে থাকবে তখন ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে। হোলিকার গায়ের জাদু চাদর তাকে রক্ষা করবে। অন্য দিকে প্রহ্লাদ আগুনে পুড়ে মারা যাবে। সেই মতো আয়োজন করা হল। আর সুযোগ বুঝে একদিন সেই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু যে কথা ভাবনায় ছিল না। আগুন জ্বলে উঠতেই প্রচন্ড ঝোড়ো বাতাস ধেয়ে এল। হোলিকার গায়ের চাদর উড়িয়ে নিয়ে গেল। আর সে চাদর গিয়ে পড়ল প্রহ্লাদের গায়ে। চাদরে ঢাকা পড়ে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ প্রাণে বেঁচে গেল। আর আগুনে পুড়ে হোলিকার মৃত্যু ঘটল। সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুর মহিমা প্রচার হতে থাকল। কারণ ওই ঝড় না কি বিষ্ণুর নির্দেশেই এমন কাজ করেছে। এই হত্যার ঘটনাকে অশুভ-র বিরুদ্ধে শুভ-র জয়ের প্রতীক বর্ণনা করে পরের যুগে এই বহ্ন্যোৎসবের আয়োজন। 

বসন্তের রঙের উৎসবের আগে শীতে ঝরে পড়া শুকনো মৃত বৃক্ষাবশেষ আগুনে জ্বালিয়ে দেবার রীতির সঙ্গে এই অনুসঙ্গ যুক্ত করে একে মহান আর পবিত্র বলে সমাজ সংস্কৃতিতে ঠাঁই করে দেওয়া হয়েছে।

এখন প্রশ্ন। আদতে ব্যাপারটা তো দেবাসুরের অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। ভারতের আম অধিবাসীর উপর বিজয়ী হলে খুশি হবেন? অথবা, কার পরাজয়ে দুঃখ প্রকাশ করবেন? কোন যুদ্ধ ন্যায় আর কোনটাই বা অন্যায়। পুরাণে লিখিত  সকল যুদ্ধকে ঘিরে এই প্রশ্ন যুগে যুগে সংস্কৃতি আর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছে  আধুনিক সভ্যতার কালেও। প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে আগুনে পুড়িয়ে অস্ত্রের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে হত্যা একান্ত ঘর জ্বালিয়ে গৃহছাড়া করার ঘটনার দৃষ্টান্ত এখনও বহন করে চলেছি আমরা সভ্যতার গর্বে গর্বিত মানুষের আধুনিক সমাজ। আচারে আচরণে কতটা উন্নত হয়েছে মানুষের আধুনিক সভ্যতা তার মূল্যায়ন হবে কবে। আর করবেনই বা কে?

Photo Courtesy: createcustomwishes.com

         


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার