একানব্বই বছর আগে

মুজফফর আহমদ

[কাকাবাবুর ১৩৩তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে ডিলিজেন্ট-এর শ্রদ্ধার্ঘ্য; জন্ম: ০৫/০৮/১৮৮৯।] 


[১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ভারত সরকারের দায়ের করা বিখ্যাত "মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমা" চলেছিল। এই মোকদ্দমার কথা অনেকের স্মৃতিতে এখনো নিশ্চয় জাগরুক আছে। মীরাট মোকদ্দমার গুরুত্ব অনেক। এত দীর্ঘদিন ধরে দিনের পর দিন এত ব্যয়বহুল কোন রাজনীতিক মোকদ্দমা পৃথিবীর আর কোনও দেশে চলেছে বলে আমরা শুনিনি। যে কোনও ফৌজদারি মোকদ্দমার শুনানির সময়ে তার এমন একটা স্তর আসে যখন আসামীরা ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৩৪২ ধারা অনুসারে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে বিবৃতি দিতে পারেন। মীরাট মোকদ্দমার আসামীরাও যুক্ত ও ব্যক্তিগতভাবে এইরূপ বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাঁদের এই বিবৃতিও দুনিয়ার ইতিহাসে অভিনব। বেশিরভাগ আসামীই তাঁদের বিবৃতির ভিতর দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন ধার ধারেননি। তাঁরা প্রচার করেছেন তাঁদের রাজনীতি ও মতবাদ। বিবৃতির ফলে তাঁদের সাজা বেড়ে যাবে কিনা সেদিকে তাঁরা ভ্রুক্ষেপও করেননি, তাঁরা চেয়েছিলেন দেশের লোক তাঁদের রাজনীতি আর মতবাদ জানুন ও বুঝুন।

আসামীদের মধ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যরা ছিলেন। কয়েকজন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন না, কিন্তু তাঁরা নিজেদের কমিউনিস্ট বলে স্বীকার করতেন। আবার এমনও কয়েকজন ছিলেন যাঁরা এর কোনটাই ছিলেন না। ভারত গবর্নমেন্ট ও তার পুলিশের অজ্ঞতার কারণেই তারা মীরাট মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। 

প্রত্যেক আসামীই আদালতে আলাদা বিবৃতি দিয়েছিলেন। আবার কমিউনিস্ট আসামীরা অর্থাৎ যাঁরা পার্টিসভ্য ও যাঁরা বিশ্বাসে কমিউনিস্ট (communist by conviction), সকলেই একটি যুক্ত বিবৃতিও দিয়েছিলেন। এই যুক্ত বিবৃতির রাজনীতিক মূল্য অত্যন্ত বেশী। আসামীদের বিবৃতির দ্বারা দেশময় কমিউনিস্ট ভাবধারা ছড়িয়ে পড়েছিল। মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কখনো রচিত হবে বলে আমার মনে হয় না। তবে মোকদ্দমার কমিউনিস্ট আসামীদের বিবৃতিগুলো সম্পাদন করে গ্রন্থাকারে কয়েক খন্ডে প্রকাশ করা আবশ্যক বলে আমি মনে করি।

বহু বৎসর পরে আমার নিজের ব্যক্তিগত বিবৃতি আমার হাতে এসেছে। তা থেকে কিছু কিছু অংশ তরজমা করে নিচে দেওয়া হল। বলা বাহুল্য, ইংরেজি ভাষায় আমাদের বিবৃতি দিতে হয়েছিল। আমি বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছিলেম ১৯৩১ সালের ৯ই জুন তারিখে অর্থাৎ এখন থেকে ২৪ বছর [বর্তমানে: ৯১ বছর] আগে। একথা মনে করে রাখতে হবে যে, যে-কোনো ব্যক্তিগত বিবৃতির চেয়ে আমাদের যুক্ত বিবৃতির দাম অনেক বেশী। আদালতের প্রশ্নের জওয়াবেই আমরা বিবৃতি দিয়েছিলেম। মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় ভারত গবর্নমেন্ট আমাদের বিরুদ্ধে এতসব রাজনীতিক দলিল দাখিল করেছিল যে, সে-সবের ভিত্তিতে আমাদের পার্টির মত,  নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে অনেক কিছু বলা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল।]

আদালতে আমি বলেছিলাম:

