অর্ধেক আকাশের জন্য সওয়াল: কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

[ভাঙড় আন্দোলনের অগ্রণী নেত্রী কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর প্রথম প্রয়াণ দিবসে (13/06/2022), এই সংকলনের মধ্যে দিয়ে 'The Diligent'-এর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন; বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত]

 


12 January, 2021

"আমরা যারা সচেতন, প্রগতিশীল, বামমনস্ক, ইত্যাদি, ইত্যাদি, সেই আমরাই অশ্লীলভাবে, নির্লজ্জভাবে, সংগ্রাম-আন্দোলন-দ্রোহ-বিপ্লবের ইতিহাস থেকে নারীর অদৃশ্যায়ন ঘটিয়েছি। আমাদের প্রেরণা, আমাদের আইকন, কখনওই ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনের পাশাপাশি বীণা দাস, সুনীতি চৌধুরী, শান্তি ঘোষ, প্রীতিলতা, দুর্গা ভোহরা, উদা দেবী, গুলাব কৌর-রা হয়ে ওঠেননি। সমাজদ্রোহে এঁদের অবিস্মরণীয় অংশগ্রহণ আমরা অনায়াসে বিস্মৃত হয়েছি। তথাপি আমাদের 'প্রগতিশীল'-তা কেউ প্রশ্ন করেনি। "বিবেকানন্দ নয়, আমাদের আইকন ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিং" -- বলে আমরা বিপ্লবী হয়েছি। পঞ্চদশী শান্তি ঘোষের যে পিস্তলের গুলি ধরাশায়ী করেছিল কুমিল্লার ইংরেজ জেলাশাসক চার্লস স্টিভেন্সকে, সেই গুলির আওয়াজ আমাদের পুরুষালী বিপ্লব-চেতনাকে ছিন্ন করতে পারেনি। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির আদেশের প্রত্যুত্তরে বদলার অ্যাকশনে দুর্গা ভোহরার আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন আমাদের পুরুষালী আকাশে ঝড় জাগাতে পারেনি।

আমাদের এই অমূল্যায়িত ব্যর্থতার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতায় আজকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বললেন -- "আমরা [কোর্ট] এই অবস্থানকে তারিফ জানাই যে আগামীদিনে বয়স্ক, নারী ও শিশুরা প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করবেন না।" বললেন ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের মামলার শুনানিতে। গতকাল বলেছিলেন -- "আমরা বুঝতে পারছি না কেন বয়স্ক ও নারীদের এই আন্দোলনে রাখা হচ্ছে।" বলেছিলেন বয়স্ক ও নারীদের 'ফেরত পাঠানোর' কথা। আজ তাঁকে 'আশ্বস্ত' করা হয়েছে যে নারীদের, বয়স্কদের আন্দোলনে 'রাখা' হবে না। সেই আশ্বাসবাণীকে প্রধান বিচারপতি তারিফ জানিয়েছেন। 

নতুন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক আন্দোলনের একটা বৈশিষ্ট্য হল নারী কৃষকদের ব্যাপক ও সচেতন অংশগ্রহণ। যে-কোনো শাসকশ্রেণীকে চ্যালেঞ্জ জানানো আন্দোলনের মতোই এই আন্দোলনেও নারীদের 'রাখা' হয়নি, নারীরা নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। কৃষিকাজে নারীদের শ্রমকে বহুলাংশে হিসাবের বাইরে রাখা হয়। নতুন কৃষি আইনগুলি যে নারী কৃষকদের অধিকার ও অস্তিত্বকে আরও বহুগুণ বিপণ্ন করে তুলবে, তা বুঝেই তাঁরা আন্দোলনে আছেন, ব্যাপকভাবে আছেন, সচেতনভাবে আছেন।

নারী কৃষকদের আন্দোলনে থাকাটাকেই নস্যাৎ করলেন প্রধান বিচারপতি। বললেন -- তাঁদের নাকি "রাখা" হয়েছে, তাই "ফেরত পাঠাতে" হবে ও ভবিষ্যতে "রাখা" চলবে না!

ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই, ঠিকই, কিন্তু তা-ও বলব, সুপ্রিম কোর্ট যা বলেছে তা এসেছে আমাদের মতো 'প্রগতিশীল, বামমনস্ক'দের দ্রোহের ইতিহাসে নারীদের প্রান্তিকায়িত করার, অদৃশ্যায়িত করার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতায়।" 

1st March, 2021

"একটু লম্বা পোস্ট। অনুরোধ করছি, সময় থাকলে ধৈর্য ধরে পড়বেন। বাম-কংগ্রেস-আব্বাস নিয়ে পোস্ট নয়, বাংলার আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন নিয়েও নয়। একেবারেই ফালতু একটা বিষয় নিয়ে লেখা -- মেয়েদের জীবন। 

কয়েক বছর আগে মহারাষ্ট্রে নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে মহারাষ্ট্র রাজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থার এক কর্মী। সেই মামলা এখন সুপ্রিম কোর্টে। আজকের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বোবডে ধর্ষকের আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করেন -- সে কি ধর্ষিতা মেয়েটিকে বিয়ে করতে প্রস্তুত। তাতে আইনজীবী বলেন -- আমরা কোর্টের নির্দেশ মানব। তাতে প্রধান বিচারপতি বলেন -- মেয়েটিকে ধর্ষণ করার আগে ভাবা উচিত ছিল, হাজার হলেও ধর্ষক সরকারি কর্মচারী! 

এর কিছু পরে ধর্ষকের আইনজীবী জানান -- আমরা যখন মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, সে রাজি হয়নি; এখন তো আমার মক্কেলের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। 

সুপ্রিম কোর্ট এরপর ধর্ষকের গ্রেপ্তারির ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে, গ্রেপ্তারি থেকে চার সপ্তাহের অন্তর্বতী সুরক্ষা মঞ্জুর করে এবং ধর্ষককে সাধারণ জামিনের জন্য আবেদন করার পরামর্শ দেয়।

কয়েক বছর আগে, মেয়েটি যখন নবম শ্রেণী, তখন ধর্ষক, যে তার আত্মীয়ও বটে, ওর মা-বাবার অনুপস্থিতিতে ওদের বাড়ি গিয়ে ওর হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে, ধর্ষণ করে। মেয়েটিকে বলে সে যদি এই ঘটনা প্রকাশ করবে তাহলে ওকে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারবে, পরিবারের লোকজনের ওপর প্রতিশোধ নেবে। এরপর নিয়মিত ধর্ষণ চলতে থাকে -- ১০-১২ বার তো হবেই। 

কিশোরী কন্যা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে আত্মহত্যা করতে যায়। ওর মা দেখে ফেলেন, মেয়েকে আটকান, সব ঘটনা শোনেন এবং সটান থানায় যান ধর্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে। কিন্তু তা কি এতই সহজ? ধর্ষকের মা মঞ্চে অবতীর্ণ হন এবং তাদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, মেয়েটির ১৮ বছর বয়স হলেই তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। 

কালের গতিতে মেয়েটি বাধা-না-মানা ১৮ হয়। ধর্ষকের মা এবার বলেন কোনও বিয়ে-টিয়ে হবে না। এবার মা-মেয়ে থানায় যায়। ধর্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও পকসোর কয়েকটি ধারায় মামলা রুজু হয়।

ধর্ষণ, পকসো ইত্যাদি ধারা থাকা সত্ত্বেও, গতবছরের গোড়ার দিকে ধর্ষক অ্যান্টিসিপেটরি বেল পায়। বম্বে হাইকোর্ট অবশ্য সেই বেল অর্ডার খারিজ করে দেয় এবং সেশনস্ কোর্টের রায়কে "বিকৃত, বিধিবহির্ভূত ও খামখেয়ালী" বলে তিরস্কার করে। 

বম্বে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ধর্ষক সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়, এবং তারপর কী কী ঘটে তা আগেই বলেছি। 

১) ধর্ষক যে মেয়েটির সঙ্গে বলপূর্বক শরীরী সম্পর্ক করেছিল, তা নিয়ে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট কোনও সংশয় প্রকাশ করেনি। অভিযুক্ত বলার চেষ্টা করেছে যে তাতে মেয়েটিরও মত ছিল, কিন্তু কোর্ট স্পষ্ট বলেছে এক্ষেত্রে নাবালিকার ক্ষেত্রে সম্মতি/অসম্মতির প্রশ্ন আসে না, বিশেষ করে সে নিজে যখন ধর্ষণের অভিযোগ আনছে। 

২) ধর্ষণের কোর্ট-অনুমোদিত দাওয়াই কী? বিয়ে! ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষিতার!

