স্মরণে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
সুমিত গাঙ্গুলি
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রয়াত। এই ছোট্ট বাক্যটির অর্থ ভারতের মার্কসবাদ চর্চার ক্ষেত্রে এক অস্বাভাবিক স্তব্ধতা এনে দেয়। সময় কোথাও যেন থমকে যায়।
ষাটের দশকে উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে তিনি নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের বঙ্গীয় শাখা বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হন। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদও পান। কিন্তু যে বছর স্নাতকোত্তর উপাধি পেলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, সেই বছরেই চেকোস্লোভাকিয়ায় লাল ফৌজের আক্রমনের প্রতিবাদে সদস্য পদ ত্যাগ করেন। সালটা ছিল ১৯৬৮। সদস্য না থাকলেও সারা জীবন কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে তিনি কিছুই করেননি। ফলে খাতায় কলমে সদস্য না হয়েও তাঁর ভূমিকা সদস্যগণের থেকে গুণগত মানে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র এই কারনেই বিজ্ঞান সংগঠন থেকে মানবাধিকার, ছাত্র আন্দোলন থেকে ট্রেড ইউনিয়ন, বিভিন্ন ধারার কমিউনিস্ট পার্টি ও গোষ্ঠীর কর্মীরা চিরটাকাল তাঁর কাছে ছুটেছে, জানতে চেয়েছে, বুঝতে চেয়েছে।
ঠিক এই কারণেই তাঁকে শুধুমাত্র 'জ্ঞানচর্চাকারী' হিসাবে চিহ্নিত করা আসলে মতাদর্শ থেকে তাঁকে পৃথক করে রাখা। ঠিক এই কথাই লেনিন তাঁর 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব' গ্রন্থে লিখেছেন "মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় উৎপীড়ক শ্রেণিরা নির্মমভাবে তাঁহাদের নির্যাতন করে, তাঁহাদের শিক্ষার প্রতি বিদ্বেষ- দুষ্ট বৈরীতা ও হিংস্র ঘৃনা প্রকাশ করে এবং নির্বিচারে তাঁহাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও কুৎসার অভিযান চালায়। মৃত্যুর পরে এইসব বিপ্লবীদের নিরীহ দেব-বিগ্রহে পরিনত করিবার, সাধু-সিদ্ধপুরুষ রূপে গণ্য করিবার চেষ্টা হইয়া থাকে; নিপীড়িত শ্রেণিদের 'সান্ত্বনা' দেওয়ার জন্য এবং তাহাদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই-সব বিপ্লবীদের নামের সহিত একটা জৌলুস ছড়িয়ে দেওয়া হয়; সেই সঙ্গে তাঁহাদের বৈপ্লবিক মতবাদের মর্মবস্তুকে ছাঁটিয়া দিয়া তাহাকে নির্বীর্য খেলো করা হয়, তাঁহার বৈপ্লবিক তীক্ষ্ণতা ভোঁতা করিয়া দেওয়া হয়" (রাষ্ট্র ও বিপ্লব, লেনিন, পৃষ্ঠা ৫, ন্যাশনাল বুক এজেন্সী, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৫৭, কলকাতা)।
প্রতিটি বামপন্থী রাজনৈতীক কর্মী যাঁরা শ্রেণি সচেতন, সমাজ বদলের পথের পথিক, ব্যক্তি মালিকানার অবসান চান, তাঁদের কাজই হলো রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের জীবন ও কাজের নির্যাস গ্রহণ করে এই সম্ভবনাকে চিরতরে নির্মূল করা।
কী নিয়ে লেখেননি? মার্কসীয় সাহিত্য তত্ত্ব, বঙ্গীয় মনীষা, শিক্ষা, রাজনীতি, সাহিত্যের আলোচনা, চার্বাক দর্শন, নাট্যতত্ত্ব সর্বত্র অবাধে বিচরণ করা এই মানুষটি অপূর্ব গদ্যভাষা ব্যবহার করেছেন। কম শব্দ দ্বারা তৈরী বাক্য, যা ঊনিশ শতকের গদ্য কাঠামোকে মনে করিয়ে দেয়, যা পুঁজিবাদী মানসিকতা ও দার্শনিক ভাবধারা বিকাশের জন্য বঙ্গীয় রচনা মন্ডল থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, তিনি ছিলেন তাঁর শেষ লেখক। ভূপেশ গুপ্ত, চিন্মোহন সেহানবীশ, জ্যোতি ভট্টাচার্যের শেষ উত্তরসুরী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বিদায়ের সঙ্গে বঙ্গীয় মার্কসীয় নন্দনতাত্ত্বিক ঘরানার একটা ধারা বিদায় নিল। স্মৃতিচারণের লোক বলতে আজ শুধুই শমীক বন্দোপাধ্যায়।
সম্ভবত বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত তিন ভাষাই জানতেন বলে, তাঁর দৃষ্টি ছিল অন্তর্ভেদী। পরশুরাম অর্থাৎ রাজশেখর বসুর ছোট গল্প নিয়ে তাঁর আলোচনা এক অন্য রসের সন্ধান দেয়।
আনন্দবাজার সহ বড় হাউসকে কোনও দিন সুযোগ দেননি। ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও এক্ষেত্রে তাঁকে প্রভাবিত করতে পারেননি। পক্ষান্তরে ছোট পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনের সবথেকে বড় অভিভাবক ছিলেন তিনি। এমনকি এইসব পত্রিকার সম্পাদকরা চিরকাল তাঁর থেকে সাহায্য ও পরামর্শ পেয়ে এসেছেন।
আজীবন মার্কসবাদী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য চিরকাল প্রতিষ্ঠান বিরোধী থেকে গিয়েছিলেন। মার্কসবাদের প্রতি গভীর আত্মপ্রত্যয় থেকে তিনি লিখেছেন "পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে, পুরো জীবজগত লোপ পাবে -- এমন ঘটনা অবধারিত জেনেও মানুষ তার সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজের আর তার ছেলেমেয়েদের আরও ভালোভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করে। শ্রেণীসমাজে অতি অল্প কিছু সুবিধেভোগী তার সুযোগ পান। কিন্তু তার জন্যে অন্যদের আত্মসংরক্ষণ ও প্রজাতি-সংরক্ষণের স্বাভাবিক প্রয়াস ব্যাহত হয় না। যে সব সুযোগ-সুবিধে অতীতে শুধু বড়লোকদেরই ছিল সেগুলো যাতে আপামর মানুষের নাগালে আসে - তার জন্যে তো কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার লড়াই" (মার্কসবাদ, আশাবাদ ও নৈরাশ্যবাদ, সুখবাদ, মার্কসবাদ জিজ্ঞাসা, অবভাস, ২০১৬, পৃ. ৭৭-৭৮)
Comments
Post a Comment