হে পার্থ, আমাদের দিব্য দৃষ্টি দাও !!!

রূপক গায়েন 


পার্থ চ্যাটার্জীর ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকার উন্মোচন একই সাথে রাজ্যের মমতা ব্যানার্জী-অভিষেক ব্যানার্জী ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দুর্নীতি এবং রাজ্যের বেকার শিক্ষকদের (প্যানেলে নাম ওঠা) ভবিতব্যকেও আরও একবার নির্লজ্জভাবে উপস্থাপিত করল। আমাদের দেশে ১৯৯১ সালে জাতীয় কংগ্রেসের লাগু করা নয়াউদারবাদী অর্থনীতির ধারা এক তীব্র আকার ধারণ করেছে বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে, আর এই অর্থনীতির মূল চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য হল বেসরকারিকরণ। একই সাথে, বাড়ন্ত ফ্যাসিবাদের অ্যাজেন্ডা হিসেবে শিক্ষার কেন্দ্রীকরণও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসর। ফ্যাসিবাদের এই লক্ষ্য বিজেপি সরকারের নয়া শিক্ষা নীতিতে খুব স্পষ্ট। বিভিন্ন আঞ্চলিক শিক্ষার ফাঁকফোকর তুলে ধরে, নিজের ধর্মীয় রাজনৈতিক ফান্ডাগুলোকে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জুড়ে দিয়ে দেশজুড়ে সেই ধর্মান্ধতার বিষ গেলানোর প্রপাগান্ডা শুরু হয়ে গেছে। এই ধর্মান্ধতাই আড়াল করবে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে রক্ষা করার তাগিদে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ টানার যাবতীয় কম্পিটিশান। 

যদি আমরা রাজ্যের দিকে তাকাই এবং শুরু থেকে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল্যায়ণের চেষ্টা করি, তাহলে দেখবো যে পূর্বতন ক্ষমতাধীন কংগ্রেস সরকার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় খুব একটা ভূমিকা রাখেনি এবং প্রবৃত্তি এমনই ছিল যে পাড়ায় কোনো বিদ্যালয় গড়ে উঠলে পরবর্তীতে সরকার ভেবে দেখতে পারে সেটিকে সরকারি অর্থ সাহায্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় কিনা, অর্থাৎ সরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয় গড়ে তোলার নীতি তো ছিলই না বরং সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের আমলে গণটোকাটুকি এক নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। তবে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছিল; যদিও বেশকিছু বিষয়ে প্রশ্নচিহ্নও ছিল। তবে মোটের উপর এমন একটা অবস্থা ছিল যাতে দীর্ঘ সময় ধরে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের ন্যূনতম আস্থা ছিল। শিক্ষাপ্রসারের সদিচ্ছা অন্তত সরকারের তরফে ছিল। তৎকালীন স্কুল শিক্ষা মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাস নিজেই ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত; তিনি নিজে একসময়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে চলেছিলেন। শুধুমাত্র শিক্ষা প্রসারেই নয়, প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রেগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া বামফ্রন্ট সরকার তার শেষ লগ্ন পর্যন্ত বজায় রেখেছিল। তবে ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কিংবা সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যাগত সীমাবদ্ধতা ছিল বাম আমলের শিক্ষা নীতির বিচ্যুতির কয়েকটা দিক।

এবার আসা যাক তৃণমূল সরকারের ভূমিকায়... এই শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতিকে শুধু আরেকটা দুর্নীতির ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে বরং এটাই সামগ্ৰিকভাবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান। এই সরকার তাদের তিনবারের নির্বাচনী উল্লাসের মাঝে কেন্দ্র সরকারের শিক্ষানীতির কাছে বারবার মাথা নত করেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, দুর্নীতি কি শুধুই এই সরকারের আমলে হয়েছে? আগে কি কিছুই হয়নি? উত্তর অবশ্যই না, আগেও হয়েছে... তবে নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে পদ প্রার্থীদের নামের তালিকার পাশে প্রাপ্ত নম্বরই গায়েব করে প্রায় একশো শতাংশ আসনেই ঘুষের টাকায় নিয়োগ আগে কখনও হয়নি। শুধু শিক্ষক নিয়োগই নয় বরং অশিক্ষক কর্মচারী বা অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্রের পরীক্ষাগুলোও বছরের পর বছর স্থগিত রেখেছে তৃণমূল। উল্টে যখনই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, তখনই কাঁড়ি কাঁড়ি দুর্নীতির দায়ে এবং যোগ্য পদ প্রার্থীদের আন্দোলনের চাপে হাই কোর্টের নির্দেশে প্যানেলের পর প্যানেল বাতিল হয়েছে। এই দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে বামপন্থী কর্মীদের লড়াই করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবয়ব তুলে ধরে তার ভিত্তিতে লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, যা একই সাথে যেমন জনভিত্তি বাড়াবে তেমনই প্রত্যেকবার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠলে রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর যারপরনাই পুলিশ লেলিয়ে সেই আন্দোলনকে স্তিমিত করার ভীতি তৈরীর প্রবণতাও কমাবে। শুধু চাকরির পরীক্ষাই নয় বরং স্কুল-কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রেও তৃণমূল ছাত্র পারিষদের "দাদা"দের চাঁদা দেওয়া যেন অলিখিত নিয়ম। বিভিন্ন কলেজগুলোতে নবীনবরণ আর ফেস্টের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা কলেজের ফান্ড থেকে লুটে নেওয়া, এটাই মূলত এই কলেজের দাদাদের প্রধান কাজ। এইভাবে রাজ্যের বিপুল সংখ্যক পড়ুয়া ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলোর দিকে; এই কলেজগুলো প্রথমে কম অঙ্কে কোর্সের লোভ দেখিয়ে ছাত্র নিচ্ছে, তারপর ইচ্ছেমত টাকা তুলছে, কোনও পরিকাঠামো নেই, পার্মানেন্ট টিচার নেই। এরই মাঝে আমরা দেখছি রাজ্যের মধ্য শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলিকে একটি অনলাইন কোচিং অ্যাপ টিউটোপিয়ার বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে। তৃণমূল সরকারের আন্দোলনকারীদের উপর বারংবার পুলিশি জুলুম চাপিয়ে দেওয়া আসলে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়া হিসেবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। তূণমূলের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সময়েই ২০১২ সালের লোয়ার প্রাইমারি টেট পরীক্ষায় দুর্নীতি জনসমক্ষে আসে। পরবর্তীতে কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া অনলাইন করার ঘোষণা করা হয় উচ্চ শিক্ষাকে শহুরে এলিটদের মধ্যে কুক্ষিগত করতে, যদিও বামেদের একাংশের তরফ থেকে অনলাইন এবং অফলাইন দুই পদ্ধতিতেই কাউন্সেলিং-এর দাবী জানানো হয়েছিল। কিন্তু মাননীয়ার সাথে মতপার্থক্য হওয়ায় ২০১৪ সালে ব্রাত্য বসুকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার জায়গায় নিয়ে আসা হয় পার্থ চ্যাটার্জীকে। অর্থাৎ ওনাকে আনাই হল কর্পোরেট স্বার্থে সরকারী শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল করে দেওয়ার জন্য। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে প্রাইমারী এবং আপার প্রাইমারী লেভেলে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি ফাঁস হয়ে যায়। ২০১৬ সালের মেধাতালিকায় নামযুক্ত নবম ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষক পদ প্রার্থীরা আন্দোলন শুরু করেন। ২০১৯শে পার্শ্বশিক্ষকরা পার্মানেন্ট হওয়ার দাবীতে আন্দোলনে নামেন। এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষক পদ প্রার্থীরা নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। বর্তমানে এসএলএসটি নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু হয়েছে। বারংবার বিপুল টাকার লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে এবং কখনও কখনও আসন সংরক্ষণের তোয়াক্কাই করা হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতির চাপে এসএসসি-র চেয়ারম্যান ইস্তফা দিতে বাধ্য হন এবং একদা ফরোয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক ও বর্তমানে তৃণমূলের বিতাড়িত মন্ত্রী পরেশ অধিকারীরও প্যানেল চেঞ্জের সাথে যুক্ত থাকার ঘটনা জনসমক্ষে চলে আসে। 

৩-৪ বছর ধরে অযোগ্য প্রার্থীদের সরিয়ে যোগ্যদের জায়গা দেওয়ার দাবী উঠছে। দীর্ঘদিন গান্ধী মূর্তির পাদদেশে চাকরী প্রার্থীদের অনশন ও বিক্ষোভ চলছে। ভোট আসার ঠিক আগে আগে নিয়োগের মিথ্যে আশ্বাস দেওয়ার গল্প চলে এসেছে। হালফিলে অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করতে আসা চাকরি প্রার্থীদের উপর ব্যাপক পুলিশি নির্যাতন মমতার নির্মমতা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। অন্যদিকে, ভুললে চলবে না ইডি লেলিয়েছে বিজেপি; সেই ব্যাপম কেলেঙ্কারির বিজেপি, সেই বিজেপি যেখানে থাকাকালীন এখন তৃণমূলে ভাসমান জয়প্রকাশ নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়েছিল!!! তবে মজার কথা, মমতা দিল্লী যেতেই টিভি চ্যানেলগুলোতে পার্থ-র খবর কমে যেতে শুরু করেছে! এরা সেই চ্যানেল যারা পিছিয়ে থাকতে এবং পিছিয়ে রাখতে এতদিন চাকরী প্রার্থীদের আন্দোলনের খবরই করত না। 

কোন ফ্ল্যাটে কতো টাকা এসব এখন অতীত, পাঁচতলা মল পুরোটাই টাকা, কারোর হাড়ভাঙা খাটুনি বা কারোর জমি, গয়না বেচা টাকা; ২০২১-এর নির্বাচনে খরচের পর 'মাত্র' এটুকুই পড়ে আছে, পুরোটা কত ছিল?! 

বাজার গরম করতে রাতারাতি শেয়ার হচ্ছে শোভন-বৈশাখীর নাচের ভিডিও... টিকটক... টিকটক... টিকটক... সময় শেষ।  

আর হ্যাঁ, শুধু সংগঠিত হলেই হবে না, জনতার সামনে একটা বিকল্প দাঁড় করাতে হবে, নইলে ফ্যাসীবাদ এসে দরজায় কড়া নাড়বে।  

Picture Courtesy: News Waali

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

ঘটনার বিবরণ নয়, উপলব্ধি জরুরী; প্রসঙ্গ আর.জি.কর

কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে লাদাখকে বাঁচাও!