গণিকাবৃত্তি সম্পর্কে ভ্রান্তি

অ্যালিন রসি


[সুপ্রিম কোর্ট গণিকাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হল। লেখিকা একজন পর্তুগীজ নারীবাদী। মূল প্রবন্ধ ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে ‘গুইলোটিনা’ পত্রিকায়। প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ: ডিলিজেন্ট পত্রিকা।]   

১: সংশোধনবাদ এবং বিতর্ক ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা

গণিকাবৃত্তি সম্পর্কে ভ্রান্তি ও সংশোধনবাদ

এটা বেশ আশ্চর্যজনক যে সমগ্র শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের বিরুদ্ধে গিয়ে এবং সেই সাথে রোজা লুক্সেমবার্গ, নাদেঝদা ক্রুপস্কায়া এবং এমা গোল্ডম্যানের মতো মহিলাদের বিশ্লেষণ অগ্রাহ্য করে আন্তর্জাতিকভাবে বামপন্থী শিবিরে যৌন দালালীর অবস্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।  

পর্তুগালে গণিকাবৃত্তিকে বৈধ করার জন্য প্রচারের বেশিরভাগই সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং লেফট ব্লকের দ্বারা করা হয়৷ ব্রাজিলে সোশ্যালিজম অ্যান্ড লিবার্টি পার্টি (PSOL)-এর পক্ষে থেকে এই বৈধকরণের বক্তব্য উঠে এসছে একটি আইনী প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে, যার ফলে তৃতীয় পক্ষকে বৈধভাবে একজন বারবনিতার আয়ের ৫০% পর্যন্ত আয় করতে দেওয়া হবে৷ ইউনাইটেড কিংডমে দ্বন্দ্ব লেবার পার্টির সঙ্গে।

বিশ্বের প্রাচীনতম নারী নিপীড়নকে “বিশ্বের প্রাচীনতম পেশা”-তে রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক ডিগবাজীগুলি বেশ বৈচিত্র্যময়: ভাষাগতভাবে বিতর্ক ধামাচাপা দেওয়ার প্রক্রিয়া “গণিকাবৃত্তি”-কে “যৌন কর্ম” এবং “আর্থিকভাবে বলপূর্বক যৌনতা”-কে “যৌন সেবা”-তে রূপান্তরিত করে, এমনকি যৌন সহবাসকে কাজের অধিকার হিসেবে দাবি করার মতো সুদূরপ্রসারী ফন্দি আঁটে।

যাই হোক, যেটার তারা সংস্কার করতে পারে না তা হল নারী বিদ্বেষ নামক এক প্রাচীন সংশোধনবাদকে।

শব্দগত ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা

গণিকাবৃত্তির বর্ণনা বা উল্লেখ করতে ব্যবহৃত শব্দ সচেতনভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সংশোধনবাদের শুরু হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল মহিলাদের “যৌনকর্মী” হিসাবে তুলে ধরার সচেতন প্রয়াস একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। 

“কর্মী” এবং “কাজ” শব্দগুলি ব্যবহার করা উক্ত পরিস্থিতি থেকে নিজেদের হাত ধুয়ে নেওয়ার একটি উৎকৃষ্ট উপায় ছাড়া আর কিছুই নয়, কারণ তখন এটি একটি কাঠামোগত, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা হওয়া বন্ধ করে দেয় এবং একটি ব্যাক্তিগত পেশাগত পছন্দের প্রশ্নে পরিণত হয় – এই ধরণের বক্তব্যের প্রতি আবার যৌন দালালরাও সহমর্মিতা দেখায়! এই দৃশ্যত সহজ শব্দার্থ পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিসংখ্যানগতভাবে একটি কাঠামোগত সমস্যাকে ব্যাক্তিগত প্রশ্নে বিশ্বব্যাপী রূপান্তরিত করা যায়।

গণিকাবৃত্তি মূলত হল নারীর অর্থনৈতিক কাঠামোগত ও সামাজিক নিপীড়নের বিষয়, সমাজের এমন একটি প্রোডাক্ট যা বহু শতাব্দী ধরে উৎপাদনশীল ও প্রজনন ক্ষেত্রে নারীর কাজকে প্রকৃত কাজের স্বীকৃতি দেয়নি বা পারিশ্রমিক দেয়নি (এর মধ্যে রয়েছে জাতগত বিন্যাস, পুরুষদের উপর আর্থিক নির্ভরতা বা গণিকাবৃত্তি ও বিবাহের অন্য দিকটি ব্যবহার করে মহিলাদের উৎপাদনশীল শ্রমে অংশগ্রহণ আইনত নিষিদ্ধ করা এবং মহিলাদের দাস শ্রমিকে পরিণত করা)।

অদূরবর্তী সময়ে যখন বিবাহ বিচ্ছেদ বা উত্তরাধিকার বা কাজ কিছুই মহিলাদের অধিকার হিসেবে স্বীকৃত ছিল না কিন্তু যখন বিবাহ পরবর্তী যৌনতা ছিল স্বামীর অধিকার (এবং ফলস্বরূপ স্ত্রীর কর্তব্য), তখন বিবাহ বিচ্ছেদ বা বিধবাত্ব ছিল পতিতা তৈরির পথ। বর্তমানে এই প্রক্রিয়ার পরিণতিগুলিকে উপেক্ষা করা হল ইতিহাস বিরোধী (যদিও এর সঠিক শব্দ হওয়া উচিৎ ক্রূরতা) – আজও দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো এবং এমনকি ব্রাজিলের কিছু অঞ্চলে পতিতাবৃত্তি বংশানুক্রমিক!

“আমরা এটা বুঝি যে পুরুষরা মজুরি পাওয়ার জন্য এমন কিছু করে যা তারা করতে পছন্দ করে না। পুরুষরা যখন কারখানায় বিচ্ছিন্ন শ্রম করে তখন আমরা বলি না যে অর্থ তাদের অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে রূপান্তরিত করেছে যে তারা এই কাজকে পছন্দ করছে, ভালো সময় কাটাচ্ছে এবং প্রকৃতপক্ষে অন্য কিছুর আকাঙ্ক্ষা তাদের ছিল না। আমরা ওই কাজের একঘেয়েমি ও দিশাহিনতার দিকে তাকাই; আমরা বলি, নিশ্চয়ই একজন মানুষের জীবনের মান এর চেয়ে ভালো হওয়া উচিৎ” - আন্দ্রেয়া ডোয়ার্কিন, “প্রস্টিটিউশান অ্যান্ড মেল সুপ্রিমাসি”

আমরা শ্রমিকের নিজের কাজের থেকে বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি বুঝতে পারি; যদি বিচ্ছিন্ন পণ্যটি আদতে যৌন ভোগবিলাসের জন্য ব্যবহৃত একজন মহিলার ছিদ্রগুলি হয় এবং যদি তার নিজের মনুষ্যত্ব এবং ব্যক্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিটি একজন মহিলা হয় তবে অবশ্যই সর্বোত্তম সমাধান হল ঠিক একই শর্তে সেই সব কিছুর বৈধতা দেওয়া যা অন্য কোনও ব্যক্তির প্রতি অমানবিক হিসাবে স্বীকৃত। 

অধিকন্তু - এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে মহিলাদের ক্ষেত্রে – এটা জিজ্ঞাসা করা দরকার যে অধিকার এবং নাগরিক মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে যৌন সহবাসকে একটি কাজ বা অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ কি? যদি এটি একটি অধিকার হয়, কাউকে অবশ্যই এটি অন্যদের উপভোগ করার জন্য প্রদান করতে হবে। আপনি কিভাবে এই “পরিষেবা” প্রদান করা উচিৎ তা সংজ্ঞায়িত করবেন? এবং এই সত্যটি কিভাবে উপেক্ষা করবেন যে গণিকাবৃত্তির পরিসরে বেশিরভাগ মানুষই নারী যখন যৌন ক্রেতাদের প্রায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হল পুরুষ? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ও পুরুষের সামাজিক নির্মাণ প্রক্রিয়াকে কিভাবে উপেক্ষা করা যায় যখন যৌনতাকে সামাজিক অভিজ্ঞতার সীমানা হিসাবে ব্যবহার করা হয়? অন্যদিকে, যৌনতা যদি কাজ হয়, তাহলে ধর্ষণ কি? …চুরি? দখল করা? 

