দুই পা পেছনে
অদ্রিরাজ তালুকদার
দৌড়োও কমরেড, পুরোনো জগৎ তোমার পিছু ধাওয়া করেছে।
১৯৬৮এর মে মাসে যখন ফ্রান্স জুড়ে শুরু হয়েছে প্রবল শিক্ষার্থী-শ্রমিক বিদ্রোহ, প্রচন্ড বৈপ্লবিক সেই সময়ে প্যারির রাস্তায় এই দেওয়াল লিখন সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের মনের কথাই বলছে। যারা শোষণ, বৈষম্যে ভরা এই সমাজের একদিকে সমৃদ্ধি আর একদিকে অভাবের সহবাস দেখতে পারছে, যারা দেখতে পারছে একবার গ্রিস, একবার ইংল্যান্ড, একবার শ্রীলঙ্কা এইভাবে পুঁজিবাদের চক্রাকারে সংকটে পড়ে আর উঠে চলতে থাকা, যারা বুঝতে পারছে জলবায়ু সংকট আর কোনো ভবিষ্যৎ নয় বরং বর্তমান, তারা এই পুরোনো জগৎ ছেড়ে বেরোতে চায়। কিন্তু সে পথ সহজ তো নয়ই, বরং এমনটাও বলা যায় যে মানব সভ্যতার শেষ কল্পনা করা, পুঁজিবাদের শেষ কল্পনা করার চেয়ে সহজ।
একুশ শতক: ‘৭০এর দশক প্রকৃত অর্থেই ছিল আন্তর্জাতিক ঘটনা (International phenomenon)। একদিকে যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ফ্রান্সে গণবিক্ষোভ, ভারতে নক্সালবাড়ি আন্দোলন। পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামের বিস্ফোরণ দেখেছিল পৃথিবী। কিন্তু সময়ের সাথে সেই আগুন থিতিয়ে গেছে। সোভিয়েতের পতন হয়েছে, বর্তমান কম্যুনিস্ট শাসিত দেশ চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম উদারীকরণের পথ অবলম্বন করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বামপন্থী দলগুলি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, শোষণবিরোধী, পুঁজিবাদবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম ধারাবাহিকভাবে চলছে। তবুও বৃহত্তম ক্ষেত্রে পুঁজিবাদের নাগপাশ ছিড়ে বের হওয়া যাচ্ছে না।
পুঁজিবাদ কিন্তু কখনওই সংকটমুক্ত হয় নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পুঁজিবাদ এক নতুন রূপ নিল – নয়াউদারবাদ (neoliberalism)। সোভিয়েতের পতন, ডিজিটাল বিপ্লব সম্ভব করল একুশ শতককে নয়াউদারবাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সময় হয়ে উঠতে। কিন্তু নতুন শতক শুরু হল সন্ত্রাসবাদ আর সাম্রাজ্যবাদকে সবার সামনে তুলে এনে। আবার ২০০৮, আমেরিকার গৃহসংকটের প্রভাব সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে এল। ২০২০ থেকে মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়ে মুক্ত বাজারের উৎপাদন-ভোগের বিরূদ্ধসম্পর্ককে প্রকট করে। মাসখানেক আগেই আমরা দেখলাম শ্রীলঙ্কায় বিদেশী ঋণে জর্জরিত, দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের গণআন্দোলন যা দেশের রাষ্ট্রপতিকেও পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। অথচ, নতুন সর্বদলীয় সরকার ক্ষমতায় এসে "স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য" সমস্ত রকমের বিক্ষোভ প্রদর্শন বন্ধ করালো। সরকার বদলের মাধ্যমে আন্দোলন শেষ হল।
গত কয়েক বছর আবহাওয়ার হাল-হকিকত দেখে আমরা এটা কি বুঝতে পারিনা যে আমাদের বর্তমানের জলবায়ুসংকট উপস্থিত – সারা পৃথিবী জুড়েই এই সংকট দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে মেরুবরফ গলে সদ্য উন্মুক্ত বিশাল ভূভাগকে পুঁজিপতিরা মনে করছে খনির সম্ভাব্য উৎস। আন্টার্কটিকা দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তার সাথে আবার পারমাণবিক শক্তি যা একই সাথে অসংখ্য সমস্যার সমাধান আবার একই সাথে প্রলয়েরও সম্ভাব্য কারণ। এটা বোঝা কঠিন নয় যে এই সমস্যাগুলি আসলে সমষ্টির সমস্যা, এককের সমস্যা নয়। এবং সমষ্টিগত চেষ্টা ছাড়া এদের সমাধান সম্ভব না। সেখানেই নয়াউদারবাদ ব্যর্থ। পুঁজিবাদ তার এই রূপে এই সংকট থেকে বেরোতে পারবে না। তাই সে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। মুক্ত বাজারের ব্যর্থতা ঢাকতে কোথাও স্বৈরাচার, কোথাও ফ্যাসিবাদ, কোথাও কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদের পথ নিয়েছে।
কিন্তু আসলে এই পন্থায় আদৌ কি সংকটগুলোকে কাটানো সম্ভব? নাকি পুঁজিবাদ একের পর এক সংকটের মধ্যে দিয়ে নিজেকে নিয়ে গিয়ে নিজেকে চিরস্থায়ী করে যায়? পুঁজিবাদ নিজের রূপ বদলের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামকেও দিশেহারা করে দেয় না?
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র: ইংল্যান্ডে "মহান" বিপ্লব, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি, শিল্পবিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, ইউরোপীয় শক্তিদের ঔপনিবেশিক বিস্তার – পঞ্চদশ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে এই ঘটনাগুলি বিশ্বপুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠাকে নিশ্চিত করে। আমেরিকার ও এশিয়ার বৃহত্তর এলাকায় শিল্পবিপ্লব এসে না পৌছলেও ইউরোপে বুর্জোয়া গণতন্ত্র বলবত হয়েছে কমবেশি। ব্যক্তিমালিকানার অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর সাথে সাথেই তার বিপরীত অর্থাৎ সামাজিক মালিকানার ধারণাও অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। বিষম সমাজে প্রথম সমাজতন্ত্রের ধারণা নিয়ে আসে সাঁ সিমো, শার্ল ফুরিয়র প্রমুখরা। একক ব্যক্তির বদলে সমাজ যদি যৌথভাবে সব কিছুর মালিক হত, যা কিছু প্রয়োজনীয় তাতে সকলের অধিকার থাকত তাহলে কতই না ভালো হত! কিন্তু এই ধারণা ছিল নিতান্ত অলীক, কল্পিত। এই ভাববাদী চিন্তাবিদরা এক আদর্শ সমাজের কথা বলতেন, তাকে প্রতিষ্ঠা করার নানা উপায় নিয়ে সহমত ব্যক্তিদের সাথে ভাবতেন। কিন্তু এদের ভাববাদী যুক্তি এটা বুঝতে পারে নি যে বাস্তব অবস্থায়, মানুষের বস্তুগত দশায় পরিবর্তন না আসলে শুধু ভাবনার জোড়ে স্বপ্নরাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। উনিশ শতকে কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলির আন্তঃক্রিয়া এবং বস্তুবাদী বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজ বদলের উপায় সন্ধানের পথ আবিষ্কার করলেন – যাকে বলা হয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র (যদিও Scientific Socialism পরিভাষা প্রথম ব্যবহার করে পিয়েরে-ইয়োসেফ প্রুধোন)। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব মনে করে যে ইতিহাস আসলে সমাজে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবস্থায় থাকা শ্রেণীগুলির (যা ঠিক হয় প্রয়োজনীয় সম্পদ উৎপাদন, বন্টন ও তার মালিকানার মধ্য দিয়ে) নিজেদের মধ্যে চলতে থাকা দ্বন্দ্বের ফসল। মানুষের শ্রম হল সেই শক্তি যা নিথর জড় পদার্থ থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য তৈরি করতে পারে। আর সবসময় সচেষ্ট মানুষের হাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, তার সাথে মানুষের বস্তুগত পরিবেশের ক্রমপরিবর্তন এবং শ্রেণীসংগ্রাম সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। সেই পথ ধরেই আমরা এই বর্তমান পুঁজিবাদী অবস্থায় এসে পৌছেছি যেখানে সমাজ পুঁজিপতি এবং শ্রমিক এই বৃহত্তর দুই শ্রেণীতে বিভাজিত এবং মার্ক্স দেখাচ্ছেন যে পুঁজিবাদের আন্তরিক কূটাভাস কীভাবে সর্বহারা শ্রমিকের হাতে নিজের ও সকল মানবজাতির শ্রেণীবিভাজিত ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করছে। বিজ্ঞান যেমন জড়জগতের উপর নানা পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে খোঁজার চেষ্টা করে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ তেমনই সমাজ-অর্থনীতির সাধারণ সুত্রগুলিকে খুঁজে বের করতে চায় একই পদ্ধতিতে। হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এঙ্গেলস তার Dialectics of Nature বইয়ে প্রকৃতি তথা মানুষের চেতনা ও সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যের সাধারণ নিয়মকে তিনটি সুত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে চান –
১) নিরবিচ্ছিন্ন পরিমাণগত পরিবর্তন ক্রমান্বয়ে গুণগত পরিবর্তন ঘটায়, আবার গুণগত পরিবর্তন আন্তরিক পরিমাণগত পরিবর্তনের বাহক। গুনগত পরিবর্তন হল এক দশা থেকে অপর দশায় (তার নেতিকরণ) যাওয়া।(উদা: ক্রমাগত কোশবিভাজনের ফলে বীজ থেকে উদ্ভিদ হয়।)
২) বিপরীত অবস্থারা পৃথক হলেও বিচ্ছিন্ন নয়, তাদের একটা অভিলেপন বিদ্যমান। (উদা: বীজ এবং উদ্ভিদ আলাদা হলেও অঙ্কুরোদ্গম দুই দশার মিলন।)
৩) এক অবস্থার নেতির নেতিকরণ (negation of negation) সেই অবস্থার আন্তরিক বিরোধ মিটিয়ে নতুন (উন্নত) অবস্থায় নিয়ে যায়। (উদা: বীজ থেকে উদ্ভিদ হয়, উদ্ভিদ থেকে বীজ, কিন্তু দ্বিতীয় বীজ আগের একই বীজ না, গুণে ও সংখ্যায় আলাদা।)
বিজ্ঞানের দর্শন: প্রকৃতিতে আমরা বস্তুর বিভিন্ন পরিমাণগত বৈশিষ্টগুলিই দেখতে পাই, যেমন – রঙ (আলোর কম্পাঙ্ক), ওজন, বেগ ইত্যাদি। নিউটনীয় বলবিদ্যা (Newtonian mechanics) অনুযায়ী কোনো বস্তুর ভরবেগ, অবস্থান, প্রযুক্ত বল ইত্যাদি ভৌতরাশি (physical quantity) জানা থাকলে বস্তুটির চলন সম্পূর্ণ নির্ধারিত (determined)। কিন্তু আজকের দিনে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্য আমরা জানি যে এই পরিমাপের মধ্যেই একটা অনিশ্চয়তা(uncertainty) আছে যার উৎস যান্ত্রিক বা দেখার ত্রুটি নয়, বরং বস্তুর নিজস্ব ধর্ম। এক কথায় ব্রহ্মান্ড নিজেই অসম্পূর্ণ। কিন্তু বস্তুর মধ্যে এই অনির্ধারণীয়তা(indeterminacy) ধরা পড়ে তার পর্যবেক্ষণেই। এভাবে বিজ্ঞানেও সচেতন ব্যক্তি বা পর্যবেক্ষকের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় – ধ্রুপদী বিজ্ঞানের লজিকাল পজিটিভিজমের (পর্যবেক্ষিত সিস্টেম পর্যবেক্ষক-নিরপেক্ষ) বিরুদ্ধে। আবার হেগেলীয় দ্বন্দ্বে বৈপরীত্যের ঐক্য মানে এই নয় যে বিপরীত দু'টি দশার মধ্যে একটা মিশ্র দশা থাকে। বরং এর অর্থ যে দু'টি দশা স্বাধীনভাবে একই ভাবে অস্থির। আমাদের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বোঝার মধ্যে এই সুক্ষ্মতাগুলি নিয়ে আসতে হবে।
ভাবধারা: হেগেল যুক্তি দেন যে মানুষ যখন আত্মসচেতন হয়, অর্থাৎ নিজেই নিজের চেতনা বুঝতে চেষ্টা করে সে যেন খন্ডিত অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। এই অসম্পূর্ণতাকে কাটানোর চেষ্টাতেই আমাদের চেতনার যাবতীয় বিকাশ ঘটে। বস্তুজগত, সেও সদাগতিশীল, পরিবর্তনশীল, কারণ বস্তুজগতের মধ্যেও এক অসম্পূর্ণতা রয়েছে। বস্তুর পরিবেশে থাকা মানুষের চিন্তা-চেতনা সেই পরিবেশের দ্বারাই আকৃতি পায়। কিন্তু মানুষও নিষ্ক্রিয় নয়। মানুষ শ্রম দেয় তার হাতের নাগালের বস্তুর মধ্যে পরিবর্তন ঘটাতে (যা পছন্দসই অথবা নয়)।
সেটাই যেন চেতনার বস্তুর ওপরে ক্রিয়া। মার্ক্স বলেন, “মানুষই ইতিহাস রচনা করে, সে যেভাবে চায় ঠিক সেভাবে নয়"। ঠিক সেভাবে নয় কারণ জগত পরম নির্ধারিত (absolutely determined) নয়। মানুষের দৃষ্টিগোচর জগতের মধ্যে যে অনিশ্চয়তা তা যেন এতই সুক্ষ্ম যে 'খালি চোখে' দেখা যায় না। জগতকে বোঝার চেষ্টায় আমরা প্রত্যেকেই একটা নিজস্ব যুক্তির ব্যবহার করি, যে যুক্তি আমাদের বাস্তবকে তৈরি করে।
বস্তুর এবং চেতনার আপসি অভাবের এলাকায় যা ক্রিয়া করে আমাদের বাস্তবনির্মাণে, তাই হল ভাবধারা।
ভাবধারা আসলে এমন বিশ্বাস নয় যার আড়ালে আসল সত্য ঢাকা পড়ছে। ভাবধারার প্রকাশ আমাদের ব্যবহারেই হয়। যেমন ধরুন, এক বাবা প্রতি ক্রিস্টমাসের রাতে তার বাচ্চার বালিশের পাশে একটা উপহার রেখে দেন এবং পরদিন সকালে ভান করেন যে সান্তা ক্লজই উপহারটা দিয়েছে। আবার বাচ্চাটা আসলে যদিও জানে যে সান্তা নয় তার বাবাই উপহারটা রেখেছে, তবুও সে ভান করে সান্তাকেই ধন্যবাদ দেয়। মানে দুজনেই জানে যে সান্তা নেই কিন্তু এই রীতির মধ্য দিয়ে দুজনেই সান্তার অস্তিত্ব স্বীকার করছে। এমনটাই ভাবধারার ক্রিয়াক্ষেত্র। তাই সব প্রার্থীই সমান দূর্নীতিগ্রস্থ এমনটা জেনেও বা ভেবেও আমরা ঠিক একজনকে ভোট দিয়ে আসি আর সংসদীয় ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখি সেটাকে মনে মনে গালি দিলেও।
আরও দু'টো উদাহরণ: ১) একটা কর্পোরেট অফিস। সেখানে একশো জন কর্মী কাজ করে। ম্যানেজার যিনি, তিনি আগের মতো দু'মিনিট পরপর এসে ঘুরে দেখেন না যে সবাই ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, দিনের শেষে সব কাজ শেষ হলেই হল। কিন্তু অফিসঘরের চার কোণায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আর দেওয়ালে লেখা, “You are under CCTV surveillance”। কর্মীরা জানে যে সত্যিই ম্যানেজার সারাদিন সিসিটিভিতে চোখা লাগিয়ে তদারকি করছে না, এত সময় তার নেই। কিন্তু প্রত্যেক কর্মীই এমন আচরণও করছে না যাকে তথাকথিত 'ফাঁকি দেওয়া' বলে।
২) পুরোহিত সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ করছেন। দর্শনার্থী আদৌ সেই মন্ত্র বোঝে না। কিন্তু সে আশা করছে যে পুরোহিত বোঝেন, আর তিনি দেবতার উদ্দেশ্যে সঠিক নিবেদনই করছেন। টিভিতে এক অর্থনীতিবিদ "ফিস্কাল ডেফিসিট", “ডেট-ইকুইটি রেশিও" ইত্যাদি নানা শব্দের ব্যবহারে দেশের অর্থনীতির অবস্থা বিচার করছেন। দর্শক এই পরিভাষা বোঝে না, কিন্তু আশা করে এই অর্থনীতিবিদ বোঝে আর সে সঠিক বিশ্লেষণই করেছে।
সবগুলো উদাহরণেই যার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত তা হল অন্য একজন, যেই অন্যের মধ্য দিয়ে আমি আমার ভাবধারাকে অভ্যাস করি। এইভাবে সমষ্টিগতভাবেও মানুষ এমন এক বৃহৎ অন্যকে গ্রহণ করে তার হয়ে ভাবধারা অভ্যাস করতে, যেই অন্য আসলে নেইই। যেমন – মুক্ত বাজার।
পুঁজিবাদ বিরোধিতা: পুঁজিবাদী তার মুনাফাসর্বস্বতার সাফাই হিসেবে মুক্ত বাজারের যুক্তি নিয়ে আসে, যেখানে 'স্বাভাবিক' অর্থনীতির নিয়মেই যোগ্যতম সফল হবে আর রাষ্ট্রের সক্রিয়তা ছাড়াই অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান হবে বাজারের নিয়মে। ২০০৮এর সংকট হোক বা আজকের অতিমারি, মুক্ত বাজারের ব্যর্থতা প্রমাণিত বারবার, কিন্তু পুঁজিবাদ যেন বারবার নিজের চেহারা পালটে অবশেষে মুক্ত বাজারকেই দীর্ঘায়িত করে। ফলে আজকের দিনে এমনটাই বিশ্বাস (মনে মনে না চাইলেও কাজে কর্মে) যে বাজার অর্থনীতি থেকে মুক্তি নেই, উদার গণতন্ত্রই চলবে। তাই অনেক বামপন্থী দলও সরকারের বা দক্ষিণপন্থী দলের বা পুঁজিবাদী আগ্রাসনের সমালোচনা করলেও, উদার গণতন্ত্র, তার সংবিধান আর পুঁজিবাদের বিরোধীতায় মুখর নয়। তবে এই সব সংস্কারবাদীদের থেকে আলাদা যে 'বিপ্লবী ঘরানা'র সংগঠনগুলো – তারাও কি বিভিন্ন আন্দোলনে আসলে নিজেদের মুখ, নাম, পতাকা, নান্দনিকতা (aesthetics), স্লোগান, ভাবধারা বিক্রির জন্য প্রতিযোগিতা করছে না? অবশ্যই তাদের সংগ্রামী ইচ্ছাশক্তি রয়েছে বলেই তারা আন্দোলনে নেমেছে। কিন্তু ভাবধারা সেটা নয় যেটা তারা সচেতনভাবে মানে বা বিশ্বাস করে। ভাবধারা সেটাই যেটা তারা অবচেতনে অভ্যাস করে। তাই পুঁজিবাদবিরোধী রাজনৈতিক পরিসরে প্রত্যেকেই বেগ পেতে চায়, কিন্তু প্রকৃত বিপ্লবী ইঙ্গিত কি আমরা দেখছি। নাকি পুঁজিবাদের উপর রেগে থাকা কিছু তরুণ-তরুণী গলা ফাটাচ্ছে রাগ কমাতে, যাতে আবার তারা দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে পারে? কিংবা কোনো রোমান্টিকতার তাড়নায় ঘরও ছেড়ে দিতে পারে।
পরিশেষ: ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে লেনিন যখন বলশেভিকদের তথা রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণীকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দিলেন তখন লেনিন বস্তুত অস্বীকার করলেন ঐতিহাসিক নির্ধারণবাদকে। রাশিয়ায় তখন সাধারণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলেও বস্তুগতভাবে রাশিয়ায় সামন্ততন্ত্র রয়েছে, শুধু কিছু কেন্দ্রীয় শহরাঞ্চলে আধুনিক শিল্প ও পুঁজিবাদের বিকাশ হচ্ছে। তার এপ্রিল থিসিসের বক্তব্য এটাই যে তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক' দশার ওপর দিয়ে লাফ দেওয়ার সুযোগ তৈরী হয়েছে শ্রমিকদের হাতে। গণতান্ত্রিক বিপ্লব আর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দ্বান্দ্বিক মিলনের কথা বললেও নিরন্তন বিপ্লবের নিশ্চয়তাকেই লেনিন কি মেনে নিচ্ছেন? নাকি ইতিহাসের অনির্ধরণীয়তার যুক্তিতে বস্তুগত সত্যের মধ্যেই যে ফাঁক রয়েছে তার মধ্যেই বিস্ফোরক সম্ভাবনা লেনিন দেখছেন? এটাই লেনিনের হেগেলীয় শিক্ষা। একশো বছর ধরে একই সূত্রে বাঁধা যে পথকে আমরা নৈর্ব্যক্তিক সত্য মনে করেছি পুঁজিবাদী বাস্তবতায় সেই পথকে নিয়ে দৃঢ় নিশ্চয়তার জায়গা হয়তো তাই আমাদের নেই। তাই শুরুতেই একটা জিনিস আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে – আমরা জানি না আমরা কী করছি, এই অজ্ঞানতা আমাদের সর্বাধিক র্যাডিকেল বানাবে।
[অদ্রিরাজ তালুকার প্রগতিশীল শিক্ষার্থী ফেডারেশন (PSFI)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মুখ্য আহ্বায়ক। এই প্রবন্ধটি 'রেনিগেড' পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।]
(লেখকের মতামত একান্ত নিজস্ব)
Comments
Post a Comment