"আমি একজন বিপ্লবী* কমিউনিস্ট। ১৯২৯ সালের ২০শে মার্চ তারিখে এই মোকদ্দমার সংস্রবে গিরেফতার হওয়ার সময় পর্যন্ত আমি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেম। আমার গিরেফতারের দিনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যথারীতি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের শাখা ছিল না। আমাদের পার্টি যে কায়দা মাফিক কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের অন্তর্ভুক্ত হয়নি তার কারণ ছিল এই যে সভ্য সংখ্যার দিক থেকে আমরা ছিলাম দুর্বল। অন্যভাবে বলতে গেলে, আমরা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মত, নীতি ও কর্মসূচী মেনে চলেছি এবং যে অবস্থায় আমরা ছিলেম সে অবস্থায় যতটা সম্ভব ছিল এ-সবের প্রচারও আমরা করেছি। বাদী পক্ষ আরোপ করেছেন যে, সেই কবে ১৯২১ সালে অন্যদের সঙ্গে এক হয়ে আমি ভারতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের শাখা স্থাপনের জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেছি। ষড়যন্ত্র যদি কোথাও হয়ে থাকে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব বাদী পক্ষের, তবে একথা বলতে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করছি যে ভারতে যাঁরা কমিউনিস্ট আন্দোলন চালু করার প্রাথমিক কাজ শুরু করেছিলেন, আমার সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও আমি তাঁদের একজন। আমি এমন কোনও কমিউনিস্ট কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির কথা কল্পনা করতে পারি না যে-কমিউনিস্ট বা কমিউনিস্ট পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের মত ও পথের অনুসরণ করে না। জগতে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালই তো সবচেয়ে বড় এবং প্রকৃত বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান।

ওয়ার্কার্স এন্ড পিজান্টস্ পার্টি (কৃষক ও শ্রমিক দল) কর্মশীল সভ্য ছিলেম। অনুসন্ধানকারী ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন যে এই পার্টি আসলে একটি ছদ্ম কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টির বৈধ অস্তিত্ব** থাকা সত্ত্বেও আর একটি ছদ্ম কমিউনিস্ট পার্টির কথা ভাবা একটা খামখেয়াল ছাড়া আর কিছুই নয়।কমিউনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও আমি যে ওয়ার্কার্স এন্ড পিজান্টস্ পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম তার কারণ এই ছিল যে, এই পার্টি জাতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল। আর, ভারতের মতো ঔপনিবেশিক ও পরাধীন দেশের জন্য জাতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালেরও কর্মসূচীর একটা দিক। আমার কমিউনিস্ট সহকর্মীরা ও আমি ওয়ার্কার্স এন্ড পিজান্টস্ পার্টির সভ্য ছিলেম বলে এই পার্টিকে ছদ্ম আবরণের কমিউনিস্ট পার্টি বলে ভাবা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। আমি তো সারা ভারত কংগ্রেস কমিটিরও সভ্য ছিলেম। তাই বলে বাদী পক্ষ কি বলতে পারেন যে, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস, কমপক্ষে সারা ভারত কংগ্রেস কমিটিও ছদ্ম কমিউনিস্ট সংগঠন?" 

"ওয়ার্কার্স এন্ড পিজান্টস্ পার্টি, শোষিত জনগণের একটি রাজনীতিক দল। এই জনগণের মধ্যে আছেন মজুরেরা ও কৃষকেরা এবং আরো আছে নানান ধরনের লোকের সংমিশ্রণ যাঁদের আমরা সাধারণতঃ 'পেটি-বুর্জোয়াজি' নামে অভিহিত করে থাকি। এই পার্টির উদ্দেশ্য, ভারতের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের (Democratic Republic) প্রতিষ্ঠা করা - যে রাষ্ট্রের পরিচালনায় মজুর, কৃষক ও অন্যান্য শোষিত জনগণের পূর্ণতম অধিকার থাকবে। এই পার্টি শ্রেণী সংগ্রামকে তীব্র হতে তীব্রতর করে তুলতে চেয়েছে। আর চেয়েছে শোষিত জনগণের রাজনীতিক চেতনা ও সংগ্রামশীলতা বাড়াতে। গণ-অভ্যুত্থান ও ধনিক শ্রেণীর গণতান্ত্রিক (Bourgeois Democratic) ধরনের বিপ্লবের মারফতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল হতে পরিপূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করাই ওয়ার্কার্স এন্ড পিজান্টস্ পার্টির চরম উদ্দেশ্য। এই পার্টি কোন সমাজতান্ত্রিক (সোশ্যালিস্ট) কর্মসূচী গ্রহণ করেনি কিংবা মজুরশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রোগ্রামও এই পার্টির ছিল না। এ কাজ ছিল পরিপূর্ণ রাজনীতিক স্বাধীনতা লাভের জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক জাতীয় মুক্তি আন্দোলন চালানো এবং এর জন্য ব্যাপক ক্ষেত্রে অনেক সম-উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে বহু শ্রেণীর সমবেত কর্মপ্রচেষ্টা গড়ে তোলা। প্রকৃতপক্ষে, ব্যাপক অর্থেই ওয়ার্কার্স এন্ড পিজান্টস্ পার্টিকে রাজনীতিক পার্টি বলা যায়। ঠিক অর্থে বলতে গেলে রাজনীতিক পার্টি বলা হয় সেই সংগঠনকে, যে সংগঠন শ্রেণী-সংগ্রামের সকল ক্ষেত্রে অন্য শ্রেণীদের বিরুদ্ধে কোন একটি শ্রেণীর বা তার অংশবিশেষের স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। এ কথা পরিষ্কার করা দরকার, যে-কোনো পার্টি যে-শ্রেণীর হবে সে-শ্রেণীর সর্বাধিক শ্রেণী-সচেতন ও কর্মশীল লোকদের নিয়েই তা গঠিত হয়। বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীকে যেন আমরা জড়িয়ে না ফেলি। জনসাধারণের যে-অংশের একই ধরনের অর্থনীতিক কাজ, কাজে কাজেই রাজনীতিক স্বার্থও একই, সে-অংশই একটি শ্রেণীতে পরিণত হয়।" 