প্যারাগুয়ের একটি সাম্প্রতিক ঘটনা এই অস্পষ্ট রেখাগুলির বেশ ভালোভাবে উদাহরণ দেয়: একটি ১৫ বছর বয়সী মেয়েকে তার বাবা-মা ভাড়া না দেওয়ার উপায় হিসাবে তাদের বাড়িওয়ালার কাছে যৌন নির্যাতনের জন্য প্রদান করার লোক নিন্দা ছড়ানোর পর উদ্ধার করা হয়েছে। তার সৎ বাবা, যে কিশোরীকে গালিগালাজ করছিল, তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। মায়ের বিরুদ্ধে গণিকাবৃত্তির ব্যবস্থাপনা করার অভিযোগ আনা হচ্ছে। মেয়েটির কাছে এটি পতিতাবৃত্তি ছিল না। এটা ছিল ধর্ষণ। কিন্তু একটি আর্থিক লেনদেন জড়িত ছিল এবং অবশ্যই সম্মতি ছিল – যারা তার জন্য আইনত দায়ী তাদের কাছ থেকে।

কাজ, পরিষেবা বা অধিকার হিসাবে যৌন সহবাসের আইনি স্বীকৃতি নারীর সমস্ত নাগরিক অধিকারের রূপরেখাকে ঝাপসা করে দেয় এবং ধর্ষণকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আমরা এখনও পর্যন্ত যা জিতেছি তার থেকে নিশ্চিতভাবে এক ধাপ পিছিয়ে দেয়।

২. নৈতিকতার ভ্রান্তি

প্রথমত, এটা বেশ কৌতূহলের বিষয় যে পতিতাবৃত্তি প্রথার বিলোপবাদীরা যখন পরিসংখ্যান ও গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে শিল্প, নিপীড়ন এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত ক্ষতিকর ধারণাগুলির বিরুদ্ধে তর্ক করে, তখন যারা পেশা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে তারা বিলোপবাদীদের, বিশেষ করে নারীবাদীদের, বিরুদ্ধে কথা বলে। এবং তাদের সবচেয়ে সাধারণ যুক্তির মধ্যে থাকে অনৈতিকতার অভিযোগ।

এটি একটি আকর্ষণীয় বিতর্কের পন্থা যেখানে পরিসংখ্যান এবং কাঠামোগত বিশ্লেষণকে নৈতিকতাবাদের অভিযোগ এবং “অ্যান্টি-সেক্স”-এর মতো শব্দের মাধ্যমে খণ্ডন করা হয়। তবে এই পন্থা এতই অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে যে এর ভ্রান্তি তুলে ধরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এটি এমন একটি তর্ক পদ্ধতি যা যুক্তি বা সঙ্গতির বদলে অসারতায় নিহিত। কেউ রক্ষণশীলের সাথে নিজের তুলনা দেখতে চায় না। কেউ নীতিবাদী হতে চায় না। বাম শিবিরে তো কোনোভাবেই নয়।