৩) ধর্ষক যেহেতু সরকারি চাকুরে, সে গ্রেপ্তার হলেই চাকরি থেকে সাসপেন্ড হবে, বরখাস্তও হতে পারে। তাই সুপ্রিম কোর্টের কাজ হল তার গ্রেপ্তারি আটকানোর জন্য ফন্দি-ফিকির খুঁজে বের করা, তাকে আইনি লড়াই লড়ার জন্য প্রস্তুতির সময় দেওয়া, ইত্যাদি। 

৪) ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় এটাই মেয়েদের জীবন। মথুরা থেকে ভাঁওরি দেবী থেকে মহারাষ্ট্রের এই মেয়েটি -- ধর্ষিত হয়ে ছেলেদের কী বিড়ম্বনাতেই না ফেলেছে। সেই অনভিপ্রেত বিড়ম্বনা থেকে ধর্ষকদের বাঁচাতে বিচারব্যবস্থা আছে, একটা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা আছে। আর 'আমরা' আছি, যারা প্রগতিশীলতার নামে, বামপন্থার নামে, এমনকি বিপ্লবের নামেও এই রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে 'ফ্যাসিবাদী দখলদারি'র হাত থেকে রক্ষা করাটাকেই পবিত্রতম কর্তব্য ভেবে ছুটে বেড়াচ্ছি।" 

27 February, 2021

"সমাজে নারীদের ভূমিকাকে 'Kinder, Küche, Kirche' (জার্মান ভাষায় 'কিন্ডার' মানে বাচ্চা, 'কুহা' মানে রান্নাঘর ও 'কির্শে' মানে গির্জা)-তে সীমিত করেছিল, খর্বিত করেছিল জার্মান সাম্রাজ্য এবং পরবর্তীতে কুখ্যাত থার্ড রাইখ। এই ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াইয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দেন আড়াই কোটিরও বেশি সোভিয়েত মানুষ, পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য কমিউনিস্ট। বাবুল সুপ্রিয়রা 'পরায়া ধন'-টন বলছে, বলুক। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে লড়াইটা যে 'Kinder, Küche, Kirche'-র মতাদর্শকে আগলে রেখে, সামান্য পরিমার্জন ক'রে 'যুগোপযোগী' ক'রে হবে না, কমরেড।" 

4 December, 2017

"So our government proves yet again that it is on the side of sexual assault and rape. With the police beating up the parents and well wishers of the students of MP Birla School, who had gathered there to seek justice for an abused child, it is painfully clear that the government upholds sexual violence, child sexual abuse and all that is most hateful and rotten in society. Shall the police be booked under POCSO for attempting to shield the offenders, in this case the school authorities who had bent themselves backwards to deny justice to the child survivor of sexual abuse? A laughable proposition indeed." 

25 November, 2020

"পৌরুষের আস্ফালন আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা একসাথে যায়? প্রকট, নির্লজ্জ মর্দানি আর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা একসাথে যায়? মাচিস্মো (machismo) আর সাম্যের স্বপ্ন একসাথে যায়? 

পরিচিতদের ভাবাবেগ সবকিছু গুলিয়ে দিচ্ছে।" 

7 November, 2020

"নভেম্বর বিপ্লব নিয়ে আজকাল মেলা আলোচনা হয়। তবে বিপ্লবের আলোচনায় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ঠিক কতটা গুরুত্ব দিয়ে নারীপ্রশ্নটাকে ধরেছিল, তা নিয়ে চর্চা দেখিনি বললেই চলে। নারীপ্রশ্ন নিয়ে আলোচনায় অবশ্য অবশ্যম্ভাবীভাবে নভেম্বর বিপ্লব আসে, কিন্তু ভাইসি ভার্সা হয় না। 

অথচ নভেম্বর বিপ্লব দেখিয়েছিল, বিপ্লবের সাথে সাথে নারীপ্রশ্নের সমাধান হয়ে যায় না। সে এক দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার, যার জন্য লাগে স্বতন্ত্র, সচেতন উদ্যোগ। বিপ্লববিজয়ী বলশেভিক পার্টি সেই উদ্যোগ হাতে নিয়েছিল। সেখানে কী কী দৃষ্টিভঙ্গীগত বা তত্ত্বগত সমস্যা ছিল, কী কী ব্যর্থতা ছিল, তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা আর যুগের সীমাবদ্ধতা কোন্ অনুপাতে ছিল -- এসব বিষয়ে চর্চা, গবেষণা হলে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত হবে পরবর্তীতে রাশিয়া তথা সারা বিশ্বে সমাজতন্ত্রের দুর্বিপাকের, পিছু হঠার, নারীপ্রশ্ন-সম্পর্কিত কারণ। যা থেকে শিক্ষা নেবে বর্তমান, শিক্ষা নেবে ক্ষীণস্রোতে হলেও ভীষণভাবে চলমান বিপ্লবী আন্দোলন। 

সমস্যা হল, রুশ বিপ্লবের আলোচনায় এই কথাগুলো কখনওই উঠে আসে না, বা বিপ্লবী শিবিরে এর মূল্যায়নের কাজও হাতে নেওয়া হয় না (সে কাজটা করে থাকেন বুর্জোয়া অ্যাকাডেমিকরা, আর কমিউনিস্টরা তাদের কথাগুলোই উদ্ধৃত ক'রে থাকে)। তাই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি তথা শিশু প্রোলেতারিয়ান রাষ্ট্র নারীমুক্তির লক্ষ্যে যে অভূতপূর্ব ও যুগান্তকারী পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিল, তার কথা চাপাই পড়ে থেকেছে। 

আমরা সবাই জানি ১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে রাশিয়ায় বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণী ক্ষমতা দখল করার পর পরই, নারী মুক্তির লক্ষ্যে সর্বজনীন ভোটাধিকার সহ একগুচ্ছ আইন পাশ করা হয়। তার ফলে, তৎকালীন বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের নারীরা অন্যান্য প্রায় সকল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশের নারীদের তুলনায় আইনি অধিকারেই শুধু এগিয়ে থাকেন না, সেই অধিকার বাস্তবে উপভোগ করার বস্তুগত ভিত্তিও পান।

লেনিনের কাছে, রুশ পার্টির কাছে, বিপ্লবী আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ, সামন্ততান্ত্রিক শেকল ভেঙে সামাজিক জীবনে প্রবেশ করা -- এগুলো ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিপ্লব সফল করার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই এক বছর পরেই, ১৯১৮ সালে -- তখন সদ্যোজাত শ্রমিক রাষ্ট্র গৃহযুদ্ধে দীর্ণ, আত্মরক্ষার প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে -- গৃহযুদ্ধের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হল সারা-রাশিয়া নারী শ্রমিক ও কৃষকদের প্রথম কংগ্রেস। ১০০০-এর বেশি প্রতিনিধি সেই সম্মেলনে অংশ নিলেন। পার্টি সেই কংগ্রেসকে দায়িত্ব দিল সাধারণ রাজনৈতিক কাজের জন্য এবং গৃহযুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য নারীদের সংগঠিত করতে। কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিল যে ততদিন অবধি যে 'কমিশন'গুলি মেয়েদের মধ্যে কাজটা করছিল সেগুলোকে পার্টির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ১৯১৯ সালে তৈরি হল 'জেনোৎদেল',  পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর নারী-বিষয়ক বিভাগ। এই জেনোৎদেলকে বলা যায় সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে নারীমুক্তির বিষয়টিকে অপ্রান্তিক জায়গায় রাখার প্রচেষ্টার মূর্ত রূপ।

প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের মুখে, রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মাঝে, এ প্রচেষ্টাগুলো কিন্তু আটকে থাকেনি। রুশ পার্টি বলেনি, আগে সাম্রাজ্যবাদীদের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হই, গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করি, তারপর নারীর অধিকার নিয়ে ভাবা যাবে। বস্তুত, পার্টি এই চেতনা থেকে এগিয়েছে যে, নারীদের মধ্যে কাজকে অসীম গুরুত্ব না দিলে, বিপ্লবকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। 

প্রথমে ইনেসা আর্মান্ড, তারপর অ্যালেক্সান্দ্রা কোলোন্তাই ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে জেনোৎদেল ছিল পার্টির ভেতর নারীদের নেতৃত্বে চলা সেই অনন্যসাধারণ মঞ্চ যেটি বিপ্লবকে ব্যাপক নারীজনতার কাছে নিয়ে যাওয়ার ও, তার মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনকে নারী-চেতনায় সম্পৃক্ত করার কাজটি করত। জেনোৎদেল পার্টির শিক্ষা ও কর্মসূচীকে মেয়েদের কাছে নিয়ে যাওয়ার এবং সারা দেশের মেয়েদের নানাবিধ বাস্তব সমস্যাকে পার্টির কাছে পৌঁছে সমাধান দাবি করার কাজটি করত। জেনোৎদেল তার কাজের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক ও কৃষক নারীকে সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল। সোভিয়েত জুড়ে নারীদের জীবনকে উন্নত করার লক্ষ্যে নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যেমন সংগ্রাম চালিয়েছিল, তেমনই শ্রমিক রাষ্ট্রের নতুন, নারীবান্ধব বিবাহ, শিক্ষা ও শ্রম সংক্রান্ত আইনগুলির সুফল যাতে মেয়েদের কাছে বাস্তবত পৌঁছায়, তার জন্য উদ্যোগী ছিল। বিশেষ করে, প্রত্যন্ত ও পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলিতে মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে জেনোৎদেল অভাবনীয় কাজ করেছিল।জেনোৎদেল-ভবনগুলি হয়ে উঠেছিল গৃহহিংসায় জর্জরিত স্ত্রীদের, বিদ্রোহী মেয়েদের, উদ্ধারীকৃত বালিকা-বধূদের আশ্রয়স্থল। এর ফলে জেনোৎদেল কর্মীদের প্রাচীনপন্থীদের হাতে প্রত্যাঘাতের মোকাবিলা করতে হয়েছে, খুনও হতে হয়েছে।

জেনোৎদেলের নেতৃবৃন্দ ছিল নিষ্ঠাবান কমিউনিস্ট এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হিসেবেই তারা কাজ করত। জেনোৎদেলের কাজের পরিসর ছিল বিশাল। যৌথ রান্নাঘর ও ক্যান্টিন খোলা, বাচ্চাদের জন্য ক্রেশ খোলা থেকে শুরু ক'রে, এমন বিভিন্ন পরিকল্পনার আয়োজন করা যার মধ্যে দিয়ে মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত হতে পারবে ছেলেদের সাথে সমমর্যাদায় ও সম-অধিকারে। মেয়েদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার কথা ভেবে প্রণীত আইনগুলি মানা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য জেনোৎদেলের উদ্যোগে কারখানা ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্র পরিদর্শন হত।

জেনোৎদেলের 'ডেলিগেটকা' বা নারী ডেলিগেট (প্রতিনিধি) সংগঠিত করার একটা ব্যবস্থা ছিল। ১৯২০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে এই 'ডেলিগেটকা'দের একটা বিশাল বাহিনী (সংখ্যায় ১০ লক্ষের কাছাকাছি) তৈরি হয়েছিল। এই ডেলিগেটকারা সাধারণ নারীদের সভার মধ্যে থেকে নির্বাচিত হতেন। শ্রমিক নারীদের ক্ষেত্রে প্রতি ৫ জনে একজন অনুপাতে নির্বাচিত হতেন এবং অফিসকর্মী, কৃষক নারী ও গৃহবধুদের ক্ষেত্রে প্রতি ২৫ জনে ১ জন। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তারপর কোনও সরকারি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা স্কুলের সঙ্গে যুক্ত করা হত। তাদের দায়িত্ব ছিল, যে প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হল, তার কাজ পরিদর্শন করা এবং সে-সম্পর্কে মতামত বা সমালোচনার রিপোর্ট তৈরি করে সেটা সেই নারীদের সামনে পেশ করা যারা তাকে নির্বাচিত করেছে। এটাও ছিল একটা ব্যতিক্রমী এক্সপেরিমেন্ট। এর ফলে, মেয়েরা শুধু প্রশাসনিক কাজে দক্ষতাই অর্জন করত না, মেয়েদের চোখ দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন করা হত, মেয়েদের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা তৈরি হত।

বর্তমানে পোল্যন্ডে গর্ভপাতের অধিকারের দাবিতে গণআন্দোলন মনে করায়, আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে জেনোৎদেলের পীড়াপীড়িতেই বলশেভিক সরকার ১৯২০ সালে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ করেছিল। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে উঠেছিল বিশ্বের প্রথম দেশ যেখানে সরকারি হাসপাতালে বিনা খরচে গর্ভপাত করানোর অধিকার মেয়েরা পেয়েছিল। 

১৯২৫ সালে জেনোৎদেলের প্রধান হলেন অ্যালেক্সান্দ্রা আরত্যুখিনা। ১৯২৮ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি 'আত্মসমালোচনা' অভিযানের ডাক দিয়ে পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যদের কাছে আহ্বান জানায় প্রশাসন ও শিল্পে ব্যবস্থাপনায় গেঁড়ে বসা সমস্যাগুলোর নির্মম সমালোচনা করতে। এই 'আত্মসমালোচনা' অভিযানের অংশ হিসেবে আরত্যুখিনা লিখলেন, "১১ বছর ধরে শ্রমিকশ্রেণী নিজের হাতে ক্ষমতা ধরে রেখেছে, এবং এই হাত দিয়েই শ্রমিক পুরুষ তার স্ত্রীকে প্রহার করে তার শ্রেণী কমরেডদের সামনে। এই ব্যাপারে নারী শ্রমিকরা এখন যুদ্ধটা নিজেদের হাতে নিয়ে নেবে... জেনে রেখো, এরকম কোনও ঘটনা দেখলেই শ্রমিক নারী হিসাবে তোমার অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় লড়াইটা নিজের হাতে তুলে নেওয়া।"

পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যখন ১৯৩০ সালে জেনোৎদেলের অবসান ঘটানো হচ্ছে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীমুক্তির দিশায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে গেছে। ততদিনে সোভিয়েত নারীদের আইনি অধিকার আছে, ব্যাপক সংখ্যায় নারীরা কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও পরিষেবা অতুলনীয়, শিশুদের জন্য গড়ে উঠেছে নানা পরিষেবা, শ্রম সুরক্ষা আইন সুপ্রতিষ্ঠিত। সোভিয়েতগুলিতে ৩ লক্ষ নারী কাজ করছে। পার্টিতে নারী সদস্য সংখ্যা ২ লক্ষের বেশি (১৩.৫ শতাংশ), কেন্দ্রীয় কমিটিতে ২০.১ শতাংশ। এই সমস্তটাই বহুলাংশে জেনোৎদেলের অবদান। 

বলাই বাহুল্য, জেনোৎদেলের অবসানকেও 'স্তালিনের বিশ্বাসঘাতকতা' বলে নিন্দা-মন্দ করা হয়ে থাকে। কিন্তু আরত্যুখিনা এ প্রসঙ্গে 'প্রাভদা'য় প্রকাশিত প্রবন্ধে বলেছেনঃ "যেহেতু বর্তমানে নারী শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কাজটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তাই কেন্দ্রীয় কমিটির সমস্ত বিভাগকেই এর সাথে যুক্ত হতে হবে। পার্টি শহরে ও গ্রামে সফলভাবে যে গণ অভিযানগুলো সংঘটিত করছে, সেই কাঠামোর মধ্যেই বিশেষভাবে নারীদের মধ্যে আলোড়নের কাজটা চালাতে হবে। তার জন্য, কেন্দ্রীয় কমিটির আলোড়ন ও গণ অভিযান বিভাগের মধ্যে একটা বিশেষ নারী বিভাগ তৈরি করা হবে। নারী শ্রমিক ও নারী কৃষকদের মধ্যে অন্য সমস্ত কাজ গোটা কেন্দ্রীয় কমিটিকেই করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত নারীপ্রশ্নকে একটা উচ্চতর স্তরে উন্নীত করছে।"

জেনোৎদেলের অভিজ্ঞতার (অবসান সহ) সারসংক্ষেপ ও পর্যালোচনা আমরা (ভারতের কমিউনিস্টরা) করিনি। করলে হয়তো আজকে আমাদের অবস্থা এত করুণ হত না।"

...............



Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার