আজকের সংকট ও জ্ঞানবাপী বিতর্ক

নাতাশা খান


দীর্ঘ লকডাউনের প্রভাবে ভারতের অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত তখনই দেশ জুড়ে ফের শুরু হয়েছে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক। ন’য়ের দশকে রাম মন্দির আন্দোলনের সময়ে থেকেই সঙ্ঘ পরিবার এবং হিন্দুত্ববাদীরা হুমকি দিয়েছিল, "অযোধ্যা সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়..."। তাই বাবরি ধ্বংসের পর থেকেই জ্ঞানবাপীতে বসেছে পাহারা। এর প্রায় ২৮ বছর পরে ২০১৯-এ সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যায় রাম জন্মভূমির পক্ষে রায় দেন এবং নরেন্দ্র মোদী কাশী বিশ্বনাথ ধাম করিডরের ভিত্তি স্থাপন করেন। অতঃপর শুরু হয় বারাণসীর ভোল পাল্টানোর কাজ।

কাশী বিশ্বনাথ ধাম করিডরের জন্য প্রয়োজন চার হাজার বর্গফুট জমি। এর মধ্যেই পড়ছে জ্ঞানবাপী মসজিদ। উত্তরপ্রদেশ রাজ্য প্রশাসনের তরফ থেকে এই করিডরের জন্য জ্ঞানবাপী মসজিদের সামনের জমি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ আসে মসজিদ কর্তৃপক্ষের কাছে। গত বছর জ্ঞানবাপী মসজিদ কর্তৃপক্ষের  তরফ থেকে সম্প্রীতির বার্তা দিতে মসজিদের একাংশ জমি ছেড়ে দেওয়া হয়। তার বিনিময়ে অন্যত্র সমমূল্যের একটি জমি দেওয়া হয় মসজিদ কর্তৃপক্ষকে। রাজ্য পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাশীবাসিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতবাসীর বলিদানের কথা খেয়াল করিয়ে তাঁদের 'স্বাধীন ভারতের বিশ্বনাথজির জন্য' জমি দান করার অনুরোধ করে চলেছেন। বুট আর বুলডোজারের হাত থেকে নিস্তার পায়নি কাশীর গঙ্গার ঘাট, শ্মশান, পান-শাড়ি-ফল-লস্যি-রাবড়ি-সংস্কৃত বইয়ের দোকান, দেড়শো বছরের পুরনো কারমাইকেল গ্রন্থাগার, সর্বোপরি কাশীর ঐতিহ্য, সাবেক পাঁচমেশালি সংস্কৃতি। এখনও পর্যন্ত গুঁড়িয়ে গিয়েছে শ’তিনেক বাড়ি যার মধ্যে আছে বিশ্বনাথ মন্দিরের মোহান্তের বাড়িও। কাশীর জনপদ বারুদের স্তূপ হয়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে কাশীতে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মন্দির থাকতেও জ্ঞানবাপী মসজিদের গায়ে শৃঙ্গার গৌরীর মূর্তির পুজো করার মতো ইস্যুর প্রয়োজন হয় বইকি। 

২০২১ সালে এপ্রিল মাসে জ্ঞানবাপী মসজিদ বিতর্ক উস্কে দিল্লির পাঁচ মহিলা জ্ঞানবাপী মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়ে বারাণসীর কোর্টে আবেদন জানান। বারাণসীর সিভিল জাজ রবিকুমার দিবাকর সত্যতা যাচাই করার জন্য জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে সরকারি খরচে সমীক্ষার নির্দেশ দেন। এই রায়ের বিরোধিতা করে মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা আনজুমান ইন্তেজামিয়া মসজিদ ও উত্তরপ্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড। মসজিদের সামনের জমি পেতে এই উত্তরপ্রদেশ সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডের সঙ্গেই চুক্তি করেছিল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ট্রাস্ট। মামলা গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট অবধি। প্রসঙ্গত, সুপ্রিম কোর্টে জ্ঞানবাপী মসজিদ সংক্রান্ত মামলাটি চলছে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি পি এস নরসিংহের বেঞ্চে। সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ বাবরি মসজিদের জমিতে রাম মন্দির এবং বিকল্প পাঁচ একর জমিতে মসজিদ গড়ার রায় দিয়েছিল, বিচারপতি চন্দ্রচূড় ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। আর বিচারপতি নরসিংহ তখন ছিলেন মামলার আবেদনকারী রাজেন্দ্র সিংহের আইনজীবী। 

এদিকে সুপ্রিম কোর্ট উপাসনালয় আইনকে (১৯৯১) স্বীকৃতি দিয়েছেন, যাতে বলা আছে যে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, ভারতের স্বাধীন হওয়ার দিন দেশের সব উপাসনালয়ের চরিত্র যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। কোনো রকম পরিবর্তন করা যাবে না। একমাত্র ব্যতিক্রম বাবরি মসজিদ বা অযোধ্যা। তবু উপাসনালয় আইনকে পাশ কাটিয়ে, শুধু 'কৌতূহল' মেটাবার জন্য বারাণসী আদালত জ্ঞানবাপী মসজিদে পর্যবেক্ষক দল নিযুক্ত করেন। সমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্টে 'শিবলিঙ্গ' উদ্ধারের উল্লেখ করা হলে সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের ভিতরের ওজুখানা ও তহ্‌খানা সিল করার নির্দেশ দেয়। আবার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মসজিদে নমাজ পড়ার 'অনুমতি'ও পান। জ্ঞানবাপীর মামলার পরবর্তীতে সারা দেশ জুড়ে একের পর এক মসজিদসহ তাজমহল, কুতুবমিনারের মত স্থাপত্য দখলের জন্য মামলা দাখিল হয়ে চলেছে। 

কিন্তু বাবরি থেকে জ্ঞানবাপী মসজিদের উপর আক্রোশ 'হিন্দুদের উপর হওয়া ঐতিহাসিক অবিচার'-এর বিচারের জন্য নয়, কিংবা মসজিদের জমি বিতর্কের লড়াই-এর নয় বরং তা শাসকশ্রেণীর বরাবরের সমসাময়িক রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা।

১৯৯০ সালে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ওবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ ঘোষণার পরে সংসদীয় রাজনীতির পরিসর থেকে খোলাখুলি মণ্ডল-বিরোধী অবস্থান নেওয়া সম্ভব ছিল না। ভোটের বালাই বড় বালাই। তাই মণ্ডল কমিশনের প্রভাবকে কাটিয়ে ওঠার জন্য রাম জন্ম ভূমি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসতে হয়েছিল। 

বর্তমানে ভারতে বেকারত্বের হার রেকর্ড স্পর্শ করেছে। এপ্রিল মাসের বেকারত্বের হার ৭.৮ শতাংশ। ভারতে চাকরি করার বয়স আছে এমন ৯০ কোটি মানুষের প্রায় অর্ধেকই চাকরি খোঁজার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছেন। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্কটের প্রভাব পড়ছে ভারতের অর্থনীতিতে। খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.৭৯ শতাংশ যা ৮ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ১৫.০৮ শতাংশ, ভেঙেছে ২৪ বছরের রেকর্ড। টাকার দর পড়ে এখন এক ডলারের দাম বেড়ে ৭৭.৭৯ টাকা হয়েছে।

বরাবরের মত এর থেকে নজর ঘোরাতে জ্ঞানবাপী মসজিদ, মথুরার ইদগাহ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়ে চলেছে। এই অবস্থায়, দেশের সাধারণ মানুষের অসহনীয় দুর্দশাগুলোকে যদি রাজনৈতিক ইস্যু করতে হয় তাহলে সর্বস্তর থেকে জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে নোংরা রাজনীতি তৈরি করার বিরুদ্ধে সজোরে আওয়াজ তুলতে হবে। 'উপরিকাঠামো' যদি শাসকের শোষণ করার প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তাহলে শোষণকে মনে করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ঐ হাতিয়ারের বিরুদ্ধেও সওয়াল করাটা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়। এটা না করলে শোষণ উন্মোচিত হতে পারে না। ধর্মীয় হিংসার জিগির তোলা ছাড়া শাসকের কাছে যখন রাস্তা খোলা নেই তখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা সত্যিই নেতৃত্ব দিতে চান তাঁদের বুঝতে হবে যে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধ সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করেই ব্যাপক জনগণের দুর্দশার বিরুদ্ধে আন্দোলনের বর্শামুখ পরিচালিত করতে হবে।

[নাতাশা খান 'অধিকার' সংগঠনের সদস্য।]

Picture Courtesy: BBC

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!