আজকের অগ্নিপথে বিজয় দীনানাথ চৌহান কারা???
অনন্যা দেব
গত মাসে আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেন্দ্রীয় সরকারের অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে যুবসমাজের বাঁধভাঙা আন্দোলন দেখতে পাচ্ছিলাম। অনেকেই এই আন্দোলন সম্পর্কে চমকিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, যুব সমাজ বোধহয় তার বিরুদ্ধে হয়ে চলা বঞ্চনার (যেমন, সমস্ত প্রকার কর্মসংস্থানের পথগুলিকে তথা সরকারী কর্মক্ষেত্রগুলোকে সংকুচিত করে প্রাইভেটাইজেশন বা বেসরকারীকরণের মাধ্যমে আসলে কর্ম নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা) বিরুদ্ধে জাগরিত হয়েছে। সত্যিই কিছুটা হয়েছে! কিন্তু আবার কয়েকটা প্রশ্নও রয়েছে। প্রথমত, যে অগ্নিপথ স্কিমের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং বিহার। এর বাইরে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গে। লক্ষণীয় যে, প্রধান কেন্দ্রবিন্দুর তিনটি রাজ্যই হল মূলত গোবলয়ের অন্তর্গত। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হল পাঞ্জাবে এর প্রভাব ছিল উক্ত তিন রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই কম। দ্বিতীয়ত, সেনা নিয়োগকে বেসরকারিকরণের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে যুবসমাজ জাগরিত হলেও বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্যান্য ক্ষেত্রে যে কর্মসংকোচন চলছে, সে বিষয়ে তারা ততটা জাগরিত নন। অন্তত কোনও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন অন্যান্য কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র থেকে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা লক্ষ করা যায়নি। আরও বেশি চিন্তার বিষয় হল, আরএসএস নিজেই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বা দেবে, এরকম গোছের একটা দাবী করে বসেছে।
এই অগ্নিপথ প্রকল্প সম্বন্ধে আপনারা সকলেই জানেন; নতুন করে বলার কিছু নেই। মূল লক্ষনীয় বিষয় হল, এই প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে সেনা নিয়োগের বেসরকারিকরণ। এই প্রকল্পে গ্রাচুইটি, পিএফ বা পেনশনের কোন ব্যবস্থা থাকছেনা। কিন্তু ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী যুবকদেরকে অস্থায়ী সৈনিক হিসেবে নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলবে। সরকারি ক্ষেত্রগুলিতে যে ধরনের বেতন দেওয়া হয়, সাময়িক নিয়োগেও সে পরিমানই বেতন দেওয়া হবে। এই প্রকল্প অনুযায়ী, তাদের বেতন থেকে ৩০ শতাংশ টাকা কেটে নিয়ে সেটাকে জমিয়ে রেখে সেই থোক টাকা তাদের হাতে চার বছর পর তুলে দেওয়া হবে, প্রকল্প থেকে বেরিয়ে অন্যান্য কাজে নিযুক্ত হবার জন্য যা আর্থিক সহায়তার কাজ করবে। এরকম বেশ কিছু প্রলোভন থাকছে। অগ্নিপথ প্রকল্পে যারা অংশগ্রহণ করবে তাদেরকে জাতীয়তাবাদের পাঠ শেখানো, শরীরচর্চা, নিয়মানুবর্তিতা এবং বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। ৪৮ লাখ টাকার লাইফ ইন্সুরেন্সের কথা বলার পরেও যে প্রশ্নগুলি থেকে যায়, হঠাৎ করে কমবয়সী যুবকদের সেনায় ঢোকানোর এত হিড়িক কেন? গোদাভাবে অনেকেই বলবেন যে এর মাধ্যমে তাদেরকে উগ্র জাতীয়তাবাদী হিসেবে গড়ে তোলা যাবে সহজেই। আজকের দিনে বহুল লক্ষনীয়, পুলিশরা আন্দোলন দমন করার জন্য নিজেরা আর লাঠিচার্জ করে না বা পাথর বৃষ্টি ঘটায়না। তারা নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে; তাদের কাজ করে দেয় সিভিক ভলান্টিয়াররা। অর্থাৎ কমবয়সী যুবকদের সিভিক ভলান্টিয়ার বানিয়ে পুলিশরা ব্যবহার করে গুন্ডাবাহিনী হিসেবে। ফলে, সেনাবাহিনী বা প্যারা-মিলিটারিতেও কি এই ধরনের ঝটিকা বাহিনী তৈরির পরিকল্পনা শুরু হল? সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হল, আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে অগ্নিবীরদের সেনা সংক্রান্ত কাজে বহাল রাখার নিশ্চয়তা না রেখে অন্যান্য ঝটিকা পেশার জন্য ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত কম বয়সে। ফলে অন্য পেশায় নিযুক্ত থাকলেও তাদেরকে প্রাইভেট হিন্দু সেনার মধ্যে ঢোকানোর সম্ভাবনা ফেলে দেওয়ার মতন নয়! এই পরিকল্পনা এখনও সম্মুখ সমরে প্রকাশিত না হলেও সহজেই অনুমেয়যোগ্য! কমবয়সী ছেলেদেরকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে তাদেরকে সরাসরি যুদ্ধাঙ্গনে যদি নাও পাঠানো হয়, দেশের আভ্যন্তরীণ জন আন্দোলনকে দমন করার কাজে লাগানো যাবে। তাতেও তাদের মৃত্যু হতে পারে। এখান থেকে দ্বিমুখী একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে। যে যুবকের প্রাণ গেল, তার পরিবার প্রচন্ড পরিমাণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুবকের প্রাণ যাওয়ার নাম করে জনগনের প্রতিবাদ-আন্দোলনকেও দমন করা, তাদের উপর নতুন করে আক্রমণ নামিয়ে আনার অজুহাত খাড়া করা যাবে। এগুলো মূলত এই প্রকল্পের ব্যবহারিক দিক।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে পার্মানেন্ট রিক্রুটমেন্ট অর্থাৎ সরাসরি নিয়োগ প্রক্রিয়াকেও স্থগিত করে দেওয়া গেল। পার্মানেন্ট রেক্রুটের সংখ্যাও কমিয়ে দেওয়া গেল। একজন পার্মানেন্ট জওয়ানকে তার জীবদ্দশায় যে পরিমাণ আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করতে হয়, তার থেকে অনেক কম ব্যয়ে অনেক কম বয়সী যুবকদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে। আবার অগ্নিবীররা চাইলে বিভিন্ন প্যারামিলিটারির মধ্যেকার বিভিন্ন পোস্টেও নতুন করে যুক্ত হতে পারবে। কম সরকারি ব্যয়ে এবং আর্থিক দায়দায়িত্ব ছাড়াই জাতীয়তাবাদের মোড়কে এই প্রাইভেট সেনা তৈরীর প্রক্রিয়া একেবারেই নতুন নয়। ইউএস-ইজরায়েল সহ বেশকিছু ইউরোপীয় দেশগুলোতে এই প্রক্রিয়া কার্যকর রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী নয়াউদারবাদের আগ্রাসনের অংশ হিসেবেই ভারতবর্ষে এই প্রজেক্ট চলছে; নতুন কিছু নয়।
বিভিন্ন গোবলয়ের রাজ্যগুলিতে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মফস্বলের যুবকরা অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রে অসফল হলেও সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে তাদের পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছল্য বজায় রাখতে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তারা যেহেতু দেখতে পাচ্ছে যে এই কর্মসংস্থানের সেক্টরটিকে সংকুচিত করা হচ্ছে, তাদের কাঙ্ক্ষিত সরকারি সুযোগ সুবিধা কমিয়ে আনা হচ্ছে জাতীয়তাবাদের নামে, তাই তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। সারা বিশ্বের চতুর্থ সর্ববৃহৎ সেনা রয়েছে ভারতে। সেনা সংক্রান্ত বাজেট বরাদ্দের নিরিখে সারা বিশ্বে তিন নম্বর স্থান দখল করে রয়েছে আমাদের দেশ। অবশ্য বিভিন্ন জীবনধারনের সুযোগসুবিধার নিরিখে আমাদের দেশের বিশেষ উজ্জ্বল উপস্থিতি কোনো বিশ্ব র্যাঙ্কিং-এ নেই। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের যুদ্ধ হিড়িক কিন্তু জারি আছে। বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র তৈরী বা আমদানির প্রকল্প বলবত রয়েছে। আবার একইসাথে সামান্য ডালরুটি খাদ্য হিসেবে না দেওয়ার জন্য প্রতিবাদ করতে হচ্ছে সেনাকর্মীদের। এই দ্বিমুখী পরিস্থিতির মাঝেই আমাদের দেশে অগ্নিবীর প্রজেক্টের আমদানি।
লক্ষনীয়, এই প্রোজেক্টের যেমন উগ্র জাতীয়তাবাদী দিককে অনেকের নঞর্থকভাবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে, আবার একইসাথে বেসরকারিকরণ বিরোধী আন্দোলনের দিকটিও উন্মোচিত রয়েছে। যদি প্রগতিশীলদের এই আন্দোলনকে ধারণ করতে হয়, তাহলে তাদেরকে আন্দোলনের নেতৃত্বের জায়গাতে আসতে হবে। নইলে এই আন্দোলন দিনের শেষে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কারণ এই প্রকল্পের বৃহদাংশ তাদের যুদ্ধবাজ হিন্দুত্ব মিশ্রিত উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অংশ। প্রগতিশীলদের এই লড়াইতে ঢুকতে গেলে দুটো অবস্থান প্রয়োজন। এক, সেনার নামে অতিরিক্ত জাতীয়তাবাদের চাষ এবং সামরিক বাজেটকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলাকে আক্রমণ করতে হবে। সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে এনে এবং অন্যান্য পড়শি দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে সঞ্চিত অর্থ বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে কাজে লাগানোর দাবী করতে হবে। দুই, সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থানের পক্ষে আন্দোলন সংঘটিত করতে হবে। সমস্ত প্রকারের বেসরকারিকরণ, কর্ম সংকোচনের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে। তাতে বিভিন্ন নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির যে আন্দোলন বর্তমানে চলছে, তাদেরকে একত্রিত করে একই মঞ্চে নিয়ে আসতে হবে। এর মধ্যে দিয়েই অগ্নিপথের মত আন্দোলনে প্রগতিশীলরা তাদের অগ্রনী ভূমিকা রেখে বৈপ্লবিক রূপান্তরের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারবে; নচেৎ নয়।
Comments
Post a Comment