"এটা বোঝা দরকার যে, দুটি সংগ্রাম - একটি পরাধীন জাতির জাতীয় স্বাধীনতা লাভের সংগ্রাম, আরেকটি মজুরশ্রেণী ও কৃষক সম্প্রদায়ের শোষণ হতে মুক্তিলাভের সংগ্রাম - পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। আরও পরিষ্কার ভাষায় বলতে গেলে একই সঙ্গে আমাদের দুটি সংগ্রাম চালাতে হবে। একটি ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রাজনীতিক অধীন হতে মুক্ত করার সংগ্রাম এবং অপরটি মজুরদের ও কৃষকদের উপরে যে অর্থনৈতিক শোষণ চলে তা বন্ধ করার সংগ্রাম। এর একটি সংগ্রামকে অন্যটি হতে পৃথক করা যায় না।

আপন আপন শ্রেণীশত্রুদের দুর্বল হতে দুর্বলতর করে তোলার জন্য এর প্রত্যেকটি শ্রেণী নিজেদের উৎপাদন কেন্দ্রে নির্মম শ্রেণী সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, কিন্তু উভয়ে যুক্তভাবে মরণ-আঘাত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ওপরে আর তার ভারতীয় বন্ধুদের অর্থাৎ জমিদারগণের, দেশীয় রাজ্যগুলোর শাসকগণের এবং সুদখোর মহাজনদের ওপরে। ভারতবর্ষের মতো ঔপনিবেশিক অধীন দেশে ফিউডাল ব্যবস্থার অনেক কিছু এখনো অবশিষ্ট আছে। এদেশে কৃষি ব্যবস্থা এখনো নৈরাশ্যজনকভাবে পশ্চাৎপদ এবং প্রায় আদিমকালীয়। এদেশে দেশীয় রাজ্যগুলোতে এখনো দাসত্ব ও ভূদাসত্ব বজায় রাখতে দিয়ে জনসাধারণকে অর্ধ-বর্বর অবস্থায় রাখা হয়েছে। এখন দেশে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের এই মুহূর্তে উদ্দেশ্য মজুর শ্রেণীর বিপ্লব (Proletarian  Revolution) বা মজুরশ্রেণীর একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা নয়, এইরকম কোন কিছু এই মুহূর্তে হতেই পারে না।" 

"কমিউনিস্টরা কল্পনা-বিলাসে গা-ভাসিয়ে দেওয়ার মত একদল আদর্শবাদী নয়। তাঁরা ইতিহাসের অগ্রগতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাতা এবং বাস্তব অবস্থার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক। ইতিহাসের বস্তুমূলক অধ্যয়নের ফলে কমিউনিস্টরা বুঝেছেন যে, তাঁদের মজুর বিপ্লবের স্তরে পৌঁছানোর আগে জাতীয় বিপ্লবের স্তর পার হতে হবে। আর এই জাতীয় বিপ্লব হবে ধনিকশ্রেণীর গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধরনের। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তার দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ কংগ্রেসে গৃহীত ঔপনিবেশিক নিবন্ধদ্বয়ে দেখিয়েছে কী ভাবে বিপ্লবের স্তরকে কার্যকরী করে তুলতে হবে।" 

"ভারতের জাতীয় বিপ্লব কেন ধনিক শ্রেণীর গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ধরন হবে, তা ব্যাখ্যাত হওয়া দরকার। একথা কেউ যেন না ভাবেন যে ধনিক শ্রেণীর গণতান্ত্রিক বিপ্লব ভারতের ধনিকশ্রেণীর নেতৃত্ব সম্পন্ন হবে। আজকের দিনে এমনটা ঘটতেই পারে না। ভারতের বিশেষ অবস্থায় মজুর শ্রেণি, কৃষক সম্প্রদায় এবং পেটি-বুর্জোয়াদের সেই অংশের নেতৃত্বে -- যে-অংশ পরগাছা ভূমধ্যিকারী সম্প্রদায় হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন এবং মজুর শ্রেণী ও কৃষক সম্প্রদায়ের স্বার্থকে নিজেদের স্বার্থ করে নিয়েছেন --  ভারতের জাতীয় বিপ্লব কার্যকরী হবে। আমাদের জাতীয় বিপ্লবকে আমরা ধনিকশ্রেণীর গণতান্ত্রিক বিপ্লব (Bourgeois-Democratic Revolution) এই কারণে বলি যে, আমাদের বিপ্লবকে এখনো সেই কাজগুলো সিদ্ধ করতে হবে যে - কাজগুলো অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। এই কাজগুলো হচ্ছেঃ- (১) জমিদারি প্রথার বিলোপ সাধন ; (২) ধনিক প্রথার পূর্ববর্তী যুগের শোষণ (ভূ-দাসত্ব, ফিউডাল যুগের আবওয়াব ইত্যাদি আদায় এবং মজুরি না দিয়ে কৃষকদের বাধ্যতামূলকভাবে খাটানো); (৩) দেশীয় রাজ্যগুলোর বিলোপ সাধন; (৪) বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী ফিউডাল গবর্নমেন্টের স্থলে গণতান্ত্রিক (রিপাব্লিকান) গবর্নমেন্ট স্থাপন করা। এই থেকে এটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন কৃষি-বিপ্লবও আমাদের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি অংশ হবে।"

"সফল জাতীয় বিপ্লবের দ্বারাই শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারত থেকে তাড়ানো সম্ভব। বিপ্লবকে বিদ্রোহ বলে ভুল করা মোটেই উচিত নয়। বিপ্লব হচ্ছে এমন ঘটনা যা বাস্তব অবস্থার চাপে মানব সমাজের ইতিহাসে সময় সময় ঘটে। যখন সাময়িক অবস্থা ও শাসন ব্যবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, তার ফলে কোন সমাজের পক্ষে আর এগিয়ে চলা সম্ভব নয়, তখনই শুরু হয় সংগ্রাম যা শেষ হয় সংঘর্ষে। বিপ্লবের কাজ সবসময়ই অগ্রগতি। এর সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই চলবে সামাজিক বিবর্তন। এই সামাজিক বিবর্তন আবার অনুন্নত ও সহজ আকার থেকে উন্নততর ও জটিল আকার পরিগ্রহ করে। আন্দোলনকারীদের দুষ্ট মগজ থেকে বিপ্লবের সৃষ্টি হয় না। ঐতিহাসিক অগ্রগতির ভিতরেই বিপ্লবের শিকড় পোঁতা থাকে। কিন্ত, তার মানে এই নয় যে সামাজিক প্রক্রিয়ায় মানুষ শুধু অকর্ম, অসহায় দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যাবে।বিপ্লবের গতিকে দ্রুততর করার জন্যে মানুষকে অবশ্যই কাজ করতে হবে এবং তাকে চলতে হবে যুগের ঐতিহাসিক প্রবণতার সঙ্গে তাল রেখে।"

---------------

*. ১৯২৮ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভায় কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার পাবলিক সেফটি বিলের খসড়া উপস্থিত করার সময় থেকে  অনেক প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিও বলে বেড়াচ্ছিলেন যে তাঁরা কমিউনিস্ট। হিন্দু মহাসভার ডাক্তার মুঞ্জে পর্যন্ত বলেছিলেন যে, তিনি একজন কমিউনিস্ট। বিবৃতি দেওয়ার সময় এই কথাটা মনে প্রবল ভাবে আশায় আমি নিজেকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট বলেছিলেম। আসলে কিন্তু বিপ্লবী কমিউনিস্ট বলাটা ভুল। কারণ, কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হওয়ার মানেই হচ্ছে বিপ্লবী পার্টির সভ্য হওয়া। তা থেকে এটা বুঝতে হবে যে পার্টির সভ্য মাত্রই বিপ্লবী। কাজেই বিবৃতিতে কমিউনিস্ট কথার আগেই বিপ্লবী কথার প্রয়োগ শব্দের বাজে খরচ। -- লেখক।

**. কার্যত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বে-আইনী ছিল। তবে, ভারত গবর্নমেন্ট ১৯৩৪ সালের আগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে সরকারীভাবে অবৈধ ঘোষণা করেনি। -- লেখক।

[মূল প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল "চব্বিশ বছর আগে" কারণ এর প্রথম প্রকাশ "নূতন পত্রিকা"-র ৪র্থ বর্ষ শারদীয়া সংখ্যায়, ১৩৬২ (১৯৫৫)। সময়োপযোগী করার উদ্দেশ্যে প্রবন্ধের নাম পরিবর্তন করা হল। প্রবন্ধ সূত্রঃ মুজফফর আহমদ নির্বাচিত প্রবন্ধ, এনবিএ।]  


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার