এবার কোন পথে ব্রাজিলের লুলা?

মৌ বাছার

গত ৩০শে অক্টোবর ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণের পর দেখা গেল যে পূর্বতন ২০০৩ থেকে  ২০১০ অবধি রাষ্ট্রপতি থাকা লুলা ডি'সিলভা দীর্ঘ ১২ বছর পর আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। লুলা ডি'সিলভা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং নয়াউদারবাদের বিরুদ্ধে কতটা লড়াই করতে পারবেন সে প্রশ্ন উঠে আসবে কারণ তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা। তাঁর সাফল্য সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করার উদ্দেশ্য এই প্রবন্ধের নয় বরং তাঁর পূর্বতন শাসনকালের বৈশিষ্ট্যগুলি চর্চার মধ্যে দিয়ে আমরা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব লুলার সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা। এই প্রবন্ধে যে ব্যাখ্যাগুলি আসবে তার একটা বড় অংশ ব্রাজিলীয় সমাজবিজ্ঞানী আমির সাদেরের মতামত থেকে অনুপ্রাণিত। এছাড়া বিজয় প্রসাদ, নোয়াম চমস্কি এবং অন্যান্য সমাজতাত্ত্বিকদের বক্তব্যগুলি উঠে আসবে এই আলোচনায়। 

ঐতিহাসিক প্রবণতার নিরিখে এটা লক্ষণীয় যে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মার্কিন মদতে যখন সামরিক অভ্যুত্থানগুলি ঘটেছে, সেই সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে একনায়কতান্ত্রিক শাসনের যে প্রাথমিক সংঘাত শুরু হয়েছে, সেই সংঘাত ব্রাজিলে সামরিক শাসনের সময়ে দেখা যায়নি। ব্রাজিলে ১৯৬৪ সালে যখন সামরিক অভ্যুত্থান হয়, সেই সময় বামপন্থীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ব্রাজিলের এই সামরিক শাসন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কার্যকলাপকে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ করেনি বরং তাদের আক্রমণের মূল নিশানা ছিল বামপন্থীরা। সেই সময়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে যায়। কমিউনিস্টদের সশস্ত্র সংগ্রাম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ বজায় রাখতে না পারলেও ১৯৭০-এর দশকে যখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে শুরু করে, তখন সাও পাওলো এবং তার আশপাশের কিছু শহরকে কেন্দ্র করে গাড়ি শিল্প এবং বস্ত্র শিল্পের কারখানা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে আর এই অঞ্চলকে ভিত্তি করেই জন্ম নেয় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন। এই সমকালীন বেআইনী আন্দোলন এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে একসময় এই সামরিক শাসন ব্যবস্থা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এর পরবর্তীতে ১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসন সামাজিকভাবে তার শক্তি ক্ষয় করতে শুরু করে, যার পরিণতিতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরে আসে এবং এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে মূলগতভাবে রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা ডানপন্থী পার্টিদের হাতে ফিরে এলেও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রের যে নীতিগুলি প্রণীত হতে থাকে তা সামরিক শাসনকালীন নীতিসমূহেরই পুনরাবৃত্তি ছিল। বিভিন্ন ডানপন্থী পার্টিদের নেতৃত্বে চলা সরকারগুলি ১৯৮০-র দশক থেকেই ট্রেড ইউনিয়নগুলির বিরোধের সম্মুখীন হয়। যেটা লক্ষণীয়, সামরিক শাসন থেকে মুক্তি আন্দোলনের সময় ওয়ার্কার্স পার্টি বিশেষ শক্তি অর্জন করে, যদিও সে ব্রাজিলের আদি কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানের নিরিখে ছিল অনেকটাই ঢিলেঢালা এবং এদের সাথে সাথে গ্রামীন ভূমিহীন কৃষক ও ক্ষেত মজুরদের সংগঠন MST ও ব্রাজিলের শ্রমিকদের সংগঠন CUT বিশেষ শক্তি বৃদ্ধি করে অনেকটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী অবস্থান থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বামপন্থীদের মধ্যে যে মতাদর্শগত কর্ষণ শুরু হয় তাতে মূল যে ধারাটা অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে তার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন পূর্বতন ব্রাজিলীয় কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক কারলোস নেলসন কুটিনহো। তাঁর মতে বাম পরিমন্ডলে গণতন্ত্রকে বিশেষ স্থান দিতে হবে, যা আগে দেওয়া হয়নি। এই গণতন্ত্রের কথা বাম মহলে ঘুরতে শুরু করে শ্রেণী সংগ্রামের কথাগুলি ফিকে হতে থাকার মূল্য চুকিয়ে। ইউরো কমিউনিজিমের প্রতি বিশেষ আনুগত্য কুটিনহো'পন্থা দেখাতে শুরু করে। অর্থাৎ, সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর সোশ্যাল ডেমোক্রেসির যে সীমিত সংস্কারমূলক অবস্থান, এই দুই পথের মধ্যবর্তী একটা অবস্থান নেওয়া যায় কিনা তার একটা প্রচেষ্টা চলতে থাকে। যখন বাম আন্দোলনের মধ্যে শ্রমিক-কৃষকের কথাগুলি কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরতে শুরু করছে, ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে সামরিক শাসনের পতন এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার হয়। এই নয়া পরিস্থিতিতে ১৯৮৯ সালে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নেতা লুলা ডি'সিলভা বামপন্থীদের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দাঁড়ান এবং ২৭% ভোট পান কিন্তু পরাজিত হয়ে যান ডানপন্থী প্রার্থীর হাতে। এটি এমন একটি টালমাটাল সময় যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হতে চলেছে, বিশ্বজুড়ে নয়াউদারবাদের বিজয় রথ এগিয়ে চলেছে বেসরকারিকরণ, মিতব্যায়িতা, সরকারি সামাজিক সুরক্ষা নীতিগুলির অবসান এবং বাজার অর্থনীতির শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে। এই সময় ব্রাজিলেও বেসরকারিকরণ এবং নয়াউদারবাদের বিজয় যাত্রা এগিয়ে যেতে শুরু করে। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা দেশে তাদের ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে। আর প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ফলে সাও পাওলো ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে শিল্পাঞ্চল তৈরি হয়েছিল তা আস্তে আস্তে রুগ্ন হতে শুরু করে, কারখানাগুলি উঠে যেতে থাকে এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দুর্বল হতে থাকে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে ১৯৯৮ সালে আবার লুলা নির্বাচনে দাঁড়ান এবং সেই সময় তাঁর বক্তব্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল ব্যাপক বেকারত্বের অবসান। কিন্তু তবুও সেই কাঁচের দেওয়ালটা ভাঙ্গা তাঁর পক্ষে সম্ভব হল না। ইতিমধ্যেই লুলার নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি সাও পাওলো ফোরাম প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। এই ফোরামের অংশ ছিল বিভিন্ন অন্যান্য দেশের বামপন্থী দল। এরা বুয়েনস এয়ার্স ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে ওয়াশিংটন ঐক্যমত্যের নয়াউদারবাদ প্রীতির বিরোধিতা করছিল। কিন্তু ১৯৯৮-এর নির্বাচনে যখন তিনি জিততে পারলেন না, তখন লুলা আস্তে আস্তে পার্টি নেতৃত্ব বা পার্টির বুদ্ধিজীবী অংশ থেকে নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে আলাদা করে একটি সুশীল সমাজ ঘেঁষা সংগঠন তৈরি করলেন। 'ইনস্টিটিউট অফ সিটিজেনশিপ' বলে এই সংস্থা তৈরির মাধ্যমে এমন কিছু অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞের তিনি একত্রিত করলেন যারা মূলগতভাবে ডানপন্থী বলেই পরিচিত। এবং তারাই তাঁকে ২০০২-এর নির্বাচনের বৈতরণী পার করিয়ে দেয়। লুলা তাঁর সরকারের মূল লক্ষ্য সামাজিক নীতিগুলিকে কেন্দ্র করে তৈরি করলেন কিন্তু সে সামাজিক নীতিগুলি নির্দিষ্টভাবে কি হবে সেগুলি নিয়ে নির্দিষ্টভাবে কিছু না বলে সরকারের সামাজিক কর্তব্যের কথাগুলি গোদাভাবে বলতে থাকলেন নয়াউদারবাদের বিরোধিতার নামে। প্রত্যেক ব্রাজিলীয় যাতে দিনে তিনবার করে পেট ভরে খেতে পারে তার দাবিতে 'জিরো হাঙ্গার' শীর্ষক প্রচার শুরু করলেন তিনি। এই প্রেক্ষাপটে ২০০২-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দ্বিতীয় স্তরে তিনি উত্তীর্ণ হলেন কিন্তু তখনও তাঁকে পাহাড় টপকাতে হতো, কারণ তখনও যেটা দেখা যাচ্ছিল, ওয়ার্কার্স পার্টি তার ঐতিহাসিক ৩০% ভোটের মাত্রা থেকে কিছুতেই এগিয়ে যেতে পারছে না। এই প্রথম নির্বাচনের প্রথম অংশ শেষ হওয়ার পরে দেখা যায় যে ফাটকা বাজারে বিনিয়োগ অস্বীকার করে ফিনান্স পুঁজি সরাসরি আক্রমণ করতে শুরু করেছে। আসলে তারা বার্তা দিল জনগণকে যে যদি তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত না হয় তাহলে দেশের অর্থনীতিকে তারা এইভাবেই পঙ্গু করে রাখবে এবং কোন সরকারি কোন সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারবে না। একই সাথে লুলার কাছেও এটা একটা সতর্কবাণী ছিল ফিনান্স পুঁজির তরফে যে তাঁর সরকারের কি পরিণতি হতে পারে যদি এরপরেও তিনি জেতেন। লুলা এর ফলে ব্রাজিলীয়দের কাছে 'লেটার টু দ্যা ব্রাজিলিয়ান্স' নামে আবেদন করলেন, যার মূল বক্তব্য ছিল যে অর্থনৈতিক পরিসরের যে অবস্থানগুলি তাঁর পূর্বতন সরকার নিয়ে এসেছে তার খুব বেশি পরিবর্তন করা হবে না তিনি ক্ষমতায় এলে। আমাদের রাজ্যে মমতা ব্যানার্জী যেভাবে প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে এসেছিলেন রাজনৈতিক উপদেশদাতা হিসেবে, ঠিক তেমনভাবেই লুলা ২০০২ সালে দুদা মেনডংকাকে নিয়ে আসেন। সে পূর্বতন একজন ডানপন্থী সদস্যের হয়েও আগে প্রচার করেছিল! এর বাইরে লুলা সেই সময় বস্ত্র শিল্পের একজন পুঁজিপতি হোসে আলেনকার এবং অন্যান্য রক্ষণশীল পার্টির সাথে তাঁর যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন। এই দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ৬১% ভোট পেয়ে লুলা নির্বাচিত হন এবং কংগ্রেসে (সংসদ) দেখা যায় যে তাঁর দলকে বিভিন্ন মধ্যপন্থী, ডানপন্থী এবং ছোট বামপন্থী দলের সাহায্য নিয়ে একটি জোট তৈরি করে কাজ চালাতে হচ্ছে। এই সময় থেকেই লুলার ওয়ার্কার্স পার্টি যে মূল কথাগুলি বলে আসতো অর্থাৎ সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি, সেই অবস্থান থেকে অনেকটাই সরতে শুরু করে। সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে লুলা হেনরিক মিরেলেসকে বসায় যে একটি পূর্বতন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের সদস্য ছিল, নাম 'ফ্লিট বস্টন'। লুলার সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীতে বিভিন্ন মূল ধারার ডানপন্থী অর্থনীতিবিদদেরকে জায়গা করে দেওয়া হলেও নিজেরই পার্টির অর্থনীতিবিদরা তাতে স্থান পেল না। দেখা গেল, ক্ষমতায় এসে লুলা বয়স্কদের পেনশন কমিয়ে বিভিন্ন করের অধীনে নিয়ে আসার অবস্থান নিল। উল্টোদিকে, পুঁজিপতিদের কর মুকুব করার অবস্থানে তিনি এগোতে থাকলেন। বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা নীতি লুলা প্রণয়ন করার চেষ্টা করলেন অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কিন্তু মূলগতভাবে নয়াউদারবাদী অর্থনীতির পথেই হাঁটার ফলে সেই সামাজিক সুরক্ষার নীতিগুলি কাগুজে  নীতিতে বা বাগাড়ম্বরতাতেই  পরিণত হল। এই প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন খুব একটা ঘটে না, এবং ২০০৪ সালে সাও পাওলোর পৌরসভা নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টি তার শাসন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। লুলা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকগুলি মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত হয় - একদিকে নয়াউদারবাদী অর্থনীতি এবং বিদেশনীতির দ্বারা পরিচালিত অর্থ মন্ত্রক ও বিদেশ মন্ত্রক রয়েছে আর অন্যদিকে এই মন্ত্রকগুলিরই আনুগত্যে থাকা সামাজিক সুরক্ষার কেন্দ্রিক মন্ত্রক অর্থাৎ কৃষি সংস্কার, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য, সেগুলি ধুঁকতে শুরু করে। লুলা আস্তে আস্তে G20-র মধ্যে এবং অন্যান্য ল্যাটিন আমেরিকান জোটগুলোর মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। তাঁর অর্থমন্ত্রী অ্যান্টোনিও পালোসি এবং সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট মিরেলেস একটা কেন্দ্রীয় ডানপন্থী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে লুলার সরকারের অভ্যন্তরে, যার উদ্দেশ্য ছিল নয়াউদারবাদের পথে বিভিন্ন বাধাগুলিকে রোধ করা। এর পরিণতিতে, দেশের পুঁজিপতিরা ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতি খুব একটা ঢলে না থাকলেও মূলগতভাবে অর্থনৈতিক দিক থেকে লুলা যেহেতু তাদের কোন বিরক্ত করছিল না ফলে তারা পরোক্ষভাবে লুলার সমর্থনেই থাকে এবং ডানপন্থী বিরোধী সমালোচকেরা তাদের সমালোচনা কেন্দ্রীভূত করে সরকারের সেইটুকু নীতির উপরেই যেটুকু নীতি সামাজিক সুরক্ষার কথা বলছিল অর্থাৎ পূর্ণরূপে সামাজিক সুরক্ষার সবটুকু তুলে দিয়ে শুধুমাত্র বেসরকারিকরণের পথে ক'পা সরকার এগোচ্ছে বা ক'পা এগোতে তারা দ্বিধাবোধ করছে তার বিরুদ্ধে তারা আক্রমণ শানিত করে বেসরকারিকরণের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্য। এমন সময়ে ওয়ার্কার্স পার্টির বিভিন্ন সদস্যরা লুলার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে এবং অনেকে বহিষ্কৃত হয়। অনেক মন্ত্রীরাও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলে লুলার চাপে তারা মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় এবং অন্যান্য গোষ্ঠী যারা পূর্বতন গেরিলা যুদ্ধের অংশ ছিল তারা ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা করে সোস্যালিজম এন্ড ফ্রিডম পার্টির প্রতিষ্ঠা করে। আমির সাদেরের মতে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন বামপন্থী দলের তুলনায় ব্রাজিলের ওয়াকার্স পার্টি অনেক তাড়াতাড়ি তার ডানদিকে হেলে যাওয়ার বা ডানকুনি লোকাল ধরার যাত্রাতে অনেক কদম এগিয়েছিল। এখান থেকে মোটামুটি দুটো জিনিস স্পষ্ট হল, একদিকে লুলার সরকার নয়াউদারবাদের পথেই হাঁটতে শুরু করেছিল ২০০৩-এ ক্ষমতায় আসার পর। খুব বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কিছুই তিনি জনগণকে দিতে পারেননি যার ফলে তার দলের অভ্যন্তরে বিরোধ শুরু হয়। আর দ্বিতীয় দিক, ব্রাজিলে শুরু থেকেই কিন্তু পাকিস্তানের মতই গণতান্ত্রিক সরকারের চেয়ে মিলিটারি অনেক বেশি শক্তিশালী। এবং এই মিলিটারির প্রভাব পরবর্তীকালে যখন উগ্রডানপন্থী জেয়ার বলসেনেরো ক্ষমতায় আসে তখন ব্রাজিলীয়রা নতুন করে বুঝতে শুরু করে। [১]

পেরি অ্যান্ডারসন প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ২০০৫ সালে ওয়ার্কাস পার্টির বিভিন্ন নেতার সাথে কংগ্রেসের বিভিন্ন সদস্যদের আর্থিক লেনদেন কেন্দ্রিক বিরাট অঙ্কের দুর্নীতি বারংবার জনসমক্ষে উঠে আসে। কংগ্রেসে নিজেদের বিলগুলো পাশ করানোর ক্ষেত্রে কিভাবে আর্থিক লেনদেনকে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্ব লুলার নির্দেশে কাজে লাগিয়েছিল তা ধরা পড়ে যায়। এরপর ২০০৬-এ আর একটা বড় ধাক্কা এলো যখন ব্রাজিলীয়া শহরে দেখা গেল যে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু আর্থিক সাহায্য প্রদানকারীদের জন্য একটি পাঁচ তারা হোটেলে মদ-মাংস-মেয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে মুখ পোড়ে লুলার। কিন্তু লুলা সেই সময়ে আমাদের রাজ্যে মমতা ব্যানার্জীর সরকারের মতোই জনগণকে ডোল দিতে শুরু করেন। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গকে না তুলে ধরে সামাজিক সুরক্ষার নামে দারিদ্রসীমার কাছাকাছি থাকা বিভিন্ন পরিবারের মহিলাদেরকে আর্থিক সাহায্য করা শুরু হয় এই শর্তে যে তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাবে এবং তাদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখবে। প্রায় বারো ডলার মত সন্তান পিছু মায়েরা পেতে থাকে। এইভাবে লুলা নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন দুর্নীতির আরোপগুলো আসার মাঝেই এবং এর ফলে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য আবার ক্ষমতায় চলে আসেন। এই সময় প্রাথমিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ফানুশ যাতে না ফেটে যায় সেই কারণে কৃত্রিমভাবে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে সুদের হার কমিয়ে রাখা হয়েছিল। যার ফলে বিদেশী পুঁজির বিনিয়োগ বাড়তে শুরু করে ব্রাজিলে। ২০০৮ সালে যখন মহামন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, সেই সময় ব্রাজিলে লুলা সফলভাবে তাঁর দেশের ব্যাংকগুলির গচ্ছিত অর্থকে সুরক্ষিত করার বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে সফল হন, যার ফলে বিনিয়োগ বাড়তে থাকে এবং এর পরিণতিতে বেসরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পায়, দেশের আর্থিক বৃদ্ধিও ৭% বাড়ে। এই পরিস্থিতিতে লুলা আস্তে আস্তে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কিছুটা করে বাড়াতে থাকেন। লুলা কিউবা, ভেনেজুয়েলা, আরবের তৈল সমৃদ্ধ দেশসমূহ, ব্রিকস জোট, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদির সাথে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্ক সুপ্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে নিজ দেশে বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে থাকেন। অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতেও তিনি সামাজিক সুরক্ষা নীতিগুলি প্রণয়ন করতে শুরু করে। তাঁর সরকারের কিছু মন্ত্রী বা অন্যান্য কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণকারী সংস্থার নেতারা বিভিন্ন দুর্নীতি বা পারস্পরিক দোষারোপের কারণে নিজেদের পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও লুলা প্রায় কুড়ি কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমার উপরে উঠিয়ে আনতে সফল হয়েছিলেন। একই সাথে তাঁর সরকারের বয়স যত বাড়তে থাকে, তত দুর্নীতিও বাড়তে থাকে ও জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। আস্তে আস্তে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর থেকে বিনিয়োগ কমতে শুরু করে। ফটকা বাজারের নিয়ন্ত্রণের অভাবে আবার একটা মন্দার পরিস্থিতি এবং কর্মসংস্থান হ্রাসের পথে যখন দেশ এগোয় তখন আবারো আমাদের রাজ্যের মমতা ব্যানার্জীর ন্যায় লুলা তাঁর নিজের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা কাজে লাগাতে থাকেন। ডানপন্থীরা যে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাগুলি পেয়ে এসছে নিজেদের ব্যাক্তি জীবনে তার ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে লুলার ঠিক করে ইংরেজি ভাষা না বলতে পারা বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্য যেগুলি তাঁকে গরিব মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা নেতা হিসেবে তুলে ধরছে সেগুলি প্রচার শুরু হয়। এর পরবর্তীতে দেখা যায়, লুলার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের রদবদলগুলির পরিণতিতে দিলমা রুসেফ, যিনি একজন বুলগেরীয় কমিউনিস্ট এবং দেশান্তরী নেতার কন্যা, আস্তে আস্তে জাতীয় সরকারে লুলার পরে দ্বিতীয় সবচেয়ে ক্ষমতাধারী ব্যাক্তি হিসেবে উঠে আসতে শুরু করেন। ২০১১-য় লুলার পরবর্তীতে ক্ষমতাধীন হওয়া দিলমার সরকারের লুলার পথেই এগিয়েছিল, শুধু দুটো এক্সট্রা কাজ করা হয়েছিল: ১. গৃহ পরিচারিকাদের সাপ্তাহিক কর্মসময় ৪৪ ঘন্টায় নামিয়ে আনা হয়েছিল যার অতিরিক্ত খাটালে তাদেরকে ওভারটাইম মজুরি দিতে হবে এবং তাদের বিশেষ স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল, ২. বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যেমন ভোজ্য তেল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ভাত, সবজি, ফল - এগুলোর উপর থেকে কর  তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একইসাথে দিলমার সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীরা বেতন ঠিক করে না পাওয়ার এবং কর্মসংস্থান হ্রাসের অভিযোগে আন্দোলন শুরু করে। তাছাড়া রাষ্ট্র পরিচালিত তৈল নিষ্কাশন কোম্পানিগুলোর আর্থিক লেনদেনগত দুর্নীতি জনসমক্ষে চলে আসে। দেশের রামধনু কমিউনিটির বিরুদ্ধে অনেক সময় দিলমা অবস্থান নেন। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সমলিঙ্গের বিবাহকে স্বীকৃতি দিলেও  দিলমার সরকার তার সামাজিক প্রচারে অস্বীকার করতে থাকে। দিলমার সরকার তার শেষ লগ্নে ২০১৫-১৬ নাগাদ বিভিন্ন নদী বাঁধ প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শ্রমিকদের সময় মত মজুরীরা না দেওয়া এবং সাধারণ কৃষকদেরকে উচ্ছেদ করে পুনর্বাসন না দেওয়া ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিদ্ধ হতে শুরু করে। এইরকম বিভিন্ন বিষয়তে আস্তে আস্তে তিনি জনসমর্থন হারাতে শুরু করেন। ২০১৬ সালে আর্থিক লেনদেনগত দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে কংগ্রেস তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস করে এবং দিলমার সরকারের পতন হয়। মাইকেল টার্মারের ডানপন্থী সরকারের পর উগ্রডানপন্থী জেয়ার বলসেনেরোর সরকার ক্ষমতাধীন হয়। [২] 

মিলিটারির সাহায্যের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া,  মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অ্যামাজন জঙ্গলের বিনাশ বলসেনেরো সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির কয়েকটি। অন্যদিকে, ২০১৮ সালে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে উচ্চ ন্যায়ালয় বিভিন্ন বলসেনেরো প্রভাবিত বিচারকদের গোষ্ঠীর প্রভাবে লুলা কারারুদ্ধ হন। কিন্তু আবার তিনি ছাড়াও পেয়ে যান রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সুরক্ষা সংস্থার হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে। ২০২২-এ লুলার জেতার ক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে: এক, এটা দেখতে হবে যে ব্রাজিলের সংসদে তাঁর যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে কিনা যাতে আবার দিলমার সময়ের মতো অনাস্থা প্রস্তাব এলে তাঁর সরকারের পতন না হয়। দুই, লুলার সাথে বলসেনেরোর দ্বিতীয় দফায় প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান মাত্র ১%। বলসেনেরো বারংবার বলেছে যে ঈশ্বর ছাড়া তাকে কেউ ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না এবং তাদের দেশের শক্তিশালী মিলিটারি কোন মতেই নির্বাচনী কারচুপি মেনে নেবে না। অর্থাৎ বলসেনেরোর নেতৃত্বে লুলার বিরুদ্ধে মিলিটারি অভ্যুত্থান চালিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। সেটা কিভাবে লুলা রোধ করবেন, সেটা একটা চিন্তার বিষয়। 

এবারের নির্বাচনে লুলার জয়ের প্রয়োজনীয়তার ক্ষেত্রে নোয়াম চমস্কি এবং বিজয় প্রসাদের মত ছিল, যেহেতু পূর্বতন উগ্র ডানপন্থী জেয়ার বলসেনেরোর সরকার অ্যামাজন জঙ্গল ধ্বংসের পথে এগোচ্ছিল, ফলে লুলার প্রথম কাজ হবে সেই ধ্বংসলীলা থামানো এবং অ্যামাজন জঙ্গলের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে এগোনো। কারণ অ্যামাজন হচ্ছে সারা পৃথিবীর কার্বন ধারণের জায়গা। যদি এই জঙ্গল বিনষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার জায়গাতেই যে ঘাস জমি প্রতিষ্ঠা হবে তা পৃথিবীর একটি সর্ববৃহৎ কার্বন নিঃসরণের অঞ্চলে পরিণত হবে যা সামগ্রিকভাবে সারা পৃথিবীর জলবায়ু সংকটের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া লুলার সরকারে আসার আরেকটি প্রয়োজনীয়তা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের একমুখী এককেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে কায়েম করার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লুলা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জোট, যেমন 'ব্রিকস',-কে শক্তিশালী করার চেষ্টা করবেন। আরেকটা দিক হলো, যেভাবে ভেনেজুয়েলার অবিসংবাদী নেতা হুগো শাভেজ সারা লাতিন আমেরিকা জুড়ে "শুক্রা" নামে একটি নতুন মুদ্রা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, ঠিক তেমনভাবেই লুলা লাতিন আমেরিকা জুড়ে "সুর" নামে একটি মুদ্রা প্রচলন করতে চাইছেন। এই মুদ্রার পেছনে ব্রাজিলের অর্থ সম্পদ চালিত করতে পারলে একটু নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়িত হতে পারে। এর ফলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও মূলত এটি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জাতীয় পুঁজিকে শক্তিশালী করতে পারে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে খেটে খাওয়া মানুষ এর দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত হবে সেটা দেখার বিষয়। [৩]

আমাদের যেটা দেখতে হবে যে নয়াউদারবাদকে আদেও লুলা চ্যালেঞ্জ করতে পারেন কিনা নাকি তাঁর প্রথম সরকারের মতোই তাঁকে পঙ্গু হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সঙ্গী দেশগুলির অর্থনৈতিক নীতির দাসত্ব বহন করতে হবে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ, লুলার পূর্বতন সরকার চরম দুর্নীতিগ্রস্থ হলেও তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট বা অন্যান্য বামপন্থীদের বিকল্প সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি? বিফলতার কারণগুলো বিবেচনা করা দরকার। 

সূত্র

১. https://newleftreview.org/issues/ii33/articles/emir-sader-taking-lula-s-measure

২. https://www.lrb.co.uk/the-paper/v33/n07/perry-anderson/lula-s-brazil

৩. https://www.peaceinkurdistancampaign.com/noam-chomsky-vijay-prashad-a-lula-victory-in-brazil-could-help-save-the-planet/

Photo Courtesy: Reuters


Comments

Popular posts from this blog

ফ্যাসিবাদের উত্থানের যুগে সুবিধাবাদের রমরমা

কমিউনিস্ট পার্টি ও তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মহিলা কর্মীরা : কমঃ শর্মিষ্ঠা চৌধুরীর কলমে

কেন্দ্র সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ – একটি শিক্ষা বিরোধী ইস্তেহার