এদিকে, বিবাহের সমালোচনা করার জন্য নৈতিকতাবাদী বা “প্রেম-বিরোধী” হওয়ার অভিযোগে কেউ ভয় পায় না: আমরা জানি যে সমালোচনাটি সম্পর্কে থাকা লোকদের বিরুদ্ধে করা হয় না, বরং এমন একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা হয় যা প্রজনন শ্রমের বেসরকারিকরণ করে পুঁজিবাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুষ্ট করে। আমরা এটাও অনুমান করি না যে কেউ “অ্যান্টি-ফুড” এবং “অ্যান্টি-ইটিং” কারণ উক্ত ব্যক্তি ফাস্ট ফুড শিল্পের সমালোচনা করেন। কিন্তু যখন আমরা যৌন শিল্পের সমালোচনা করি, সেটা প্রথাগত পতিতাবৃত্তি হোক বা প্রযুক্তিগত পতিতাবৃত্তি (ওরফে: পর্নোগ্রাফি) - এবং এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প যা অ্যামাজন, নেটফ্লিক্স, গুগল এবং মাইক্রোসফ্টকে একত্রিতভাবে ছাড়িয়ে যাচ্ছে - আমাদের বলা হয় “নৈতিকতাবাদী”।

দৃশ্যত, অধ্যয়নের এমন একটি ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে বস্তুবাদী কাঠামোগত বিশ্লেষণ অনুমোদিত নয়; যদিও সেই ক্ষেত্রটি মানব পাচার এবং বিচ্ছিন্ন শ্রমের উপর প্রতিষ্ঠিত লক্ষ কোটি টাকার শিল্পের স্বার্থে কাজ করে।

কোনো বিলোপবাদী বা যৌন শিল্পের সমালোচক নৈতিকতার অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে পারে না। এমনকি আন্দ্রেয়া ডোয়ার্কিনও নন; এই নারীবাদী লেখক তাঁর পর্নোগ্রাফি বিরোধী এবং পতিতাবৃত্তি বিরোধী জঙ্গিপনার জন্য পরিচিত, যিনি বছরের পর বছর “নিজ সম্মতি”-তে একজন পতিতা ছিলেন। যারা পতিতা ছিল, এমনকি স্বীকৃতির আইনের জন্য জঙ্গি ছিল, এবং আজ বিলোপবাদী, তাদের সম্পর্কে কি বলবেন? নিউজিল্যান্ডের সাব্রিনা ভ্যালিসে, দক্ষিণ আফ্রিকার নোমোন্ডে মিহালি, আয়ারল্যান্ডের রেচেল মোরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেদনিটা কার্টারের মতো মহিলারা।

পতিতাবৃত্তি প্রথার বিলুপ্তিবাদীরা “যৌনতা প্রেমময়” বা অন্য কোনো বিভ্রান্তিকর রোমান্টিকরণের আশ্রয় নিয়ে পতিতাবৃত্তিকে “বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা”-র অপরাধে সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকে না। বিলোপবাদীরা যৌনতার শিল্পায়ন এবং মানবদেহের পণ্যায়নের সমালোচনা করে। কারণ পতিতাবৃত্তি ও পর্নোগ্রাফি মহিলাদের মানবাধিকারকে বিকৃত করে। এই মানবাধিকার বিলীন হয়ে যায় এক মুহুর্তে যখন মহিলাদের দেহে যৌন প্রবেশাধিকার আর্থিক ক্ষমতার মাধ্যমে বৈধতা লাভ করে – এটা অধিকার আন্দোলনের জন্য একটি উদ্বেগজনক চিহ্ন হওয়া উচিৎ তাদের কাছে যারা নিজেদের পুঁজিবাদ বিরোধী বলে। আপনি যদি একজন নৈতিকতাবাদী রক্ষণশীল খুঁজে পান যিনি একই যুক্তি ব্যবহার করেন - শুধু একটি - আমি নিজের কাপড় খুলে দেব।

৩. সম্মতি সম্পর্কে ভ্রান্তি

সম্মতির প্রসঙ্গ যুক্তি পরিত্যাগের ক্ষেত্রে আপনার নিজের হাত ধুয়ে নেওয়ার একটি দুর্দান্ত উপায় হতে পারে। এটাকে সহজ ভাষায় বলতে গেলে, দায়িত্ব এড়ানোর এবং অত্যাচারিতকেই দোষারোপ করার একটি বিখ্যাত কৌশল। সম্মতি হল এমন একটি ধারণা যা আপাতদৃষ্টিতে মহিলাদের পক্ষে থাকলেও আদতে মহিলাদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিকর।

প্রথমত কারণ, সম্মতি বিষয়গত এবং আদর্শগত এবং অত্যাচার বাস্তব এবং বস্তুগত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিসরে সম্মতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ যে একজন ব্যক্তি দাস শ্রমের অনুরূপ পরিস্থিতিতে কাজ করার ক্ষেত্রে নিজে সম্মত? এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ যে একজন ব্যক্তি প্রতিদিনের গার্হস্থ্য সহিংসতার শিকার হওয়ার সময় একটি সম্পর্কে থাকতে সম্মত হন কারণ নিজের আশ্রয় সুরক্ষিত করার জন্য তা একমাত্র উপায়?

যখন লোকেরা আমাকে বলে যে তারা পতিতাবৃত্তির সাথে কোনও সমস্যা দেখে না যখন তা “দুটি সম্মতিযুক্ত লোক”-এর মধ্যে ঘটে, তখন আমি নিজের ভিতরে কিছুটা মরে যাই। কারণ, একজন নারী হিসেবে আমি জানি যে যৌনতার ক্ষেত্রে সম্মতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কারণ এটিকে “যৌন কাজ” হিসাবে পুনর্গঠিত করে এবং “সম্মতি” সম্পর্কে কথা বলে আমরা ধরে নিচ্ছি যে সম্মতি বাজারজাত করা যেতে পারে - যা অত্যন্ত অসঙ্গতিপূর্ণ।

সম্মতি মানে ইচ্ছা নয়। সম্মতি চাহিদা নয়। এবং মহিলারা সম্মতি দেন, বিশেষ করে যৌন সহবাসের ক্ষেত্রে, প্রায়শই তাদের নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন কারণগুলির জন্য - কারণ আমরা একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করি যেটি আমাদের বলে যে পুরুষদের খুশি করাই আপনার জীবনে সবচেয়ে ভালো জিনিস, যে বিয়ে করা হল সাফল্যের শিখর, যে একজন মহিলাকে অবশ্যই “রাস্তায় সম্ভ্রম কিন্তু বিছানায় নির্লজ্জ” হতে হবে এবং সর্বদা এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সে নিজের মুখে না বললেও তাকে সবসময় এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এমনকি যদিও তার কথা অন্য অর্থ বহন করে, তখন তার “না” “হ্যাঁ”-ত্র পরিণত হয় এই যুক্তিতে যে তার পোশাক অমনটাই চাইছে এবং যত বেশি হিংসাত্মক সম্ভোগ, তত বেশি আনন্দ সে অনুভব করে।

আইনজ্ঞ ক্যাথরিন ম্যাককিনন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ের অগ্রদূত, সম্মতি এবং পতিতাবৃত্তি নিয়ে বিতর্কের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব৷ এই লেখক এবং আইনবিদ একটি সম্মেলনে বলেছিলেন, পতিতাবৃত্তিতে যৌন সহবাস “শুধুই যৌনতা” নয়। এটি হল “আমি যা চাই তুমি তাই করবে”, “আমি যা বলব তুমি তাই করবে”। এটি ক্রেতার যৌনতা। এটি পারস্পরিক স্বাধীনতা বা আকাঙ্ক্ষার দ্বারা নির্দেশিত নয়, বরং অর্থ দ্বারা চিহ্নিত একটি সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি - যার মধ্যে একজনের অর্থ প্রদানের উপায় রয়েছে এবং অন্যের বেঁচে থাকার জন্য সেই অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতি যা অগত্যা একজন মানুষের শরীরকে পণ্যে পরিণত করার সাথে জড়িত, তার নিজের শরীরের উপর অধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত। 

আমার মনে হয় যে অত্যাচারিতকে দোষারোপ করার অভ্যাস আমাদেরকে পতিতাবৃত্তির সমস্যাকে ভুলভাবে দেখতে এবং সর্বদা নারীদের মধ্যে দোষ বা অপরাধের সন্ধান করতে পরিচালিত করে - যেমন বিচারক নেটো ডি মৌরা একজন মহিলাকে পেরেক দিয়ে পেটানোর জন্য একজন পুরুষের সাজা কমিয়েছিলেন কারণ সেই মহিলা “ব্যভিচারী” ছিল বা এক মহিলা বিচারক যিনি একজন ধর্ষিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি “তার পায়ের ফাঁক বন্ধ” করার চেষ্টা করেছিলেন কিনা।

সেই অর্থে, পতিতা ব্যক্তি অধিকার হারাতে রাজি কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন করা আদতে ধর্ষণ সংস্কৃতির আরেকটি সম্প্রসারণ এবং অত্যাচারিতকে দোষারোপ করারই পথ। সম্মতি আছে না নেই, টাকা দেওয়া হয়েছে না হয়নি; চূড়ান্ত প্রশ্ন হওয়া উচিত: মানবাধিকারকে ধর্ষণ করা কি গ্রহণযোগ্য না নয়?

নিজ ইচ্ছা সম্পর্কে ভ্রান্তি

আবারও, এটা বেশ মজাদার বিষয় যে বিভিন্ন বামপন্থী শিবিরে এই প্রশ্নটির উত্তর উদারনৈতিক পথে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বস্তুবাদী আন্দোলন এবং কাঠামোগত বিশ্লেষণ, দুবার চিন্তা না করে, পতিতাবৃত্তির ক্ষেত্রে “ব্যক্তিগত ইচ্ছা”-র যুক্তিকেই অবলম্বন করে নেয়।

প্রথমত, এই অনুদিত “ব্যক্তি ইচ্ছার পক্ষে অবস্থান”-এর জন্য তর্ক করা এখানে সরাসরি বিতর্ক ধামাচাপা দেওয়ার সাথে সম্পর্কিত যা বিতর্ককে ফ্রেম করে দর্শক/পাঠক/শ্রোতার বোঝাপড়ার পূর্ব-নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। এর কারণ হল চয়েসের পক্ষে কথা বলার অবস্থানের বিরুদ্ধে থাকাদের “অ্যান্টি-চয়েস” হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। জীবনবাদী রক্ষণশীলরা যেমন নারীবাদীদের উপর গর্ভপাতের বিষয়ে যা করে: তারা নিজেদেরকে জীবন-পন্থী বলে এবং ফলস্বরূপ, অন্য পক্ষ হয়ে ওঠে “জীবন-বিরোধী”, “বিরুদ্ধ”, হত্যাকারী, নরহত্যাকারী এবং মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত।

আমরা এটা উপেক্ষা করি না যে কিছু লোক আসলে পতিতাবৃত্তি বেছে নিতে পারে। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নয়। এটি একটি ব্যক্তি সিদ্ধান্ত হতে পারে তা জানার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল সেই সিদ্ধান্তকে কে লালন ও নিয়ন্ত্রণ করছে, তা জানা। কে সিদ্ধান্ত নেয়। কোন পরিস্থিতিতে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়…

এটা বেশ চমকপ্রদ কিভাবে পতিতাবৃত্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহিলারাই বেছে নেন। বিশেষ করে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মহিলারা। “বিলাসী এসকর্ট” মহিলা, যারা কলেজে আছে বা ইতিমধ্যে স্নাতক হয়েছে, যারা স্বাধীনভাবে পতিতাবৃত্তির পথ “বেছে নিয়েছে”, তাদের প্রসঙ্গেই সমগ্র বিতর্কটা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা চলে। একই যুক্তি যারা পুঁজিতন্ত্রে ধনী হয়ে উঠেছে, যে সেই লক্ষ কোটি দরিদ্র ও শোষিতদের মধ্যে একজন যারা কোনোদিন নিরাপদ আবাসন কি জানবেও না, সেও ব্যবহার করে।

“বিলাসী পতিতা”, যে এক রাতে কল সেন্টার বা রেস্তোরাঁর কর্মীর এক মাসের আয়ের সমান রোজগার করে, তার কথা তুলে ধরে একটি সাধারণ যুক্তি ব্যবহার করা হয় যে যৌন কাজ অর্থের দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি সচেতন চয়েস, কিন্তু তা অবিলম্বে এই পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরোধিতাও করে। যে সমাজে মহিলারা সমান শ্রমের জন্য সমান বেতনও পান না, যেখানে তাঁরা এখনও শীর্ষ পদগুলিতে সংখ্যালঘু, যেখানে তাঁরা এখনও গর্ভবতী হওয়ার জন্য বরখাস্ত হন বা তাঁরা মা হওয়ার ফলে চাকুরী প্রদানের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দে পরিণত হন, সেখানে এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ যে কিভাবে একজন মহিলা যুক্তিসঙ্গত পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট অর্থ পেতে পারেন পুরুষদের যৌন সেবা করে।

তদুপরি, বিলাসবহুল পতিতাবৃত্তি এবং “অশ্লীল” পতিতাবৃত্তির মধ্যে মিথ্যা পার্থক্য সম্পর্কে নারীবাদী লেখক আন্দ্রেয়া ডোয়ার্কিনের একটি অপরিহার্য অনুচ্ছেদ মনে রাখা দরকার:

“...পতিতাবৃত্তিতে থাকা একজন মহিলার বা পতিতাবৃত্তিতে একদা থাকা একজন মহিলার দৃষ্টিকোণ থেকে - ঘটনাটি প্লাজা হোটেলে সংঘটিত হয়েছে কিনা বা আরও এলাহি কোথাও হয়েছে কিনা সে বিষয়ে লোকেরা যে পার্থক্য টানে তা আদতে গুরত্বপূর্ণ পার্থক্য নয়৷ এগুলি হল অসংলগ্ন প্রাঙ্গণে অসংলগ্ন উপলব্ধি। আপনি বলবেন, অবশ্যই পরিস্থিতি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। না, তারা কিন্তু অমন বলে না, কারণ আমরা মুখ, যোনি এবং মলদ্বার ব্যবহারের কথা বলছি। পরিস্থিতি পতিতাবৃত্তি কি তা প্রশমিত বা পরিবর্তন করে না” - আন্দ্রেয়া ডোয়ার্কিন, “প্রস্টিটিউশান অ্যান্ড মেল সুপ্রিমাসি”

এটা কিভাবে ধর্ষণের থেকে আলাদা?

সর্বোপরি, এই “বাম” এবং “সম্মতি”সূচক উদারবাদের মধ্যে পার্থক্য কি, যখন আমাদের শোষণকারীদের জন্য উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন করতে হয়, আবাসন এবং খাদ্য পাওয়ার জন্য নিজ “পছন্দ” জমা দিয়ে আসতে হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বৈধ হয়ে ওঠে, লক্ষ কোটির মধ্যে একজন “বৈষম্য সত্ত্বেও” নিজ যোগ্যতায় জেতেন, জীবনকে পণ্যে পরিণত করতে হয়? 

Link to original article: https://guilhotina.info/en/2019/02/09/fallacies-prostitution-revisionism-whitewashing/ 

Picture Courtesy: Forbes India

Comments

Popular posts from this blog

বর্তমান সময়ে বাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা

আম্বেদকরের চোখে - কেন ব্রাহ্মণ্যবাদ শাকাহারী পথ গ্রহণ করল? গো ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণের সাথে অস্পৃশ্যতার কি সম্পর্ক রয়েছে?

Polemics on 'Fractured Freedom': C Sekhar responds to Kobad Ghandy's views