লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প

 বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত

জন্মের পর মানবশিশুর একটা নাম রাখা হয়। সেটা অন্যের থেকে শিশুকে পৃথক করে চিনতে পারার কথা ভেবে। এর পরে সেই নামের গায়ে উপাধি পদবি যুক্ত করে মানবটিকে ক্ষুদ্র করবার আয়োজন চলে। অনেকটা যেমন সোনার অলঙ্কারের গায়ে পুঁতি পাথর বসিয়ে বাহারি করবার চেষ্টা। সোনা যে তাতে কমে যায় সে খেয়াল থাকে না। বিপরীত উদাহরণ যে নেই এমন নয়। তবে সে একান্তই সীমিত। এমনই একজন ব্যতিক্রমী মানুষের কথা আলোচনা প্রসঙ্গে অলঙ্কারের কথা মনে এল। তিনি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। দি লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প। আজ তাঁর জন্মদিন।

জন্মেছিলেন ১৮২০ সালে। প্রয়াণ তাঁর ১৯১০-এ। দীর্ঘ নব্বই বছরের তাঁর জীবনের পরিধি। ইংলন্ডের এক উচ্চবিত্ত শিক্ষিত সংস্কৃতিবান বনেদি পরিবারের সন্তান। জন্ম তাঁর ইতালির বিখ্যাত ফ্লোরেন্স শহরে। জন্মশহরটিকে নিজের নামের সঙ্গে যুক্র করে নিজেকে পরিচিত করেছেন। সেই সঙ্গে বাড়িয়ে নিয়েছেন নিজের পরিধি। যা আরও প্রসারিত হয়েছে পরবর্তী জীবনে। কর্মের সাফল্যের স্বীকৃতি, ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ উপাধি নিয়ে। পরিবারের পদবি-পরিচয় তাঁকে ক্ষুদ্র খণ্ড করতে পারে নি।

পরিসংখ্যানবিৎ সমাজ সংস্কারক নাইটিঙ্গেল ইতিহাস দর্শন আর সাহিত্য নিয়ে তাঁর পড়াশুনা করেছেন। নিজের মাতৃভাষা ইংরাজি ছাড়া ফরাসি জার্মান ইতালীয় গ্রীক লাটিন ভাষায় ছিলেন সচ্ছন্দ।   ধর্মবিশ্বাসে ছিলেন প্রোটেস্টান খ্রীস্টান।

নিজের সামাজিক কাজের জায়গা নির্বাচন করলেন, আর্তের সেবা আর রোগীর শুশ্রূষা। পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর এই সিদ্ধান্ত। কারণ কাজটা খুব একটা মর্যাদার ছিল না সেকালের সমাজে।

তাঁর প্রথম কাজ বিজ্ঞানভিত্তিক নার্সিং ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা। তাঁর এই কাজ দুনিয়ার অনেক অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ল। দেশে দেশে নার্সিং ট্রেনিং স্কুল গড়ে উঠতে থাকল। দ্বিতীয় কাজ হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় যা ছিল একেবারেই নতুন। এবং আধুনিক ব্যবস্থা। নার্সদের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠক্রম আর পাঠ্যবই রচনা তাঁর আরও এক যুগান্তকারী অবদান।

এই কাজ নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত তিনি। এমনই সময় ঘটল এক যুদ্ধের ঘটনা। সন ১৮৫৩। তুরস্কের খলিফা আর রাশিয়ার জারের মধ্যে যুদ্ধ। খলিফার যুদ্ধ, অটোমান সাম্রাজ্য রক্ষা। আর জারের যুদ্ধ অধিকার সম্প্রসারণ। এই যুদ্ধে ফ্রান্স আর ইংলন্ডও জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের স্থান, কৃষ্ণ সাগরের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। এই যুদ্ধে সেবাস্তিপোলের রণস্থল ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের জীবনের এক বিশেষ ঘটনা। এখানেই তিনি তাঁর বাহিনি নিয়ে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা পরিষেবা দেবার জন্য কম্যান্ড হাসপাতালে যান। অনেক কাঠ খড় পোড়ানোর পর এই ব্যবস্থার অনুমোদন। তিনি তাঁর দল নিয়ে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের শুশ্রূষার কাজ করতে থাকেন। শুধু ক্ষত পরিষ্কার আর ব্যান্ডেজ বাঁধা নয়। আহত সৈনিকদের মানসিক চিকিৎসাও ছিল তাঁর শুশ্রূষা কর্মসূচির অঙ্গ। নার্সিংয়ে এটি একটি মানবিক সংযোজন। রাতে আলো নিয়ে রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। বাড়ির পরিজনের সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ করে দিতেন। এখান থেকেই নাম না জানা এই মহিলা পরিচিত হলেন ‘লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ নামে। যে নাম তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল চিরকালের জন্য। আর্ত মানুষকে রক্ষার দায় যে একটা সামাজিক দায় এই বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠা তাঁকে অমর করেছে মানবের ইতিহাসে।

আজ তাঁর জন্মদিন। সাম্প্রতিক পৃথিবীতে মহামারী কোভিড-১৯-র আক্রমণে অসংখ্য সেবিকা নিজেদের জীবন বলি দিয়েছেন। আর্ত মানুষকে সহায়তা দিতে গিয়ে এই একই আদর্শে বিশ্বাস করে। আজ তাঁদের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করবার দিন। আর সেই সঙ্গে কর্মরত সেবিকাদের জন্য শুভকামনা করবার দিন আজকের এই পুন্যদিনে।

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views