পঠনপাঠন ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনে নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছু কথা

অদ্রিরাজ তালুকদার, ভারতের প্রগতিশীল শিক্ষার্থী ফেডারেশন (পিএসএফআই)

অনন্যা দেব, সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম (সিএসএ)


দীর্ঘ দুই বছর ধরে ধারাবাহিক লকডাউনের কারণে এই রাজ্যে ও সারা দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেছে। ইস্কুল কলেজে প্রচুর শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। অনলাইন ব্যবস্থায় অনেক শিক্ষার্থী ইন্টারনেট পরিষেবার অভাবে ক্লাসে ধারাবাহিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারেনি। তবুও লকডাউনকালে অনলাইন ক্লাস এবং অনলাইন পরীক্ষার ব্যবস্থাকে মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যায় না যে অনলাইন ব্যবস্থা সবার কাছে না পৌঁছতে পারার কারণে এবং সরকারি পদক্ষেপের অভাবে সচ্ছল এবং অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ডিজিটাল বৈষম্য তৈরী হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে লকডাউন উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, সামাজিক জীবন অনেকটাই স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক বিধিনিষেধও এখন শিথিল। এরকম পরিস্থিতিতে কোনো মতেই অনলাইন ক্লাস এবং অনলাইন পরীক্ষাকে সমর্থন করা যায় না। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এ রাজ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অফলাইন ক্লাস শুরু করে। যদিও আবার সরকারি নির্দাশিকার মাধ্যমে গরমের ছুটি ঘোষণা করা হলে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যক্রম শেষ করার জন্য যথেষ্ট ক্লাস পায়নি। ঠিক এই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পরীক্ষা অনলাইন না অফলাইন করা উচিৎ তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে অনলাইন পরীক্ষার দাবী তোলা হচ্ছে। লকডাউন জনমানসে অবশ্যই কিছু প্রভাব ফেলেছে। অনলাইন ব্যবস্থার স্বাভাবিকীকরণও তার অংশ। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ সত্যিই অনভ্যাস, অনলাইন পরীক্ষায় তদারকির অভাব, ঘরে বসে নিজের পরিসরে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ইত্যাদি অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হয়েছে এবং ফলত পুনরায় অফলাইন পরীক্ষা তাদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করেছে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, করোনা মহামারীর আগে অফলাইন পরীক্ষা আদৌ কোনো সমস্যার কারণ হয়নি বরং সেটাই স্বাভাবিক বিবেচিত হয়েছে, যদিও তখনও ক্লাস না হওয়ার বা পাঠ্যক্রম অসম্পূর্ণ থাকার মতো অভিযোগগুলি ছিল। লকডাউনে পরীক্ষা ও ক্লাসের শিথিলতা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করা আবশ্যিক এবং সর্বোপরি অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের কাছে ইন্টারনেট পরিষেবা সহজলোভ্য নয় বলে অনলাইন পরীক্ষা নেওয়া হলে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক অনাচার করা হবে।

এখানে বিশেষভাবে যা লক্ষণীয় তা হল অনলাইন পরীক্ষার দাবীতে শিক্ষার্থীদের উসকে দিচ্ছে রাজ্য ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোই। বিভিন্ন অজুহাতে ক্লাস বন্ধ করে রেখে অনলাইন মাধ্যমকে স্বাভাবিক করার এবং ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি করার প্রয়াস করছে শাসকদল। আসলে নয়াউদারবাদী সরকার সমগ্র সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্ষয়িষ্ণু ও দুর্বল করে দিতে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারীকরণের পথ মসৃণ করতেই ইচ্ছাকৃতভাবে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। শিক্ষার এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে আমাদের এই প্রয়াসকে প্রতিহত করতে হবে। 

আমরা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে অফলাইন পরীক্ষার দাবী জানাই। প্রয়োজনে পরীক্ষার সময়সূচী পিছিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ও অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে পাঠ্যক্রম শেষ করার সুযোগ দিতে হবে। পাঠ্যক্রম যে সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করা হয়নি, পড়ুয়াদের এই দাবী আজ রূঢ় বাস্তব। পড়ুয়াদের প্রয়োজনমত সময় প্রদান করে এই পাঠ্যক্রম শেষ করার দায় অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এবং প্রয়োজনে একমাস অথবা দু'মাস বিলম্বিত করে পরীক্ষার নির্ঘন্ট দেওয়া উচিৎ। সঠিক মূল্যায়নের তাগিদে পরীক্ষা একমাত্র অফলাইনে করা হোক, কোনোরূপ অনলাইন পদ্ধতিতে নয়।

বিভিন্ন প্রকার অজুহাত অনলাইন পরীক্ষার স্বপক্ষে খাড়া করে শাসক দলের ছাত্র নেতৃত্ব ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে ভুল পথে চালিত করতে চাইছে; সেই প্রত্যেকটি অজুহাতই খন্ডনীয়। মাত্র দেড়-দু’মাস ক্লাস হওয়ার পরেই স্নাতকোত্তরের প্রথম সেমিস্টার সম্পন্ন হওয়ার রীতি আগেও ছিল। অনেক কলেজেই যথাযথভাবে পাঠ্যক্রম শেষ না করা বহু বছরের রেওয়াজ; এটা বহুদিন ধরেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি পরিকাঠামোগত সমস্যা। কিন্তু তারপরেও এত বছর অবধি পড়ুয়ারা অফলাইনেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা দিয়ে এসেছে। তাই বিলম্বিত করে হলেও এবারও অফলাইন পদ্ধতিতেই পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। 

আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এখনও পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অফলাইন মাধ্যমে এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটি, বর্ধমান ইউনিভার্সিটি, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এর ফলে অনলাইনে প্রাপ্ত এবং অফলাইনে প্রাপ্ত নম্বরের বৈষম্য দেখা দেবে যার ফলে আবারও বিশৃঙ্খলতা বাড়বে। তাই আমরা দাবী করছি, সারা রাজ্যের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে পারস্পরিক কথোপকথন ও যৌথ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অফলাইন এবং অভিন্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে হবে। 

শিক্ষাক্ষেত্রে এই নৈরাজ্যের পরিস্থিতির দায় সম্পূর্ণরূপে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হলেও ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠন বিষয়ক প্রতিবাদকে ধামাচাপা দিতে এবং অনলাইন পরীক্ষার দাবীর প্রতি সামাজিক বিতৃষ্ণাকে কাজে লাগিয়ে পুলিশ নামিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উপর লাঠিচার্জ করার ঘটনাকে আমরা তীব্র ধিক্কার জানাই।  

ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করাতে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলি এবিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ না করে কিছু গতানুগতিক কথা বলে চলেছে। একইসাথে, পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এযাবৎকাল ছিনিমিনি খেলা রাজ্য সরকারের হাতেই পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের দায়ভার ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, নির্দিষ্ট কোনো প্রগতিশীল দাবীকে সামনে না রেখে। সমস্ত ছাত্রছাত্রী সংগঠনগুলির সুনির্দিষ্ট ছাত্রবান্ধব অবস্থান নেওয়া উচিৎ এই বিষয়ে। বেসরকারিকরণের পথ উন্মুক্ত করতে সামাজিকভাবে সরকারি বা সরকার অনুদিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি যে বিতৃষ্ণা তৈরি করা হচ্ছে তা রুখতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রের এই নৈরাজ্যকরণের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে।

Picture Courtesy: News Click

Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার