২৫শে জুন: দুই কোর্টের কিসসা!!!

অঙ্কিতা সরকার


সারা পৃথিবী জুড়ে যখন একটা অর্থনৈতিক মহামন্দার পরিস্থিতি চলছে, ঠিক সেই সময় জনরোষকে দমন করার জন্য বিভিন্ন দেশে উগ্রডানপন্থী সরকারগুলো ক্ষমতায় আসছে। যেখানে সরাসরি উগ্রডানপন্থী সরকার ক্ষমতায় নেই, সেখানেও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের উপর তাদের প্রভাব যথেষ্ট বেশি। যেমন একটি উদাহরণ হল, সাম্প্রতিক ২৫শে জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক ন্যক্কারজনক রায় দিয়েছে যার ফলে মিসিসিপি অঞ্চলের নির্দিষ্ট গর্ভপাত বিরোধী আইনের পক্ষে সওয়াল করা হয়েছে।এই রায়ের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজ্যগুলোতে রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় আছে, সেখানে গর্ভপাত আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেল এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোতে এর কি ধরনের প্রভাব পড়বে সেটা আগামী দিনগুলোতে আমাদের দেখতে হবে। সাধারণভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসমাজে গর্ভপাতের পক্ষেই একটা অবস্থান রয়েছে, কিন্তু তার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে অবস্থান করে, সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিয়েছে।লক্ষণীয়, যে নয়'জন বিচারপতি ছিলেন, তাদের মধ্যে ছয়'জনই পূর্বতন ট্রাম্প জমানায় মনোনীত। তাদের মধ্যে পাঁচজনই পুরুষ, মাত্র একজন মহিলা! আর যে তিনজন এই রায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের মতবাদ জানিয়েছেন, সেই তিন বিচারপতি ডেমোক্রেটিক পার্টির সাথে সম্পর্কযুক্ত, যাদের মধ্যে দুজন মহিলা, একজন পুরুষ। অর্থাৎ পুরুষরা যেন নির্ধারিত করছে, গর্ভপাত মহিলারা করতে পারবে কি পারবে না; নিজের শরীরের ওপর একজন মহিলার অধিকার পুরুষরাই নির্ধারিত করছে এই রায়ের মধ্যে দিয়ে। যে অগ্রগতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে তা অনেক পা পিছিয়ে গেল এই রায়ের ফলে। একই দিনে যেটা ভারতে লক্ষ্য করা গেল, সমাজকর্মী তিস্তা শীতলবাদ, গুজরাটের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ আর. বি. শ্রীকুমার এবং প্রাক্তন আইপিএস অফিসার সঞ্জীব ভাটকে গ্রেফতার করল গুজরাট অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াড। কেন গ্রেফতার করল? প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অ্যাসান জাফরি ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় মারা যান। তাঁর স্ত্রী জাকিয়া জাফরি গুজরাট দাঙ্গায় গঠিত সিট এবং বিভিন্ন সরকারি পদস্থ কর্মচারী ও সরাসরি তৎকালিন মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। গত ২৪শে জুন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক(!) রায়ের মধ্যে দিয়ে সরকারের প্রতি যে অভিযোগগুলো উঠেছিল তা খারিজ করে দেয়। খারিজই শুধু করেননি, বরং একটা কথাও বলেছেন, "As a matter of fact all those involved in such abuse of process need to be in the doc ad, proceeded with in accordance with law"। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট যে অভিযুক্তদেরকে শুধু ছাড়পত্র দিলেন এমনটা নয়, বরং যারা অভিযোগ তুলেছিল তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ারও একটা নিদান দেওয়া হল। এই নিদানের ফলে পরের দিনই অর্থাৎ ২৫শে জুন দেশের গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ একটি বক্তব্য রাখেন, যেখানে তিনি বলেন যে যারা যারা এই অভিযোগগুলো করে এসেছিল, তাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ এবং তার এই বক্তব্যের কিছু ঘণ্টার মধ্যেই এই গ্রেপ্তারি শুরু হয়। তিস্তাদের বিরুদ্ধে যে ছটা ধারায় কেস করা হয়েছে সেগুলি হল: 194 অর্থাৎ ভুঁয়ো প্রমাণ দেখিয়ে দোষী সাব্যস্ত করার প্রচেষ্টা, 211 অর্থাৎ ভুঁয়ো অভিযোগ করার চেষ্টা, 218 অর্থাৎ কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো সঠিক প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধাচরণ করা, 468 অর্থাৎ তথ্য কারচুপি, 471 অর্থাৎ ভুঁয়ো তথ্য পেশ করা এবং 120(B) অর্থাৎ ক্রিমিনাল কন্সপিরাসি। এই ধরনের অভিযোগ এনে তাদেরকে জেলে আটক করা হয়েছে। এখান থেকে যেটা স্পষ্ট, আমাদের দেশের সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল খর্বিত হচ্ছে। দেশের কোর্ট ব্যবস্থা এর আগেও এক পৌরাণিক চরিত্রকে জমি প্রদান করেছে এবং বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অযোধ্যা কাণ্ডে অভিযুক্তদেরকে ছাড়পত্র দিয়েছে। এই কোর্ট ব্যবস্থাই এবার গুজরাট দাঙ্গায় অভিযুক্তদের ছাড়পত্রই শুধু দিল না বরং যারা প্রতিবাদ করল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সরাসরি নির্দেশ দিল। অর্থাৎ এবার সরাসরি গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলোকেই ব্যবহার করে সারা দেশ জুড়ে ভয়ের পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে; সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলা যাবে না, কোনো প্রতিবাদ করা যাবে না, এইরকম একটা কর্তৃত্বকামী পরিমণ্ডল তৈরি করার চেষ্টা চলছে। স্বৈরাচার এবং ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী জুড়ে যে লড়াই চলছে তারই অংশ হিসেবে একজোট হয়ে আমাদের এই লড়াই করতে হবে। কোর্ট রায় দিতেই পারে কিন্তু গণতন্ত্রে দ্বিমত পোষণ করার এবং আবার কোর্টের কাছে অ্যাপিল করার অধিকার সকলের রয়েছে। সসম্মানে মুক্তি পাওয়া অভিযুক্ত মানহানি বা অন্যান্য অভিযোগ আনতেই পারে, সে অধিকার তারও রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে আটক করা হচ্ছে কেন যখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সেই কঠোরতা দেখা যায়নি? আইনী লড়াই চলবে, আবার সংসদে ধর্মীয় চরমপন্থীদের সংখ্যা কমানোর জন্য নির্বাচনেও উত্তীর্ণ হতে হবে... আইনী পথে ন্যায় বিচার চাইতে গিয়ে এই পরিণতি ভারতীয় গণতন্ত্রের একটা কালিমালিপ্ত অধ্যায় হয়ে থাকবে।

Picture Courtesy: LiveLaw

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার